সমাজ-শারদীয়া-সমকাল
মানুষ সামাজিক জীব। মানুষই সমাজ গড়ে তুলেছে। নিজের সুবিধা ও পারিপার্শ্বিক প্রয়োজনে বেছে নিয়েছে প্রকৃতির মধুর রূপ রসের অঙ্গন। দেয়াল তুলেছে নিজের চারিদিকে। আবদ্ধ হয়ে পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে খাবার জোগাড় করেছে। গাছপালা, বন-জঙ্গল কেটে পথ বানিয়েছে। উপায় খুঁজেছে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার।
সমাজের মধ্যে প্রত্যেক মানুষ নিজের স্বপ্ন নিয়ে চলে। বুকের মধ্যে পুষে রাখে অসম্ভব কল্পনার চাদর। বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে অটুট থাকে। কখনো সফল, কখনো বা অসফল। আর সামাজিক জীব হিসাবে প্রত্যেক মানুষেরই একটা দায়বদ্ধতা থাকে। সেই দায়িত্ব থেকেই সমাজ উন্নত করার চেষ্টা করে।
মানুষ যুগের বিস্তারে কর্মঠ হয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ ও বাস্তবে মনের ভিত শক্ত হয়েছে। সমাজের ধারণা গেছে পাল্টে। যে সমাজের মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে ঈশ্বর অর্থাৎ দেব-দেবীর কাল্পনিক চেহারা গড়েছে, সেই সমাজের মানুষ দেব-দেবীর মূর্তি বানিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রত্যেকের হাতেই টাকার বান্ডিল। স্বাবলম্বী মানুষ অর্থের দিক দিয়ে আর দুর্বল নয়। একে অপরে টাকার লড়াইয়ে মেতেছে।
শারদীয়া মানে শরত কালীন উৎসব। এই উৎসবের শুভ সূচনা পুরানের(রামায়ন) চরিত্র রাবনের হাত ধরে। রাবনবধের পর থেকে তারই কথানুযায়ী রাম পূজার প্রচলন করেন। যা এখনো আম-বাঙালির মনে ও চেতনায় মিশে আছে।
মহালয়ায় থেকে দেবীপক্ষের শুভ সূচনা। প্রস্তুতি শুরু হয় পিতৃগৃহে ফেরার। শিবালয় থেকে তিন-চার দিনের সফরে মেতে ওঠে উমা। এমনকি সমগ্র বাঙালি জাতি অধীর উন্মাদনায় প্রহর গোনে। এই সময় কাশ ফুলে ভরে ওঠে মাঠ। শিউলির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। ঢাকের আওয়াজ শোনা যায় প্রকৃতির কোলে কান রাখলেই। এই শারদীয়া মানুষের জীবনে অন্য মাত্রা দেয়। বাঙালির সবথেকে বড় উৎসব আজ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রবাসী বাঙালিরা সমান তালে উৎসবে মুখর কটা দিন।
শারদীয়ায় বাঙালিরা আত্মশুদ্ধি ঘটানোর জন্য মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে পুজোর মন্ত্র উচ্চারণে আত্মার মিল ঘটিয়ে মগ্ন হয়ে থাকে। দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে সমাজের মঙ্গল সাধনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। ত্রিনয়নির দিকে তাকিয়ে মনে মনে কত কথা যেন বলে। অষ্টমীর দিনে নারী পুরুষ সকলেই একসাথে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে মানবিকতার পরিচয় দেয়। বিদায়ের মুহূর্তেও কেঁদে ফেলে মানুষ। সকল ধর্মের মানুষ একসাথে মিলন মেলায় অংশ নেয় পূজা যজ্ঞে। ছোট থেকে বড় সবার মনেই একরাশ আনন্দ, অনুভূতির পারদ উচ্চ মাত্রায়। যুবক-যুবতীর মনেও প্রেমের আলাদা মানে ছিল। ঠোঁটের কম্পনেই বোঝা যেত প্রেমের গভীরতা। সমাজ পরিবেশে মানুষ হিসাবে জন্ম নিয়ে আমরা গর্বিত। প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের জন্য কাজ করে যেতে পারি। এই মর্মে দায়বদ্ধ আমরা যেন হতে পারি।
সমকলীন পুজো একটু অন্যরকম। ভিন্ন পথে বাঁক নিয়েছে পুজোর প্যাটার্ন। আধুনিক যুগ, যন্ত্র নির্ভর যুগ। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে পাল্টে গেছে মা দুর্গার আবাহন-আগমনী গান। ঋতুর বৈচিত্র্যে অনিয়ম যেমন ধরা পড়েছে, তেমনি বদল ঘটেছে মানুষের রুচি, সমাজ কলায়। আগেকার মতো এখন আর সাবেকি পুজো তো নেই-ই। এখন বেশিরভাগ বারোয়ারী পুজো। তাও গ্রামে এর প্রচলন ভালোই। কোথাও কোথাও পল্লী এলাকায় মন্ডপের পুজো দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া এখন এই মন্ডপের পুজো বেশি। ফলে পুজোর ধারণা পাল্টে যাচ্ছে অত্যাধুনিক যুগে। ছেলে-মেয়ের প্রেমেও বদল ঘটেছে। অঞ্জলি দিতে দিতেও তীব্র যৌনাকাঙ্ক্ষা। কখন একটু আড়ালে গিয়ে ঠোঁটে একটা চুমু দেবে, আর কখনই বা শরীরের গন্ধ নেবে মেপে।
মহিলারাও মাতে শাড়ি, গয়না আর ফ্যাশনে। আগেকার মতো আর নেই সেই একতা। সবাই মিলে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার তাৎপর্য যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পুরুষরাও বাইক ছুটিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সাথে মদ, গাঁজা তো আছেই। যারা পুজোর কর্মী, উদ্যোগী তাদের আবার অন্য নেশা। তাদের চিন্তা কিভাবে নিজেদের প্রতিমা শারদ সম্মান পাবে! কিভাবে অন্য মন্ডপের প্রতিমাকে টেক্কা দেওয়া যায়। এককথায় এগিয়ে থাকার দৌড়ে আকাশচুম্বী প্রতিমারও দমবন্ধ অবস্থা। ঢাকিরাও তেমন আর ঢাক বাজায়না। অর্থের সচ্ছলতা এসেছে তাদের কিন্তু এখন যেন দায়সারা বাজায়। ওই বাজালেই হলো আর কী! আরতির ঘন্টাও পাল্টে গেছে পুরোহিতের। মন্ত্র উচ্চারণে তেমন তীব্রতা দেখিনা। বর্তমানে প্রশাসনকে খাড়া করে পুজোর আনন্দ উপভোগ করতে হয়। মনের মধ্যে কাঁটা খচখচ করে এই বুঝি ঝামেলা হলো! এমনকি বিসর্জনেও পুলিশি তদারকি। সাম্প্রদায়িক উস্কানির প্রবণতা থাকেই যেন।
আসলে যুগ পাল্টেছে, পাল্টেছে প্রযুক্তির ব্যবহার, মানুষও পাল্টে যাচ্ছে সমকালীন হাওয়ায়। সমাজ পাল্টে যাচ্ছে দিশাহীন উদ্দেশ্যের কোন অনামি পরিণতির দিকে? "শারদীয়া ও শারদ উৎসব হয়ে উঠছে সমকালীন সমাজের প্রতিযোগিতার আলকাপ।"
-------------------
সুনন্দ মন্ডল
কাঠিয়া, পাইকর,বীরভূম
731219
পশ্চিমবঙ্গ
8637064029