গল্প
দুর্ভাগ্যের সম্মুখ সমরে
সমীর কুমার দত্ত
সমর গুপ্ত নামের যুবকটি সর্বদা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরতো। ওটা শিখেছে ও ওর চেয়ে বয়সে কিছু বড়ো শম্ভুনাথ সরকারের কাছ থেকে বন্ধুত্বের সুবাদে। ধুতি পরার অভ্যাস শম্ভুর গ্রাম থেকে। গ্রাম থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এসে পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা কর্পোরেশনে চাকরি পায়। নাইটে নরসিংহ দত্ত কলেজ থেকে বি.কম পাশ করে। রবিবার দিন আর অন্যান্য ছুটির দিনগুলোতে বিকেল বেলায ধুতি পাঞ্জাবি পরে সমরের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে। ঘোরা বলতে পাড়ার শাশ্বতী লেডিজ হোষ্টেলের পাশে উকিলবাবুর বাড়ির সামনের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সমরের সঙ্গে গল্প করতে।
বহুদূর থেকে হাওড়ার গার্লস্ কলেজে পড়তে আসা চামেলী ঘোষ নামের একটি মেয়ে ওই লেডিজ হোষ্টেলে বোর্ডার হিসেবে এসে ওঠে। নিত্য যাতায়াতের পথে ওই রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শম্ভুনাথ ও সমরের সঙ্গে চোখের দেখায় পরিচিত হয়ে হাসি বিনিময় করে। হাসির পরিণতিতে বাক্যালাপ, বাক্যালাপের পরিণতি প্রেমে পৌঁছায়। একদিন সমর গুপ্তের সালিশিতে শম্ভুনাথের সঙ্গে চামেলীর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ঘনিষ্ঠতা প্রেমে পরিণতি পায়। নিত্য যাতায়াতের ফলে সমর একদিন শম্ভুনাথের হয়ে চামেলীকে প্রোপোজ করে,"এই যে শুনছেন, যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা বলার ছিলো।"
—না না কিছু মনে করবো না। বলুন আপনি, নির্ভয়ে বলুন।
—আমার বন্ধুকে তো আপনি চেনেন,রোজই দেখছেন। আপনাকে ভালোবাসে এবং আপনার সঙ্গে কথা বলতে কোন নির্জন জায়গায় যেতে চায়, অবশ্য যদি আপনি রাজি থাকেন।
চামেলীও যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যায়। ও নিজেও তো ওর বন্ধুকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু নিজের থেকে প্রোপোজ ও করবে না,হার মানবার পাত্রী ও নয়। কথায় আছে না —মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। বললো,"আচ্ছা আমি ভেবে দেখে জানাবো।"
"জানালে একটু তাড়াতাড়ি জানাবেন।" সমর বললো। আপনার পরিচয় কি জানতে পারি?
—আমার আবার পরিচয়! এই অধমের নাম সমর গুপ্ত। পেশা টিউশন আর ছোট খাটো একটা অফিসে কেরানীর চাকরী। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।
শাশ্বতী লেডিজ হোষ্টেলে চামেলীর রুমমেট ছিলো ব্যঞ্জনা ব্যানার্জ্জী। দুজনের খুব ভাব। চামেলী ব্যঞ্জনাকে কথাটা জানায় এবং বলে," ব্যঞ্জনা,কী বলবো বলতো? তুই একটা যুক্তি দে না। আমার ওদের সঙ্গে যাওয়া কি ঠিক হবে?"
"তোর ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে, তুই ওদের সঙ্গে ভাব করতে মুখিয়ে আছিস। সুতরাং আমি কী বলবো বলতো। আমি বারণ করলে তুই কি শুনবি? শুনবি না। 'মেয়া বিবি রাজি তো কেয়া করেগা কাজী।' লেগে পড়, লেগে পড়। শুভস্যম্ শীঘ্রম্।" ব্যঞ্জনা বললো।
—তুই আমাকে সঙ্গ দিস্। আমার একা যাওয়াটা কি ঠিক হবে? ওদের মুখ চেনা আছে। আসল পরিচয় তো কিছুই জানি না। তুই সঙ্গে থাকলে ভরসা পাই।
—যথা আজ্ঞা। তারপর তো মজে গিয়ে আমায় ভুলে যাবি।
—কী যে বলিস্ না। তোকে ভুলে যাবো। এখানে তুই আমার একমাত্র বন্ধু। আর আশাকরি এই বন্ধুত্বের বন্ধন যেন অটুট থাকে। দুদিন পর চামেলী সমরকে ডেকে জিজ্ঞেস করে,
"আপনার বন্ধু কোথায় যাবেন জিজ্ঞেস করে আমায় জানান।
"মনের কথা বলার মতো জায়গা তো লঞ্চ পেরিয়ে ইডেন গার্ডেন্স। আপনার আপত্তি নেই তো?" সমর উৎসাহিত হয়ে বলে।
— আমি তো এখানের মেয়ে নই। ইডেন গার্ডেন্স কোথায় আমি জানি না। তবে বেশি দেরি করতে পারবো না। সঙ্গে কিন্তু আমার বন্ধু ব্যঞ্জনা থাকবে।
— কেন একা যেতে ভয় পাচ্ছেন?
—ভয় পাওয়ারই তো কথা। একটা মেয়ে একা একা শুধুমাত্র চোখের দেখায় পরিচিত একজন পুরুষের সঙ্গে অপরিচিত জায়গায় যাবে, ভয় পাবে না?
—ঠিক আছে, বান্ধবীকে সঙ্গে নেবেন।
—আপনি থাকবেন তো?
—বলতে পারছি না। ব্যাপারটা আপনাদের দুজনের। আমি থেকে কী করবো? তা ছাড়া আমার উপস্থিতিতে আপনারা দুজনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না।
—সে তো আমার বন্ধু ব্যঞ্জনাও থাকবে।
—ওই জন্যেই তো বলছিলাম, আবার বন্ধু কেন।
—আপনি নয় আমার বন্ধুর সঙ্গে গল্প করবেন।
—আমরা আর কী গল্প করবো?
—কেন আপনার কোন গল্প নেই?
—আমার আবার গল্প! আমার গল্প মানে তো দুঃখের কাহিনী। কে শুনতে চায় বলুন তো?
পরের দিন ছিলো রবিবার। শম্ভুনাথ ও সমর দুজনে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল যথাস্থানে অর্থাৎ উকিলবাবুর বাড়ির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে। চামেলী ও ব্যঞ্জনা দুজনে সেজেগুজে ওদের পাশ দিয়ে চোখের ইশারা করে এগিয়ে গেলো, যাতে পাড়ার কেউ ব্যাপারটা বুঝতে না পারে। বড়ো রাস্তায় বাস এলে চারজনে উঠে পড়লো হাওড়া স্টেশনের উদ্দ্যেশ্যে। চারটে টিকিট কাটলো শম্ভুনাথ। হাওড়ায় নেমে লঞ্চঘাটের দিকে এগিয়ে গেলো। লঞ্চ পেরিয়ে সামনেই ইডেন গার্ডেন্স। শম্ভুনাথ ও চামেলী একটা গাছের তলায় গিয়ে বসলো পাশাপাশি। আর সমর বসলো সামান্য কিছুটা দূরে একটা গাছের তলায়। ব্যঞ্জনা আরও কিছুটা দূরে একা দাঁড়িয়েছিল। সমরই ওকে ডেকে পাশে বসালো। চামেলী যেদিন ব্যঞ্জনাকে ওদের কথা বলছিলো , সেদিন কথা প্রসঙ্গে সমরের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলো, "জানিস ব্যঞ্জনা, ওই বন্ধুটা নাম সমর খুব দুখী রে। খুলে কিছু বললো না। ওকে দেখে মনে হলো , প্রেম ট্রেমের ধার ও ধারে না। ওকে খুব অসহায় লাগছিলো।"
"তা তুই কি বলতে চাস্ আমি ওর দুঃখের ভাগীদার হই ?" ব্যঞ্জনা বললো।
—না, আমি তা বলবো কেন। কারোর দুঃখের ভাগীদার হওয়া কি সোজা ব্যাপার। ইচ্ছে করলেই হওয়া যায় না।
—তুই প্রেম করছিস্ আর আমাকে ওর সঙ্গে ভিড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিস্।
—মোটেই না। তুই একা একা বসে থাকবি, তোর ভালো লাগবে না। কুশল বিনিময় করে একটু ভদ্রতা বজায় রাখবি আর সময়ও কেটে যাবে। এই আর কী। তোর ইচ্ছে না হলে শুনিস্ না। আমি তো তোকে প্রেমালাপ করতে বলছি না।
শম্ভুনাথ ও চামেলী এতক্ষণে বেশ মজে গেছে মনে হলো। শম্ভুনাথ শিক্ষিত, মার্জিত ও হ্যান্ডসাম এবং দস্তুর মতো সরকারী চাকুরে। তবে দাদা ও ভায়েরা মিলে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে। সবে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে ওরা এক এক করে। গ্রামের ছেলেরা বড়ো একটা খারাপ হয় না। সুতরাং ওর সঙ্গে জীবন জোড়া দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সমরও দেখতে মন্দ নয়। তবে টিউশনি আর ছোট খাটো একটা অফিসে কেরানীর চাকরী করে এই যা। সমর ও ব্যঞ্জনা দু জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসেছিলো। মৌনতা ভঙ্গ করে সমর বললো,"আপনার নাম তো আমার জানা হয়ে গেছে। ভারি সুন্দর নাম। নামের মধ্যেও একটা ব্যঞ্জনা আছে। একটা নতুনত্ব আছে।
—আমার নাম কী করে জানলেন?
— চামেলীদেবীর মুখে শুনেছি।
—চামেলী দে-----বী----ঈ! বুড়োটে বুড়োটে কথা। ও তো আপনার থেকে ছোটোই হবে। শুধু নাম ধরে ডাকলে পারেন। আর আমার নাম নিয়ে কী বলছিলেন যেন? হ্যাঁ 'ব্যঞ্জনা' আর 'নতুনত্ব'। নতুনত্ব কথাটা অনেকেই বলে কিন্তু 'ব্যঞ্জনা' নামের ব্যঞ্জনা আছে এই প্রথম শুনলুম। এরজন্য ধন্যবাদ। আর আপনার পরিচয়টা একটু দিন।
—এ অধমের নাম সমর গুপ্ত। পেশা টিউশন আর একটা ছেটোখাটো কোম্পানির কেরানীগিরি।
—নিজেকে অধম বলছেন কেন? আপনাকে দেখলে কেউ অধম বলবে। বেশ হাসিখুশি।
—বাব্বা! আপনি তো দেখছি আমার সম্পর্কে অনেক জেনে ফেলেছেন। আমি অধম ছাড়া আর কী? যাক্ গে, ছাড়ুন আমার কথা। আপনার কথা বলুন। কথা তো আমাদের বলতেই হবে। না হলে সময় কাটবে কীভাবে। আপনার বাড়ি কোথায়? কে কে আছেন বাড়িতে?
—আমার বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার কাছে। বাড়িতে বাবা, মা,দাদা বৌদি আর এক ভাইঝি আছে। আমাদের জলের পাম্প তৈরির কারখানা। বাবা দাদা মিলে দেখাশোনা করে।
—তা এতো দূরে কেন?
—হাওড়া গার্লস কলেজের নাম আছে। কবি জীবনানন্দ একসময় এখানে অধ্যাপনা করেছেন শুনেছি। এখানে চান্স পেয়ে গেলাম। তাই হস্টেলে থাকতে হচ্ছে।
—আপনার বন্ধু কি আপনাদের ওখানে থাকে?
— না, না। ওদের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাঁটালে। এখানেই আমাদের পরিচয়।
দুজনে এভাবে বাক্যালাপ করে একসময় দুজনেই চূপ হয়ে যায়। কথা আর খুঁজে পায় না। সমর একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ব্যঞ্জনা মাঝে মাঝে সমরকে পর্যবেক্ষণ করে চলে।একসময় ব্যঞ্জনা বলে ওঠে,
"আপনার কথা তো কিছু বললেন না।"
—আমার আবার কথা! ওসব দুঃখের কথা শুনতে কারো ভালো লাগবে না।
—দুঃখের কথা সবার জীবনেই থাকে,কম আর বেশি। দুঃখটাই তো সত্যি। সুখ তো ক্ষণস্থায়ী। '
'দুঃখে যাদের জীবন গড়া, তাদের আবার দুঃখ কিসের।'
—বাঃ, জীবন সম্বন্ধে আপনার উপলব্ধি তো খুব সুন্দর। বাইরে থেকে আপনাকে বোঝা যায় না যে ভিতরে আপনার একটা মূল্যবোধ আছে। জেনে খুব ভালো লাগলো।
—আপনার প্রসঙ্গ এলেই আপনি দেখছি এড়িয়ে যাচ্ছেন। আপনার কথা বলতে কি আপত্তি আছে? বলুন না। আমার শুনতে খুব ইচ্ছা করছে।
— একান্তই শুনবেন, তবে শুনুন। আমার বাড়ি নদীয়ার বীরপাড়া গ্রামে। আমাদের অনেক জমিজমা ছিলো। ছোটবেলায় আমি আমার মা'কে হারাই। তখন আমি পাঁচ- ছয় বছরের ছেলে। মায়ের মৃত্যু খুব মর্মান্তিক ভাবে হয়। একদিন আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামে কি একটা উৎসব উপলক্ষ্যে মেলা বসে। আমি মেলায় যাবো বলে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকি। বাবার তখন সময় ছিলো না, তাই মা আমায় মেলায় নিয়ে যায়। মেলায় নাগরদোলায় চাপবো বলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছু দূরে গ্যাস বেলুন বিক্রি হচ্ছিল। বালক মনে এক সাধের উদয় হলো —গ্যাস বেলুন নিয়ে নাগরদোলায় চাপবো। বেশ মজা লাগবে। আমি লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম পর পর উঠবো বলে। তাই মাকে বললাম একটা গ্যাস বেলুন কিনে আনতে। মা গ্যাস বেলুন কিনতে গেলো। এমন সময় হাইড্রোজেন সিলিন্ডার তীব্রভাবে বার্স্ট করলো। মা মর্মান্তিকভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। তখন বোঝার মতো বয়স হয়নি যে আমি যদি মেলায় যাবার জন্য ঘ্যান ঘ্যান না করতাম কিংবা গ্যাস বেলুন কিনতে মাকে না পাঠাতাম তাহলে মাকে পৃথিবী থেকে এইভাবে চলে যেতে হতো না, বড়ো হয়ে যেটা আমি মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। তখন থেকে আমায় একটা অপরাধ বোধ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বিরলে অশ্রু বিসর্জন করে চলেছি। মা মারা যাবার পর আমার ও বাবার জীবনে অন্ধকার নেমে এলো। ঠাকুরদা, ঠাকুমা মারা যাবার পর আমাদের সংসার ছিলো বাবা, মা, কাকা, কাকীমা, দুই খুড়তুতো ভাই বোন আর আমাকে নিয়ে মোট সাত জনের। বাড়ির সব কর্তৃত্ব ছিলো আমার মায়ের হাতে। এ দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আমার স্বর্গীয় ঠাকুরদা। মা মারা যাবার পর সব কর্তৃত্ব চলে গেলো আমার কাকীমার হাতে। সেই থেকে আমার এবং বাবার জীবনে নেমে এলো অমাবস্যার অন্ধকার। আমার বাবা ছিলেন গোবেচারা। কাকা যা করতেন সেটাই বাবা মেনে নিতে বাধ্য হতেন। আমার মা ছিলেন খুব শক্ত। তখন কেউ ট্যাঁ পোঁ টি করতে পারতেন না। মায়ের অনুপস্থিতির সুযোগে কাকা কাকীমা চাইছিলেন সবকিছু আত্মসাৎ করতে। জমি থেকে কী আয় হতো না হতো তার কোন হিসেবই দিতেন না বাবাকে। ওরা অন্যায় করলেও ফ্যাল ফ্যাল করে দেখা ছাড়া বাবা আর কিছুই করতে পারতেন না। আমি এবং বাবা প্রায় সবকিছুতেই বঞ্চিত হচ্ছিলাম। এমনকি খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও। কাকীমা তাঁর ছেলে মেয়ের জন্য ভালো ভালো খাবার সরিয়ে রেখে দিতেন। আমার আর বাবার জন্য যতোটুকু না দিলে নয় ততোটুকুই বরাদ্দ ছিলো। আমাকে এবং বাবাকে একসঙ্গে খেতে দেওয়া হতো না। পাছে বাবা দেখে ফেলেন আমাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে । একদিন কি কারণে বাবা মাঠ থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসেন কাকীমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে রান্না ঘরে যান।দেখেন মাছ ভাজা হচ্ছে। বাবাকে দেখে কাকীমা সঙ্গে সঙ্গে মাছের ওপর বাটি চাপা দিয়ে দেন। উদ্দেশ্য আমাদের মাছ খেতে না দেওয়া। বাবার তা নজর এড়ায় নি। খেতে দেবার সময় বাবা দেখেন তাঁর পাতে মাছ নেই। বাবা মুখে কিছু বলেন না। যা পান তাই খেয়ে উঠে যান। আমিও স্কুলে চলে যেতাম কিছুই জানতাম না। স্কুলে যাবার তাড়ায় যা দিতো নাকে মুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়তাম। বাবা রাত্রে আমায় জিজ্ঞেস করতেন, " সমু, আজ কি দিয়ে ভাত খেলি?" আমি হয়তো বলতাম,"আলু,পটল ভাজা,ডাল, আর তরকারি।" শুনে বাবা চুপ হয়ে যেতেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাপড় দিয়ে চোখ মুছতেন। বাপ বেটার শোয়ার ঘরের আবহাওয়াটা তখন শোকাবহ হত। মায়ের কথা মনে পড়ে যেতো বাবার। বাবা বুক চাপড়াতেন। তখন আমার বোঝার মতো বয়েস হয়েছে। তাই কষ্ট পেতাম। বাবা প্রতিবাদ করতেন না শুধু যে মুখচোরা বলে তা নয়। তিনি শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। পাছে সংসারে অশান্তি হয় সেই ভয়ে মুখ খুলতেন না।
শুনেছি আমার দাদু ঠাকুমা আমার মা বাবাকে খুব ভালো বাসতেন। কাকা কাকীমাকে একদম দেখতে পারতেন না ওদের ব্যবহারের জন্য। তাঁরা যখন বেঁচে ছিলেন প্রায়ই ঝগড়া হতো। ওরা দাদু ঠাকুমাকে অপমান করতো। আমার মায়ের কাছে জব্দ ছিলো। তাই তো মা মারা যেতে কাকীমা বলেছিলো, "ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন।" গ্রামের কেউ ওদের দেখতে পারে না। মা মরে যেতে ওরা আরও জো পেয়ে গেলো। আমাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে এলো। রাতে বাবার সঙ্গে কথা হতো। বাবা বলতেন," আমি যদি না থাকি, লেখাপড়া শিখে এখান থেকে শহরে চলে যাস্। চাকরি করে ওখানে থাকবি। আর এখানে আসিস না। এখানে থাকলে মরে যাবি। জায়গা জমির লোভে ওরা তোকে মেরে ফেলবে। একদিন তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে বাবা জমিতে বাবা কাজ করছিলো। কাকা রোদে জলে কাজ করতে বের হয় না, বাবাকে দিয়ে বাইরের সব কাজ করায়। কাজ করবেন বাবা কর্তৃত্ব করবেন উনি। রাতে বাবার ধূম জ্বর। দুদিন হয়ে গেলো ডাক্তার ডাকার নামই নেই। খালি বলে, "ও ঠিক হয়ে যাবে।" টাকা খরচের ভয়ে ডাক্তার ডাকে না। রোগী কি বলবে ডাক্তার ডাকতে? আমিও বলতে সাহস পাইনা। বাবাকে মেরে ফেলতেই চেয়েছিলো। তাই হলো। দুদিনের মাথায় বাবা মারা গেলেন বেঘোরে মাথায় রক্ত উঠে। ভালো করে শ্রাদ্ধও করলো না। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবো, আমাকে পড়তে দিতো না। ফাই ফরমাশ খাটাতো । নিজের ছেলেমেয়েকে কিছু করতে দিতো না। আমি রাত জেগে পড়তাম। তাতেও জ্বালা। হারিকেনের তেল পুড়বে তাই। মাঝরাতে বাথরুম করতে উঠে যদি দেখে আমি পড়ছি, বলবে,
" এবার শুয়ে পড়। অতো রাত জেগে পড়তে হবে না। সকালে উঠে অনেক কাজ আছে।"
মাধ্যমিকটা পাশ করার পর, ইতস্ততঃ করছি কাকাকে বলবো উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার জন্য। কিছু বলার আগেই কাকা বললেন," আর পড়ে কী হবে। একটা পাশ তো দিয়েছিস্। এখন থেকে চাকরির দরখাস্ত কর। এখানে পড়ে থেকে মার খাবি। তারচেয়ে বাইরে চলে যা। একটা থাকার জায়গা জুটিয়ে নে। ওখান থেকে চাকরির চেষ্টা করবি। যতদিন না কিছু জোটাতে পারছিস্, আমি না হয় মাসে মাসে কিছু করে টাকা পাঠাবো। ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিস্।" আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো। আশা ত্যাগ করে মনস্থির করলাম চলেই যাবো। প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি আমার হলো না। কারণ যার আসল প্রাপ্য সেই বাবাই যখন মুখ খুলতে পারলো না। আমি একা দাবি করি কি ভাবে। কিন্তু কোথায় যাবো? কিছুই তো চিনি না। ভাবলাম পথ চলতে চলতেই পথ খুঁজে পাবো। সেই পথকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হবে। কাকা আসার সময় হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বিদায় করে দিলো। কাকা নয় লোভের বশবর্তী হয়ে এরকম গর্হিত কাজ করতে পারে। কিন্তু কাকীমা তো মায়ের জাত। তাঁর একটু মন কাঁদলো না একজন বাপ - মা মরা কিশোরকে বাড়ি থেকে বিদায় করে দিতে। বিবেকের দরজা কি বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে। মনকে সান্ত্বনা দিলাম বাবা- মা ছাড়া কেউ কারোর নয় এ দুনিয়ায়। তাই নিজের আইনতঃ প্রাপ্য সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে ভাগ্য দেবতাকে সম্বল করে বেরিয়ে পড়লাম অনির্দিষ্ট পথে।"
"শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ক্ষুধা ডাক দিয়ে যায়। কাকার দেওয়া টাকাটা পকেট থেকে বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। ইচ্ছে হলো না টাকাটা খরচ করার, কারণ এটাই তো সম্বল। কলসীর জল গড়াতে গড়াতে কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর? পাশে রাস্তায় কল দিয়ে জল পড়ে যাচ্ছিল। কেউ কলটা খুলে রেখে চলে গেছে হবে। এভাবে জল অপচয় করলে, একদিন তৃষ্ণার জলও পাওয়া যাবে না। তাই খোলা কালের জল পেট ভরে খেয়ে নিলাম যাতে অনেকক্ষণ খিদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। জন খেয়ে পাশে উদ্দেশ্যহীন ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নিজের ওপর খুব ঘৃণা হচ্ছিলো। আমিই তো এই সকল সর্বনাশের আসল স্থপতি। আমার অন্যায় আবদার সেদিন যদি না করতাম, মাকে অকালে মর্মান্তিকভাবে চলে যেতে হতো না আর বাবার আমার এই দুর্গতি হতো না। কেন আমি মা বাবার মতো চলে গেলাম না। সেদিন যদি মায়ের পাশে আমি থাকতাম তাহলে আপদ চুকে যেতো। এখন তো বালাই ছাড়া কিছু না। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো এভাবে। তারপর কোথায় যাবো। হে ঈশ্বর,আমায় পথ দেখাও।
আমার এই স্টেশনের বাইরে আসা থেকে আমার অবস্থাটা কেউ একজন বয়স্ক ভদ্রলোক পাশে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলেন। তাঁর কি মনে হলো আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, "বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছো তো। কোথায় যাবে ঠিক করতে পারছো না । দেখে তো মনে হচ্ছে খিদেও পেয়েছে। অথচ পকেটে তেমন পয়সা নেই। কি তাইতো? এসো আমার সঙ্গে। ভয় নেই। আমি কোন ছেলেধরা নই। আমার নাম নীলকান্ত রায়। সবাই নীলুবাবু বলে ডাকে।"
আমাকে নিয়ে নীলুবাবু একটা মিষ্টির দোকানে গিয়ে ঢুকলেন। আমি আপত্তি করলে তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন," প্রয়োজনে যেখানে যা জুটবে খেয়ে নিতে হয়। না হলে পেট কাঁদবে। পেটের জ্বালা বড়ো জ্বাল। অবশ্য কোন বাজে লোকের পাল্লায় পড়ে খাওয়া উচিত নয়। এসো তোমার কোন ভয় নেই। আগে তো পেটের চাহিদা মেটাও,তারপর অন্যকিছুর চাহিদা মেটানো যাবে। "
তিনি কয়েকটা কচুরি আর মিষ্টির অর্ডার দিলেন। ইতস্ততঃ করে খাবারের দিকে হাত বাড়ালাম বললাম," আপনি খাবেন না?"
—না , আমার তো খিদে পায়নি। তুমি নির্দ্বিধায় খাও।"
মনে মনে ভাবলাম —জীব দিয়েছেন যিনি,আহার দেবেন তিনি। কেউ যার নেই, ঈশ্বর আছেন তার। খাওয়ার পর মনে হলো ধড়ে প্রাণ এলো। ভদ্রলোক বললেন, " তোমার নাম যেন কী?
—সমর গুপ্ত। থাকি নদীয়ার বীরনগরে।
—কোথায় যাবে কিছু ঠিক করলে? যাবার যে কোথাও জায়গা নেই, সে তোমাকে আর তোমার হাবভাব দেখে বুঝতে পেরেছি। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম বাড়ি ফিরবো বলে। তোমায় দেখে বাসের কথা বেমালুম ভুলে গেলুম। এখন বলোতো তোমার কী হয়েছে?
আমি ওনাকে বিশ্বাস করে সব কথা বললাম। ভদ্রলোক বললেন," এ পৃথিবীতে কতো রকমের লোক আছে। কী করে অপরকে মেরে বড়োলোক হওয়া যায়,সেই ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়। আবার কতো লোক আছে ধন দৌলতে অন্ধ না হয়ে অপরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তবে তাদের সংখ্যা অনেক কম।"
আমি মাঝখানে মুখ ফসকে বলে ফেললাম," যেমন আপনি।"
ভদ্রলোক হেসে বললেন," আমি আর কী করতে পারি। কিছুই পারি না। করতে পারলে তো পরকালের রাস্তাটা তৈরি করতে পারতাম। আর তাছাড়া উপকার করবো বললেই তো করা যায় না। ভগবান যদি তার সেই মন দেন তবেই সে পারে। রাখে হরি তো মারে কে? তোমাকে দেখে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম কেন জানো? তোমার মতো আমার একটা ছেলে ছিলো। অনেক দিন আগে সে কোথায় হারিয়েগেছে। আর ফেরেনি। আমার স্ত্রী তার কথা ভেবে ভেবে শেষ হয়ে গেছে। তোমাকে দেখে আমার ছেলের কথা মনে হলো। তোমার মুখটার সঙ্গে তার মুখের অবিশ্বাস্যভাবে মিল রয়েছে। তাই দেখেই তো দাঁড়িয়ে পড়লাম। জানি না তোমার মতোই হয়তো এইভাবে খিদের জ্বালায় কলের জল খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। কোন বদ্ লোকের কাছে মানুষ হচ্ছে হবে। আমি তো আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমার স্ত্রী আজও তার আশায় আশায় দিন গুনে চলেছে। আমার কথা ছাড়ো। তুমি চলো আমার বাড়ি। আমার স্ত্রী হয়তো কিছু সান্ত্বনা পেলেও পেতে পারে।"
কথা গুলো বলতে বলতে ভদ্রলোকের গলা ভারি হয়ে এল। চোখের কোণায় জল চিকচিক করছিলো। তাঁর দুঃখের কথা শুনে আমি আমার দুঃখের কথা ভুলে গেলাম। পৃথিবীতে কতো দুঃখ আছে আমরা তার কতটুকু জানি। ভদ্রলোক আজ অযাচিত ভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।আমারও ওনাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। না হলে আমিও তো মনুষ্যত্বহীন হয়ে পড়বো। আর তা ছাড়া আমারও তো থাকা-খাওয়ার জায়গা দরকার। ভগবানকে দেখা যায় না। তিনি মানুষের মধ্যে থেকে মানুষকে সাহায্য করেন। এখানে আমার কর্তব্য ও প্রয়োজন দুটোই আছে। আমি সাগ্রহে বললুম,
" চলুন, আমি আপনার সঙ্গে যাবো।"
—তুমি যাবে? আমি জানতাম। তুমি যে সৎ বাবা -মা'র সন্তান এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। চলো আমরা বাসে উঠি হাওড়া যাবো। আমার বাড়ি হাওড়ার কালিবাবুর বাজারের কাছে চৌধুরীবাগানে। তোমাকে দেখলে আমার স্ত্রী খুব খুশী হবে। তবে হ্যাঁ, একটা কথা—তুমি ওনাকে 'মা' বলে সম্বোধন করবে। আর আমাকে বাবা। তাহলে আরও খুশি হবে। তোমায় আমি সব বলে দেবো কখন কী করতে হবে কী বলতে হবে।
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললুম," আপনি আজ আমার জন্যে যা করলেন, নিজের লোকও তা করে না। আর আমি আপনাদের জন্যে কিছু করবো না তাই হয়? তাহলে তো আমি আমার কাকা-কাকীমার মতোই হয়ে যাবো।
"আমাকে নিয়ে নীলুবাবু তাঁর হাওড়ার বাড়িতে এসে পৌঁছলেন। আমাকে দেখে ওনার স্ত্রী আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, "কে এ? "
ভদ্র মহিলাকে দেখে মনে হলো একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে জীবনের সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছেন। নীলুবাবু বললেন,"কি চিনতে পারছো?"
—ও কে---------এ?
—কি চেনা চেনা লাগছে তো? ও আমাদের 'সমু' গো।
—'সমু' ? ওকে তুমি কোথায় পেলে?
—ওকে দেখতে পেয়েই তো ধরে আনলুম। ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। একজন মায়ের দুঃখ তিনি বুঝেছেন, তাই ঠিক আমার নজরের সামনে এনে হাজির করে দিয়েছেন।
বলেই উনি আমায় চোখের ইশারা করলেন বুঝতে পারলাম ওনাকে ভোলানোর জন্যই এই অভিনয় করছেন। ঘটনাচক্রে আমার নামের সঙ্গে এবং মুখের মিল কাকতালীয় ভাবে মিলে গিয়েছিলো। মুখের মিল থাকার জন্যই নীলুবাবু থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। অনেকক্ষণ দেখার পর কাছে এসে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার নাম। আমি বলেছিলাম— সমর গুপ্ত। উনি স্বগতোক্তি করে বলেছিলেন,
"ওতেই হবে।" আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম," কী হবে?"
—কিছু না।
দেখলাম রমলা দেবী মানে নীলুবাবুর স্ত্রী আমায় পেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছেন। মানসিক ভাবে প্রস্তুত হলাম ওনাকে মায়ের আসনে বসাবার। ওনার মনের আনন্দ ফিরিয়ে আনার জন্য আমিও 'মা' 'মা' বলে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। তাঁর মনে কোন সংশয় থাকলেও থাকতে পারে। কারণ গর্ভধারিণী মা নিজের সন্তানের গায়ের গন্ধ চেনেন। কিন্তু আমায় হাল ছাড়লে তো চলবে না। আমি ওনাকে ঠকাতে আসিনি। আমি ওনাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করছি ওনার সবচেয়ে কাছের জনের অনুরোধে। তাছাড়া নিজের সার্থ জড়িয়ে আছে ঠিকই। ওনার ছেলে সত্যি সত্যিই যদি ফিরে আসে, তখন না হয় আশ্রয় ভিক্ষা করে নেবো। বলবো —নিজের মাকে হারিয়ে একজন মা খুঁজতে চেয়ে ছিলাম। আমি তো নিজে মুখে বলিনি ওনার ছেলে। ওনাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে দেখে আমি সেই থেকে ওনাদের ছেলে হয়ে ওনাদের কাছে রয়ে গেছি। নীলুবাবুকে বাবা বলতেই হলো। সেটাও সম্পূর্ণ ওনার ইচ্ছায়। আর তাছাড়া উনি তো আমার সঙ্গে বাবার মতোই আচরণ করেছেন। আমাকে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি করিয়েছেন সমর গুপ্ত নামেই। রমলা দেবী যখন জিজ্ঞেস করেছেন," সমর গুপ্ত কেন? ওর নাম তো সমরেন্দ্র রায়। নীলবাবু বুঝিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে ওই নামেই তো মাধ্যমিক পাশ করেছে। তাই ওই নামেই উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে হবে। নাম পাল্টানো অসুবিধে। আর নামে কী যায় আসে। সরলমনের রমলা দেবী তাই বিশ্বাস করে নিয়েছেন। এর কিছুদিন পর রমলা দেবী লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মারা যাবার পূর্ব পর্যন্ত তিনি আমাকে নিজের হারানো ছেলে বলেই জানতেন।"
ব্যঞ্জনা কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো আর ভাবছিলো —সত্যিই ছেলেটা খুব দুখী বটে !
জিজ্ঞেস করলো, " তারপর কাকা -কাকীমার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ রাখেন নি?"
—না, কারণ তিনি আমায় মাসোহারা তো দেবেন না, উল্টে আমি ভালো আছি জানলে, আমার কাছে এসে কাঁদুনি গেয়ে টাকা পয়সা আদায় করার চেষ্টা করবে। ওনাদের ছেলেকে এখানে নিয়ে এসে তুলবে। এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে যদি ঠিকানা দিতাম, উনি এসে সত্যি কথা বলে দিয়ে রমলা দেবীর মন ভেঙে দিতেনই। আমার আশ্রয়টুকূও নষ্ট করে দিতেন। কারণ ওরা তো আমাদের সর্বনাশই চেয়েছিলো। বদলোক সব পারে। শম্ভুদারা আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকে। সেই থেকে শম্ভুদার সঙ্গে আমার পরিচয়। ওই একটা ভালো মানুষকে আমি পাশে পেয়েছি। আমাকে উচ্চমাধ্যমিক ও বি.এ পাশ করতে সাহায্য করেছে।
কথাগূলো শুনতে শুনতে ব্যঞ্জনা আস্তে আস্তে সমরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে। তারপর থেকে সর্বদাই সমরের কথা ভাবে। ছুটির দিন শম্ভুনাথকে উকিলবাবুর বাড়ির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে আর দেখা যায় না। চামেলীর সঙ্গে ডেটিং থাকে। বেরিয়ে পড়ে তিনজনে। সমর ওদের আর সঙ্গ দেয় না। ভাবে ওদের মধ্যে উপস্থিত থাকা মানে ওদের এবং ওর নিজের অস্বস্তি বাড়ানো। যদিও ওদের মধ্যে ব্যঞ্জনা উপস্থিত থাকে,সে তো চামেলীকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। আসলে সমর একটু ইনফিরিয়োরিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। ও ভাবে ওর মতো 'হারালে খুঁজতে নেই, মরলে কাঁদতে নেই ' এমন মানুষের সঙ্গে কে প্রেম করবে। সেহেতু ও ওদের এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। এদিকে ব্যঞ্জনা ছুটির দিনগুলোতে সমরকে দেখতে না পেলে নিজে থেকেই শম্ভুনাথকে জিজ্ঞাসা করে,
"আপনার বন্ধুকে তো দেখছি না, ওনার কি কিছু হয়েছে?" শম্ভু ও চামেলী পরস্পরে দৃষ্টি বিনিময় করে মুচকি হাসে। ভাবে ব্যঞ্জনার মনে প্রেমের রঙ ধরেছে। ওর মনের কৃষ্ণচূড়া আবির খেলে চলেছে। এবার সমর ছাড়া ও আর আসবে না। আর প্রেমের আমন্ত্রণ ছাড়া সমরও আসবে না। সমরের সঙ্গে ব্যঞ্জনাকে ভিড়িয়ে দিতে পারলে ভালোই হয়। শম্ভু আর চামেলী দুজনেরই সুবিধে হবে।না হলে ওদের সঙ্গে বন্ধুত্বের দূরত্ব বেড়ে যাবে। সেটা মোটেই ভালো দেখায় না। ব্যঞ্জনা কোন্ ইন্টারেস্টে চামলীকে সঙ্গ দেবে। আবার ব্যঞ্জনাকে সঙ্গে না নিলে ব্যঞ্জনা ভাববে —প্রেমের পূর্বে তাকে খুব দরকার ছিলো। এখন মনের মানুষ পেয়ে গিয়ে ও পর হয়ে গেছে। একদিন চামেলী ব্যঞ্জনাকে জিজ্ঞাসা করে, "ব্যঞ্জনা, একটা প্রশ্ন করবো সত্যি সত্যি উত্তর দিবি ?
—উত্তর দেবার মতো হলে দেবো।
—সমরকে তোর কেমন লাগে?"
—ভালোই।
—আমি ভালো না মন্দ এটা জানতে চাই না। তোর কি ওকে মনে ধরেছে? যদি ধরে তাহলে একটা যুক্তি দিতে পারি।
— কি যুক্তি?
—একটা কাজ কর। তোর সঙ্গে তো ওর অনেক কথা হয়েছে। তুই একটা প্রেমপত্র লিখে শম্ভু মারফৎ পাঠিয়ে দে। দ্যাখ না কী উত্তর দেয়। না হলে ও আর আসবে না। চামেলীর কথামতো ব্যঞ্জনা সমরকে প্রেমপত্র লেখে। প্রেমপত্র পেয়ে সমরের যে খারাপ লেগেছে তা নয়। বরং তার ভালো লেগেছে এই ভেবে যে তাকে শম্ভুর মতো প্রেম নিবেদন করতে হয় নি। উপরন্তু পত্রের প্রত্যুত্তরে সে তুলে ধরেছে তার সমস্যার কথা। যার অর্থ ভালো মন্দ ফলাফল যাই হোক না কেন তার জন্য সমর কোন ভাবেই দায়ী থাকবে না। ব্যঞ্জনা সবকিছু মেনে নিয়ে সমরের হাত ধরতে রাজি হয়েছে।
চামেলী ও ব্যঞ্জনার লেডিজ হোষ্টেলের থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিলো ,কারণ তাদের এবার তৃতীয় বর্ষ। পার্ট ওয়ান পাশ করেছে। থার্ড ইয়ারের পরীক্ষার একমাস আগে থেকে ওরা ঘোরাঘুরি না করে পড়ায় মনোনিবেশ করেছে। কারণ অনেক পয়সা খরচ করে তারা এতো দূরে হোষ্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। রেজাল্ট খারাপ হলে বাড়িতে জবাবদিহি করতে হবে। শম্ভুনাথও বলে দিয়েছে এ সময় দেখা আর না করতে। শুধু ফেরার সময় পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানিয়ে গেলেই হবে। পার্ট ওয়ানের ফল তাদের ভালোই হয়েছে। পার্ট টু ভালো দিতে পারলেই হলো। কিন্তু পার্ট টু দেওয়ার পর কী হবে? তখন তো তাদের বাড়ি ফিরে যেতে হবে। ওদের সঙ্গে দেখা করবে কী ভাবে? অতদূর থেকে তো আসা সম্ভব নয়। বাড়িতে কী বলবে? শম্ভুনাথ এ কথাগুলো ভেবে রেখেছে। সে মনে মনে ঠিক করেই রেখেছে ওরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাবে। শম্ভুনাথের বাড়ির দিক থেকে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু ব্যঞ্জনা কী করবে? সমরের মতামত তো জানাই হয়নি। শম্ভু সমরকে বলে,"সমর, দেখ ওদের পরীক্ষা তো শেষ হয়ে যাবে। আমি তো বিয়ে করে নেবো। তুই কি করবি ঠিক কর। আমার মনে হয় ওর সঙ্গে তোর কথা বলা উচিত। তোর বাড়িতে মেসোমশাইকে বললে উনি হাসিমুখে রাজি হয়ে যাবেন।
সমর শম্ভুর কথা ফেলে দিতে পারে না। তাই বলে,"আমার তো এই আয়, ওর বাড়ির লোক কি রাজি হবে? ব্যঞ্জনা মেয়েটা ভালো। খুবই বুদ্ধিমতী ও চটপটে। দেখছি কী করা যায়।
—হ্যাঁ, ও যদি তোকেই বিয়ে করতে চায় তাহলে বাড়ি গিয়ে বাবা-মা'র সঙ্গে কথা বলুক। আর তাছাড়া ও বিয়ে পাশ করে যাবে,তারপর একটা চাকরির চেষ্টা করলেই হলো। চাকরি করতে না চাইলে টিউশন করতে পারে। মেসোমশাই তো পেনশন পান। তোদের ভালো ভাবেই চলে যাবে।
—সে মেসোমশাই যতোদিন বেঁচে আছেন ততোদিন পেনশন পাবেন। তারপর?
—আরে, তোদের তো বাড়ি ভাড়া লাগবে না। আমার তো বাড়ি ভাড়া দিতে হয়। ও ঠিক চলে যাবে। ব্যঞ্জনা নিশ্চয়ই বাড়িতে জানিয়ে দেবে। কিন্তু তুই মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাক।
সমরের নিজের বলতে কেউ নেই। তাই সে ব্যঞ্জনাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। মেয়েরা যখন নিজ নিজ পাত্র পছন্দ করেছে পাত্রী পক্ষের পছন্দ না হলেও আপত্তি ওঠে নি। দু বন্ধুর হবু শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে দেখাশোনা পর্ব চুকে গিয়ে বিবাহ পর্ব মিটে গেলো।
ছেলেবন্ধু যুগল ও মেয়েবন্ধু যুগল অর্থাৎ শম্ভু -চামেলী আর সমর-ব্যঞ্জনা বেশ ঘরকন্না করে চলেছে। শম্ভু তার অফিসের লোক ধরে হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটিতে চামেলীর চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সময়মতো দু জনকেই বের হতে হয়। ফলতঃ চামেলী সংসারের তেমন কোন কাজে আসতে পারে না। শম্ভুনাথেরা সাত ভাই। ছোট আর সেজ ভাই দেশে থেকে জমিজমা দেখাশোনা করে। সেজ ভাইকে ছোট ভায়েরা নদা বলে ডাকে,এই কারণে যে ওদের জেঠার ছেলে বংশের সবচেয়ে বড় বলে সবাই তাকে বড়দা বলে আর এদের ভায়েরা মেজ দিয়ে শুরু। অর্থাৎ এদের বড়দা মানে বংশের মেজদা গৌরমোহন রেলওয়েতে ভালো চাকরি করে। কাছাকাছি বিয়ে করেছে এক মস্তিষ্ক বিকৃত মহিলাকে। মস্তিষ্ক বিকৃতি অনেক পরে ধরা পড়ে। যাইহোক সেই সূত্রে শ্বশুরবাড়িটা পেয়ে যায এবং সেখানেই বসবাস করে। বংশের সেজোভাই অর্থাৎ শম্ভুনাথের মেজদা গোপীনাথ রাজ্য সরকারের হেল্থ ডিপার্টমেন্টে অল্প বেতনে চাকরি করে ছোট ভায়েদের নিয়ে ভাড়াবাড়িতে বাস করে। গোপীনাথের স্ত্রী হাসিদেবী ভীষণ ভালো মহিলা। দেবরদের নিয়ে একা পরিশ্রম করে সংসার চালাতো। সংসারের অভাব পূরণ করার জন্য গোপীনাথকে চাকরির পরে টিউশন করতে হতো। এখানে দু ভাই বিশ্বনাথ ও কাশীনাথের দায়িত্ব। যদিও তারা সেজদা অর্থাৎ ওদের মেজদাকে কিছুটা রেহাই দিতো হাতে টিউশনের কিছু টাকা তুলে দিয়ে। দেশে বাবা-মা ও আরও দুইভায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে হতো গোপীনাথকে। সব মিলিয়ে গোপীনাথ জেরবার হয়ে যেতো। তবু গৌরমোহন বড়ো ভায়ের দায়িত্ব পালন করতো না। সম্পুর্ন স্বার্থপরের মতো জীবন যাপন করতো। পরবর্তী কালে বিশ্বনাথ পাশ টাশ করে স্কুলে চাকরি পেয়ে যায়। শম্ভুনাথের কথায় ফিরে আসি। শম্ভুনাথ ও স্ত্রী চামেলী চাকরি করেও নিজেদের টুকু ছাড়া গোপীনাথকে ও বৌদি হাসিদেবীকে এতোটুকু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি কি অর্থ কি গতর দিয়ে। ফলতঃ একা হাসিদেবীকে সব কাজ করতে হতো । এ অবিচার তো মেনে নেওয়া যায় না। তাই বিয়ের পর লাগলো সংঘাত। শম্ভুনাথ চামেলীর হাত ধরে বেরিয়ে গেলো সংসার থেকে জায়গা কিনে বাড়ি করে। বিশ্বনাথ কয়লার ব্যবসা শুরু করে দুহাতে আয় করে জায়গা জমি কিনে বাড়ি করে, বিয়ে করে ভেগে গেলো। সবাই যে যার গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। পড়ে রইলো গোপীনাথ।এরমধ্যে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে ওরা গৌরমোহনের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে ওঠে। তার কিছু দিন পর গৌর মোহনের ছেলে 'পল' তার বাবা মারা যাবার পর সকলকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সবার জন্য করতে গিয়ে গোপীনাথ নিজের একমাত্র ছেলে বাপিকে মানুষ করতে পারলো না। ছেলেটা বদ্সঙ্গে পড়ে মারা গেলো। একমাত্র মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। গোপীনাথ মারা যাবার পর হাসিদেবী মেয়ের কাছে গিয়ে ওঠে। এই হলো শম্ভুনাথের পারিবারিক উপাখ্যান। আমার গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো সমরকে নিয়ে। সমর শম্ভুর সঙ্গে চামেলীর প্রেমে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে ব্যঞ্জনাকে বিয়ে করে নিজের বিপদ আরও বাড়িয়ে তুললো যার পরিণতি তাকে কোথায় টেনে নিয়ে গেলো।
ব্যঞ্জনাকে বিয়ে করে আর নীলকান্ত মেসোমশাইকে নিয়ে বেশ সংসার যাত্রা নির্বাহ করে যাচ্ছিল সমর। বিপদ ঘনিয়ে এলো নীলুবাবুর প্রকৃত সন্তান সমরেন্দ্র ওরফে সমু ফিরে এলে। হারিয়ে যাওয়া সন্তান ফিরে এলে নীলুবাবু যার পর নাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। সমরেন্দ্র উড়ে এসে জুড়ে বসা সমর ও তার স্ত্রী ব্যঞ্জনাকে সহ্য করতে পারলো না। ঘর থেকে বের করে দিলো। নীলুবাবু অনেক চেষ্টা করলেন ওদের আটকাবার। ছেলেকে বললেন,"তোর অবর্তমানে তোর মা ভেঙে পড়েছিলো। তোর মাকে বাঁচানোর জন্য ওকে আমি রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম। শেষ জীবনটা অনেক শান্তি পেয়েছিলো। কিন্তু তোর শোকে না খেয়ে খেয়ে লিভারের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছিলো। তারপর যা হবার তাই হলো। তোর মাকে বাঁচাতে পারিনি। আমি ওর মুখ চেয়ে এতোদিন বেঁচে আছি। আজ ওকে তাড়িয়ে দিলে অন্যায় হবে। আজ তুই ফিরে এসেছিস্ বলে ওকে তাড়িয়ে দেবো? ওকে তাড়িয়ে দিলে আমি মরেও শান্তি পাবো না। সমরেন্দ্র বাবার কথা শুনলো না। সমর ও ব্যঞ্জনাকে বললো," তোমাদের লজ্জা করে না,থাকার জায়গা নেই আবার বিয়ে করছো?" নীলুবাবু অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে দেখতে দেখতে চোখের জলে ওদের বিদায় নিতে দেখলেন। দুচোখ দিয়ে গাল বেয়ে বেদনাশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলতে লাগলেন,"যে দিন তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হলো আমি তোমায় বলেছিলাম — রাখে হরি তো মারে কে? আর আজ বলছি — মারে হরি তো রাখে কে? তোমায় অনেক বড়ো মুখ করে ঘরে এনেছিলুম কিন্তু কোন নিরাপত্তা দিতে পারলুম না। তোমরা আমায় ক্ষমা করে দিও। এ পৃথিবীতে তোমার কাকা-কাকীমাদের মতো লোক অনেক আছে। তাদের হাত থেকে বাঁচা খুব মুশকিল। আমি এমন সন্তান ফিরে পেতে চাই নি।" কথাগুলো বলে নীলু বাবু মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লেন। মৃত নীলু বাবুর চরণস্পর্শ করে মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে সমর আর ব্যঞ্জনা দুজনে বিনা বাক্য ব্যয়ে মাথা নিচু করে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলো।
ওদের সঙ্গে কিছু নেওয়ার ছিলো না। কারণ সমর এসেছিলো নীলু বাবুর সাজানো সংসারে। এখন তাদের নতুন করে সবকিছু কিনতে হবে। সর্বপ্রথম যে কাজটা তাদের করতে হবে তা হলো একখানা ঘর ভাড়া করা। তারা পেয়েও গেলো অল্প ভাড়ায়। এখন তাদের আর পাঁচ জন ভাড়াটেদের সঙ্গে থাকতে হবে। মাথার ওপরের ছাতাটা ঝড়ে উড়ে গেলো। সমর আবার নিমজ্জিত হলো অন্ধকারে। ব্যঞ্জনা সন্তানসম্ভবা। সময় একদম এগিয়ে এসেছে। সেই সেদিনের মতো , যেদিন বেরিয়ে পড়েছিলো ঘর ছেড়ে নিঃসম্বল দিশেহারা হয়ে, কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না, সেদিন তো ও একা ছিলো। এমনসময় এক ঈশ্বর এসে ওকে বাঁচিয়েছিলো। কিন্তু আজ তো ও একা নয়। ওর মুখ চেয়ে আছে আরো কেউ। আজ কি কোন ঈশ্বর তার সামনে এসে দাঁড়াবে না?
সেদিন আকাশের মুখ কালো সকাল থেকে। দিন যতো গড়িয়ে যায় আকাশ ততো ঘন মেঘে ছেয়ে যায়। বিদ্যুৎ ঝলক সঙ্গে মুহুর্মুহু বাজের তীব্র আওয়াজ ভেদ করে বেরিয়ে আসে দুই সদ্যজাতকের অসহায় আর্তনাদ জন্মদাত্রীর হৃদস্পন্দনকে স্তব্ধ করে দিয়ে চিরকালের মতো। সমর কান্নায় ভেঙে পড়ে। এ কি দায় দিয়ে গেলো তার কাঁধে একা করে রেখে গিয়ে! যাবে যদি কেন এলো সে ওর রুক্ষ মরুময় জীবনে ।সমরের চোখের সামনে যেন প্রেতাত্মারা অট্টহাস্য করছে তার দুর্ভাগ্যকে দেখে। সদ্যজাতরা চিৎকার করে কেঁদে উঠে যেন বলছে — আমরা মাতৃহারা হয়ে পড়েছি, তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে আমরা কোথায় যাবো?
Samir Kumar Dutta
Pune, Maharashtra
Mobile no. 9051095623
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন