তৃতীয়
একচিলতে মাটির দাওয়ায় নরম রোদে পিঠ দিয়ে বসেছিল দুর্গা । সামনে তেল মাখিয়ে শুইয়ে রাখা ছোট্ট মেয়েটা ঘুমোচ্ছে । একটানা কপালকে দুষে যাওয়া শাশুড়ির বিলাপের মাঝে একটা নাম ভাবছিলো দুর্গা, মেয়েটার জন্য । প্রথম দুই কন্যা লক্ষ্মী সরস্বতীর পর এবার কার্তিকেরই অপেক্ষা ছিলো । আশাভঙ্গ হওয়ায় কেউই আর নাম দিতে এগিয়ে আসে নি- না পাড়া প্রতিবেশী, না আত্মীয় কুটুম । তবু ওরা ঠিক এসেছিলো । ডুগডুগ ঢোল বাজিয়ে, হাতে হাতে তালি দিয়ে ওরা এসেছিল । কচি মেয়েটাকে নাচালো এমন যত্ন করে , যেন রাজকুমারী ।
প্রথম আদরের ছোঁয়ায়, প্রথম বার মেয়ের ঠোঁটে আলতো হাসি দেখে কান্না চেপে দুর্গা যখন বললো- " কী আর দেবো তোমাদের ? তিন নম্বর, তাও আবার মেয়ে!" তখন গাঢ় কাজল পরা ঈষৎ বাদামি দুটো চোখ এক ঝলক দপ্ করে জ্বলে উঠলো যেন । তারপর কর্কশ একটা মৃদু কণ্ঠ কেটে কেটে উত্তর দিলো -
" দিদি রে! যদি মেয়েও হতাম!!"
আকাঙ্ক্ষা
বাড়িতে পা দিয়েই বাসন্তী বোঝে আজও বাড়ির পরিবেশটা বেশ থমথমে । নিশ্চয়ই সকাল সকাল শাশুড়ি- বৌয়ে একচোট হয়ে গেছে । রোজ এদের ঝগড়া-ঝামেলা লেগেই আছে । কোনোকিছুর অভাব নেই অথচ মানিয়ে থাকতে পারে না । থাকবেও একসঙ্গে, নিত্য অশান্তিও চলবে । অনেক বছর এবাড়িতে কাজ করছে বাসন্তী । গিন্নিকে দেখছে তখন থেকেই আর বৌ-কে তো বিয়ের সময় থেকেই দেখছে। বাসন্তীর ছেলেরও বিয়ে লেগেছে সামনের শ্রাবণে ।
গিন্নির ঘরটাই প্রথমে মুছতে ঢুকলো বাসন্তী ন্যাতা- বালতি হাতে । বাসন্তীকে দেখেই কথা শুরু করলো খাটের উপর গোঁজ হয়ে বসে থাকা গিন্নি-"বৌ আনছিস তো! প্রথম থেকেই শাসনে রাখবি । লাই দিলেই মাথায় উঠবে । বৌ কক্ষনো মেয়ের মতো হবে না ।"
বাসন্তীও দৃঢ় জবাব দেয়-" আমি প্রথমে মেয়ে বলে না ভাবলে, সেও আমাকে মা বলে ভাবতে শিখবে না গো কাকিমা!"
মিষ্টিমুখ
"কী হে মাস্টার! খাতা নিয়ে ক্লাসে চললে নাকি?"
অ্যাসিস্টেন্ট হেড নন্দীবাবুর কথায় চমকে উঠে পিছন ফেরে গ্রুপ ডি অরুণ । একটু তুতলে উত্তর দেয় –
" স্যার আপনিই তো বললেন ডি কে বি স্যারকে এই অ্যাটেন্ডেন্স খাতাটা দিয়ে আসতে ।"
" ও, তাই তো । আমি ভাবলাম খাতা নিয়ে ক্লাসে চললে বুঝি । হা হা! তোমার তো ক্লাসে যাওয়ার খুব শখ ।"
হ্যাঁ, বড়ো শখ অরুণের, সেই ছোটবেলা থেকে শখ ক্লাস করার, শিক্ষক হওয়ার । খুব চেষ্টা করেছিল সে কিন্তু শেষপর্যন্ত এস এস সি-টা লাগাতে পারেনি । হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ার পর খড়কুটোর মতো এই গ্রুপ ডি-র চাকরিটা নিতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছে সে । নাহলে, ইচ্ছে তো অন্যকিছু ছিল ।
তার এই স্বপ্নের কথাটা কোনোদিন দুর্বল হয়ে নন্দীবাবুকে বলে ফেলেছিল অরুণ ।সেই থেকে ক্রমাগত তাকে ঠাট্টা করেন নন্দীবাবু। করুক! কতদিন আর করবে ! এই তো কালই রেজিগনেশন দেবে অরুণ । এস এস সি-র ওয়েটিং থেকে চাকরিটা কনফার্ম হয়ে গেছে, পোস্টিং-ও। কাল রেজিগনেশন দিয়ে একবারে সবাইকে খবরটা দেবে । মিষ্টিও আনতে হবে অনেকটা, নন্দীবাবুকে মুখ মিষ্টি করাতে হবে যে!!!
===================
জয়তী ব্যানার্জি মুখার্জি
বর্ধমান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন