ইতিহাসের কলঙ্কঃ সেলুলার জেল
সূচনা ও ইতিহাসঃ
১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আমবাগানে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌল্লার পতন আর বাংলায় ইংরেজ শাসনের পত্তন হয়। ইংরেজরা ভারতে ঢুকেছিল মূলত ভারতের পূর্ব অর্থাৎ কোলকাতা দিয়েই। তাই বাংলার এই পরাজয় তাদের রক্তে এনেছিল অভূতপূর্ব এক উন্মাদনা। বাংলায় নবাবী শাসনের পর ধীরে ধীরে সেই পরাজয়ের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে কারণ দিল্লীর দুর্বল মোঘল শাসন ইংরেজদের মোকাবিলা করতে সমর্থ ছিল না। ফলে সেদিন পলাশীর আমবাগানে স্বাধীনতার যে সূর্যটি অস্ত গিয়েছিলে তা সারা ভারতবর্ষকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছিল দীর্ঘ অন্তত একশ বছর যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে জোরাল কোনও প্রতিবাদের স্বর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে নি। প্রায় একশ বছর পর ১৮৫৭ সালের ১০ই মে সিপাহি বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে সূচনা হল একটা আন্দোলনের বৃটিশ শাসকের বিরুদ্ধে। যদিও এই প্রতিবাদ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, মতান্তরে ব্যর্থই হয়েছিল বলা চলে, তবু এই বিদ্রোহই ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। এই বিদ্রোহই কিন্তু ইতিহাস স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম বলে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছে। এই যুদ্ধ ইংরেজদের যেমন হতচকিত করেছিল তেমনি সতর্ক করেছিল প্রচন্ডভাবে। ভবিষ্যতে যে এমন অথবা এর চেয়ে বড় বিদ্রোহ তাদের বিরুদ্ধে হতে পারে এ আন্দাজ তারা তখন থেকেই করে ফেলেছিল।
প্রকৃতপক্ষে সিপাহি বিদ্রোহকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা বলে ধরা হয় এটা আগেই বলেছি। বলা বাহুল্য ইংরেজরা ছিল যেমন ধূর্ত তেমন দূরদর্শী। তারা বুঝতে পেরেছিল এই সংগ্রামকে একেবারেই ছোট করে দেখা যাবে না। তাই উপেক্ষা করা যাবে না এই সংগ্রামীদেরও। তারা জানত সংগ্রাম শুধু দমন করাই নয়, সংগ্রামের সমস্ত ভাবী সম্ভাবনাগুলোকে উৎপাটিত করাই হল আসল কাজ।
আমরা জানি আমের ঝুড়িতে একটা আম পচলে তাকে তৎক্ষণাৎ বাইরে বার করে দিতে হয়। নাহলে সেটি ঝুড়ির বাকি আমগুলিকে ধীরে ধীরে পচিয়ে ফেলবে। দূরদর্শী ইংরেজরাও এটা জানত। তাই তারা সিপাহি বিদ্রোহের সংগ্রামীদের এমন জায়গায় সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল যাতে তারা আর কখনওই অন্যান্য সিপাহিদের সংসর্গে আসতে না পারে। এই উদ্দেশ্যে তারা এমন একটা স্থান খুঁজছিল যাতে কোনওক্রমে জেল ভেঙ্গে হলেও পালিয়ে আসতে না পারে। এটা তখনই সম্ভব ছিল যদি তাদের ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে একটা অগম্য স্থানে নির্বাসিত করা যায়।
বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অবস্থিত প্রায় পাঁচশ বাহাত্তরটি ছোটবড় দ্বীপ মিলিয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জটি তাদের এই কাজের জন্যে উপযুক্ত নির্বাসন ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হল। সম্পূর্ণ সমুদ্রে ঘেরা এই দ্বীপগুলির একটা থেকে আর একটার দূরত্ব মোটামুটি এমন বেশী যে এখানে কোনও জেল স্থাপন করে বন্দিদের রাখলে তারা যদি কখনও জেল ভেঙ্গে পালাতেও সক্ষম হয় তো সাঁতরে অন্য কোনও দ্বীপে যাওয়া বেশ অসম্ভব। তাছাড়া এর মধ্যে মাত্র ৩৭টিতে মানুষ বাস করে (যে সময়ে জেলটি তৈরি হয় তখন সভ্য বাসিন্দা বসবাসকারী দ্বীপের সংখ্যা অবশ্যই আরও কম ছিল বলেই অনুমিত হয়)। বাকি দ্বীপগুলি হয় জনশূন্য আর নয় সাংঘাতিক জারোয়া, ওঙ্গি, সেন্টিনিলি নামের জংলিদের বাস। এদের মধ্যে প্রথম দুই গোষ্ঠী সভ্যতার সংস্পর্শে এখন কিছুটা আসার চেষ্টা করলেও বিপজ্জনক সেন্টিনিলি সম্প্রদায় একেবারেই সভ্যতা বরদাস্ত করে না। তারা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে আর অন্য সম্প্রদায় তাদের কাছ ঘেঁষতে চেষ্টা করলেই মেরে ফেলে। এটা একালে মানে এই ২০১৯ সালেও যদি সত্য হয় তো সেই ১৮৯৬ সালে যখন জেলটি তৈরি হয় অথবা ১৮৮৯ সালে যখন এটির প্রস্তাবনা হয় তখন কত বড় সত্য ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়।
সুতরাং পালিয়ে তারা যাবে কোথায়? হয় মনুষ্যশূন্য দ্বীপে গিয়ে না খেয়ে মরবে আর নয় বিপজ্জনক জংলিদের হাতে পড়ে প্রাণ খোয়াবে। বন্য স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া (আন্দামানে প্রায় সাতমাস বর্ষাকাল), বিষাক্ত সাপ আর সামুদ্রিক প্রাণীর সঙ্গে মানুষ আর কতদিন যুঝতে পারে? আর সাঁতরে ভারতের মূল ভূখন্ডে পৌঁছোবার আশা একটা মারাত্মক দুরাশা তো বটেই। আজ এই ২০১৯ সালেও যেখানে জাহাজে কোলকাতা থেকে আন্দামানে পৌঁছতে লাগে চার দিনের কাছাকাছি সেখানে সাঁতরে আসার পরিকল্পনা একটা কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
এই সব সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়েও যদি কোনও বন্দি পালিয়ে আসতে সক্ষম হল বলে মারাত্মক রকমের শক্ত একটা কষ্টকল্পনা করা যায় তবে তাদের জন্যেও রইল আর একটা অন্তিম বেড়াজাল। সেটা হল জাত খোয়ানোর ভয়। সেই সে যুগে যখন সমুদ্র পেরোন আমাদের কাছে ছিল জাত খোয়ানোর সমতুল, তখন তাদের সমাজচ্যুত হবার বা করার জন্যে চাপ দেওয়াও যেত। যদিও কেউ সেলুলার জেল থেকে পালিয়ে এসেছিল এ খবর এখনও পর্যন্ত জানা নেই তাই এই শেষ বেড়াজাল সত্যি সত্যি কতটা প্রয়োগ করা যেত সে ব্যাপারে সন্দেহের নিরসন করাও যাচ্ছে না এই মুহূর্তে।
এই জেল স্থাপনের সূত্রপাত বলতে গেলে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে। ১৮৯৬ থেকে ১৯০৬ হল এর নির্মাণকাল। তবে এর আগেও একটা ইতিহাস আছে। হঠাৎ করেই সেলুলার জেল তৈরি হয়ে যায় নি। যদিও ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর পরই ইংরেজদের মধ্যে জোর তাগিদ আসে বিদ্রোহীদের অন্যান্যদের থেকে আলাদা করার, তবু সেলুলার জেলের মত একটা শক্ত সমর্থ জেল তৈরির পরিকল্পনা তাদের ছিল এটা জোর দিয়ে বলা যায় না।
সেলুলার জেল তৈরির পরিকল্পনার বহু পূর্বে অর্থাৎ ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমন করার পরে হাজার হাজার বিদ্রোহীকে গাছের ডালে লটকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। কামানের গোলার মুখে উড়িয়ে দিয়েছিল বা কাউকে ধারাল তলোয়ারের কোপে বা বন্দুকের গুলিতে করেছিল নিঃশেষ। এভাবে তারা চেষ্টা করেছিল বিদ্রোহটিকে মূল থেকে উপড়ে ফেলতে।
এ সত্বেও যারা বেঁচেছিল তাদের সংখ্যাও খুব একটা কম ছিল না। কারণ এই বিদ্রোহ সারা দেশে ব্যাপক আকার নিয়েই হয়েছিল। তাই অবশিষ্ট বন্দিদের তারা নির্বাসন দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। এক ভয়ংকর সর্বাঙ্গীন নির্বাসন যাতে তারা তাদের আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব এমন কী দেশের লোকের কাছে থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু এই নির্বাসন হবে এমন যায়গায় যাতে তারা আরও একটা বিদ্রোহের সূচনা ঘটাতে না পারে। তখনই তাদের মাথায় আসে এই আন্দামানের কথা। প্রায় নির্জন অথবা জংলিবেষ্টিত এই দ্বীপপুঞ্জকে তারা তাদের এই উদ্দেশ্য সফলের সহায়ক বলে ধরে নিয়েছিল। আর এটি অধিকার করেছিল।
জেলার ডেভিড ব্যারির অধীনে প্রায় ২০০ জন সিপাহি বিদ্রোহের বন্দি ১৮৫৮ সালের ১০মার্চ সর্বপ্রথম নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আন্দামানে। সেকালে এত বিশাল পরিমাণ মানুষকে বাষ্পচালিত জাহাজে করে এতখানি দীর্ঘ পথ নিয়ে যাওয়া কম ঝামেলার ছিল না। অনেকেই হয়ত ট্রাকে করে গরুছাগল নিয়ে যেতে দেখেছে। প্রত্যেকেটি পশু একে অপরের সঙ্গে বাঁধা থাকে। এতটুকু নড়াচড়া করার জায়গাও থাকে না। সেকালে জাহাজের খোলে ভরে বন্দিদের এমন ভাবেই নিয়ে যাওয়া হত।
দ্বিতীয় দফায় এপ্রিল, ১৮৬৮ সালে করাচী থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ৭৩৩ জন বন্দি। এরপর ধীরে ধীরে বোম্বাই, কোলকাতা আর মাদ্রাজ থেকে হাজার হাজার বন্দি (বলাই বাহুল্য এরা সব ছিল রাজনৈতিক বন্দি। সিপাহি বিদ্রোহীরাও ছিল অবশ্যই রাজনৈতিক বন্দি। সাধারণ অপরাধীদের জন্যে তখন অত বেশি মাথাব্যথা ছিল না বৃটিশ শাসকের) আন্দামানে চালান করা হয়।
অবিভক্ত ভারতের (অধুনা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারে হাজারে বন্দি পাঠানো হতে থাকে। এ বিষয়ে ইংরেজরা বিশেষ ভাবে কিছুই বিবেচনা করে নি। যাদেরই তারা তাদের পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করেছিল তাদেররই আন্দামানে চালান করে দিয়েছিল। মোঘল পরিবারে লোকজন এমন কী বিদ্রোহের সময় যারা মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কাছে আবেদন করেছিল তাদের সবাইকেই শত্রু বিবেচনা করে পাঠিয়ে দিয়েছিল এই দ্বীপে। অর্থাৎ তারা শত্রুর শেষ রাখতে চায় নি কোনোভাবেই।
এতদিন এই বন্দীদের রাখা হচ্ছিল অস্থায়ী আবাস 'আন্দামানিজ হোমে'। ১৮৬৩ সালে রেভারেন্ড হেনরি ফিশার করভিন্সকে (যার নামে পোর্ট ব্লেয়ারে করভিন্স কোভ বীচ) আন্দামানে পাঠানো হয়েছিল ইংরেজদের তরফ থেকে। তিনি সেখানে গিয়ে এই আবাসটি তৈরি করেন। ওপর থেকে এটি ছিল একটি বিনামূল্যের সেবা প্রতিষ্ঠান। ভেতরে ছিল এই বন্দিদের রাখা আর তাদের ওপর অত্যাচার করার ক্ষেত্র।
কিন্তু এই হাজার হাজার বন্দির চাপ সহ্য করা ধীরে ধীরে অসম্ভব হয়ে আসতে লাগল যে ১৮৮৯ সালে ইংরেজদের মাথায় এই জেল স্থাপনের পরিকল্পনা মাথায় আসে। ১৮৯৬ সাল থেকে শুরু হয় এর নির্মাণ। ১৮৮৯ সালের আগষ্ট মাসে তৎকালীন ইংরেজ সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব চার্লস জেমস লায়ালস আর এ এস লেথব্রিজ নামে বৃটিশ প্রশাসকের একজন সার্জন পোর্ট ব্লেয়ারে যান সমীক্ষার উদ্দেশ্যে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, যে উদ্দেশ্যে বন্দিদের এই দ্বীপান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা তেমন সফল হয় নি। এই বন্দিদের এখানে বরং বেশ কিছুদিনের জন্যে 'হয়রানির উদ্দেশ্যে' (harsh treatment) রাখা যেতে পারে। তবে তার জন্যে বেশ শক্তপোক্ত ভাবে এই জেল নির্মাণ করতে হবে।
বর্ণনাঃ
একেবারে সমুদ্রের পাশে এই জেল। বলতে গেলে বলতে হয় আন্দামানে এসে সেলুলার জেল না দেখলে যেন আন্দামান দেখাটাই সম্পূর্ণ হয় না। এর অবশ্যই মানে এই নয় যে আকাশছোঁয়া নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মোড়া এই জেলটি। আসলে ভীষণ এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব লুকিয়ে আছে এই জেলের মধ্যে। এই জেলের ইতিহাসের পাতাগুলো সব কালো কালির বদলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রক্তের লাল অক্ষরে লেখা আছে। বিশেষভাবে স্বাধীনোত্তর যুগে যারা জন্মেছেন, পরাধীনতার আঁচ যাদের গায়ে কোনদিন লাগে নি তাদের অবশ্যই এই জেলটি ঘুরে দেখা দরকার আর ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরির ভেতর তৎকালীন রাজবন্দীদের যে দুঃসহ অত্যাচার সহ্য করতে হত তা অনুধাবন করার জন্যে।
গাঢ় লাল রঙের ইঁট দিয়ে গড়া এই জেল সাতটি ভাগে বিভক্ত। এই জেলে মোট কুঠুরির সংখ্যা হল ৬৯৬। আকাশ থেকে দেখলে জেলটিকে মনে হবে যেন সাত পাপড়ি বিশিষ্ট একটি ফুল। একটি কেন্দ্র থেকে লম্বা হয়ে চলে গেছে সাতটি ভাগ। কেন্দ্রের মাথায় রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে রক্ষীরা জেলটির সব ক্ষেত্রে নজর রাখতে পারত। এর নির্মাণ এমন কৌশলে যে কেন্দ্র থেকে এই ৬৯৬ টি কক্ষে যাওয়া যায়। সাতটি পাপড়ির প্রত্যেকটি ত্রিতল বিশিষ্ট।
অতীতের সেলুলারঃ
লম্বা বারান্দার পাশে সার সার কুঠুরি। তিনটি ভাগে তিনটি তলায় মোট ৬৯৬ টি সেল বা কক্ষ। প্রতি কক্ষের মাপ প্রায় ১৫ ফুট বাই ৯ ফুট। ছোট্ট ছোট্ট ঘর। পেছনের দেওয়ালে অনেক ওপরে প্রায় ১০ ফুট ওপরে ছোট্ট একফালি জানলা। দেওয়াল এত খাড়া যে তা বেয়ে জানলার নাগাল পাওয়াই এত কঠিন যে পালানোর চিন্তা দূর অস্ত। ওই জানালা একটি বড় ছিদ্রের সমান প্রায়। তা দিয়ে যেটুকু আলো আর বাতাস আসে তাই বরাদ্দ ছিল কয়েদিদের। কম থাকলে বরং কৃতকর্মের জন্যে অনুতাপে দগ্ধ হবার সুযোগ পাবে। আর বেশী হলে পালাবার চিন্তা করার জন্যে অতিরিক্ত অক্সিজেন পাবে। তাই এই ব্যবস্থা। কথিত আছে এখানে রাজবন্দিদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার। সাগর পেরিয়ে বন্দিদের আন্দামানের এই নির্বাসনকে বহু অর্থে কালাপানি যাত্রা বলা হত। এক, এই জল বা পানি (তখন বৃটিশরা মোঘলদের কাছ থেকে উর্দু আর হিন্দি ভাষা আয়ত্ত করেছিল ব্যবসা আর পরবর্তীকালে শাসনের জন্যে। হিন্দিতে জলকে পানি বলা হয়।) পেরিয়ে আন্দামান থেকে আর ফিরে আসা যেত না। দুই, পানি পেরিয়ে এই যাত্রার গোড়া থেকে আন্দামানে অবস্থানের সবটাই অকথ্য অত্যাচারে মোড়া। তাই এই পানির রং কাল। তিন, এই পানি বা সাগর পেরিয়ে অন্য দেশে যাওয়াকে তখনকার ভারতীয় সমাজ অত্যন্ত খারাপ নজরে দেখত। সমাজের নজরে তারা অপবিত্র হত আর সমাজচ্যুত হতে হত। ১৮৬৮ সালে তখনও সেলুলার জেল স্থাপিত হয় নি, অমানুষিক অত্যাচারের ফলশ্রুতিতে আন্দামান থেকে ২৩৮জন বন্দি পালাবার চেষ্টা করে ধরা পড়ে। এদের মধ্যে একজন আত্মহত্যা করে আর বাকিদের মধ্যে ৮৭জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৯৩৩ সালের মে মাসে এই জেলে কিছু বন্দি অনশন আন্দোলন করে। এটি নজরে আসা মাত্র ইংরেজরা এটিকে প্রতিহত করার চেষ্টায় বন্দিদের খাওয়াতে তাদের চিকিৎসা করতে বল প্রয়োগ করে। যে ৩৩ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী অনশন করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভগৎ সিংহের সঙ্গি মহাবীর সিং, মোহন কিশোর নামাদাস, এবং মোহন মৈত্র অনশন রত অবস্থায় যাঁরা ইংরেজ কর্তৃক বলপূর্বক খাদ্য প্রদানের প্রচেষ্টায় মারা যান।
জেল স্থাপনের উদ্দেশ্যঃ
এই প্রবন্ধের গোড়ার দিকে অনেকটাই বলা হয়েছে। আর বলা হয়েছে কিছু সিদ্ধান্ত বদলের উদ্দেশ্যও। প্রথমে ঠিক ছিল বন্দিদের একেবারে নির্বাসনে পাঠান হবে দেশ থেকে যাতে তারা ভুলে যায় দেশকে আর দেশ ভুলে যায় তাদের। পরে ইংরেজরা সিদ্ধান্ত নেয় এই দেশান্তর যাবজ্জীবন কারাদন্ডের একটা মারাত্মক শাস্তির অংশ হিসেবে থাকবে আর সেই উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে অনুরূপ বীভৎস ভাবে স্থাপিত হল এই জেল। এমন অত্যাচার তারা করবে যাতে প্রতি মুহূর্তেই বন্দিরা কামনা করবে হয় পলায়ন নয় মৃত্যু। কিন্তু চারিদিক সমুদ্রবেষ্টিত ভয়াবহ এই কারাগারে দুটোর যেকোনও একটি অসম্ভব কিংবা অবাস্তব হয়ে দাঁড়াবে তাদের কাছে।
সেলুলার জেলের পরিণতিঃ
১৯৩৯ সালে সেলুলার জেল বন্দিশূন্য করে দেওয়া হয়। এর দুবছর পরে অর্থাৎ ১৯৪১ সালে জাপানীরা আন্দামান দখল করে নেয়। তখন বন্দিশূন্য সেলুলার জেল তাদের যুদ্ধশিবিরে রূপান্তরিত হয়। ১৯৪২ সালে নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বাধীন আই-এন-এ সম্পূর্ণ দ্বীপটি দখল করে আর সেখানে ভারতের জাতীয় পতাকা প্রোথিত করেন। সেলুলার জেলটি বৃটিশ আর বৃটিশভক্ত ভারতীয়দের বন্দিশালায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৪৫ সালে আন্দামান হল ভারতের সেই অংশ যা সর্বপ্রথম স্বাধীন বলে ঘোষিত হয়। কিন্তু ৭ই অক্টোবর ১৯৪৫ বৃটিশরা দ্বীপটির পুনর্দখল নেয়।
বর্তমানে সেলুলার জেল—স্বাধীনোত্তর প্রযত্ন আর সংরক্ষণঃ
বর্তমানে এই জেলে কোনও বন্দি নেই। জেলটিকে বর্তমানে জাতীয় স্মারক হিসেবে সংরক্ষিত করা হচ্ছে। সেই কারণে কিছু কিছু সংস্কার করা হয়েছে। বাইরেটা খুব সুন্দর দেখালেও ভেতরে কী আছে তা দেখার জন্যে বুকের ভেতরটা যেন গুড় গুড় করে ওঠে। কে না জানে একটা কালিমালিপ্ত দুঃখের আর দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাসের কংকাল দাঁড়িয়ে আছে পাঁচিলের ভেতরে। ছোট্ট ছোট্ট সেলগুলোর বদ্ধ দেওয়ালে দেওয়ালে গুমরে উঠছে অত্যাচার, অবিচার আর কিছু মানুষের পাশব পরিচয়ের শব্দ।
ভেতরে ঢুকে প্রথমেই ডানদিকে পড়ে স্বতন্ত্র জ্যোতি দাউ দাউ করে জ্বলছে পেতলের বিশাল প্রদীপে। এই জ্যোতি মনে করিয়ে দেয় পরাধীন সারা ভারতের মত একদা অন্ধকার এই সেলুলার জেলে আলোর জ্যোতি আজ ফিরে এসেছে। এই জ্যোতিতে আজ ভাস্বর হচ্ছে এই জেলের অতীত অন্ধকার কাহিনী।
স্বতন্ত্র জ্যোতির ঠিক পরেই এক শহীদ মিনার। এটি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের শহীদদের স্মরণে নির্মিত। মূল গেট থেকে ভেতরে গিয়ে স্বতন্ত্র জ্যোতির ঠিক উল্টোদিকে সারি সারি চেয়ার পাতা। এখানে রাতের অন্ধকার ঘন হলে লাইট এন্ড সাউন্ড দেখানো হয়। সেটাকে ডিঙ্গিয়ে আরও ডানদিকে গেলে ওঠা যাবে সেলুলার জেলের মূল চত্বরে। কিন্তু সেখানে ওঠার কিছু আগেই আটকে পড়তে হয় কুখ্যাত ফাঁসিঘরে। এই ফাঁসিঘর আপনাদের দেখতেই হবে আর শুনতেই হবে গাইডের বর্ণনা। নাহলে আপনার সেলুলার জেল পরিদর্শন হবে কিন্তু জানা হবে না সেলুলার জেলকে।
ছোট্ট এই ঘরটিতে নীচু ছাদের থেকে ঝুলতে থাকে ফাঁসির দড়িগুলো শোনাচ্ছে অনেক করুণ কাহিনী। তাতে সে বলছে আন্দামানের এই সেলুলার জেল পর্যটকদের কাছে পর্যটনের কোনও মহাক্ষেত্র নয়। একদা বৃটিশ যুগের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মৃত্যদন্ড দেওয়া এই কুঠরিগুলো শহীদদের নীরবে মাথা নীচু করে স্মরণ করার এক পুণ্যভূমি। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের কেমন ভাবে ফাঁসি দেওয়া হত সেই বর্ণনা যখন গাইড দিচ্ছিল তখন কেউ আর চোখের জল সামলাতে পারে না। কারোর চামড়ার চোখ দিয়ে যদি জল না পড়ে তো মনের চোখ দিয়ে তো অবশ্যই পড়বে। মানুষ ভেবে উঠতে পারবে না মানুষ হয়ে একজন আর এক মানুষের ওপর কী সাংঘাতিক নারকীয় পৈশাচিক অত্যাচার করতে পারে।
এই ফাঁসিঘরের পরেই শুরু হচ্ছে জেলের মূল অংশ। তিনতলা বিশাল এই কক্ষগুলিতেই এককালে সংগ্রামী উল্লাসকর দত্ত ছিলেন, ছিলেন বারীন ঘোষ, ভগত সিং, মোহিত মৈত্র, বটুকেশ্বর দত্ত, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল প্রমুখ। দোতলায় স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকরের একটি কক্ষ সযত্নে রক্ষিত আছে।
একেবারে ওপরের ওয়াচ টাওয়ারটি বর্তমানে সংরক্ষিত সংগ্রহশালা। মাঝখানে একটি থামে মার্বেলের ওপর ভারতের যে সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী এই জেলে ছিলেন রাজ্যওয়াড়ি তাঁদের নাম সযত্নে লেখা আছে। যে মাঠে সন্ধ্যার পরে লাইট এন্ড সাউন্ড দেখান হবে তার ঠিক পেছনেই একটা ঘেরা জায়গায় দেখান হচ্ছে সাবেক আন্দামানের জিনিস অর্থাৎ আন্দামান আগে যা ছিল।
রাতের সেলুলার জেল
রাতের সেলুলার জেল বাইরে থেকে যেন অনেক বেশী আকর্ষণীয়। অনেক বেশী মনোহর। আলোয় ঝলমল করে উঠেছে। সুন্দর করে সাজানো এই জেল। রঙে রঙে রঙিন। এটা যে সেই প্রাচীন স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে একটা কলঙ্কের ইতিহাস বহন করে বেড়াচ্ছে তা যেন বোঝাই যায় না। মনে হয় যেন কোনও সৌধ। রাতে এখানে দেখান হয় লাইট এন্ড সাউন্ড অনুষ্ঠান। শুরু হয়ে যায় আলোছায়ার মায়ার খেলা। ওম পুরী আর গুলজারের ভরাট উদাত্ত আবেগভরা কন্ঠ। সুদূর স্বাধীনতাপূর্ব অতীতের সেই বীভৎস আঁধার ঢুকে পড়ে বর্তমানের এই সেলুলার জেলের আলো-আঁধারিতে। দর্শকরা বিমোহিত, বিষণ্ণ, চিন্তিত আর কখনও বা ক্ষুব্ধ। সে তো ছিল না কোনও মধ্যযুগের অংশ তবু এত অন্ধকারে কেন ছিল ঢাকা? সেই ভয়াবহ যুগে সেলুলারের অভ্যন্তরে কয়েদি মানুষগুলোর ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তা আমরা কখনও কোনওদিন হিংস্র পশুদের ওপরেও করেছি বলে মনে হয় না। অথচ ভাবুন এই বৃটিশ জাতটাই ছিল সবচেয়ে শিক্ষিত আর উন্নত। প্রবাদ ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনও অস্ত যায় না। অর্থাৎ ভূ-গোলার্ধের পূর্ব থেকে পশ্চিম যেদিকেই তাকানো যাক না কেন বৃটিশের শাসন নজরে পড়বে।
আজ আমরা মাত্র ঘন্টা দুয়েকের ব্যবধানে আকাশপথে চলে আসছি এই আন্দামানে। কিন্তু সেই যুগে বাষ্পীয় জাহাজে দিনের পর দিন ঢেউ আর হাওয়ায় ভর করে জাহাজের খোলের মধ্যে গরু-ছাগলের মত ভরে আনা হত একগাদা বন্দিকে। তাদের সেই দুঃসহ অবর্ণনীয় অবস্থা যখন আবেগরুদ্ধ ভাবে বর্ণিত হয় ভাষ্যকার যুগলের মুখে তখন কার না অন্তর ভারি হয়? কার না চোখের পলক তার গতি হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে মুহূর্তের পরে মুহূর্ত? কার না চক্ষু হয় সজল?
দিনের আলোয় জেল পরিদর্শন করে যা জানা যায় এই জানা তার থেকেও বহু বহু গুণ বেশী। দিনের আলোয় দেখি আর শুনি চর্ম ইন্দ্রিয়ে দিয়ে। আর এখন মন দিয়ে, হৃদয় আর উপলব্ধি দিয়ে। চোখ যদি আমাদের বন্ধও থাকত কোনও অসুবিধে হত না সেলুলার জেল নামে ইতিহাসের বিরাট এক কলংককে দেখতে।
========================================
DR. ARUN CHATTOPADHYAY
181/44 G.T.Road (Gantir Bagan)
P.O.Baidyabati
Dist. Hooghly(PIN 712222)
Mobile 8017413028