google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র ।। দেবাংশু সরকার - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র ।। দেবাংশু সরকার

নবপ্রভাত

রম্যগল্প 


    বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র

        দেবাংশু সরকার


       দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের অবসরের পর পাকাপাকিভাবে কলকাতা ছেড়ে পৈতৃক ভিটেতে ফিরে এসেছেন মিলন রায়। ত্রিশ বছর আগে, স্কুলের চাকরিটা পাওয়ার পর সেই যে গ্রাম ছেড়েছিলেন, তারপর প্রায় কোনও যোগাযোগ ছিল না গ্রামের সঙ্গে। মাঝে মাঝে গ্রামে এসেছেন। দু একদিন ছুটি কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু সেভাবে নিবিড় সম্পর্ক ছিল না গ্রামের সঙ্গে। স্কুল শিক্ষকতার চাপ, সেই সঙ্গে প্রাইভেট টিউশনের চাপে তিনি তার গ্রামের দিকে ঘুরে তাকানোর সময় পাননি। এতদিনে তিনি চাপমুক্ত হয়েছেন। কলকাতার ভাড়া বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন নিজের গ্রামের বাড়িতে।

      দীর্ঘ ত্রিশ বছরের ব্যবধান। কত পরিবর্তন হয়েছে তার গ্রামে! নিজেই চিনতে পারছেন না নিজের গ্রামকে। পাকা ঘরবাড়ি তৈরী হয়েছে। অনেকাংশেই কাঁচা মেঠো রাস্তা পাকা রাস্তায় পরিবর্তিত হয়েছে। পানীয় জলের সুব্যবস্থা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে তার গ্রাম এবং আশপাশের অঞ্চল। তেমনি নৈতিক অবনতিও তার চোখে পড়ছে। শিক্ষার মান তলানিতে ঠেকেছে। গ্রামে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও, ছাত্র সংখ্যা নগণ্য। চারিদিকে গজিয়ে উঠেছে দেশি মদের দোকান, জুয়ার আড্ডা। বিপথগামী হয়ে পড়েছে যুব সমাজ। এক কথায় বলতে গেলে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে সামাজিক পরিবেশ। 

      সবকিছু দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন মিলন বাবু। এভাবেতো চলতে দেওয়া যায় না। কিছু একটা তাকে করতে হবে। এই সমাজের পরিবর্তন করতে হলে শিক্ষার আলো প্রয়োজন। মিলন বাবু দেখেছেন এখনও গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর। তাদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করছে গ্রামের কতিপয় ব্যবসায়ী। এই সমাজের পরিবর্তন করতে হলে শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষার আলো পড়লে গ্রামের অবোধ মানুষগুলো নিজেদের ভালো মন্দ বুঝতে পারবে।

      শিক্ষার কোনও শেষ নেই। শিক্ষার কোনও বয়স নেই। বাচ্চাদের শিক্ষার জন্য স্কুল আছে। কিন্তু শিক্ষার প্রয়োজনটা যতক্ষণ না তাদের অভিভাবকরা জানতে পারছে, ততক্ষণ তারা তাদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চাইবে না। শিক্ষার প্রয়োজনটা জানার জন্য অভিভাবকদেরও ন্যুনতম শিক্ষার প্রয়োজন। মিলন বাবু ঠিক করেন গ্রামে তিনি একটা বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র খুলবেন। সম্পুর্ণ অবৈতনিক ভাবে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবেন তার গ্রামে। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। লেগে পড়লেন কাজে। তিনি লক্ষ্য করেছেন অশিক্ষিত মুর্খ গ্রামবাসীরা একজন মাষ্টার মশাই হিসেবে তাকে যথেষ্ট সম্মান করে, তার কথা শোনে। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু করেন বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র।

      গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাতে শুরু করেন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষার গুরুত্ব। একজন দুজন করে আসতে শুরু করে তার বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে। গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দেন মাষ্টার মশাই। নিরক্ষরকে স্বাক্ষর করে তোলেন।

      বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। আজ একাজ ওকাজ সারতে সারতে বেশ দেরি হয়ে গেছে।  নাড়ু বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। সে চলেছে সতুর দেশী মদের দোকানে। সন্ধ্যার সময়ে একটু গলায় না ঢাললে মন মেজাজ ভালো থাকে না নাড়ুর। যেতে যেতে পুরানো বাড়িটা দেখে অবাক হয় সে। বাড়িটাতে কেউ থাকে বলে মনে হয় না। বরাবরই সে দেখেছে বাড়িটার জানালা দরজা বন্ধ থাকে। কিন্তু আজ খোলা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাড়িটাতে আলো জ্বলছে। নতুন কেউ এল? নাকি চোর ছ্যাঁচড়ের আমদানি হল? ভাবতে ভাবতে জানালার দিকে এগিয়ে যায় সে। দেখে ভেতরে চিনু, মন্টু, গোকুল বসে আছে। আর একজন কে? আরও কিছুটা এগিয়ে যায় নাড়ু। একি! মাষ্টার মশাই এদের সঙ্গে! কি করছে এখানে? তবে কি মাষ্টার মশাইয়েরও পাত্তি খেলার নেশা আছে? দেখতেই হচ্ছে! কৌতুহল বাড়ে নাড়ুর। জানালায় উঁকি দিয়ে সে দেখতে থাকে। মাষ্টার মশাই কি যেন বলছে, চিনুরা মন দিয়ে শুনছে। শোনার চেষ্টা করে নাড়ু। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। আবার সে হাঁটতে থাকে সতুর দোকানের দিকে।

      গ্লাস হাতে নাড়ু সতুকে বলে, "জানিস সতু লেখাপড়া জানা লোকেরাও পাত্তি খেলে, গলায় ঢালে! আমাদের সঙ্গে তাদের কোনও তফাত নেই। তোর দোকানে আসার সময়ে দেখলাম মাষ্টার মশাই একটা ঘরে চিনু, মন্টুদের সঙ্গে আড্ডা মারছে!"

      - "আড্ডা নয়রে নাড়ু, মাষ্টার ইস্কুল খুলেছে। বুড়োদের ইস্কুল। মুখ্যু বুড়োদের লেখা পড়া শিখিয়ে দিগগজ করবে।"

      - "অ্যাঁ!"

      - "তাহলে আর বলছি কি! সব দল বেঁধে মাস্টারের ইস্কুলে লেখা পড়া শিখতে যাচ্ছে।"

      গ্লাস হাতে নাড়ু ভাবতে থাকে, লেখা পড়া না শিখে সে খুব ভুল করেছে। কয়েক মাস আগে তার বৌয়ের জোরাজুরিতে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে কি বেইজ্জত না হতে হয়েছিল তাকে! আজও মনে পড়ে সেই অপমানের কথা।

      বছরের শুরুতে নাড়ু তার ছেলেকে নিয়ে স্কুলে গেছে ভর্তি করবে বলে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল। কো এডুকেশন স্কুল। ছেলে মেয়ে সবাই পড়ে। স্কুল থেকে তাকে একটা কাগজ দিয়ে বলা হয়, কাগজটা ফিল আপ করে আনতে। কাগজটা উল্টে পাল্টে দেখে নাড়ু। কিছুই বুঝতে পারে না। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এক দিদিমণি নাড়ুর অবস্থা দেখে, তাকে ডেকে বলেন, "কাগজটা দাও। এটাকে ফর্ম বলে। আমি ফিল আপ করে দিচ্ছি। তোমাকে যা জিজ্ঞাসা করব ঠিকঠাক বলবে। ভুল বললে পরে সমস্যা হবে।"

      একটা টেবিলে কাগজটা রেখে দিদিমণি প্রশ্ন করেন, "নেম?"

      কিছুই বুঝতে পারে না নাড়ু। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দিদিমণি আবার জিজ্ঞাসা করেন, "তোমার বাচ্চার নাম কি?"

      নাড়ু বলে, "কাজল বারুই।" উত্তর দিয়ে নাড়ু জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

      কাজল ছেলেদের নাম হয়। আবার মেয়েদেরও নাম হয়। দিদিমণি বুঝতে পারেন না নাড়ুর বাচ্চা, ছেলে না মেয়ে। তাই ফর্ম ফিল আপ করতে করতে দিদিমণি আবার প্রশ্ন করেন, "সেক্স?"

      এই কথাটার মানে নাড়ুর ভালোভাবেই জানা আছে। সতুর দোকানে এসব নিয়ে অনেককেই সে আলোচনা করতে শুনেছে। সপ্রতিভভাবে সে উত্তর দেয়, "সপ্তাহে তিন বার। মানে একদিন ছাড়া। তবে লজ্জার কথা কি বলব দিদিমণি, আপনি একদম ঠিকঠাক বলতে বলেছেন তাই বলছি, মন মেজাজ ভালো থাকলে, হাতে টাকা পয়সা থাকলে পরপর হয়ে যায়। মানে...।"

      - "চুপ করো।" প্রচন্ড জোরে ধমকে ওঠেন দিদিমণি, "এটা চায়ের দোকান নয়। এটা স্কুল। জায়গা বুঝে কথা বলতে শেখো। আর জায়গা বুঝে কথা বলতে না পারলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। মুর্খ কোথাকার, জীবনে স্কুলের ধার মাড়াওনি। বাচ্চার জন্য স্কুলে এসেছো, স্কুলের মর্যাদা রাখতে শেখো। তোমার পার্সোনাল ব্যাপারে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।"

      ধমক খেয়ে চুপ করে যায় নাড়ু। সেই থেকে সে এক হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। মনের দুঃখ এতদিন মনের মধ্যেই চেপে রেখেছিল। আজ সতুকে বলে কিছুটা হালকা হয়।

      - "বুঝলি সতু, ভাবছি আমিও মাষ্টারের পাঠশালায় যাব। একটু লেখাপড়া জানা দরকার। না হলে মেয়েছেলে দিদিমণিরাও অপমান করার সুযোগ পেয়ে যায়।"

      - "তাই বলে এই বয়সে পিঠে ব্যাগ, হাতে জলের বোতল নিয়ে ইস্কুলে যাবি?"

      - "বই খাতা নেব কেন? মাষ্টার যেটুকু শেখাবে, সেটুকুই শিখব। ঐ কাজ চালানোর মত।"

      নাড়ুর কথা শুনে সতুর চিন্তা বাড়ে। সে ভাবে যারা মাষ্টারের পাঠশালায় গেছে, তাদের কেউ আর তার দোকানে মদ খেতে আসছে না। এভাবে চললেতো তার ব্যবসা লাটে উঠে যাবে! চিনু, মন্টু, গোকুল, ভুতো যে কটা মাষ্টারের পাল্লায় পড়েছে, সবকটা তার মদের দোকান ছেড়েছে। যত নষ্টের মুল এই মিলন মাষ্টার। মাষ্টারের পাঠশালাকে বন্ধ করতে না পারলে, তার মদের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কি করে সে বন্ধ করবে মাষ্টারের পাঠশালা? 

      পরের দিন বিকালে নাড়ু সতুর মদের দোকানে না গিয়ে পায়ে পায়ে হাজির হয় মাষ্টার মশাইয়ের শিক্ষা কেন্দ্রে। দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি দিয়ে দেখে চিনু, মন্টু, গোকুল, ভুতোরা সকলে এসে গেছে। মাষ্টার মশাই তাকে ভেতরে আসতে বলেন। নাড়ুর অভিপ্রায় জানতে পেরে খুশি হন। প্রথাগত পদ্ধতিতে না পড়িয়ে, গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দেন মাষ্টার মশাই। মাষ্টার মশাইয়ের মুখে শোনা গল্পগুলো বেশ মনে ধরে বয়স্ক মানুষগুলোর।

      ভেবে চলেছে সতু কিভাবে মাষ্টার মশাইকে টাইট দেওয়া যায়। একে ওকে জিজ্ঞাসা করছে, পরামর্শ চাইছে। কিন্তু কোনও সদুত্তর পাচ্ছে না। কি করবে বুঝতে পারছে না। তবে কি তার মদের দোকান উঠে যাবে? সেটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। কিছু না কিছু তাকে করতে হবে। কিন্তু কি করবে, কিছুই তার মাথায় আসছে না! অবশেষে ভেবেচিন্তে সে ঠিক করে যে বাইরে থেকে কিছু করা যাবে না। কিছু করতে হলে ভেতরে ঢুকতে হবে। মাষ্টারের স্কুলে ঢুকতে হবে। তারপর ফাঁক ফোকর খুঁজে নিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে। ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে।

      একদিন পরে সতুও যায় মাষ্টার মশাইয়ের বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে। ভিতরে চিনু, মন্টুদের দেখে তার মাথায় আগুন জ্বলে যায়। এরা সকলেই তার বাঁধা খদ্দের ছিল। আর একমাস হল এরা কেউ আর সতুর দোকানের ধার মাড়ায় না। কোনও রকমে নিজেকে শান্ত করে সে। হাসি মুখে বসে পড়ে মন্টুর পাশে। মাষ্টার মশাই আজ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের গল্প শোনাচ্ছেন।

      তিনি বলে চলেছেন, "কবি মধুসূদন বেহিসেবি খরচ করতেন। তিনি...।"  

      - "মাষ্টার মশাই, কবি বেহিসেবি খরচ করতেন মানে কি নেশাভান করে পয়সা ওড়াতেন? মানে চোলাই খোর ছিলেন?" প্রশ্ন করে সতু।

     - "আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা করবে না। এরকম কোনও কথা কোথাও লেখা নেই। শুধু মনে রাখবে তিনি একজন মহান কবি ছিলেন। বাংলা সাহিত্যকে অনেক উঁচুতে তুলে ধরেছিলেন। বাংলা কবিতাকে দিয়েছিলেন এক অন্য মাত্রা। মেঘনাদ বধ কাব্য তার অমর সৃষ্টি।" ঈষৎ রাগত সুরে বলেন মাষ্টার মশাই। 

      - "আমিও কাব্যি খুব ভালোবাসি। আমার মনেও কত কাব্যি আসে। আবার ভুলে যাই। লেখাপড়া জানলে মনে আসা সব কাব্যিগুলো লিখে রাখতাম।" বলে গোকুল। 

      - "কাব্যি নয়, বলো কাব্য অথবা কবিতা। সঠিক উচ্চারণ করতে শেখো।" বুঝিয়ে দেন মাষ্টার মশাই। 

      একজন কবির জীবনী নিয়ে আলোচনা করছেন মাষ্টার মশাই। সেই আলোচনা শুনতে খুবই আগ্রহী গোকুল। গোকুল ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। সেই ছন্দ মেলানো কথাগুলোকে জুড়ে কবিতা সৃষ্টি করার এক সুপ্ত বাসনা রয়েছে তার মনে। সেই জন্যই সে মাষ্টার মশাইয়ের শিক্ষা কেন্দ্রে এসেছে। সে চায় লেখা পড়া শিখে সে কবিতা লিখবে।

      কবি মধুসূদনের জীবনী শোনার আগ্রহে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছে গোকুল। তার যাওয়ার পথে পড়ে সতুর মদের দোকান। সে ভেবেছে সতুকে ডেকে নিয়ে একসঙ্গে মাষ্টার মশাইয়ের কাছে যাবে। সতুর দোকানের সামনে গিয়ে অবাক হয়ে গোকুল দেখে বিকাল গড়াতে না গড়াতেই সতু বোতল খুলে বসেছে।

      - "কিরে সতু তুই মাল খাচ্ছিস! পড়তে যাবিনি?"

      - "না আজ যাবুনি।"

      - "সে না হয় না গেলি। কিন্তু তুই যদি এখনই মাল খেয়ে আউট হয়ে যাস, তাহলে কাস্টোমার সামলাবি কি করে?"

      - "কোথায় কাস্টোমার! সবতো দিগগজ হতে মাষ্টারের দোকানে লাইন দিয়েছে। মাল নষ্ট হচ্ছে তাই নিজেই খাচ্ছি। তুই খাবি?"

      - "না খাবুনি। মাষ্টার মশাই এসব খেতে বারণ করেছে।"

      - "মাল না খেলে কোনও দিন কাব্যি লিখতে পারবি নি। সব বড় বড় কবিরা মাল টানতো। শুনলিনি মাষ্টারের মুখে। কিন্তু কাব্যির ভুত তোর মাথায় কবে থেকে চাপে?"

      - "সে অনেক দিন থেকে। মনে মনে কত কাব্যি করেছি। সব মনে নেই। একবার পেরাইজও পেয়েছি কাব্যি করে।"

      - "পেরাইজ! তুই পেরাইজ পেয়েছিস? কে তোকে পেরাইজ দিল রে?"

      - "হ্যাঁ রে, পঞ্চাশ ট্যাকা পেরাইজ পেয়েছিলুম।"

      - "কবে পেলি? কোত্থেকে পেলি?"

      - "সে এক মজার কথা। ঐ যে ঝিলের ধারে শীতকালে কলকাতা থেকে সাহেব মেম সাহেবরা ফিষ্টি করতে আসে। সেদিনও একদল এসেছিল। আমি ওদিক দিয়ে ফিরছিলুম। দেখি একটা সাহেব আর একটা মেম সাহেবের মধ্যে কেমন যেন আড়ু আড়ু ছাড়ু ছাড়ু ভাব। দেখি ওরা দুজনে পায়ে পায়ে হোগলা বনের দিকে যাচ্ছে। ব্যাপারটা সুবিধার মনে হলুনি। আমিও পিছু নিলুম। হোগলা বনের আড়ালে  এসে সেই সাহেব, ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর সাহেবটা হড়াস করে ঢুকিয়ে দিল।"

      - "কি ঢুকিয়ে দিল? কোথায় ঢুকিয়ে দিল?"

      - "ও আমি বলতে পারবুনি। আমার লজ্জা করছে।"

      - "দুর হ, মেনিমুখো ব্যাটা ছেলে। কোত্থেকে এলোরে আমার লজ্জাবতী! আমার বৌ আমাকে দেখে লজ্জা পায়নে, রাত দুপুরে দরজা বন্ধ যা তা কান্ড করে। এনার লজ্জা করছে আমাকে দেখে! বলতে হলে বল, না হলে ভাগ এখান থেকে। আমার নেশা চটকাসনি।"

      - "বলছি বলছি, রাগ করছিস কেন? দেখি সাহেবটা হড়াস করে মেম সাহেবটার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিড়ির বাসকো বের করে, একটা নিজে ধরাল। আর একটা মেম সাহেবকে দিল। কি লম্বা লম্বা বিড়ি! আমি জম্মে দেখিনি!"

      - "বিড়ি না সিগ্রেট?"

      - "নারে, সাদা সিগ্রেট নয়, বিড়ি। ওগুলো খুব লম্বা, বাস্কোতে ভরা। মনে হয় বিলিতি বিড়ি। মেম সাহেবকে বিড়ি টানতে দেখে আমার কাব্যি পেয়ে গেল। কিন্তু আমি তখন চুপ করে ওদের কাজ কারবার দেখছি। অপেক্ষা করছি কি করে, সেটা দেখব বলে। এদিকেতো আমার কাব্যি পাচ্ছে। খুব কাব্যি পাচ্ছে। একদম সামলাতে পাচ্ছিনি। পেট কটকট কত্তেছে। তারপর এক সময়ে সামলাতে না পেরে কলকল করে দিলুম কাব্যি ছেড়ে।"

      - "কি কাব্যি ছাড়লি?"

      - "এক বান্ডিল বিড়ি,
         যেন সগ্গের সিঁড়ি।
         আগে ফুঁকতো বাবা কাকা,
         এখন পিসি খুড়ি।"

      - "মেম সাহেবকে বিড়ি খেতে দেখেই তোর মাথায় কাব্যি এসে গেল! সত্যি তোর বেরেন আছে।"

      - "সেই কাব্যি শুনে সাহেবটা ইংরিজিতে ব্যা বো করে কিসব বলল। আর আমাকে পঞ্চাশ ট্যাকা পেরাইজ দিল।"

      - "তবে যাই বল, ভালো কাব্যি লিখতে হলে মাল খেতে হবে। মাষ্টারের মুখে শুনলিনি, ঐ কবি, কি যেন নাম বলল, ও বেহিসেবি খরচ করত। তার মানে কি? যদি মাল খাওয়া বাদ দিই, তাহলে কি পড়ে থাকে পাত্তি খেলা নয়ত পাড়ায় যাওয়া। পাত্তি খেললে মাল খেতে হবে। আর পাড়ায় গেলেতো মাল খেতেই হবে। দুটোতেই মাল খেতে হবে। তাহলে কি দাঁড়াল, যেভাবেই বেহিসেবী খরচ কর না কেন, তারসঙ্গে মাল খাওয়া জুড়ে থাকবে। মাল না খেলে জীবনে উন্নতি করতে পারবিনি। কথাটা মনে রাখবি।"

      - "বলছিস?"

      - "হুঁ।"

      - "ঠিক আছে আজ মাষ্টার মশাইয়ের কাছ থেকে ফেরার পথে তোর দোকানে আসব।"

      পড়ানো শেষ করে মাষ্টার মশাই বাড়ি ফিরে, রাতের খাওয়া সেরে ঘুমোতে যাবেন, হঠাৎ একটা কোলাহল কানে এল। মহিলা কন্ঠ, পুরুষ কন্ঠ একসাথে চিৎকার করছে। কি বলছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে কথাগুলো। মনে হচ্ছে এদিকেই আসছে। কান পেতে শুনতে থাকেন মাষ্টার মশাই। মনে হচ্ছে কেউ মদ্যপ অবস্থায় জড়ানো গলায় চিৎকার করে বলছে, "আজ আমি মধুসূদন বধ করব। আজ আমি মেঘনাদ বধ করব। না না, ভুল হচ্ছে, আজ আমি মেঘনাদ বধ কাব্যি লিখব। আজ আমি...।"

      চিৎকার শুনে মাষ্টার মশাই পরিস্কার বুঝতে পারছেন গোকুল আবার নেশা করে ঝামেলা পাকাচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন গোকুল মত্ত অবস্থায় টলতে টলতে চিৎকার করতে করতে চলেছে। গোকুলের বউ, গোকুলের কলার ধরে চিৎকার করতে করতে গোকুলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গোকুলের পদস্খলন দেখে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন মাষ্টার মশাই।  আরও জোরে চিৎকার করে বলেন, "তুই আগে আমাকে বধ কর হতচ্ছাড়া।"

      কিছু দুরে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে সতু। ভাবতে থাকে কিভাবে মাষ্টারের হাত থেকে বের করে আনা যায় নাড়ু, চিনু, মন্টুদের।

                          ।। সমাপ্ত ।।
          
     
    

 দেবাংশু সরকার,

      ঠিকানা - 34/10/A/M.G. ROAD,
                    BUDGE BUDGE, 

                    KOLKATA  - 700137. 


 




      
        

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন