পিয়া বিন নাহি আবত চাইন (১৯২৫)
শিশির আজম
সুর আসলে প্রকৃতিতেই মিশে আছে। আমাদের সবার ভেতরেই সুর রয়েছে। হয় তো সব সময় টের পাইনে। তা বলে তো আমাদের এই জগৎ থেকে সুর নেই হয়ে যাবে না, যায় না। সুর না থাকলে দুনিয়া নেই, আমরা নেই। উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁর গলায় প্রতিবার যখন রাগ ঝিঁঝিটে এই 'পিয়া বিন নাহি আবত চাইন' (১৯২৫) গানটা শুনি তখন আমার প্রতিদিনকার যাপিত পরিবেশ মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আমার চারপাশ থেকে যাবতীয় কলুষতা-হিংসা-বেদনা মিলিয়ে যায়। আমি সেই নিষ্কলুষ মায়াবী জগতের বাসিন্দা হয়ে যায় যে জগৎ যুদ্ধবাজ নেতারা ছুঁতে পারে না। যেখানে মানুষের অসহায়তা নেই, লোভ-শঠতা-ঘৃণাবোধ নেই। এই গানটা আমরা রোশনারা বেগম, ভিমসেন যোশি, ফরিদা খানমসহ অনেক উস্তাদের গলায় শুনেছি। মুগ্ধ হয়েছি। বড়ে গোলাম আলি খাঁও তার নিজস্ব ভঙ্গীতে গেয়েছেন। প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ১৯৩৬ সালের 'দেবদাস' সিনেমায় গেয়েছেন কে এল সায়গল। গানটিতে লিপসিং করেছেনও উনি। তবে সত্যি কথা হলো, কখনও কখনও যেন মনে হয়েছে এরা সবাই নিজেদের সংগীত-সক্ষমতার ক্যারিশমা দেখিয়েছেন। এতে এই গানের মায়া-সরলতা-মোহনীয়তার পরশ থেকে আমরা কি কিছুটা বিচ্যূত হয়েছি? না কি এই গানটা কেবল করিমের জন্যই। হ্যা, হিন্দুস্তানি রাগ সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তী আব্দুল করিম খাঁর গলায় ঠুমরিকে আমরা নতুনভাবে পেয়েছি। তার আগে সংগীতের অভিজাত সমঝদারদের মজলিসে ঠুমরির কদর যথাযথ ছিল না। এখন ঠুমরির খ্যাতি ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে বিশ্বজোড়া। এর কৃতিত্ব অনেকটাই কিরানা ঘরানার উজ্জ্বল নক্ষত্র এই আব্দুল করিম খাঁর। উনি যখন গাইতেন অনেক সময় রাগ-রাগিণীর নিয়মকানুনের বিধিনিষেধ ভুলে যেতেন। যা প্রাণকে ছুঁয়ে দেয় তার বিচার কে করতে বসে? হয় তো মহত্মের নিজস্ব জায়গা সেটা। গানকে যিনি অন্য স্তরে নিয়ে যেতে পারেন তার জন্য এই যথেচ্ছাচার বৈধ! উল্লেখ্য, খুব অল্প বয়সেই করিম সংগীতের তালিম নেন বাবা কালে খান আর কাকা আবদুল্লা খানের কাছে। পরে উস্তাদ নান্নে খাঁর খাছেও তালিম নেন। বড় কথা হলো সুর তিনি পেয়েছিলেন প্রকৃতির কাছ থেকে। আর প্রকৃতিও তার কাছে সুর উজাড় করে দিয়েছিল। পিলু, খাম্বাজ আর দক্ষিণী রাগে যেসব গান উনি গেয়েছেন তার তুলনা হয় না। অনেক সংগীতজ্ঞের মতে মারাঠী নাট্যগীতি আর ভাবান্দোলনের প্রভাব ওর সংগীতচর্চায় পড়েছে। যে কারণে খেয়াল আর ঠুমরির গায়কীকে কেবল পরিবর্তনই না, রাগসংগীতের এই দুই ভিন্ন ধারার মেলবন্ধনও উনি ঘটাতে পেরেছেন। আব্দুল করিম খাঁর গান শুনলে যে কেউই এটা অনুভব করবেন। পাঠক, দেখুন আমার এই কবিতায়, একটু আলাদা ভঙ্গীতে...
প্রকৃতির যে স্নেহ-ভালবাসা-মায়া-সহিষ্ণুতা তা সুরে সুরে মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন শিল্পী। 'পিয়া বিন নাহি আবত চাইন' গানটা উনার গলায় প্রথম শোনা যায় ১৯২৫ সালে। উনি মারা যান ১৯৩৭ সালে। অর্থাৎ এটা ওর শেষ দিককার সৃষ্টি। এই সৃষ্টিতে উনি নিজেকে নিবেদন করেছেন। বলা যায় উজাড় করে দিয়েছেন নিজেকে। জগতের সব দুঃখ নিজের করে নিয়েছেন। ছোট ছোট রাগের এই গানগুলোকে রবিশঙ্কর পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সংগীতের অন্তর্গত বলে মনে করেছেন। যেমনটা ভৈরবী রাগে 'যমুনা কে তীর' (১৯৩৪) বা 'গোপালা মোরি করুণা'র (Raga Sarpada) ক্ষেত্রে বলা যায়। এরকম অসংখ্য গানে প্রকৃতির অফুরন্ত দান উনি নিংড়ে নিয়েছেন আর মিলিয়ে দিয়েছেন তার সুরের মালায়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন