গুজব এবং গণপ্রহার বন্ধ করার দায়বদ্ধতা সকলের
-----------------------------------------------------------------------
পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে ঢুকে মহিলাদের 'কিডনি কেটে নিয়ে যাচ্ছে' অথবা হিন্দিভাষী অপরিচিত যুবক 'জঙ্গি' অথবা বস্তা কাঁধে ময়লা পোশাক লোক 'ছেলেধরা'। না এর একটিও সত্যি নয়, নিছক সন্দেহ। অতএব শুধুমাত্র ঐ সন্দেহটুকু কখনও মুখে মুখে, কখনও সোস্যালমিডিয়া মারফত ছড়িয়ে দাও । এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গতিশীল বিষয় হলো গুজব । মুহূর্তে সহস্র হাজারে পৌঁছে যেতে যেতে সুতীব্র একটা সক্রিয়তা কিড়মিড় করে ধেয়ে আসে ঘটনার উৎসে। তার পর যা ঘটে তাকে তাণ্ডবলীলা বললেও কম বলা হবে।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের পাশাপাশি এই রাজ্যেও ডাইন-ডাইনি প্রসঙ্গ এখনও খেয়াল করলে শোনা যায় । কিছুটা অস্বাভাবিক-দর্শন সঙ্গতিহীন দরিদ্র মলিন পোশাক বা মানসিক ভারসাম্যের বিন্দুমাত্র অসংলগ্নতা থাকলেই উপযুক্ত ভূমি রচিত । বহুকাল থেকে প্রাকৃতিক, সামাজিক এমনকি ব্যক্তিগত পারিবারিক যে কোনও উদ্ভূত সমস্যার জন্য এই জাতীয় নিরীহের উপর 'অলক্ষ্যণ' মূলক তকমা সেটে অত্যাচার হয়ে আসছে। এই শতাব্দীতে এসেও বাস্তব পরিস্থিতি খুব একটা বদলেছে বলা সম্ভব নয় ।
এটা সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষের জানা যে , কেউ কারও বাড়িতে ঢুকে জোর করে কিডনি কেটে নিতে পারে না। কিডনি কেটে বিক্রি করতে গেলেও তাতে ডাক্তারি প্রসেস লাগবে। হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের উপযুক্ত পরিবেশ ও যন্ত্রপাতি থাকতে হবে। এবং অবশ্যই তা জোর করে কেটে নেওয়ার মতো কলা গাছের কলা বা লাউ গাছের লাউ নয়। কাঁধে ঝোলা নিয়ে কেউ যদি পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, প্রথমত প্রত্যক্ষদর্শী যে কেউ তাকে প্রশ্ন করতেই পারে কী তার উদ্দেশ্য বা তার ঝোলায় কী আছে । সন্দেহ হতে পারে আদৌ সে কিছু চুরি করছে কি না,তখন প্রয়োজনে বস্তার ভিতরটা দেখা যেতেই পারে। আর যদি তাতে সত্যিই চোরাই মাল আছে বলে দেখা যায় অথবা মনে হয়, তখন পুলিশকে জানানো তো প্রথম নাগরিক কর্তব্য । আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, 'ছেলেধরা' নামক অতি নাবালক প্রাচীন ছেলেভুলানো ব্যাপারটাকে একালে টেনে এনে গণসংহারক গুজব তৈরির মূল লক্ষ্যটাই বা কী ? এখনও পর্যন্ত শিশু চুরি সংক্রান্ত যত অভিযোগ প্রশাসনের কাছে আছে,যতদূর মনে হয় সেখানে কোনও ঝোলা কাঁধে ময়লা কাপড় পরা ব্যক্তির নাম সন্দেহের তালিকায় নেই । বরং যা খবর মিডিয়াতে দেখা যায় তাতে ঐ সব ক্রাইমে হাসপাতাল নার্সিংহোম সম্পর্কিত কিছু লোকজনের প্রসঙ্গ উঠে আসে। নিরীহ বস্তা কাঁধে কাগজ কুড়ানী, নিতান্ত ফেরিওয়ালা, ভবঘুরে এই সব মানুষের উপর শুধুমাত্র সন্দেহটুকু ভিত্তি করে কেন ছড়িয়ে দিতে হবে হাজার মানুষের মনে হিংসার বিষ ? আর কেনই বা বিচার বিবেচনা ছুড়ে ফেলে দিয়ে চার দিক থেকে রে রে করে তেড়ে আসতে হবে আদিম হিংস্র তাড়নায় ?
যারা শারীরিক আঘাত করতে, মানসিক অত্যাচার করতে ছুটে আসছেন, মনে রাখতে হবে যে ঐ লোকটি বা ছেলেটি আপনার নিকটজন হলে কেমন হতো । হয়তো সে অন্য গ্রাম, অন্য শহর বা অন্য জেলা বা রাজ্যের একজন অধিবাসী । তার ভাষা,পোশাক, আচরণ, ব্যবহার, চেহারা কিছুটা স্বতন্ত্র হওয়াটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। সবচাইতে বড়ো কথা সন্দেহ বোধ হলে পুলিশ প্রশাসন রয়েছে, তাদের জানানো প্রথম কাজ । অথচ তা না করে সকলে এতো মারমুখী কেন ? তবু ভরসা সকলেই এমন নয়।আর নয় বলেই কেউ কেউ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে গিয়ে রক্ষাকারীর ভূমিকা নিয়েছেন। অর্থাত্ সেই মানুষ গুলোই সমাজের প্রকৃত বিবেক।
জঙ্গি তৎপরতা ভারতবর্ষে লেগেই আছে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে অপরিচিত, ভিনভাষী দেখলেই হো হো করে এগিয়ে যেতে হবে গণপিটুনি দিতে । তবে তো দেশপ্রেম চুলোয়, বরং উন্মাদের দেশ হয়ে উঠবে এটা। আইন শৃঙ্খলা দেখার জন্য স্বাধীন সার্বভৌম দেশে প্রশাসন আছে। এক্ষেত্রেও সন্দেহ হলে সোজাসুজি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের অপেক্ষা করাটাই একমাত্র কাজ । তাছাড়া নিরীহ হোক বা সত্য অপরাধী, কোনও ক্ষেত্রেই আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া যে অনেক বড়ো অপরাধ সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন।
দেশকে ভালবাসার, সমাজ থেকে অন্যায় অপরাধ দূর করার মতো ইচ্ছে প্রত্যেক সাধারণের মধ্যে থাকাটা জরুরি । আর ঠিক ততটাই সচেতন থাকা দরকার যে, হুজুগ, গুজব, গণপিটুনি, নিরপরাধের উপর কোনও প্রকার অবমাননা সমাজের সবচেয়ে বড়ো ক্ষয় রোগ। যার বাড়বাড়ন্ত অচিরেই বৃহত্তর সামাজিক ও মানবিক ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।তখন জাতীয়তা, দেশপ্রেম, সংহতি সব অর্থহীন হতে বাধ্য । সংহারী ঔদ্ধত্যের পরিবর্তে আমাদের আরও সংযমী ও সুবিবেচক নাগরিক হতেই হবে। সমবেত অঙ্গীকার করতে হবে যে কোথাও এমন কোনও অনৈতিক গণপ্রহারের ঘটনা আর একটাও ঘটতে দেবো না।
পুনশ্চ, ভোটের আবহে আমরা যেন শুধু আলোচনা সমালোচনা আর পরস্পর বিরোধীতার বিতর্কে জ্লন্ত আলোর নীচের অন্ধকারের কথা ভুলে না যাই । সামাজিক উত্তেজনা সামাজিক মানুষই তোলে,তাই সমস্ত প্রকার ভ্রান্তি দূর করার দায় আমাদের প্রত্যেকেরই।
===================================
সুব্রত বিশ্বাস
গ্রাম ও পোস্ট-ধর্মপুকুরিয়া
বনগাঁ, উত্তর ২৪পরগণা
পিন-৭৪৩২৩৫
ফোন-৬২৯৫৯৫৭৫৯৩