গল্প
প্রতীক্ষা
চন্দন দাশগুপ্ত
আমার কথা শুনেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন সুকুমার কাকু,
------কি বললে ? বাদাবনে ঢুকে তুমি মন্দির দেখবে ? ক্ষেপেছ নাকি ? চৈতি বাওড়ের পাল্লায় পড়লে আর বেঁচে ফিরবে না, বুঝেছ ?
------চৈতি বাওড় ! সেটা কি ?
হাসলেন কাকু,
------শহরের ছেলে, 'বাওড়' বুঝবে কি ? এ হল চৈত্র-বৈশাখ মাসে আসা প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড়, যখন আসবে---তখন চারদিকে ধুন্ধুমার কান্ড বাধাবে। তাছাড়া বাবা দক্ষিণরায়ের চেলাদের কথা ছেড়ে দিলেও বাদাবনে রয়েছে সাপখোপ-শূলো এইসব হাজার ফ্যাঁকড়া। তুমি জঙ্গলে ঢোকার প্ল্যান বাদ দাও তো !
ইতিহাস নিয়ে আমার পড়াশোনা। সুযোগ পেলেই তাই এদিক-সেদিক ঘুরে আসি। মুর্শিদাবাদ-মালদা বার কয়েক গিয়েছিলাম। এবার ভাবলাম সুন্দরবন যাওয়া যাক। সপ্তদশ শতাব্দীতে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের আমলে সুন্দরবনের দক্ষিণে সাগরদ্বীপ ছিল জমজমাট এলাকা। শোনা যায়, সেখানেই নাকি ছিল তাঁর জাহাজ তৈরির কারখানা। তৈরি হত মাচোয়া, কোশা, ঘুরাব....কত বিচিত্র সব জলযান ! সাগরদ্বীপ থেকে ধূমঘাট পর্যন্ত দোর্দন্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়াত বাঙালি রণতরী। তাছাড়া আধুনিক ইতিহাসবিদেরা বলেন, তারও বহু আগে, পাল ও সেনযুগেই সুন্দরবন এলাকায় নাকি সভ্যতার বিস্তার হয়েছিল। জটার দেউল এবং অন্যান্য বহু ভগ্ন মন্দির-কেল্লা এর সাক্ষ্য দিচ্ছে।
সুকুমার কাকু বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুন্দরবনের গোবিন্দপুরে থাকেন। বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য নিজের চোখে দেখার উদ্দেশ্যে আজই বিকেলবেলা আমি কাকুর বাড়িতে এসেছি। কিন্তু রাত্তিরে খাবার সময় আমার আসার উদ্দেশ্যটা জানাতেই কাকু এক কথায় তা নাকচ করে দিলেন।
মনটা খারাপ হয়ে গেল।
খেয়ে উঠে মুখ ধুয়ে ছাদে গিয়ে বসলাম। বোধহয় লোডশেডিং----তাই ঘরে ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। কলকাতা থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে আছি, কিন্তু কী অদ্ভুত নিস্তব্ধতা চারদিকে ! কানে আসছে শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক।
------কি রে মন্টু, পান খাবি ?
সুকুমার কাকুর মেয়ে, ময়নাদি কখন ছাদে এসেছে টেরই পাইনি। বললাম,
------নাঃ, পান তো খাইনা দিদি !
------সত্যি পান খাস না ?---ময়নাদি অবাক,-----যাকগে শোন্ ! বাবার কথায় ঘাবড়াবি না। বাদাবনের ভেতর তোকে আমি একটা পুরনো মন্দির দেখিয়ে দেব। বাবা টেরও পাবে না। কাল দুপুরবেলা----কেমন ?
আমি লাফিয়ে উঠলাম,
------সত্যি বলছ ?
------সত্যি-সত্যি-সত্যি । হলত ?
গরমের দুপুর। সুকুমার কাকু সকালবেলাই খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে গেছেন----সন্ধ্যের আগে ফিরবেন না। ময়নাদির সাথে চুপিচুপি বেরিয়ে এসে ওদের ছোট্ট নৌকোটায় উঠলাম। এ-অঞ্চলে প্রায় সব বাড়িতেই এরকম ছোটোখাটো নৌকো আছে।
ময়নাদি বেশ বেপরোয়া মেয়ে, মাথার টুপিটা ভাল করে বসিয়ে নিয়ে নিপুণ হাতে বৈঠা বাইতে শুরু করেছে।
নৌকোটা তরতর্ করে এগোচ্ছে। অল্প অল্প বাতাস বইছে। চারদিক চুপচাপ। ছোট ছোট ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ করে এসে নৌকোর গায়ে লাগছে। আমি অবাক হয়ে দুপাশের ঘন বন-জঙ্গল দেখছি। মাঝে মাঝে ময়নাদি দু একটা কথা বলছে, পাখি চেনাচ্ছে। একটা বাঁক ফিরতেই আমরা একটা বেশ বড় নদীতে এসে পড়লাম।
------এটা হল মাতলা নদী, আর ঐ যে দেখছিস দূরে জঙ্গল---ওখানেই যাব আমরা।
প্রায় আধমাইল দূরের একটা জঙ্গলের দিকে ময়নাদি আঙুল দেখাল।
একটু পরেই আমরা অকুস্থলে পৌঁছে গেলাম। নৌকোটাকে একটা গাছের গুঁড়ির সাথে বেশ করে বেঁধে ময়নাদি বলল,
------আয়, এবার কিছুটা হাঁটতে হবে।
ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে একটা পায়ে-চলা সুঁড়িপথ দেখা যাচ্ছে। দুজনে সেই পথটা ধরে এগিয়ে চললাম। চারদিকে কত রকমের জানা-অজানা গাছগাছালি, কানে আসছে নানা রকম পাখির ডাক। একেকটা জায়গায় পথটা এত সরু যে দুজন পাশাপাশি হাঁটাই যাচ্ছে না। তখন ময়নাদির পেছন পেছন চলতে হচ্ছে আমাকে।
প্রায় মাইলখানেক হাঁটার পর শেষ পর্যন্ত একটা পরিত্যক্ত ভাঙা মন্দিরে এসে পৌঁছলাম আমরা। দেখা গেল, মন্দিরের ঠিক পেছন দিয়েই বয়ে চলেছে একটা নদী।
------মাতলারই এটা একটা শাখা---ময়নাদি জানাল।
কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে আমরা মন্দিরের সামনের একটা চওড়া বারান্দায় উঠলাম। প্রাচীন হলেও বোঝা যায়, এখনও কেউ কেউ আসে এখানে। কারণ ভাঙাচোরা হলেও মোটামুটি পরিচ্ছন্ন চারদিক। উড়ে এসে পড়া গাছের পাতা ছাড়া অন্য নোংরা আবর্জনা চোখে পড়ছে না।
এদিক সেদিক ঘুরে দেখছি, এই সময় একটা অস্বাভাবিক সোঁ সোঁ শব্দে চমকে উঠলাম আমরা। ময়নাদির মুখ দেখি কাগজের মতো সাদা হয়ে উঠেছে ! বলল,
--‐---সর্বনাশ হল রে মন্টু ! এ-তো চৈতি বাওড়---আজ আর বাড়ি ফেরা যাবেনা রে !
বাইরে জঙ্গল মহলে তখন একটা দুর্দান্ত হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেছে। ঠিক মনে হচ্ছে, একটা বুনো মোষ বুঝি গোটা পৃথিবীটা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গাছপালাগুলো পাগলের মতো এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ছে। শুকনো পাতা ওড়ার চড়চড়্ শব্দ, পাখিদের ভয়ার্ত চীৎকার-----সব মিলিয়ে এক নারকীয় কান্ড ! আকাশটা ঢেকে গেছে কালো মেঘে।
------এই বারান্দায় এখন দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয় রে।-----ময়নাদি বলল।
আমরা মূল মন্দিরের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বাইরে এতক্ষণে তীব্র বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সীসের মতো জমাট অন্ধকার যেন আমাদের গিলে ফেলেছে। কড়-কড়-কড়াৎ করে বাজ পড়ল কাছাকাছি কোথাও। ময়নাদি আমার হাত চেপে ধরে বলল,
------ঘাবড়াবি না। এখানে এরকম প্রতি বছরেই হয়। আজ রাতটা নাহয় বাড়ির বাইরেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তবে সঙ্গে তো খাবার দাবার নেই----
------বাদ দাও তো। একটা রাত না খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।---আমি বললাম।
দেখতে দেখতে কাটতে লাগল ঘন্টার পর ঘন্টা। বাইরে ঝড়ের তান্ডব এখন একটু কমেছে। রাত এখন কত কে জানে। বললাম,
------ময়নাদি, এখানেই যখন থাকতে হবে, তখন একটু ঘুমিয়েই নেওয়া যাক। কি বলো ?
------বেশ তো, তুই ঘুমো। তবে ভয় পাস না, এসব জায়গায় সাপখোপ থাকতে পারে, আমি এখন জেগেই থাকব। পরে তোকে তুলে দিয়ে আমি ঘুমিয়ে নেব। ঠিক আছে ?
------আচ্ছা।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎই সেতারের মিঠে আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার। চোখ খুলেই দেখলাম জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় ঘর ভেসে যাচ্ছে। ভাঙা দরজার সামনে হাতে মাথা রেখে ময়নাদি ঘুমিয়ে পড়েছে। আর বাইরে কাছেই কোথাও খুব ধীরলয়ে বেজে চলেছে সেতার। অবসর সময়ে আমিও সেতারের চর্চা করি। তাই একটু কান পেতে শুনতেই বুঝতে পারলাম গুর্জরী টোড়ি রাগের আলাপ হচ্ছে।
ময়নাদিকে ডাকলাম,
------এই ময়নাদি, ওঠো ওঠো !
ধড়মড় করে উঠে বসল ময়নাদি। বলল,
------ইস, কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম ! কিন্তু, এ-কী, এখানে এতো রাতে কে সেতার বাজাচ্ছে রে ?
------চলো, বেরিয়ে গিয়ে দেখি।
দুজনে সাবধানে মন্দিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় চারদিক দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। কে বলবে, কয়েক ঘন্টা আগে এখানে ঝড়ের তান্ডব বয়ে গেছে ! মন্দিরের বারান্দা ধরে কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালাম।
এক অপূর্ব দৃশ্য !
বারান্দার শেষপ্রান্তে একটা হাতখানেক উঁচু পাথরের বেদীতে বসে চাঁদের আলোয় তন্ময় হয়ে সেতার বাজিয়ে চলেছেন এক বৃদ্ধ। তাঁর বয়স বোধহয় সত্তর পার হয়ে গেছে। একমাথা ঝাঁকড়া চুলের একটাও কাঁচা নেই। তার ওপর দুধের মতো সাদা এক মুখ দাড়ি তাঁর মুখে এনে দিয়েছে এক অপার্থিব স্বর্গীয় দ্যুতি।
চারপাশের আরণ্যক পরিবেশ, উড়ে যাওয়া জোনাকির দল, আর সুরের মায়াজাল আমাদের দুজনকেই মোহাবিষ্ট করে তুলেছে। দেওয়াল ঘেঁষে আমরা চিত্রার্পিতের মতোই দাঁড়িয়ে আছি। এতক্ষণে আলাপ শেষ করে মূল গৎ আর তানবিস্তার শুরু করেছেন বৃদ্ধ শিল্পী। অবাক হয়ে দেখছি, কিভাবে তরফদার সেতারের ঘাটগুলোর ওপর অনায়াসে খেলা করছে তাঁর বাঁ- হাতের আঙুলগুলো। বাজনার বেগও ধীরে ধীরে বাড়ছে । মীড়, গমক আর তেহাইয়ের কাজ মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। গাছপালা, জঙ্গলের রাতজাগা পশুপাখি---সবাই যেন একমনে শুনে চলেছে এই মোহময়ী সুর-লহরী। বৃদ্ধ বাদকের মনের কোনও গভীর বেদনা যেন গলে গলে ছড়িয়ে পড়ছে নিথর বনভূমিতে.....
সময় কেটে যাচ্ছে........গুর্জরী টোড়ি রাগের সুরের মায়াবী বৈচিত্র্যে আমরা হতবাক্ ! এবার বাদক শুরু করেছেন বাজনার শেষ পর্যায়---ঝালা। সেতার এখন অসম্ভব দ্রুতলয়ে বেজে চলেছে........আঃ ! এই অপূর্ব সুরমূর্ছনা শোনার পর মরে গেলেও আমার কোনো আক্ষেপ থাকবে না......।
কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়ালই নেই। শেষ পর্যন্ত ক্ষান্ত হলেন সেই বৃদ্ধ শিল্পী, থেমে গেল বাজনা। আমরা এবার এগিয়ে গেলাম। গম্ভীর গলায় বৃদ্ধ বললেন,
------জয় কেশবেশ্বর ! ঝড়ে আটকে গিয়েছিস বুঝি ?
------হ্যাঁ।
------ভয় নেই। সকালবেলায় ফিরে যাবি।
------কিন্তু, আপনি এত রাতে----
ময়নাদিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বৃদ্ধ বললেন,
------জয় কেশবেশ্বর! আমার নাম শেখর আচার্য। বছর দশেক আগে পর্যন্ত আমিই ছিলাম এই মন্দিরের পুরোহিত। তারপর সেবারের প্রচন্ড ঘুর্ণীঝড়ে মন্দির ভেঙে পড়ল, এখন পুজোও আর হয়না। তবে আমি কিন্তু রোজ আসি। সাধ্যমতো মন্দির পরিষ্কার রাখি। যতদিন বাঁচবো, করে যাব।
এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম,
------কিন্তু আপনি এত রাতে বিশ্রাম না করে সেতার বাজাচ্ছিলেন কেন ?
------তাহলে তো অনেক কথা বলতে হয়। শুনবি সে-সব ?
------হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনবো।----আমরা একসাথে বললাম।
এরপর শেখর আচার্য শোনালেন এক আশ্চর্য কাহিনী.........
প্রায় চারশো বছর আগেকার ঘটনা। ভারতবর্ষে তখন মোগল যুগ। দিল্লীর মসনদে আসীন স্বয়ং বাদশাহ জাহাঙ্গীর। দক্ষিণবঙ্গের ভাটি অঞ্চলে কিন্তু তখন বারো ভুঁইঞার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রবল প্রতাপ।
সুন্দরবনের সাগরদ্বীপে নিজের জাহাজ-নির্মাণ কারখানার কাজকর্ম সরেজমিনে তদারক করতে এসেছেন স্বয়ং প্রতাপাদিত্য। সঙ্গে আছেন তাঁর গুপ্তচর বিভাগের প্রধান সুখাসর্দার। লোকে বলত, এক মাইল দূর থেকেও সুখাসর্দার নাকি ষড়যন্ত্রের আভাস স্রেফ গন্ধ শুঁকেই বার করে ফেলতেন।
যাই হোক, পরিদর্শনের কাজ শেষ করে মহারাজ প্রতাপাদিত্য নিজস্ব বজরায় বিশ্রাম করছিলেন। এমন সময় এক গুপ্তচর এসে তাঁকে একটি অদ্ভুত খবর দিল। সুন্দরবনের ভেতরে হরিণচক্ গাঁয়ে আছে জাগ্রত কেশবেশ্বরের মন্দির।প্রতি পূর্ণিমা তিথিতে মধ্যরাত্রে সেই মন্দিরের পুরোহিত বাসব আচার্য বীণা বাজিয়ে সুরসাধনা করেন। আর মন্দিরের বিগ্রহ তখন জীবন্ত হয়ে ওঠে। স্বয়ং কেশবেশ্বর সশরীরে বেদী থেকে নেমে এসে সেই অপূর্ব সুর উপভোগ করেন শেষরাত্রি পর্যন্ত।
------বলছ কি হে ! এসব সত্যি ?
------আজ্ঞে, মহারাজকে মিথ্যে বলার সাহস আমার নেই ।
------হুম। খবর সত্যি হলে তোমাকে অবশ্যই পরে পুরস্কার দেব। এখন তুমি যাও।
প্রণাম করে গুপ্তচর বিদায় নেয়।
পরদিনই ছিল পূর্ণিমা।
গোপনে রাত্রি তৃতীয় প্রহরে একাকী কেশবেশ্বর মন্দিরে প্রবেশ করেন মহারাজ প্রতাপাদিত্য। তাঁর বুকটা কেঁপে ওঠে একবার। মনে পড়ে একান্ত অনুগত সুখা সর্দারের সাবধানবাণী,
------কাজ কি মহারাজ দেবদর্শনে ? সশরীরে দেবদর্শন তো সহজ নয়, তাতে অনেক বাধা।
পরক্ষণেই নিজের মনকে শক্ত করেন প্রতাপাদিত্য। ফুঃ, একটা মন্দিরের সামান্য পুরোহিত-----তার বাজনা শুনতে যদি স্বয়ং ভগবান আসতে পারেন, তবে তিনি দোর্দন্ডপ্রতাপ মহারাজ প্রতাপাদিত্যকে দেখা দেবেন না ?
শেষপর্যন্ত দেখা দিয়েছিলেন স্বয়ং কেশবেশ্বর। আর বাজনা শোনায় ব্যাঘাত ঘটানোর অপরাধে দিয়েছিলেন ভয়ঙ্কর অভিশাপ। বিধর্মীর হাতে সবংশে নিহত হবেন মহারাজ প্রতাপাদিত্য। আর ঠিক জানোয়ারের মতোই হবে তাঁর নিজের মৃত্যু।
শিউরে উঠে ক্ষমাভিক্ষা চেয়েছিলেন মহারাজ। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
একটানা বলে শেখর আচার্য থামলেন। আমরা বললাম,
-------তারপর ?
-------তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। কয়েক বছরের মধ্যেই বিধর্মী মোগলদের হাতে শোচনীয় পরাজয় ঘটে প্রতাপাদিত্যের। শোনা যায়, আত্মসম্মান বাঁচানোর জন্য তাঁর স্ত্রী শরৎকুমারী দেবী সহ বহু মহিলা কামারখালি নদীতে আত্মবিসর্জন দেন। যে জায়গায় তাঁরা ঐ কাজ করেছিলেন, সেই জায়গাটাকে এখনও লোকে বলে 'শরৎখানার দহ'। শোনা যায়, মহারাজ প্রতাপাদিত্যকে মোগলেরা হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে ঠিক বন্য জন্তুর মতোই খাঁচায় ভরে দিল্লি নিয়ে যাচ্ছিল। পথের মাঝে বেনারসে তাঁর মৃত্যু হয়। কেশবেশ্বরের অভিশাপ এতদিনে পূর্ণ হল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেশব আচার্য আবার বলতে শুরু করলেন,
-------সবচেয়ে দুঃখের কথা কি জানিস ? এই মন্দিরে আর কখনও কেশবেশ্বরের সশরীরে আবির্ভাব ঘটেনি। বাসব আচার্য প্রতি পূর্ণিমায় এই বেদীতে বসে বীণা বাজাতেন। আমি তাঁর শেষ বংশধর, বংশ পরম্পরায় আমরা আজও প্রতি পূর্ণিমা তিথিতে বীণা আর সেতার বাজিয়ে চলেছি এখানে বসে। কিন্তু কেশবেশ্বর আজও আসেননি। জানিনা, আর কখনও তিনি আসবেন কি-না। তবুও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করব।
কথা শেষ করে একটু নীরবতার পর শেখর আচার্য আবার বলেন,
------আমার সাথে আয়। তোদেরকে আজ একটা জিনিস দেখাব।
আমরা সেই বৃদ্ধকে অনুসরণ করলাম। মন্দিরের ভেতর একটা অন্ধকার ঘরে ঢুকে তিনি প্রদীপ জ্বালালেন। তারপর মেঝে থেকে একটা ভারী পাটাতন টেনে তুললেন। তাঁর হাতের প্রদীপের শিখা অল্প অল্প কাঁপছে। দেখলাম, পাটাতনের নীচেই সুড়ঙ্গ----পর পর কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে।
কেশব আচার্যের সাথে আমরা সেই মন্দিরের গর্ভগৃহে নেমে এলাম।
একটা অপরিসর কক্ষ।
এ-কী ! একটা বিরাট সোনার থালায় স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে আছে অজস্র বাদশাহী মোহর আর অলঙ্কার। ময়নাদির চোখ ছানাবড়া ! আমার মনে হচ্ছে আমরা চারশো বছর আগেকার মোগল যুগে ফিরে গিয়েছি ।
বদ্ধ ঘরে বাসব আচার্যের কন্ঠ গমগম করে ওঠে,
-------কেশবেশ্বরের অভিশাপ মুক্ত হবার জন্য মহারাজ প্রতাপাদিত্য এই মন্দিরের সংস্কার করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেবতা বাসব আচার্য কে স্বপ্নে নির্দেশ দেন মহারাজের দেওয়া সেইসব অর্থ ও অলঙ্কার ব্যবহার না করতে। ধনরত্নগুলো সেই থেকে এখানেই পড়ে আছে।
আমরা এবার একে একে ওপরে উঠে আসছি। ভাবছি, কলকাতায় ফিরে গিয়ে ভারত সরকারের আর্কিওলজি দফতরে এইসব কথা জানালে বাংলার ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় লেখা হবে।
কিন্তু তা করার আর সুযোগ পেলাম না। সবার আগে ওপরে উঠে এলাম আমি। আমার ঠিক পেছনেই এল ময়নাদি। শেখর আচার্য আসছিলেন সবার পেছনে। কিন্তু তিনি আর উঠে আসতে পারলেন না।
হঠাৎই একটা অস্বাভাবিক তীব্র গুড়গুড় শব্দ শোনা গেল। কিছু বুঝবার আগেই ময়নাদি অমানুষিক শক্তিতে হ্যাঁচকা টানে আমাকে অনেকটা সরিয়ে আনল। যেখানটায় আমরা কয়েক সেকেন্ড আগেই দাঁড়িয়েছিলাম, দেখতে দেখতে মন্দিরের সেই অংশটা আমাদের চোখের সামনে ধ্বসে পড়ল। নদীগর্ভে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল কেশবেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহ-----সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হল শেখর আচার্যের অন্তিম প্রতীক্ষা, ইতিহাসের নীরব সাক্ষী নিজেই আমাদের চোখের সামনে ইতিহাস হয়ে গেলেন।
আমার হাতের ভেতর ময়নাদির হাতটা এখনো কাঁপছে.......ভোরবেলার সুন্দরবন জেগে উঠছে অজস্র পাখির কাকলীতে.........
( সম্পূর্ণ কাল্পনিক গল্প। কোনও ঐতিহাসিক চরিত্রে কলঙ্কলেপন করা লেখকের উদ্দেশ্য নয় )
====================
চন্দন দাশগুপ্ত
সি/৩০/১, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, রিজেন্ট এস্টেট,
কলকাতা---৭০০ ০৯২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন