প্রতিশোধ
আমার কাবেল দাদু এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। আমার নিজের দাদু অবশ্য নয়, আমার বাড়ির পাশেই তার বাড়ি। সেই খুব ছোটবেলা থেকে তার রঙ্গ-তামাশা দেখে আসছি। তার রঙ্গ-তামাশায় আমি সব সময় মুগ্ধ হয়; শুধু আমি কেন, যারা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। সবসময় তার ছেলে মানুষী লেগেই আছে। তার মেলামেশা করার মানুষের কোন বয়সসীমা নেই; বাচ্চা থেকে বুড়ো সব ধরনের মানুষের সাথেই তার খুব গভীর সম্পর্ক। তাই বুড়ো থেকে ছোকরা সবাই কাছে সে কেষ্ট খুড়ো হয়ে উঠছে। মানে তার নাম কৃষ্ণপদ দাস; তাকে সবাই কেষ্ট খুড়ো বলে ডাকে, আর আগেই বলেছি আমি ডাকি কাবেল দাদু বলে।
কাবেল দাদুর শরীর এখন ভাঙতে শুরু করেছে, বয়স হচ্ছে তো। তার বয়স প্রায় ষাট পেরিয়ে গেল। তার সেই বলিষ্ঠ শরীরে এখন পাঁজর দেখা দিচ্ছে। কিন্তু তার মানসিক জোর একই রকম আছে; যৌবনে যেমন ছিল, এখনও তাই আছে। এতটুকুও পরিবর্তন ঘটেনি। সারাক্ষণ গল্প আড্ডায় মেতে থাকে, আর সবাইকে মাতিয়ে রাখে। কিন্তু তার যেন কোনো ক্লান্তি নেই, নিজের ঘরে তাকে খুব কম সময়ই দেখা যায়। কাজ না থাকলে সে কোথাও না কোথাও আনন্দে মত্ত হয়ে থাকবেই।
ছোটো গ্রাম, লোক বসতি কম বললেই চলে। তবে আমাদের গ্রামের বেশ কয়েকজন ছেলের উদ্যোগে একটা ক্লাব এখনও টিকে আছে। ক্লাবের ছেলেরা সারাদিন যে যার মতো কাজ করে; ক্লাবের পাশেই খেলার মাঠ, বিকালে মাঠে খেলাধুলা করে, আর রাতে ক্লাবে আড্ডা মারে। তবে ওই ক্লাবটা আমাদের সময়ে গঠিত নয়। কাবেল দাদু যখন যুবক ছিল তখন দাদু ও তার বয়সী বেশ কয়েকজন গ্রামের ছেলে মিলে ক্লাবটি তৈরি করে। ক্লাবের ইতিহাসটা আমি কাবেল দাদুর মুখেই শুনেছি। খুব কষ্ট করে তারা এই ক্লাবটি গঠন করেছিল। তখন অবশ্য ক্লাবটি মাটির ছিল, এই বেশ কয়েক বছর হল সেটি পাকার হয়ে গেছে।
দাদু খেলা খুব ভালোবাসেন। আমরা যখন ক্লাবে ভারতের ক্রিকেট খেলা দেখি তখন তার উত্তেজনা ও চেঁচামেচি সবথেকে বেশি থাকে। আমাদের তাকে দেখে মনে হয় সে একাই যেন চেঁচিয়ে ভারতকে জিতিয়ে দেবে। তাছাড়া আমরাও বিকালে মাঠে যখন খেলি দাদুর কাজ না থাকলে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের খেলা দেখতে মাঠে উপস্থিত থাকে। আর খেলার বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিতেই থাকে। তবে অনেকের মুখে শুনেছি দাদু যখন যুবক ছিল ক্রিকেট ও ফুটবল দুটো খেলাতেই খুব পারদর্শী ছিল। সেই জন্যই হয়তো খেলার প্রতি অনুরাগটা তার এখনও থেকে গেছে।
দাদুর সম্পর্কে একটা কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়। সেটা হচ্ছে দাদু ভূত-প্রেত খুব দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে। দাদু নাকি নিজের চোখে অনেক ভূত-প্রেত দেখেছে। এমনকি ভূতের সাথে কথা পর্যন্ত বলেছে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম ভূতের সাথে কথা বলতে তার ভয় করেছিল কিনা। সে বলেছিল ভয় করবে কেন, ভূত তার কথা বলেছে, আমি আমার কথা বলেছি। তবে আমি যে খুব দৃঢ় ভাবে ভূত-প্রেত বিশ্বাস করি তা ঠিক নয়, আবার অবিশ্বাসও করতে পারি না। ভূতের কথা শুনলেই আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। কাবেল দাদু নিজের জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া গল্প বলতে খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু দাদুর গল্প শুনতেও খুব ভালোবাসি। দাদুকে যখনই গল্প বলতে বলি, কোনো না কোনো গল্প দাদু ঠিকই বলে। আর সেটা শুনে আমরা আনন্দও পাই। তবে যেসব গল্প দাদু বলে থাকে তার মধ্যে বেশির ভাগই ভূতের ঘটনা। সেই সব ঘটনাগুলো দাদু নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছে।
দাদুর গল্প বলার প্রধান জায়গা হচ্ছে আমাদের খেলার মাঠ। দাদুর যদি কোন কাজ না থাকে প্রতিদিন খেলার শেষে একটা করে গল্প আমরা শুনি। গল্পের শ্রোতা থাকে আমি ছাড়া আমার তিনজন বন্ধু ও দুজন দাদা। বন্ধুদের গ্রামেতেই বাড়ি এবং দাদা দুটো নিজের নয়, পাড়াতুতো। তাছাড়া এক একদিন আরও দু- একজন শ্রোতা জুটে যায়। শ্রোতাদের নামগুলো বলে রাখাটাই ভালো; তিনজন বন্ধু বিজয়, অপূর্ব ও আশিষ এবং বিকাশদা ও অমিয়দা।
প্রতিদিনের মতো আজকেও আমরা খেলা শেষে মাঠে বসে আছি। গ্রীষ্মকাল, বাড়িতে সারাদিন থেকে গরমে প্রাণ যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল; বিকালে ঠান্ডা বাতাসে মন প্রাণ সব তৃপ্তি পেল। পাশের গ্রাম থেকে একটা বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছিল। এই সময় প্রত্যেক গ্রামেই পূজা হয়ে থাকে, সেই পূজা ও বাজনা নিয়েই বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। হঠাৎ কাবেল দাদুর আগমন, আমাদের উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা, "কিরে কিসের আড্ডা চলছে?"
অপূর্ব বলল, "এই পাশের গ্রামে পূজো হচ্ছে, ওই নিয়েই আলোচনা করছিলাম।"
দাদু বলল, "হ্যাঁ, আজ হরিশ্চন্দ্রপুরে পূজো আছে, খুব ভালো বাজনা করেছে শুনলাম।"
অপূর্ব বলল, "এইতো শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।"
দাদু বলল, "বাজনাটা কি সুন্দর বাজছে না, শুনতে বেশ ভালো লাগছে।"
অপূর্ব বলল, "হ্যাঁ।"
দাদু বলল, "জানিস, পাশের গ্রামে পুজোর কথা শুনে আমার একটা গল্পের কথা মনে পরে গেল।"
অমিয়দা আজ খেলতে আসেনি, তার আজকে কি কাজ আছে। বিকাশদা আমার পাশেই বসেছিল, সে বলল, "কেষ্টখুড়ো তোমার গল্প শোনার অপেক্ষাতেই তো আছি। তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন বসো, তোমাকে কি নেমন্তন্ন করতে হবে।"
বিকাশদা আর অমিয়দা দাদুকে কেষ্টখুড়ো বলে ডাকে। দাদু বিকাশদার দিকে তাকিয়ে বলল, "তোরা তো আমাকে প্রতিদিন নেমন্তন্ন করিস, ওই জন্য তো আমি আসি।"
বিকাশদা বলল, "ভণিতা না করে গল্পটা বলো, এক্ষুনি সন্ধে হয়ে যাবে। বাড়ি যেতে হবে তো নাকি।"
দাদু আমাদের পাশে বসলো, আমরা তাকে ঘিরে গোল হয়ে বসলাম। দাদু তার দেখা একটা ঘটনা বলতে লাগলো।
বুঝলি এই রকমই একদিন বিকালে আমরা বেশ কয়েকজন ছেলে ক্রিকেট খেলা শেষ হলে, মাঠে বসে গল্প করছি। সেই সময় মন্টুদা এসে আমাদেরকে বলল, "তোরা আজকে কেও আমার সাথে পলাশপুরে মেলা দেখতে যাবি?"
পলাশপুর কিছুটা দূরেই, তোরা সবাই জানিস। আর মন্টুদাকে তোরা চিনতিস, বছর দুয়েক আগে মারা গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কখন মেলা দেখতে যাবে মন্টুদা?"
মন্টুদা বলল, "এখনই বেরিয়ে যাবো, বিকাল থেকে মেলা আরম্ভ হয়ে গেছে। কৃষ্ণ তুই যাবি?"
আমি বললাম, "গেলে তো ভালোই হতো, অনেকদিন মেলা দেখা হয়নি।"
সন্টুর বাবা গোপালকে জানিস, তখন গোপালও ওখানে ছিল। সে বলল, "মন্টুদা কৃষ্ণ যদি যায়, তাহলে আমিও যাব।"
আমি বললাম, "চল, ঘুরে আসা যাক তাহলে।"
আমরা তখন চলে যাচ্ছি তোদের অসিতদাদু বলল, "আমারও যেতে ইচ্ছা করছে, আমিও তোদের সঙ্গে যাব রে।"
আমি বললাম, "যেতে ইচ্ছা করছে তো বসে আছিস কেন, চলে আয়, এক্ষুনি সন্ধ্যা হয়ে যাবে তো।"
মন্টুদা আমার থেকে চার বছরের বড়ো ছিল। মন্টুদা প্রচন্ড সাহসী; অন্যায় দেখলে মন্টুদা চুপ করে থাকতে পারত না, প্রতিবাদ সে করবেই। তবে মন্টুদা খেলাধুলা করতে পারত না, আমরা যখন খেলা করতাম তখন সে আমাদের খেলা দেখতো। তবে মন্টুদা আড্ডা দিতে খুব ভালোবাসত, প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় ক্লাবটা সে একাই মাতিয়ে রাখতো। পলাশপুরে দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে প্রতিবছর একদিন মেলা হতো, এখনও অবশ্য হয়। আমাদের গ্রাম থেকে প্রতিবছর অনেকেই পলাশপুরে মেলা দেখতে যেত।
আমরা সেদিন চারজন যখন পলাশপুরে মেলা দেখতে গেলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারজনে চারটি সাইকেলে করে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। পলাশপুর সাইকেলে করে কুড়ি মিনিটের রাস্তা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেলায় পৌঁছে গেলাম। একদিনের মেলা হওয়াই মেলায় ভীষণ ভিড় হয়েছিল, স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা করা যাচ্ছিল না। সেজন্য বেশিরভাগ লোক নিজেদের পরিচিত মানুষের সাথে দল বেঁধে মত্ত ছিল। আমরাও একদল ছেলের সাথে গল্প করছিলাম, তবে তাদেরকে আমি চিনি না, মন্টুদা তাদের ভালো করে চিনতো। একটু রাতের দিকে মেলার ভিড় কিছুটা কমে এলে, আমরা চারিদিক ঘুরে ভালো করে সবকিছু দেখলাম। মেলাতে পেট পুরে খাওয়া দাওয়াটাও বেশ ভালোই হলো। অনেকদিন পর কোথাও মেলা দেখতে গিয়ে বেশ আনন্দ পেলাম। মেলাতে লোকের ভিড় বেশ কিছুটা কমে এলে আমরাও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মেলা থেকে আমরা যখন বেরোলাম তখন ঘড়িতে প্রায় বারোটা বেজে গেছে। ফাঁকা রাস্তায় চারজন গল্প করতে করতে আসতে বেশ ভালোই লাগছিল। প্রায় অর্ধেক রাস্তা আসার পর একটা ঘটনা ঘটল; সেটা আমরা ঠিক আশা করিনি। মন্টুদা আমাদের সাথে আসতে আসতে কিছুটা পিছিয়ে গেল; আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদেরকে ফেলে রেখে বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে এলো। আমরাও সাইকেল একটু জোরে চালালাম, কিন্তু মন্টুদাকে ধরতে পারলাম না। মন্টুদা হঠাৎ আমাদের থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সাইকেলের গতি আমরা কমিয়ে দিয়ে যেরকম আসছিলাম আবার সেরকম আসতে লাগলাম। অসিত আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, "মন্টুদার এটা উচিত হয়নি, আমাদেরকে এনে এভাবে ফেলে রেখে চলে গেল!"
আমি বললাম, "মন্টুদাতো এরকম করে না, হঠাৎ কিছু না বলে একা চলে গেল। কোন বিপদ হয়েছে কিনা কে জানে।"
গোপাল বলল, "কিন্তু কিছু না বলে একা যাওয়ার কি দরকার ছিল, আমাদেরকে বললে আমরাও জোরে সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম।"
গল্প করতে করতে আমরা বাড়ি পৌঁছালাম। গোপালের বাড়ির পাশেই মন্টুদার বাড়ি, সেটা তোরা সবাই জানিস। আমি বললাম, "মন্টুদা কি জন্য তাড়াতাড়ি চলে এলো দেখে আসি চল।"
তিনজনে মন্টুদার বাড়ি গেলাম; দেখলাম মন্টুদার দাদা সিন্টুদা এক ঘুম দিয়ে বাইরে উঠেছে। আমাদেরকে দেখে জিজ্ঞেস করল, "কিরে তোদের মেলা দেখা হয়ে গেল।"
অসিত বলল, "হ্যাঁ, কিন্তু মন্টুদা তাড়াতাড়ি চলে এলো কেন গো, কোন বিপদ হয়েছে নাকি।"
একথা শুনে সিন্টুদা অবাক হয়ে বলল, "কই, মন্টু তো এখনও বাড়ি ফেরেনি।"
মন্টুদা সিন্টুদার সাথেই রাতে ঘুমাতো। সুতরাং মন্টুদা বাড়ি ফিরলে সিন্টুদা জানবে। আমি বললাম, "কিন্তু মন্টুদাতো আমাদের আগে চলে এসেছে। "
সিন্টুদা বলল, "বাড়িতে সে এসে পৌঁছায়নি তো। কখন ও এসেছে?"
আমরা সমস্ত ঘটনাটা সিন্টুদাকে বললাম। সিন্টুদা অবাক হয়ে কি যেন ভাবলো, তারপর বলল, "তোরা আমার সাথে চল, দেখি সে কোথায় রইল।"
আমরা সাইকেলগুলো রেখে হেঁটে হেঁটে যেদিকে এসেছিলাম, ওই পলাশপুরের দিকে , রাস্তার দুপাশে খুঁজতে খুঁজতে চারজনে গেলাম। আমাদের কাছে দুটো টর্চ ছিল, তাই খুঁজতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। চারজনের কাছে চারটি টর্চ থাকলে ভালো হতো। আমি সিন্টুদাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, "মন্টুদা যে কোথায় গেল। কিন্তু এভাবে খুঁজলে মন্টুদাকে কি আমরা পাব। মন্টুদা কি কোথাও পরে থাকবে?"
সিন্টুদা কোন কথা বললো না। সে শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে মন্টুদাকে খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে ওই নিমপুকুরের আগে রাস্তার ধারে জমিতে মন্টুদার সাইকেলটা পরে থাকতে দেখলাম। তোরা নিশ্চয় নিমপুকুর কোনটাকে বলে জানিস?
আশিষ বলল, "হ্যাঁ জানি, তারপর তোমার মন্টুদাকে কোথায় পেলে?"
কাবেলদাদু বলল, "বলছি।"
সাইকেলটা আমরা রাস্তায় রেখে মন্টুদাকে আশেপাশে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু ওই জায়গায় কোথাও পেলাম না। তখন ওই নিমপুকুরের রাস্তার ধারের দক্ষিণ পাড়টা শ্মশান ছিল; এখন আর ওখানে মরা পোড়ানো হয় না, তোরা সেটা জানিস। আর ওই শ্মশানের পাশেই একটা বড়ো বটগাছ ছিল। আমরা মন্টুদাকে খুঁজতে খুঁজতে ওই শ্মশানে চলে গেলাম। পুকুরের পুরো পাড়টা, এমনকি জলের ধারে পর্যন্ত দেখলাম; কিন্তু মন্টুদাকে দেখতে পেলাম না।
আশিষ বিরক্ত হয়ে বলল, "মন্টুদার যে কি হয়েছিল কে জানে, শুধু শুধু জোরে আসার কি দরকার ছিল।"
সিন্টুদা ধমক দিয়ে বলল, "বাজে না বকে ভালো করে খোঁজ, সাইকেলটা যখন পাওয়া গেছে আশেপাশেই কোথাও থাকবে।"
আমরা কোনো কথা না বলে চারিদিক ভালো করে খুঁজতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সিন্টুদাই মন্টুদাকে দেখতে পেয়েছিল। সিন্টুদা আমাদেরকে ডাকলো, আমরা তাড়াতাড়ি তার কাছে গেলাম, দেখলাম সিন্টুদা ভয়ে কাঁপছে। কিন্তু মন্টুদাকে তার কাছে দেখতে পেলাম না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কি হল সিন্টুদা।"
সিন্টুদা কোনো উত্তর দিল না। সে শুধু টর্চের আলোটা শ্মশানের বটগাছের কিছুটা উপরে ফেললো। আমরা সেদিকে তাকিয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। দেখলাম বটগাছের কান্ডটার যেখান থেকে শাখা-প্রশাখা ভেঙেছে, সেখানে একটা শাখায় ঠেস দিয়ে অচৈতন্য অবস্থায় মন্টুদা বসে আছে। আমরা ধরাধরি করে গাছ থেকে মন্টুদাকে নামালাম। তারপর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে চারজনে তাকে বাড়িতে নিয়ে গেলাম। ততক্ষণে মন্টুদার বাড়ির সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে। সবাই ধরাধরি করে তাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শোয়ানো হলো। তারপর তার অচৈতন্য চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতেই আস্তে আস্তে তার জ্ঞান ফিরে এলো। সে উঠে বসল, কিন্তু তার ভাবভঙ্গি দেখে স্বাভাবিক মনে হলো না। তার চোখ ঘরের চারিদিক ঘুরছে, দেখে মনে হলো সে যেন কিছু খুঁজছে। তারপর তার চোখের স্থির দৃষ্টি ঘরের মধ্যে থাকা লোকের উপর পড়ল। সেই দৃষ্টি দেখে আমি ভয়ে চমকে গেলাম। এই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি মন্টুদার নয়, তার চোখের মধ্যে যেন বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে।
আমাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মন্টুদা ভাঙা ভাঙা স্বরে তীব্র ভাবে বলল, "কি হয়েছে, এই ঘরে এতো লোকজন কেন?"
আমি এই ভয়ঙ্কর স্বর শুনে দু-পা পিছিয়ে এলাম। মনে মনে ভাবলাম এই স্বর তো মন্টুদার নয়, অচেনা মানুষের গলার স্বর। কোনদিন শুনেছি বলে মনে হলো না। সবাইকে দেখে মনে হলো আমার মতোই খুব ভয় পেয়ে গেছে। সিন্টুদা মনে হয় আগে থেকেই কিছু একটা আন্দাজ করেছিল। সেই জন্য আমাদেরকে চুপচাপ মন্টুদাকে খুঁজতে বলছিল, কোনো কথা তখন থেকে বলেনি। সিন্টুদার চোখে মুখে আমি কোনো ভয় দেখতে পেলাম না। সে বেশ স্বাভাবিক ভাবে মন্টুদাকে জিজ্ঞাসা করল, "কে আপনি?"
এই কথা শুনে আমি একটু অবাক হলেও পরক্ষণেই ভাবলাম, এই প্রশ্নের অর্থ মন্টুদার শরীরে কোনো প্রেতাত্মা প্রবেশ করেছে। মন্টুদা একপ্রকার ভয়ঙ্কর হেসে কর্কশ স্বরে বলল, "আমি নিতাই মন্ডল।"
এই কথা শুনে আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ মাসদুয়েক আগেই নিতাই মন্ডল মারা গেছে। শুনেছিলাম কোনো রাজনৈতিক দলের লোকেরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। ওই নিমপুকুরের শ্মশানেই তাকে পোড়ানো হয়েছিল। সিন্টুদা আবার স্বাভাবিক কন্ঠেই জিজ্ঞাসা করল, "তা আপনি ওর ওপর ভর করেছেন কেন?"
মন্টুদা আবার ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল, "প্রতিশোধ নেবো বলে। ওরা আমাকে বিনা অপরাধে পিটিয়ে মেরে ফেললো, আমি তো ওদের কোনো দোষ করিনি। আমি শুধু ওদের বিরোধী দলে ছিলাম। ওদের কাজকর্ম আমার ভালো লাগেনি, সুতরাং আমি ওদের বিরোধী দলে থাকতেই পারি।"
সিন্টুদা জিজ্ঞাসা করল, "আপনি ওদের উপর প্রতিশোধ নিন; কিন্তু আপনি মন্টুকে ধরেছেন কেন?"
মন্টুদা আবার কর্কশ স্বরে বলল, "ওকে দিয়েই আমি প্রতিশোধ নেবো। ওর মতো সাহসী পুরুষ আর কে আছে।"
সিন্টুদা আর কোনো কথা বললো না। আমাদের সবাইকে ঘর থেকে বের করে, ঘরে তালা দিয়ে দিল। আর আমাদেরকে বলল, "কেউ যেন এই দরজা না খুলে। কাল সকালে কি করা যায় আমি দেখছি।"
মন্টুদা ঘরের ভেতর থেকে জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে, "দরজা খুলে দাও, না হলে আমি দরজা ভেঙে দেব।"
কিন্তু ওই চিৎকার বেশিক্ষণ টিকলো না, কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে গেল। সেই রাতে আর ভালো করে ঘুম হয়নি, এমনিতেই রাত শেষ হয়ে গিয়েছিল; ওই ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙতেই মন্টুদাদের ঘর চলে গেলাম। দেখলাম প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে, কিন্তু ঘরের তালা এখনও খোলা হয়নি। সিন্টুদা ভোরে কোন ওঝার বাড়ি গেছে, সে ফিরলে তারপর তালা খোলা হবে। কিছুক্ষণ পরেই সিন্টুদা দুটো লোককে সঙ্গে করে নিয়ে এলো। তারা এসে দরজাটা খুললো; দেখলো মন্টুদা খাটের উপর অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে। আবার তার চোখে মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হলো। কিন্তু সেই কর্কশ গলার স্বর আর শোনা গেল না। এই স্বরটা মন্টুদারই, আমার খুব চেনা। মন্টুদা বলল, "আমার কি হয়েছে, এখানে এতো ভিড় কেন?"
ওঝাটা বলল, "কিছু হয়নি, তুমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে।"
মন্টুদা উঠে বসার চেষ্টা করলো, কিন্তু উঠতে পারলো না। তার শরীর প্রচন্ড দুর্বল ছিল। ওঝাটা বলল, "তোমাকে উঠতে হবে না। তুমি অসুস্থ আছো, ঘুমিয়ে পড়ো।"
সবাইকে সিন্টুদা বাড়ি যেতে বললো। যাবার সময় ওঝা সিন্টুদাকে বলে গেল, "এখন সুস্থ আছে, তবে দুর্বল। ভালো করে খাওয়া দাওয়া করাবেন। আর এখন বাড়ির বাইরে বেড়োতে দেবেন না, বিশেষ করে রাতে।"
তারপর বেশ কয়েকদিন মন্টুদা বাড়ির বাইরে বেড়োয়নি। আমরাই দুবেলা দেখা করতে যেতাম। ক্রমে মন্টুদা সব জানতে পারলো তার সাথে কি হয়েছিল।
এরপর কাবেল দাদু একটু থামল, বুক পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে সেটা ধরালো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার গল্প শেষ হয়ে গেল?"
দাদু বিড়িতে বেশ বড়ো একটা টান দিয়ে বলল, "আর একটু আছে।"
বিড়িটা তাড়াতাড়ি শেষ করে দাদু আবার বলতে লাগল। দিন কুড়ি মন্টুদা বাড়িতে ছিল, ওই রকম চনমনে ছেলে কতদিন আর বাড়িতে থাকবে। তারপর হঠাৎ একদিন একটা ভয়ঙ্কর দূর্ঘটনা ঘটল। মন্টুদাকে একদিন রাতে খুঁজে পাওয়া গেল না। সিন্টুদা আমাদেরকে খবর দেয়। সারারাত খোঁজাখুঁজির পরও তার কোনো টিকি দেখা গেল না। নিরাশা হয়ে আমরা ভোররাতে বাড়ি ফিরে এলাম। তাকে পাওয়া গেল পরের দিন সকালে পাশের গ্রামে অচৈতন্য অবস্থায়। তার সঙ্গে সকালে আর একটা খবরও পাওয়া গেল; দু-তিনটি গ্রাম পরে একটি গ্রামে তিনজন লোক খুন হয়েছে। কারা যেন ধাঁরালো কিছু দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে। তিনজন লোকই কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা।
__________________
অলোক দাস
গ্রাম- খাটগ্রাম
ডাকঘর- সন্তোষপুর
থানা- গোঘাট
হুগলি, ৭১২৬০২
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
মোঃ- ৮৩৪৮৯২৯৬৩০
সহযোগিতা
কাম্য
এই সংখ্যার সমস্ত লেখা একত্রিত করে একটি
সুসজ্জিত ইবুক তৈরি করা হয়েছে। আপনি যদি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হন তাহলে ৯৪৩৩৩৯৩৫৫৬
নম্বরে ন্যুনতম ১০ টাকা google pay, phonepe, paytm, freecharge বা amazon pay করতে
পারেন। প্রদানের স্ক্রীনশট ওই নম্বরে whatsapp করলেই ইবুকটি পেয়ে যাবেন। সহযোগিতা
কাম্য।
|
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন