গল্প
আশ্রয়
সায়নী সাহা
রবিবার সকালে যে একটু ছুটির মুড নিয়ে মর্নিং ওয়াক করতে যাবো তার আর উপায় নেই!বাড়ি থেকে বেরোতে না বেরোতেই মটকা টা গরম করে দিলো হতচ্ছাড়া রামু।
-- দিদিমণি আজ আর মোনিং ওয়েক করতে বের হইয়েন না। বাসায় ফিরি যান।
-- কেনো রে? এখন আমি কোথায় যাবো আর কোথায় যাবো না সেটাও তুই ঠিক করে দিবি?বাড়ির কাজকর্ম ছেড়ে এখন আমি কোথায় যাবো না যাবো সেটার তদারকি করা শুরু করলি নাকি!
-- আহা,আমার কথাখান পুরো শোনেন দিদিমণি..
-- আচ্ছা শুনি তোর বক্তব্য!
-- ওই বেণিপাড়ার মোড়ে বিশাল ঝামেলা হইচ্চে গো দিদিমণি..আমি আসার পথে খবর পেলুম।
আমি খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েই বললাম...
--তা ঝামেলা আবার কীসের জন্যে?
--খুন হইছে গো,এক বুড়া লোক খুন হইছে!
আমি আর কথা না বাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে সাত-পাঁচ না ভেবেই বেরিয়ে পড়লাম বেণিপাড়ার দিকে। গিয়ে দেখি রামুর কথা'ই ঠিক।লোকের ভিড়ে ঢুকে দম আটকে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে আমার।
সামনে এগিয়ে দেখি রাস্তার মোড়ে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে এক বয়স্ক লোকের নিথর দেহ।মুখটা দেখার উপায় নেই। ওপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেহ খানা উল্টিয়ে পড়ে রয়েছে আর তার চারপাশ ভেসে গেছে রক্তে। আশেপাশের লোকজন লাশটাকে ঘিরে তুমুল কোলাহল শুরু করেছে।পুলিশকে সবে মাত্র খবর দিয়েছে বেণিপাড়ার কাউন্সিলর রমেশ মুখার্জ্জী।
প্রায় মিনিট পনেরোর মধ্যে এসে হাজির হলো পুলিশ।পুলিশ আসা মাত্রই অর্ধেক লোক ফাঁকা হয়ে গেলো। কি না কি জেরা-টেরা করবে,এসব উটকো ঝামেলায় না থাকাই ভালো ভেবে কেটে পড়েছে অনেক লোক। তবে লাশের মুখ ভালো ভাবে না দেখা অবধি আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
পুলিশের লোক কিছুক্ষণ পর লাশটাকে সোজা করতেই আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। এ আমি কাকে দেখছি! আমার অজান্তেই আমার গলার থেকে কখন যে আতঙ্ক জড়ানো চিৎকার বেরিয়ে আসলো আমি টেরই পাইনি। আমার চিৎকার শুনে পুলিশ আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন...
--চেনন আপনি?
আমি সাত - পাঁচ না ভেবেই ঘাড় নেড়ে উত্তর দিয়ে দিলাম...
-- হ্যাঁ;
আমায় থানায় নিয়ে যাওয়া হল। বয়স্ক লোকটার ব্যাপারে যা যা জানি সব বলতে বলা হল আমায়। আমি বলতে শুরু করলাম...
রোজ মর্নিং ওয়াক করতে যাওয়ার পথে এই বয়স্ক লোক আমার হাতে পায়ে ধরে বলতো....
-- ওরা আমায় মেরে ফেলবে।আমায় একটু আশ্রয় দে না মা। আজ তোর বাবা তোকে এভাবে বললে তুই পারতি তাকে ফিরিয়ে দিতে?
পরে খবর পেয়েছিলাম ওনার ছেলে আর ছেলের বউ রোজ তাকে অমানবিক নির্যাতন করে এমনকি দুবেলা ঠিক করে খেতে অবধি দেয়না। তাই আমি মাঝেমধ্যে যা পারতাম তাই দিতাম ওনাকে। কিন্তু আপনারাই বলুন এমন ঝামেলাকে কেউ ঘাড়ে করে বাড়িতে বয়ে নিয়ে আসে? কিন্তু এমনটা হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি।
একটা দম বন্ধ করা কষ্ট আর অপরাধবোধ আমায় কুরে কুরে খাচ্ছিলো সেই মুহূর্তে।
চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল নিয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখি এতক্ষণ ঘোর দুঃস্বপ্নে ডুবে ছিলাম আমি। মনে মনে ভাবলাম,আজ মর্নিং ওয়াক করতে যাওয়ার সময় লোকটাকে আর ফেরাবো না। তার ছেলেকে লোক মারফতে খবর দিয়ে তাকে আশ্রয় দেবো বাড়িতে...
।। সমাপ্ত।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন