সব স্বাধীনতা এক হয় না
আগষ্ট মাস।সারাদিন প্রচন্ড রোদের পর বিকেল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া হয়ে এসেছিলো। আর এখন অঝোরে ঝরছে।কদিন ধরে এমনটাই হয়ে চলেছে।মাঝে তো কদিন আবার দিনরাত একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চললো। আমাদের নীচু শহরের অনেক জায়গায় জল উঠে এলো। তার মধ্যে দিয়েই চললো আমাদের দৈনন্দিনের অফিসে যাতায়াত।ছুটি বাঁচাতেই হবে যে কোনভাবে।আর যাদের হাতের অন্ন খেয়ে আমাদের দিন কাটে,তারাও কিন্তু এলেন ,প্রায় নিয়মিতই। মাঝে হয়তো একদিন নীচু এলাকায় নদীর জল উঠে আসাতে আসতে পারেননি,কিন্তু প্রতিদিনই প্রায় এসেছেন।মাঝে মাঝে মনে হয় কি সেই জিনিস যা কোনরূপ লিখিত চুক্তিভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত না হয়েও এই তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষগুলিকে নিয়ে আসে প্রতিদিন নিজের নিজের কর্মস্থলে।উত্তর কি শুধু একটাই-অভাব?না তার সাথে কোথাও মিশে আছে একটু হলেও দায়িত্ববোধ।না কি এরা ডরায় সেই অমোঘ মুখঝামটাকে বা কাজ চলে যাবার ভয়কে। একদিন ইচ্ছে হলেও বিশ্রাম নিতে পারে না এরা,পারে না কোন নির্দিষ্ট দিনে নিজের পরিবারকে সময় দিতে। আর এখানেই উঠে আসে প্রশ্ন-তাহলে কোথায় এদের স্বাধীনতা-কোথায়ই বা স্বাধীনতা দিবস?
ছোটবেলা থেকেই আমার অভ্যেস স্বাধীনতা দিবসের দিন জাতীয় পতাকা তোলার। এখোনো তুলি।ছোট থেকে বড় হবার পথে যখন একটু বুঝতে শিখলাম-মানুষকে জ্ঞান দেবার ইচ্ছে হল-হাতের সামনে কাউকে না পেয়ে বাড়ির কাজের মানুষটিকেই বলতাম-আজকে স্বাধীনতা দিবস। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে।তাকে আরো অবাক করে দিতে তখন প্রশ্ন করতাম-বলোতো স্বাধীনতা কি?স্বাভাবিক বলতে পারতো না।আমি তখন কি অবাকই না হতাম এই ভেবে যে এরা স্বাধীনতা দিবস জানে না! আজ বুঝতে পারি কি মূর্খই না ছিলো ভাবনা আমার। এদের কাছে কোথায় স্বাধীনতা?দৈনিক অন্যের গৃহের অন্ন ঠেলে যারা শেষ বেলায় ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে যায় তাদের কাছে স্বাধীনতা ডুমুর ফুলের চেয়েও দুর্লভ।ঝড় জল বাদলাতে বাড়ির ব্যালকনিতে বসে বসে দেখি কিভাবে প্রতি সকালে এরা ছুটতে কাজে চলে,আবার দিন শেষে কেউ বা রাতের দিকে কোনক্রমে নিজের শরীরটাকে টানতে টানতে ঘরে ফেরে,গতি শ্লথ হয়ে যায় অনেক সকালের চাইতে।কিন্তু জীবন তো শেষ হয় না। এরপরও চলবে নিজের ঘরের কাজ।আর কপাল খারাপদের জুটবে মদ্যপ স্বামী বা ছেলের অত্যাচার। চোখের নীচের সেই কালসিটে নিয়েই কাজে আসবে এরা।তাই স্বাধীনতা এদের কাছে কৌতুক জাতীয় শব্দ ছাড়া আর কি হতে পারে।
একে একে মুখ ঘোরাই।দেখি বন্ধ চা-বাগানের শ্রমিকদের।পেটে পাগল করা ক্ষিদে নিয়ে যখন জ্বালানী কাঠ কুড়িয়ে বৃদ্ধা মহিলা থেকে বছর পাঁচ ছয়েকের বাচ্চা অব্দি মাথায় বোঝা নিয়ে ফেরে তখন মনে হয় এদের কাছে স্বাধীনতা দিবসের মানে কি?আর এ কথা এদেরকে জিজ্ঞেস করলে এদের চোখের অবাক চাহুনিই গালে এক সপাটে চড় মারবে।আর বাগান খোলা হলে তো আছে ম্যানেজার বা বাবুদের নিরন্তর অত্যাচার।এখন সময় বদলের সাথে সাথে সেটা চলে গেছে শারীরিক স্তর থেকে মানসিক স্তরে।যে কোন মুহূর্তে কাজ থেকে বিতাড়িত হবার ভয়।চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে বসে চা এর সাথে যে ওমলেটটি মুখ নীচু করা কালো বধূটি রেখে যায় তার কি মন চায় না ওমন সুদৃশ্য প্লেটে তার ঘরের প্রিয় মানুষটিকে বা সন্তানকে নুন গোলমরিচ ছড়িয়ে খাবার দিতে।হয়তো এই একই রকমের অত্যাচারের ঘটনা ঘটে চলে খাদানে বা দক্ষিণবঙ্গের খাদানে বা কোলিয়ারীতে।
আবার কখোনো মনে পড়ে বস্তির যে ছেলেটি বা মেয়েটি স্রেফ দুবেলা খাবার জন্য চা এর দোকান বা হোটেলে দিনরাত বাসন ধোয়,খদ্দেরকে চা দিতে জনবহুল রাস্তায় গাড়িঘোড়া উপেক্ষা করে রাস্তা পেরোয়-কোনদিন কি ভেবে দেখেছি স্বাধীনতা শব্দটি কি মানে নিয়ে দাঁড়ায় এদের সামনে?কোনদিন একটু বেচাল করলেই শুধু তাড়িয়েই দেয় না এদেরকে মালিক,ছেলে হলে অর্ধচন্দ্র আর মেয়ে হলে তো কথাই নেই-ছাড়ানোর আগে মনের সুখ মেটাতে কেউই ছাড়েন না।তাই স্বাধীনতার পতাকা ওড়ে শুধু লালবাতিওয়ালা বা শিক্ষিত জনগণের জন্য।আমার দেশ ভারতবর্ষের অধিকাংশ না খেতে পাওয়া লোকেরই স্বাধীনতা বা স্বাধীনতা দিবসে কিছু আসে যায় না।
==========================
সত্যম ভট্টাচার্য
আস্থা এপার্টমেন্ট ৩য় তল
তাং-০৮।০৮।২০১৯
মোবাইল-9475893433/7908288548