প্রবন্ধ
রবীন্দ্রনাথ এবং কয়েকজন নারী
অনিন্দ্য পাল
বিখ্যাত এবং মেধাবী মানুষদের অনেকেরই জীবনে কোনো না কোনো সময় একজন নেপথ্যচারিনীর ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। আর্থার টেনিসন, উইলিয়ম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, জন কিটস, ভিকতর হুগো প্রভৃতি পৃথিবী বিখ্যাত এবং যুগোত্তীর্ণ ব্যক্তিত্বদের অনেকেই নেপথ্যচারিনীদের দ্বারা জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। প্রেমিকা 'লরা' কে উদ্দেশ্য করে 'পেত্রার্কের সনেট গুচ্ছ' আজো সেই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
রবীন্দ্রনাথও এমনই কয়েকজন নারীদের নেপথ্য প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন তাঁর জ্যোতিদাদার স্ত্রী কাদম্বরী দেবী। সমস্ত জীবন ধরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রায় সমবয়স্ক 'নতুন বউঠান'কে নিজের অজস্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
কাদম্বরী দেবী যখন ঠাকুরবাড়িতে বউ হয়ে আসেন তখন তাঁর বয়স ছিল নয় বৎসর আর রবীন্দ্রনাথ তখন সাত। তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠতে দেরি হয়নি। মায়ের মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র চোদ্দ বছর। জীবনস্মৃতিতে কবি লিখছেন, " বাড়িতে যিনি কনিষ্ঠা বধূ ছিলেন তিনিই মাতৃহীন বালকদের ভার লইলেন। " ষোলো বছরের কাদম্বরী দেবী তাঁর সমস্ত স্নেহ বাৎসল্য উজাড় করে দিয়েছিলেন এই দেবরটিকে। বারবার রবীন্দ্রনাথের রচনায় ফিরে ফিরে এসেছেন কাদম্বরী, বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন চিত্রণে। একদম শুরুর দিকে, কবির বাল্যকালে, লেখেন
'ওই স্নেহময় কোলে রাখি শ্রান্ত মাথা
কাতর হইয়া কত করেছি রোদন
কত না ব্যথিত হোয়ে আদরে যতনে
অঞ্চলে সে অশ্রুজল দিয়াছ মুছায়ে,' ( প্রাপ্ত প্রথম পান্ডুলিপি, মালতি পুঁথি)। পরবর্তীকালে এই অনুভূতিরই অনুরণন পাওয়া যায় গীতবিতানের প্রেম পর্যায়ে সেই বিখ্যাত গানে -'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা ' (প্রকাশকাল, ১২৮৭সন)। শুধু লেখার মধ্যেই সেই কল্প-বাস্তবের নারীর নিভৃত উপস্থিতি ছিল তা কিন্তু নয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রকাশিত অনেক কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন সেই নিভৃতচারিনীকে। তাঁর ভগ্নহৃদয় গীতিকাব্যটি (২৩ জুন, ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে) উৎসর্গ করেছিলেন 'শ্রীমতি হে 'কে। কে এই শ্রীমতি হে? বুঝতে অসুবিধা হয় না সেই নেপথ্য মানুষটি তাঁর অতিপ্রিয় নতুন বউঠান - কাদম্বরী দেবী। 'ভগ্নহৃদয়' - এর 'উপহার' গীতিতে রবীন্দ্রনাথ একস্থানে লিখছেন,
" স্নেহের অরুণালোকে খুলিয়া হৃদয় প্রাণ
এ পারে দাঁড়ায়ে দেবী, গাহিনু যে শেষ গান,
তোমারি মনের ছায় সে গান আশ্রয় চায়,
একটি নয়ন জল তাহারে করিও দান।" কবি সেই নারীকে প্রথম থেকেই সমস্ত আত্মস্থ ভাবালুতা এবং গাঢ়তর অনুভূতির কল্পরাজ্যের ইষ্টদেবী করে তুলে ছিলেন। 'ভগ্নহৃদয় এর তিনবছর পর (২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪, ফাল্গুন ১২৯০ সন) সদ্য বিবাহিত কবি লিখলেন (১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর; ১২৯০ সনের ২০ অগ্রহায়ণ) তাঁর নতুন কাব্যগ্রন্থটি "ছবি ও গান"। কাছাকাছি সময়েই তিনি লিখলেন"রাহুর প্রেম" এবং উৎসর্গ করলেন সেই নেপথ্যচারিনীকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবনের বাঁক ঘোরা এরপরেই। বিবাহের মাত্র সাড়ে চার মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরেই প্রাণপ্রিয় ' কাদম্বরী দেবী' অর্থাৎ 'নতুন বৌঠান' এর আত্মহত্যা (১২৯১ সনের ১০ বৈশাখ, ২১ শে এপ্রিল ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ) রবীন্দ্রনাথের অন্তরকে অশ্রু সজল করে তুলেছিল। এই শোকানুভূতি, এই আন্তরিক বিহ্বলতা কবির জীবনের পরবর্তী পর্যায়ের রচনায় প্রকাশিত। কাদম্বরীর মৃত্যুর মাত্র সাতমাস পরেই কবি লিখলেন শৈশবের খেলাঘর-এ
' যারে দিয়েছিল ওই ফুল উপহার
কোথায় যে গেছে চলে, সে তো নেই আর।'
কাদম্বরী মৃত্যুর সময় ছিলেন পঁচিশ বছর বয়স্ক, আর রবীন্দ্রনাথ তখন তেইশ বছর, কবিপত্নী মৃণালিনীর মাত্র এগারো। মৃণালিনী তখনও রবীন্দ্রনাথের জীবনে কোনো ছাপ ফেলতে পারেননি।
কাদম্বরীর প্রিয় কবি ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। এমনকি রবীন্দ্রনাথও কাদম্বরীকে খুশী করার জন্য কখনও কখনও বিহারীলালকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কাদম্বরী চাইতেন রবীন্দ্রনাথ যেন আত্মতুষ্ট না হন। হয়ত তাই তিনি কবিকে সচরাচর প্রশংসায় ভরিয়ে দিতেন না, তাঁর গান, তাঁর কণ্ঠ সম্পর্কে কাদম্বরী তাই উচ্ছসিত ব্যকুলতা প্রকাশ করেননি। হয়ত তাই কাদম্বরীর মৃত্যুর পরবর্তী রচনায় রবীন্দ্রনাথ নিয়ন্ত্রিত, আরও পরিণত এবং সরাসরি নাম না উল্লেখ করেও বারংবার সেই গোপনচারিনীকেই উৎসর্গ করেছেন তাঁর কবিসত্ত্বা, সাহিত্যের কেন্দ্রিকতা।
কাদম্বরীর মৃত্যুর পর 'পুষ্পাঞ্জলী', ভারতী পত্রিকায় লেখা 'কোথায়', 'শৈশব সংগীত' (কাদম্বরীর মৃত্যুর মাত্র একমাস পরেই) প্রভৃতি রচনায় কাদম্বরীর উজ্জ্বল উপস্থিতি চোখে পড়ে। ১৮৮৪ সালের ১লা জুলাই প্রকাশিত ভানুসিংহের পদাবলী ও উৎসর্গ করেন সেই কাদম্বরীকে, লেখেন - ' উৎসর্গ। ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ আর তুমি দেখিতে পাইলে না।' সমস্ত গীতবিতানেও রবীন্দ্রনাথের যে দুঃখ মথিত গোপন কান্না অনুরণিত হয়েছে, তা তো সেই নেপথ্যচারিনীরই মায়া-মোহ-স্নেহ বিজড়িত কাব্যপথ। এই অন্তঃসলীলা হারানোর ব্যাথা কবির ষাট বৎসরের পর রচিত 'পূরবীর কিশোর প্রেম ' কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে। 'তখন জানা ছিল না তো ভালোবাসার ভাষা;
যেন প্রথম দখিন বায়ে,
শিহর লেগেছিল গায়ে,'
সত্তর বৎসরের পরও তো 'শেষ সপ্তক' এর ৪৬তম কবিতার প্রথম ছত্রে বললেন 'তখন আমার বয়স ছিল সাত'।
এই কল্প-বাস্তবের স্নেহ-প্রেমদায়িনী মানবীর এক আপাত অদৃশ্য উপস্থিতি কবির জীবন সায়াহ্নেও দেখতে পাই যখন কবি মৃত্যুর সময় কাদম্বরীর ছবি দেখতে চান, তবে দুঃখের কথা, সে ছবিতাকে কেউ দেখাতে পারেনি। তার জন্য কেঁদেছেন,
'কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম '।আবার নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিয়েছেন 'আছ অন্তরে চিরদিন, তবু কেন কাঁদি'।
মৃণালিনী মারা যান আটাশ বছর বয়সে, কিন্তু কাদম্বরীর স্থান তিনি নিতে পারেননি। কবির পত্নী বিয়োগের বিচ্ছেদ-বেদনা 'স্মরণ'-এ প্রকাশিত হলেও তা জোয়ার-ছাপানো ছিল না।
তবে আরও তিনজন নারী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে রবীন্দ্রনাথের উপর মানসিক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। প্রথমেই বলতে হবে, মারাঠি কন্যা আনা তরখড় পাণ্ডুরঙ। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কয়েক বৎসর বড় এই 'আনা'র কাছে সতের বছর বয়স্ক কবি বিলেত যাত্রার আগে ইংরেজি ভাষা আর আদব কায়দা শিক্ষা করেন। তবে এই সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হন আনা। রবীন্দ্রনাথ আনার একটা নামও দেন, 'নলিনী'। আনার কথায় "কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধহয় আমার মরণ দিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।" কবি পরে আনাকে স্মরণ করে ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে বলেন "সেই মেয়েটিকে আমি ভুলিনি বা তার আকর্ষণকে কোন লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি।" আনার প্রতি কবির যে স্বীকার তা"ছেলেবেলা" গ্রন্থে (১৩৪৭ সনের ভাদ্র) পাই, তিনি বলেছেন " আমাদের ওই বট গাছটাতে কোনো কোনো বছরে হঠাৎ বিদেশী পাখি এসে বাসা বাঁধে। তাদের ডানার নাচ চিনে নিতে নিতেই দেখি তারা চলে গেছে। তারা অজানা সুর নিয়ে আসে দূরের বন থেকে। তেমনি জীবনযাত্রার মাঝে মাঝে জগতের অচেনা মহল থেকে আসে আপন-মানুষের দূতী, হৃদয়ের দখলের সীমানা বড়ো করে দিয়ে যায়।"
ভগিনী নিবেদিতা বিবেকানন্দের মানসকন্যা হলেও তাঁর নিজস্বতা, ভারতবর্ষের প্রতি মমত্ববোধ রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিতার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহবাসী তখনই নিবেদিতাকে তাঁর সন্তানদের শিক্ষার ভার নিতে বলেন। যদিও নিবেদিতা সম্মত হননি, তিনি চাননি রবীন্দ্রনাথের মত মানুষের সন্তানরা প্রথম থেকেই বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসটিতে 'গোরা' চরিত্রটির সঙ্গে নিবেদিতার চরিত্রের অনেক মিল পাওয়া যায়। এই আইরিশ মহিলার লোকসেবা, তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, উগ্রতা আর অসহিষ্ণুতার সঙ্গে গোরার আশ্চর্য মিল।
আর একজনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় বা তেমন আদান-প্রদানের চর্চা না হলেও পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী জোনা গেল- এর কথা না বলা হলে এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদিও জোনা গেল সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছু রবীন্দ্রনাথের লেখনী থেকে জানা যায় না, তবে ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে একটি সাক্ষাতে তিনি জোনাকে একটি কবিতা উপহার দেন,
" To Miss Zona Gale
I lived on the shady side of the road,
And watched my neighbours' gardens
across the way revelling in the Sunshine."
জোনা গেলও রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর লেখা "Frank Miller of Mission Inn" বইটিতে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পাওয়া যায়।
এভাবেই এক আকাশচুম্বী মানুষ অন্তরাত্মায় কখনও নেপথ্যচারিনী কাদম্বরী কখনো, স্ত্রী মৃণালিনী, কখনও নিবেদিতা বা কখনো আনার মানসিক অভিসারে কাব্যরসসিক্ত হয়ে উঠেছেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতার রশ্মিছটা, গানের ভেলা ভাসিয়ে পেরিয়ে গেছেন সাত সমুদ্র তের নদী, আবার কখনও গদ্যে তাঁদের চরিত্র চিত্রণে অমরত্ব দিয়েছেন। আমৃত্যু এক গোপন কান্নায় কেঁদেছেন, খুঁজেছেন তাঁর সাহিত্যে সেই পরম মানবীকে, সেই 'শ্রীমতি হে' কে।
===============
অনিন্দ্য পাল। চাম্পাহাটি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন