পরাবাস্তববাদ ও বাংলায় জীবনানন্দের কাব্যচর্চা
রণেশ রায়
পরাবাস্তববাদ বলতে কী বুঝি
অধিবাস্তবতা বা পরাবাস্তববাদ (surrealism) হলো মানুষের একটা এমন মনোগত অবস্থান যেখানে তার সচেতন আর অবচেতন মন পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় যুক্ত থাকে। মানুষের বিভিন্ন ভাবনার মধ্যে বুননের কাজ চলতে থাকে। বস্তুজগতের বাস্তবতার উর্দ্ধে এক বাস্তবতা যেখানে মানুষের কল্পনা ডানা মেলে, সেজে ওঠে নানা কল্প কথায়। মানুষের মন ভেসে যায় এক স্বপ্ন জগতে। বস্তুজগতের সঙ্গে মনোজগতের এক সেতুবন্ধন ঘটে। এ যেন এক সূচি শিল্প।
১৯১৭ সালে "পরাবাস্তববাদ" শব্দটি ফরাসি কবি নাট্যকার গুইলাম অ্যাপোলিনার প্রবর্তন করেন। ফরাসি দেশের শিল্পব্যক্তিত্ব আন্দ্রে ব্রেটন (১৮৯৬-১৯৬৬), পরাবাস্তববাদ নামক আন্দোলনের প্রথপ্রদর্শকদের মধ্যে অগ্রণী। ১৯২০-এর দশকে প্যারিসে একটি শৈল্পিক আন্দোলন হিসেবে এর সূত্রপাত। দুটি বিশ্বযুদ্ধের অন্তরবর্তীকালে এই আন্দোলন এতটাই গতিময় ছিল যে সাড়া বিশ্বে সাহিত্য চিত্রকলা এক নতুন মোড় নেয় যার প্রভাব আজও আধুনিক শিল্প সাহিত্যে অব্যাহত।। লেখক এবং দার্শনিক ব্রেটন "The Manifesto of Surrealism" প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান , যা সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত সনাতনী শিল্প ভাবনার বিরোধিতা করে গড়ে তোলার একটি প্রচেষ্টা বলে খ্যাত । তখনকার সমাজজীবনের ওপর বিজ্ঞানের অপব্যবহারের কুফল ও যুদ্ধের ভয়াভয়তার বিরোধিতা করার কথা বলা হয় এই আন্দোলনে। যুক্তিবাদের নামে বিজ্ঞানের অগ্রগতির নামে সমাজজীবনে যে ভয়াভয়তা নামিয়ে আনা হয় তার বিরোধিতার একটা ধরণ হলো এই আন্দোলন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা যখন ইউরোপে প্রকট শিল্পকলা তখন রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছিল। শিল্পকলা তখন তথাকথিত সামরিক ঢঙে শৃঙ্খলা বজায় রাখার এবং বিপ্লবকে দূরে রাখার একটি উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এর বিরুদ্ধে পরাবাস্তববাদীরা শিল্পের উপর শাসক সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। তাঁরা রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিরোধিতা করলেও তাঁদের লড়াইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত বলে ভাবার কারণ নেই। তাঁদের আন্দোলনের লক্ষ্য রাজনৈতিক ছিল না। পরাবাস্তববাদ শিল্প জগতে মানুষের মধ্যে সচেতনা ও অবচেতনার মধ্যে বিরোধের মীমাংসা করে ভাববাদ ও বস্তুবাদের মধ্যে এক সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে চেয়েছিলো যা যান্ত্রিক অতিবাস্তবতার দর্শনের বিরোধিতা করে গড়ে তোলে বাস্তবতার উর্দ্ধে অবস্থিত এক মনন যাতে তাঁরা বিশ্বাসী ছিলেন। সেটাই ছিল পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিক মানবদরদী ভাবনাকে তথাকথিত যুক্তিবাদের উর্দ্ধে তুলে ধরা। শিল্পকলাকে সব ধরণের নিয়ন্ত্রণের উর্দ্ধে রেখে বিশুদ্ধতা দেওয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে মানবতাকে যেভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছিল তা মেরামত করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখে এই আন্দোলন শাসক সম্প্রদায়ের রোষের সম্মুখীন হয়।যদিও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনটি আর আন্দোলনের আঁকারে থাকেনি, তবুও আজকের চিত্র শিল্প সাহিত্যের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরাবাস্তববাদের প্রভাব বিশেষ লক্ষণীয়। পরাবাস্তববাদী চিত্রকল্প, কাব্য চর্চায় কাব্যিক কৌশল ব্যবহার আজের সাহিত্যে একটা উন্নত আঙ্গিক হিসেবে সাহিত্য জগতে স্থান পেয়েছে। সাহিত্যের সীমানা প্রসারিত হয়েছে।
জীবনের কোন বাস্তবতা মানুষের অবচেতন মনে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যা মানুষের কল্পলোকে প্রতিফলিত হয়। সচেতন মনোজগতের সঙ্গে অবচেতন মনের কল্পকথার সংযোগ ঘটিয়ে শিল্প সাহিত্যকে শিল্পগুনে সমৃদ্ধ করে তোলার কথা বলা হয় পরাবাস্তবাদে। বাস্তবের সঙ্গে মানুষের অবচেতন মনের যে স্বপ্নলোকের বিরোধ তার সমাধান খোঁজে পরাবাস্তুবাদ বলে অনেকে মনে করেন। আমরা দেখি মানুষের মনোলোকের সঙ্গে বাস্তবের সংঘাত ঘটে। এর ফলে মানুষের ব্যবহারে স্ববিরোধিতার সৃষ্টি হয়। পরাবাস্তুবাস এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করে এক কল্পকথা গেঁথে। তাকে অধিবাস্তবতা বলে বিচার করা হয় পরাবাস্তুবাদী দর্শনে। শিল্প সাহিত্যে এই বিষয় নিয়ে চর্চা প্রাধান্য পায় । বাংলা কবিতায় এই দর্শন বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয় জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। মানুষের অবচেতন মনের ভাবনার সঙ্গে বাস্তবতাকে যুক্ত করে এক অধিবাস্তবাদের ভাবনাতে রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয় এই পরাবাস্তবাদের দর্শনে যাকে অনেকে উদ্ভট কল্পকথা বলে মনে করেন, যার সঙ্গে বস্তুবাদের কোন সম্পর্ক নেই বলে বলা হয়। নানা রূপকের সাহায্যে বাস্তবতাকে চিহ্নিত করা হয় পরাবাস্তুবাদে। এই রূপকগুলো অনেক সময় দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। তাই অনেকে একে কল্পলোকের কল্পকথায় কোন এক রূপসীর বিচরণ বলে মনে করেন। মানুষের সচেতন ও অবচেতন মনের ভাবনার মধ্যে এক সেতুবন্ধনের কথা বলা হয় পরাবাস্তবাদের দর্শনে।
তবে আমার মনে হয় এর কিছু বিমূর্ত অস্পষ্ট বোধাতীত দিক থাকলেও এই ভাবনার উদ্ভবের বাস্তব ভিত্তি আছে। তা নিয়ে আমরা দুএকটা কথা বলে নিতে পারি বিষয়টাকে আরও ব্যাপ্তিতে বোঝার জন্য। সহিত্যে পরবাস্তুবাদের প্রভাব আলোচনার আগে কল্প কথা সৃষ্টি ও তার সাথে বস্তুবাদের সম্পর্কটা আমি যেভাবে ভাবি সেভাবে তুলে ধরছি।
দ্বন্দ্ব তত্ত্বের আবহে সাহিত্যে কল্পকথা ও কল্পচিত্র:
সাহিত্য ও সাহিত্যিকের সঙ্গে কল্পকথা কল্পচিত্র সৃষ্টির ওতপ্রোত সম্পর্ক থাকলেও সাহিত্যকে নেহাত সাহিত্যিকের স্বপ্ন বিলাস অলস কল্পনার এক আবেগঘন ক্ষণিক মুহূর্তের নান্দনিক প্রকাশ বলে মনে করার কারণ নেই। প্রকৃতিরই অংশ মানুষ তার বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাঁচে। মানুষের অন্তর্মুখী বৈশিষ্ট্য তার চেতনায় আলোকিত। সেটা তার মনোজগত তথা মানসলোক। এই মনোজগতকে মানুষ কথায় প্রকাশ করতে পারে ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে পারে ইঙ্গিতে উপমায় প্রকাশ করতে পারে। একে সাহিত্যিক তাঁর নিজের জীবন বোধ সৌন্দর্য বোধে নান্দনিক করে তোলেন সন্দেহ নেই। তিনি সাহিত্যে কল্পকথা কল্পচিত্র সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাঁর এই শিল্পসৃষ্টি নেহাত স্বপ্ন বিলাস, জীবনবোধ বর্জিত কল্পনার জালবোনা নয়, তার থেকে বেশি আরো কিছু। একটা সমাজ কাঠামোয় সাহিত্য কোন সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে বেষ্টন করে থাকে। সাহিত্যিকের জীবন দর্শন জীবন বোধ সমাজের প্রতি দায়িত্ব বোধকে তুলে ধরে।
এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বিষয়টাকে সামগ্রিকতায় বিচার করা দরকার । এই সামগ্রিকতা হল এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যা প্রকৃতি ও মানব সমাজ আর প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কে সম্পর্কিত। মানুষে মানুষে সম্পর্ক নিয়ে এই সমাজ। প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে এই বস্তু জগৎ বা ভৌত জগৎ যা সাহিত্যিককে তাঁর সাহিত্যের বিষয় বস্তু বেছে নিতে সাহায্য করে। মানুষ তার ইন্দ্রিয় দিয়ে এই বস্তুজগতকে অবলোকন করে, তার বিবর্তন প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে। তার মনোজগতে প্রতিবিম্বিত হয় এই প্রকৃতি এই মানব সমাজ যখনই সে প্রকৃতিকে মানব সমাজকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করে তাকে অবলোকন করে। বস্তুজগতের প্রতিফলন ঘটে তার স্নায়ুজগতে। তার মনোজগত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আবার মনোজগত এইভাবে যে বার্তা পায় সেটা তাকে উপলব্ধিতে সাহায্য করে। অতীত বর্তমানকালকে সে বোঝার চেষ্টা করে তা তাকে জীবনটাকে বুঝতে সাহায্য করে। তার জীবন বোধ তৈরি হয়। অতীত ও বর্তমানের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে মানুষ। সাহিত্যিক তা দিয়ে তাঁর কল্পনার মালা গাঁথেন। এক কল্পচিত্র তৈরি হয় যার থেকে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি যা একান্তই সাহিত্যিকের নিজের এক অনবদ্য সৃষ্টি। ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করতে চান তিনি। এর থেকে সৃষ্টি হয় কল্পকথা যা সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে ভাষায় রূপ পায়। ছন্দ তাল লয়ে কবিতায গল্পে সেজে ওঠে। অর্থাৎ বস্তুজগত যেমন মনোজগতের ওপর ক্রিয়া করে তেমনি মনোজগত প্রকৃতি জগতকে অনুধাবন করে, মানব সমাজের দিক নির্দেশ করে, তাকে বুঝতে সাহায্য করে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে হাসি কান্না প্রেম ভালোবাসা জীবন যুদ্ধকে বোঝার চেষ্টা করেন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্য চর্চায়। এসবই তাঁর কল্পকথা হয়ে ওঠে, কল্পচিত্র সাহিত্যের সৃষ্টি করে যা সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন ভাবে রূপ পায়। সৃষ্টি হয় সাহিত্য শিল্প।সেখানে মনোজগতের প্রকৃতিজগতকে সঠিক প্রেক্ষাপটে তার কার্যকরণ দিয়ে বোঝার ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ন। এখানেই বস্তু জগৎ ও মনোজগতের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা তাৎপর্যপূর্ণ যা আর বস্তুজগতকে বাদ দিয়ে কল্প বিলাস থাকে না। কবিতায় উভয় জগতের বিষয়টা মূর্ত হয়ে ওঠে। বাস্তব অবস্থা থেকে উঠে এসে লেখকের কল্পজগতে এক কল্পচিত্র সৃষ্টি হয়। সে আবেগ তাড়িত হয়ে ওঠে তাঁর ভাবের জগতে তাঁর ভাবনা তাঁর কল্পকথায়।
আমরা বলেছি যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বস্তুজগত মানুষের মননে কল্পজগতে প্রতিবিম্বিত হয়। সাহিত্যিক তাঁর পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করেন কল্পকথা কল্পচিত্র যা সুর ছন্দ লয়ে ভাষায় সেজে ওঠে সাহিত্যিকের সাহিত্য চর্চায়। বিশেষ করে কাব্যচর্চায়। মানুষের মনন সাহিত্যের মাধ্যমে বস্তুজগতের ও সমাজজীবনের কর্ম কাণ্ডকে অবলোকন করে তাকে নিজের ভাবনায় রাঙিয়ে নেয়। প্রশ্ন হলো কোনটা প্রধান। বস্তুলোক না মনলোক কোনটা সাহিত্য সৃষ্টিতে সাহিত্যের আধারে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? যারা সাহিত্য সৃষ্টিতে মনলোককে প্রধান বলে মনে করেন তাঁরা মনে করেন বস্তুজগত যেমনই হোক না কেন সাহিত্যিক তাঁর ভাবনায় তাকে যেভাবে দেখেন কল্পনায় তাকে যে ভাবে রাঙিয়ে নেন সেভাবে নিজের কলমে তাকে উপস্থাপন করেন।বস্তুজগতকে তাঁরা মনোজগতের প্রতিবিম্ব বলে মনে করেন। পাঠকের স্বাধীনতা আছে তাঁর মনন দিয়ে গল্প কবিতাকে নিজের মত বুঝে নেওয়ার।তার ফলে বিমূর্তভাবে গল্প কবিতাকে পরিবেশন করার সুযোগ থাকে, তাকে নিজের মত করে বুঝে নেয় পাঠক। লেখক যা বলতে চান তা না বুঝলেও তা যদি পাঠকের মননে আনন্দ উৎসারিত করতে পারে তবেই সাহিত্যিকের সাহিত্য পরিবেশন সার্থক বলে এঁরা মনে করেন। আর যাঁরা মনে করেন বস্তুজগতটা প্রধান তার আধারে কল্প কথার সমন্বয়ে সাহিত্য সৃষ্টি হয় তাঁরা বস্তুজগতকে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দিয়ে চেনার চেষ্টা করেন।মনোজগতকে বস্তুজগতের প্রতিবিম্ব বলে মনে করা হয়। যেটা যেমন তাকে পাঠক সেভাবে যেন দেখতে পারেন সেটাই চান। সাহিত্যিক সমাজের ভবিষ্যত গতিপথ নিয়ে ছবি আঁকতে পারেন। সাহিত্য সমাজের কাজে লাগে পরিবর্তনের দিশা দেখাতে পারে নেহাত পাঠকের মনোরঞ্জন করে না, নেহাত অস্পষ্ট অনিদ্দৃষ্ট বিমূর্ত ভাবে তাকে পরিবেশন করে না। করা উচিত না।
দেখা গেল বস্তু ও ভাবের এক দ্বিমুখী সম্পর্ক দেখা যায়। হেগেলের মত দার্শনিকরা বস্তু ও ভাবের মধ্যে ভাবকে প্রাধান্য দিয়ে জীবনকে জীবনের ভালমন্দকে ব্যাখ্যা করেছেন । তাঁর অনুগামী সাহিত্যিকরা সাহিত্য কর্মকে সাহিত্যিকের মনের রঙে রাঙানো বলে মনে করেন। রামায়ন মহাভারতে সাহিত্যিকের কল্পনায় চরিত্রের সৃষ্টি। তার বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। সেখানে মানুষকে দেবতার আসনে নয়তো রাক্ষস খোক্ষস বা অসুর বলে চিত্রিত করা হয়ছে। অপরদিকে বস্তুবাদী ভাবনায় বস্তু প্রাধান্য পায়। বস্তুজগতকে সাহিত্যের আধার বলে বিবেচনা করা হয়। কার্ল মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন অনুসরণ করে সমাজের শ্রেণী দ্বন্দ্বকে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে মনে করেন। আর শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিতে সাহিত্যিকের কাঙ্ক্ষিত জীবন বোধকে দেখার চেষ্টা করেন।তাকে কেন্দ্র করে মার্কসবাদী সাহিত্য গড়ে ওঠে যেখানে তথাকথিত শ্রেণীনিরপেক্ষ সাহিত্য সৃষ্টিকে শোষক সম্রদায়ের স্বার্থ সিদ্ধ করে, শোষণ নিপীড়নের হাতিয়ার বলে মনে করা হয়। তাঁরা মনে করেন শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণী নিরপেক্ষ সাহিত্য বলে কিছু হয় না।
পরাবাস্তববাদ ভাবনার বিকাশ :
আমরা বলেছি যে পরাবাস্তববাদ দর্শনের মূল কান্ডারি ফরাসি কবি-সমালোচক আন্ড্রে ব্রেটন। এই দর্শন বলে যে মানুষের অবচেতন মনে কল্পজগতে প্রকৃত সত্য জন্ম লাভ করে, কল্পকথায় সেজে ওঠে। জীবনের বাস্তব সত্যকে রূপকের মাধ্যমে তুলে আনতে চায় সাহিত্য শিল্পীর কল্পকথায়, তাকে সাজিয়ে তুলতে চায় নান্দনিক রূপ দিযে। এর আগে পরাবাস্তববাদ প্রাথমিক বিকাশ ঘটেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ডাডাবাদী কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সের প্যারিসে, ১৯২০-এর সময়কালে। এই ভাবনা তখন থেকেই ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় বিস্তারিত হতে থাকে সাহিত্য শিল্পের বিভিন্ন আঙ্গিকে। শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে সিনেমা জগতে এর অনুপ্রবেশ ঘটে। এর উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনীতির জগতেব জঞ্জাল থেকে উদ্ভাবিত মানবতাবিরোধী তথাকথিত মূল্যবোধকে অস্বীকার করে মানুষকে একটি নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করা। সেটাই পারে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল ভেঙে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে পৌঁছতে। এই সত্যে পৌঁছবার ভাবনাটাই আরও বিশদে প্রতিফলিত হয় পরাবাস্তুবাদের চেতনায়।
উল্লেখযোগ্য যে পরাবাস্তুবাদের সূত্রপাতের সূত্র ডাডা আন্দোলনের মধ্যে পাওয়া গেলেও ডাডা আন্দোলন যুক্তিবাদকে অস্বীকার করে কল্পলোকের মাধ্যমে ভাববাদকে প্রতিষ্ঠিত করে যা প্রগতি পরিপন্থী বলে ব্রেটনের মত পরাবাস্তুবাদের প্রবর্তকরা মনে করেন। তাঁরা কল্পলোকের সঙ্গে জীবনের বাস্তবতার সমন্বয় ঘটিয়ে যান্ত্রিক বস্তুবাদের বিরোধিতা করেন। বিজ্ঞানের তথা যুক্তিবাদের অপপ্রয়োগের কথা বলেন যদিও তাদের ভাবনায় ভাববাদের প্রাধান্য থাকায় কল্পনা সর্বস্বতার একটা প্রবণতা দেখা যায়। তবে তাঁদের ধারণায় যে কল্পলোক সেটার গুরুত্ব আমাদের জীবনে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। মার্ক্সবাদও মানুষের মনন ও কল্পলোককে অস্বীকার করে না সেটা আমরা আগে আলোচনায় দেখেছি।
মনে রাখতে হয় আন্দ্রে ব্রেটন ছাড়াও সাহিত্যে ও বিভিন্ন শিল্পকলায় পরাবাস্তুবাদের পৃষ্ঠপোষক হলেন পল এলুয়ার্ড, পিয়েরে রেভার্ডি প্রমুখ। এঁরা কবিতায় পরাবাস্তুবাদের চর্চার মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। যুক্তিবাদ নয় মনস্তাত্ত্বিক - অর্থাৎ অবচেতন - চেতন চিন্তা প্রক্রিয়ার সাহায্যে তাঁরা পরাবাস্তুবাদের চর্চা করেন। তাঁদের ভাবনায় কল্পলোকে বিচরণ ও সেখানে নান্দনিক পথে সাহিত্য শিল্পকে তুলে ধরা ছিল চমকপ্রদ যা পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে।তবে, চিত্রকলার জগতে পরাবাস্তুবাদ সবচেয়ে বেশী সাফল্য লাভ করে। পরাবাস্তববাদী চিত্রকলা কেবল ডাডাবাদ দ্বারাই পুষ্ট হয়নি। হিয়েরোনিমাস বোশ এবং ফ্রান্সিসকো গোয়ার মতো পূর্ববর্তী চিত্রশিল্পীদের দ্বারা যেমন প্রভাবিভ হয়েছিল তেমনি ওডিলন রেডন, জর্জিও ডি চিরিকো এবং মার্ক চাগালের মতো সমসাময়িক সাহিত্যিক শিল্পীদের কল্পনাপ্রসূত এবং অদ্ভুত চিত্তাকর্ষক চিত্রকর্ম দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিল । মার্ক্সবাদী না হয়েও তাঁদের অনেকেই মার্ক্সবাদী ও মাৰ্ক্সের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যেমন আমরা পরর্তীকালে জীবনানন্দ দাশকে দেখি যার ওপর আমরা আমাদের আলোচনার এবার আসব।
বাংলাভাষায় পরাবাস্তববাদী সাহিত্যচর্চায় জীবনানন্দন্দ দাশ :
বাংলাভাষায় জীবনানন্দ দাশ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সমীর রায়চৌধুরী, রবীন্দ্র গুহ, সিকদার আমিনুল হক প্রমুখ কবিদের হাতে পরাবাস্তববাদিতা চৰ্চার বিকাশ ঘটে। রবীন্দ্রনাথের আঙ্গিকের এক বিকল্প আঙ্গিক বাংলার কবিতা সাহিত্যে বিকাশলাভ করে। বর্তমান সময়ের আল শাহারিয়ার জিদনি, মারজুক রাসেল, সাইম রানা, মাদল হাসান, ফেরদৌস মাহমুদ, বিজয় আহমেদ, আমজাদ সুজন প্রমুখ কবিগণও, সচেতন বা অবচেতন মনে সীমিতভাবে হলেও কবিতাচর্চায় পরাবাস্তুবাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন।
বাংলা ভাষায় পরাবাস্তুবাদ প্রসঙ্গে আলোচনায় জীবানানন্দ দাশের কথা না বললে নয় যিনি আধুনিক কবিতার একজন অগ্রদূত। আধুনিক কবিতায় ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ গল্পের ঢংয়ে তাকে উপস্থাপন করার বদলে অনুভূতিকে চিত্রকল্পের ছোঁয়ায় বিমূর্তভাবে কবিতায় উপস্থাপনের ওপর নজর দেওয়া হয় যার কল্পরূপের স্রষ্টা হিসেবে আমরা জীবনানন্দ দাশকে পাই। আবার যেমন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তীর কলকাতার যীশু কবিতায় তিনি লেখেন:
"ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে।/ স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে, টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।"
বলনে বিস্তার নেই, যেন এক খন্ড মুহূর্তের চমকপ্রদ উপস্থাপন। খুলে বলা নয়। যেন নীরব স্থির চিত্র পরিবেশিত হয়েছে। এক মননের অনুভূতির বিমূর্ত উপস্থাপন। কম বলেও অনেক বলা। আমরা জীবনানন্দের কবিতায় এক ধরনের ঝটকা উপস্থাপন পাই যেখানে তাঁর অনুভূতিকে বুঝে নিতে হয়, বুঝিয়ে দেওয়ার দায় থাকে না কবির। জীবানন্দ দাশের কবিতার একটা কথা 'আজ পৃথিবীর গভীর অসুখ' এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।কোন বিস্তৃত বিবরণ নেই কিন্তু এর মধ্যে কত গভীর কথা বলে দেওয়া।। বা 'ঘোড়া' কবিতায়, ''আমরা যাইনি মরে---- তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়'' ইঙ্গিতে বুঝে নিতে হয় তাঁর ভাবনায়।প্রকাশের ভাবটা বিমূর্ত কিন্তু মূর্ত হয়ে ওঠে জীবন ভাবনা। জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতায় দেখা যায় তাঁর মানস পটে যেন তিনি চিত্র শিল্পী। ছবি হয়ে প্রানবন্ত হয়ে ওঠেন।কবিমানস থেকে পাঠক মানসে রূপান্তরিত হয় সে ছবি। যেন একটা মুহূর্তের আচমকা ছবি। পড়েই মনে হয় সেগুলি চিত্রকলায় রূপান্তর করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।
যেমন, "কচি লেবু পাতার মত নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
কাঁচা বাতাবির মত সবুজ ঘাস — তেমনি সুঘ্রাণ—
হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে!" (ঘাস, বনলতা সেন)।
এই লাইনগুলির জন্মই হয়েছে শিল্পীর কবি মানসে স্থান পাবার জন্য। জীবনানন্দর কবিতার ওপর অনেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পীই ছবির সিরিজ এঁকেছেন বলে জানা যায়। সেরকমই তাঁর "আট বছর আগের একদিন" নামক অসাধারণ পরাবাস্তববাদী কবিতার একটা ছত্র হলো:
"হে প্রগাঢ় পিতামহী! আজও চমৎকার!
আমিও তোমার মত বুড়ো হবো, বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনো জল পার,
আমরা দু'জনা মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাড়ার"!
কবির অবচেতন মনোলোকের সব দ্বিধা দ্বন্দ্বের যেন অবসান ঘটিয়ে নিজের উত্তরণ ঘটিয়েছেন সচেতন মননে, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশে। কবি কল্পলোকে বিচরণ করতে করতে কল্পকথায় কী অসাধারণ মালা গাঁথেন কবিতায়। পরাবাস্তুবাদের আঙ্গিকে কী চমৎকার কবিতার নিবেদন।
কবি তাঁর কবিতায় প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলেছেন নানা রঙে নানা বর্ণে। বিশেষ করে গ্রাম বাংলার আকাশ বাতাস মাঠ ঘাট নদী ফুল বর্ণময় হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়। মাতৃরূপী প্রকৃতি বন্দনায় কোন কোন কবিতা প্রকৃতি পূজা হয়ে উঠেছে।বিভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতি যে বিভিন্ন সাজে সেজে ওঠে তা কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কল্পলোকে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের বিমূর্ত প্রতীক। তিনি প্রকৃতিকে ধরে রাখেন তাঁর কল্পলোকে। বাস্তবের প্রকৃতি কল্পলোকে অধিবাস্তব এক সৌন্দর্য হয়ে ওঠে যা কবিকে নিয়ে যায় পরাবাস্তুবাদের এক কল্পলোকে।
জীবনানন্দের কবিতা অবলম্বনে পরাবাস্তুবাদের (surrealism) দর্শন নিয়ে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। যে বাস্তবকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অবলোকন করা হয় তাকে মনোলোকে কল্পরূপের সাহায্যে কথামালায় নান্দনিক রূপ দেওয়াকে এক কথায় পরাবাস্তববাদ বলা চলে যা আমরা আগের আলোচনায় দেখেছি। পরাবাস্তুবদিরা মনে করেন সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায় বাস্তবকে চাঁচাছোলা ভাবে উলংগ করে তুলে ধরার মধ্যে শিল্পগুণ থাকে না। তাকে নানা রকম মূর্ত বিমূর্ত উপমায় সাহিত্যিকের মনোজগতে কল্পকথায় সাজিয়ে তুলে পরিবেশন করতে হয় যাতে তা নান্দনিক হয়ে ওঠে। অর্থাৎ বস্তুজগতের প্রতিফলন ঘটে সাহিত্যিকের মনোলোকে যা কল্পকথায় সেজে ওঠে নানা ধরনের উপমার সাহায্যে। এতে মানুষের অবচেতন মনে যে একটা কল্পজগত তাকে বাস্তব জগৎ থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সাহিত্য বিশেষ করে কবিতা নেহাত অন্তর্মুখী এক বিমূর্ত শিল্প কর্ম হয়ে ওঠে বলে পরাবাস্তুবাদের সমালোচনা করা হয়।বাংলা কাব্য সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতার আঙ্গিকে পরাবাস্তুবাদের দর্শনের রূপকার।এছাড়া আবদুল মান্নান সৈয়দ, সমীর রায়চৌধুরী, রবীন্দ্র গুহ, সিকদার আমিনুল হক প্রমুখ কবিগণের কবিতায় পরাবাস্তববাদিতার দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
বাস্তবের উর্দ্ধে উঠে জীবনকে চেতন অবচেতনের দোলাচলে কবি যখন কল্পকথাকে সাজিয়ে তুলে তাকে নান্দনিক রূপ দেন তখন তাকে আমরা অধিবাস্তবতার আঙ্গিকে বিচার করি। একেই পরাবাস্তুবাদের কবিতার আঙ্গিক বলে ভাবা যেতে পারে যেখানে বস্তুবাদ থেকে ভাববাদ বেশী গুরুত্ব পেলেও বাস্তব আর কল্পকথার মধ্যে একটা মেলবন্ধনের চেষ্টা থাকে। চেতন অবচেতন মনের মধ্য যে বিরোধ তা দূর করার কথা বলা হয়। জীবনানন্দ দাশের কাব্যচর্চায় এই পরাবাস্তুবাদ বিশেষ গুরুতপূর্ন।
রবীন্দ্র যুগে জন্মগ্রহণ (১৮৯৯-১৯৫৪) করেও রবীন্দ্র প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ এক নতুন আঙ্গিকে জীবনানন্দ দাশ কবিতা চর্চা করেন যা পরাবাস্তুবাদের দর্শনে গড়ে ওঠে। তাই বাংলার কবিতার জগতে একে পরাবাস্তুবাদধর্মী আঙ্গিক বলা চলে।
আমরা জানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানব ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা করেছে। মানিবতাকে পদীদলত করেছে। একই সঙ্গে বিধ্বংসী রুশ বিপ্লব ভবিষ্যতের নতুন দিশা দেখিয়েছে। জীবনানন্দ দাশ সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ জিগির মানবতাবিরোধী ধ্বংসাত্বক কাজকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। মার্ক্সবাদের প্রতি তাঁর আস্থা দেখা যায়। কিন্তু বাংলায় কাব্যচর্চায় পরাবাস্তুবাদী দর্শনের একনিষ্ঠ রূপকার ছিলেন যা মার্ক্সবাদী আঙিকের অনুরূপ নয়।
বিশ শতকের প্রথম বিশ্বত্তর যুগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালের সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্যবোধের অবক্ষয় জীবনানন্দকে কাব্যের জগতে নতুন পথে এগোতে বাধ্য করে। জীবনের জটিল সমীকরণের ফলস্বরূপ ক্লান্তি, অবসাদ, নৈরাশ্য, নৈরাজ্যকে জীবনানন্দ রূপ দিয়েছেন তাঁর কবিতায়। চেতনার এক অজানা রাজ্যে তাঁর প্রবেশ এই নতুন আঙ্গিকে কবিত চর্চার দৌলতে।
জীবনানন্দ একদিকে জীবনকে কাব্যে রূপায়িত করতে প্রকৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তেমনি তাঁর মনোজগতের চেতন অবচেতন মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মুখে কবিতা চর্চায় হয়ে উঠেছেন তিনি অধিবাস্তববাদী। পরবাস্তুবাদের উপাসক। তিনি চেয়েছেন অন্তর্জগতের তথা মনোজগতের সঙ্গে বহিঃর্জগতের বস্তুবাদের মেলবন্ধন ঘটাতে। কবি সারাজীবন তাঁর মনোজগতে সত্যের সন্ধান করেছেন। সমকালীন যুগের যান্ত্রীকতা ও জটিলতার বিরোধিতা করার জন্য তিনি আশ্রয় নেন পরাবাস্তবতাবাদে।
বাস্তবের দৈনন্দিন জীবনে পর্যদুস্ত কবি তাঁর কবি প্রতিভাকে যেন উৎসর্গ করেন পরাবাস্তব জগতকে। সেই কাব্য জগৎ দুঃখ, কষ্ট, হতাশা থেকে মুক্ত বলে পরাবাস্তুবাদীরা মনে করতেন। সেখানে তিনি যেমন বনলতাকে পেয়েছেন তেমনি পেয়েছেন সুচেতনাকে। তাঁর সমস্ত কবিতায় হতাশা, ব্যথা, কষ্ট ইত্যাদির বিবিধ প্রকাশ লক্ষ্য করি। তাঁর মনোজগতে যেন এক অজানা রহস্যয়ী বাসা বেঁধেছিল বনলতা সুচেতনা নামে।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর বোধ কবিতায় লেখেন:
আলো –অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে !
স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
কী সে বোধ? মনে হয় কবির একাকিত্ব বোধ। তিনি তাঁর কবিতার কবি মানস নিয়ে এক কল্পলোকে চলে যান। সেখানে এক অধিবাস্তব জগতে কল্পনার জগতে তাঁর বাস। তাঁর বোধ তাকে যন্ত্রনা এই নির্বাসনেড জন্য। বস্তু জগতকে তিনি অস্বীকার করতে পারেন না তাই এক বিরহ বেদনা তাঁকে যন্ত্রণা দেয়। নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর'পরে ?
স্বপ্ন নয়,- শান্তি নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে!
তিনি তাঁর বাস্তবের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা হেতু যে সীমাবদ্ধতা তা জানেন। তাঁত বোধ তাকে জানান দেয়:
সকল লোকের মাঝে ব'সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধাঁ ?
অতীবস্তুবাদের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবন,
চেতন অবচেতন মনের মধ্যে যে দ্বন্দ বিরোধী তা ভাষা পায় কবিতায়। প্রাণবন্ত হয়ে তা কবিতায় সেজে ওঠে।
বনলতা সেন কবিতায় তিনি তাঁর কল্পলোকের এক পথিক। হেঁটে চলেন সীমাহীন পথ যেন অনন্তের পথ ধরে তাঁর হেঁটে চলা। কিন্তু তিনি যখন বাস্তবে নেমে আসেন তখন জীবনের অনিবার্যতা মৃত্যুকে তিনি অবলোকন করেন যাকে তিনি তুলে ধরেন কবিতায়।
বনলতা সেন কবিতার প্রথম ও শেষ পংক্তি আমরা তুলে ধরতে পারি তাঁর এই দ্বৈত সত্তা চিনে নেওয়ার জন্য:
বাস্তবের দৈনন্দিন জীবনে পর্যদুস্ত কবি তাঁর কবি প্রতিভাকে যেন উৎসর্গ করেন পরাবাস্তব জগতকে। সেই কাব্য জগৎ দুঃখ, কষ্ট, হতাশা থেকে মুক্ত বলে পরাবাস্তুবাদীরা মনে করতেন। সেখানে তিনি যেমন বনলতাকে পেয়েছেন তেমনি পেয়েছেন সুচেতনাকে। তাঁর সমস্ত কবিতায় হতাশা, ব্যথা, কষ্ট ইত্যাদির বিবিধ প্রকাশ লক্ষ্য করি। তাঁর মনোজগতে যেন এক অজানা রহস্যয়ী বাসা বেঁধেছিল বনলতা সুচেতনা নামে। তাঁর এই কাব্যিক চরিত্র নীচে আমার একটা কবিতায় তুলে ধরার চেষ্টা করলাম:
অধিবাস্তবতায় জীবনানন্দ
মনের কল্প সুন্দরী ভেসে বেড়ায়
জীবন ভাবনার বুনন তোমার চেতনায়
চেতন অবচেতনের সঙ্গম মেলা সে জগতে
এ যে কল্প স্বর্গ তোমার
মনন তোমার কল্পনার মালা গাঁথে স্বপনে
নিংড়ে নাও জীবনের বাস্তবতা
বসাও তাকে বিমূর্ততার নন্দন কাননে
সে যে তোমার অধিবাস্তবতা
কল্পনার মায়াজালে বাঁধা তোমার কবিতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন