কবিতার লিরিক্যাল অনুভব
গোবিন্দ মোদক
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে – ভাষাহীন দিনলিপি একটি 'যুগ্ম কাব্যগ্রন্থ' যার প্রথমার্ধে কবি অনুশ্রী বিশ্বাস সিহির ২৯টি প্রাণস্পর্শী কবিতা এবং দ্বিতীয়ার্ধে কবি অপূর্ব বিশ্বাসের ২৩ টি বাঙ্ময় কবিতা স্থান পেয়েছে। বাংলাকে ভালোবেসে বাংলা ভাষাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির অধিকারিণী নদীয়ার করিমপুর নিবাসী অনুশ্রী বিশ্বাস সিহি মনের আবেগকে বিভিন্ন সময়ে তুলে এনেছেন তাঁর ভাবালু কলমে – তা থেকে ২৯ টি রত্ন ভাষাহীন দিনলিপি হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে পাঠকের দরবারে। মূলতঃ প্রেম এবং বিরহই কবি অনুশ্রীর কবিতার মূল উপজীব্য হলেও কবি কড়া নেড়েছেন বিশ্বাসের উত্তুঙ্গ পর্বতে, ভরসার অতল সমুদ্রে। তাঁর কলমের গভীর নেশা কখন যেন হঠাৎ করেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে আশাময় জীবনে; আর ছন্দ বুকে করে খুঁজতে বেরিয়েছে ভাষাহীন দিনলিপি-র সেই সব নোটেশন যেগুলিকে উপজীব্য করে ব্যস্ততার খেলাঘরে মেতে ওঠা যায় অনন্ত এক কাব্যখেলায় আর তুচ্ছ জীবনের খুদকুঁড়োকে পরম রত্নের মতো আদর করে রচনা করা যায় বেশ কিছু ইচ্ছে-শরীর আর অনুভব করা যায় নিভৃত ভাবনার ধুকপুক। কবির বেশ কিছু কবিতা ফিরে পড়বার মতো সুন্দর। যেমন মায়াময় ভুবনে, ভাষাহীন দিনলিপি, একটা 'আমি' যত্ন করে রেখো, তবুও চলা, স্মৃতির ভারে, সূচনার পথে, ব্যস্ততার খেলা ঘরে, অন্তর্দ্বন্দ্ব, একটা প্রেম সাজিয়ে রেখো ইত্যাদি। কবির বেশ কিছু কবিতা-পঙক্তিও পাঠকমনে দাগ কাটে —
ভাঙা গড়ার এই খেলাতে সবাই যাযাবর,
তারই মাঝে খুঁজতে থাকা সত্যিকারের ঘর।
(তবুও চলা)
রঙের নেশায় বেড়ে ওঠে প্রত্যাশাদের দহন,
পান্ডুলিপির ধূসরতায় স্মৃতির সাতকাহন।
নির্জনতায় খুঁজে পাওয়া রহস্যের এক গন্ধ,
বেহিসেবি অনুভবে জাগায় অন্তর্দ্বন্দ্ব।
(অন্তর্দ্বন্দ্ব)
কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয়ার্ধের কবি অপূর্ব বিশ্বাস বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজী সাহিত্যের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হলেও বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তাঁর নিত্য যাতায়াত। প্রায় তিন দশক ধরে কাব্যচর্চার রঙিন হয়ে থাকা পঞ্চাশোর্ধ এই ব্যক্তিত্বের কলম যেমন জাদুভরা, সুরেলা, তেমনই বাস্তবানুগ। বর্তমান কালের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়, ক্রমহ্রাসমান মূল্যবোধ, অশান্ত পরিবেশ ইতাদি বিষয় যেমন কবিকে ভাবায়, তেমনই যাপিত জীবনের কন্দরে ফুটে থাকা নগণ্য ফুলের সৌন্দর্যও কবির নজর এড়ায় না। তাই তাঁর রঙচটা স্বপ্নের পাশাপাশি অবস্থান করে ভালোবাসার বর্ণমালা আর আবির মাখা ফুলেল ইচ্ছাকুসুম। ভূয়োদর্শী কবি সম্যক জানেন যে- জীবনের ধ্বংসাবশেষের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে নতুন ভোরের আলো যা রাতের অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে রক্তগোলাপ ফোটাবার প্রত্যয়ে নিয়ত বলীয়ান। কবি তাই সেই অতলান্ত বিশ্বাসে বিশ্বাসী – যে বিশ্বাস নিয়ে প্রতিদিন নীড়ে ফেরে পাখির দল, যে বিশ্বাস নিয়ে মায়ের স্তন্যপান করে দুগ্ধপোষ্য শিশু, যে বিশ্বাস নিয়ে কিশোরী আঁকড়ে ধরে তার পিতার হাতের আঙুল, যে বিশ্বাস নিয়ে একটি মেয়ে ঘর ছাড়ে তার প্রেমিকের সঙ্গে, যে বিশ্বাস নিয়ে একটি গাছ মাটির মধ্যে প্রোথিত করে তার মূল, শাখামূল। তাই দিগন্ত ছুঁয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠলে কবিও হেসে ওঠেন রোদের মতো; খোলা বাতাসে পাখির গান ভেসে এলে কবিও টের পান একটি নিশ্চিত সকাল আসছে। তখন তিনি মুক্তকণ্ঠে বলে ওঠেন —
দাঁড়িয়ে আছি জীবনের ধ্বংসাবশেষের মাঝে
বিশ্বস্ততা আর বেইমানির মাঝে আজও টিকে আছি বেশ
মাঝে মাঝে অনুভব করি এই বুঝি জীবনের শেষ!
(জীবনের ধ্বংসাবশেষ)
আবার কবি কখনও জীবনের রঙচটা স্বপ্নের ব্যর্থ ফসিলে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেন —
রঙিন দুনিয়ায় বেরঙিন হয়ে গেছি আমি
ধুলোপড়া কাঁচের স্বর্গটাই আছে
প্রেমহীন রুক্ষতায় আছি কাছে কাছে
আমার আমিকেই ভালোবাসি এইটাই দামি!
(রঙচটা স্বপ্নেরা)
এভাবে নানাবিধ ভাবনার কবিতায় সেজে উঠেছে ভাষাহীন দিনলিপি-র অবয়ব। তাই ভাষাহীন দিনলিপি সম্পর্কে ভাষায় বলা যায় – একটা শীত-রোদ্দুরে ব্যালকনিতে বসে, কিংবা উপুর-ঝুপুর বর্ষায় মন খারাপের একাকীত্বে যখন মন কোনও অবলম্বন খোঁজে তখন ভাষাহীন দিনলিপি-র পাতা উল্টে পাঠক অনিবার্যভাবেই পেয়ে যান কবি অনুশ্রী-অপূর্বর কবিতার লিরিক্যাল অনুভব। আর সেইখানেই ভাষাহীন দিনলিপি-র সার্থকতা।
ঝকঝকে প্রায় নির্ভুল ছাপা, চমৎকার অনুভবী প্রচ্ছদ, উৎকৃষ্ট কাগজ, মজবুত বাঁধাই বইটিকে প্রকৃত অর্থেই আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আশা করা যেতেই পারে যুগ্ম কাব্যগ্রন্থটি পাঠক ও বিদগ্ধমহলে সমাদৃত হবে।
=====================
— গোবিন্দ মোদক, কৃষ্ণনগর, নদীয়া
___________________________
কাব্যগ্রন্থ: ভাষাহীন দিনলিপি (যুগ্ম কাব্যগ্রন্থ)
কবি: অনুশ্রী বিশ্বাস সিহি ও অপূর্ব বিশ্বাস
প্রকাশক: সাহিত্যলিপি পাবলিকেশন
প্রচ্ছদ: চূড়ামণি ॥ মূল্য - ১৫০ টাকা
প্রকাশকাল: কলকাতা বইমেলা- ২০২৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন