আত্মকথা
স্তুতি সরকার
বনেদি বাড়ির একমাত্র নাতনী জন্মালাম বাবার বাবা, মা, মামা, কাকা, বাবার ভাই বোন বাবার খুড়তুতো , মামাতো ভাই বোনের এক বিরাট যৌথ পরিবারে র এক মাত্র মেয়ে । জন্মের সময়ে বাড়িতে শাঁখ বেজেছিলো। পড়াশুনো, গান বাজনা, আঁকা, খেলাধুলা তে তুখোড় ছিলাম। স্কুলে পড়তে স্পোর্টস এ অনেক প্রাইজ পেয়েছিলাম। ( গভর্মেন্ট থেকে ৩ স্টার সার্টিফিকেট পেয়েছি।)।
জীবনে কিন্তু অনেক টুইস্ট এসেছে পরবর্তী দিনগুলোতে।
অল্প বয়সে স্কুলে পড়তে বিয়ে হয়ে যায়। বাল্যবিবাহ বলা চলে। ১৯৭২ সালে স্কুল পাস ও একই বছরে বিয়ে হয়। কিছু বছরের মধ্যেই একমাত্র ছেলের জন্ম। তখনই হয়তো জীবন থেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু না। পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকি। জয়েন্ট ফ্যামেলিতে শ্বশুর বাড়িতে থাকতাম। ছেলে বাপের বাড়ি তে বড়ো হতে থাকে। পরে ছেলে যখন একটু বড়ো হলো, আমার বিএ অনার্স কম্প্লিট। ছেলেকে নিজের কাছে এনে রাখি । ওর স্কুল শুরু হয়। পড়ার সঙ্গে আঁকা, আবৃত্তি, গীটার, তবলা, স্কেটিং এ শিক্ষালাভ করে। ফার্স্ট হতো সব কিছুতেই। আমিও তখন এম এ পড়া আবার শুরু করি। ।.. দিন কাটে।।
বললাম না- আমার জীবনটা স্মুথ ছিলো না। স্বামী অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। হঠাৎ...
জীবনের ছন্দপতন ঘটে গেলো। এক মিনিটের মধ্যেই ম্যাসিভ হার্ট অটাকে স্বামীর মৃত্যু। । ছেলে তখন ক্লাস টুয়েল্ভ এর ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে। কএকটা পরীক্ষা তখনো বাকী। উইদাউট এনি নোটিস ছন্দ পতন। এক মিনিটের মধ্যেই আমার অতো ভালো মানুষ স্বামীর মৃত্যু হয়। আমার তখন ৩৬ বছর বয়স। স্বামীর ৪২ বছর। ছেলে ১৭ বছরে বাবাকে হারালো। ওই টিনএজ বয়সে ওর চোখের সব স্বপ্ন নিভে গেলো।আমার কোনো সেন্স ছিলো না প্রথম কিছুদিন। তারপর যখন ছেলের রেজাল্ট বেরুলো হায়ার সেকেণ্ডারীর, অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট, তখন যে কি ভাবে হাউস ওয়াইফ আমি নিজেকে বাস্তবের প্রতিকূলতার মধ্যে আবিষ্কার করলাম একটা নিরিহ প্রায় অবুঝ টিনএজ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে অন্ধকারময় বিপদশঙ্কুল সংসার সমুদ্রে সাঁতার কাটতে আরম্ভ করতে হবে! হাউস ওয়াইফ আমি। একটিমাত্র ছোটো ৭৪০ স্কোয়ারফুটের ফ্ল্যাট আমার অনেস্ট স্বামী রেখে গেছেন। সামান্য কিছু সঞ্চিত অর্থ নিয়ে পথে নামলাম।
আমার ছেলে জয়েন্টে বাইরে মেডিকেল পড়তে চান্স পেয়েছিলো।
তখন তো বাঙালী বাড়ির অল্প বয়সী বিধবা আমি। দেখতেও সুন্দরী ছিলাম। আমার সব দিক থেকেই বিপদ এসে উপস্থিত।
একমাত্র দেওর , (ওর সঙ্গে আমার একমাত্র বোনের বিয়ে হয়েছে, ) বলল ছেলেকে অর্ডিনারি কলেজে ভর্তি করে দাও।বিএ বা বিএস সি বা বি-কম্ পড়ুক। তখন পাশে কেউ নেই, হাউস ওয়াইফ আমি, কোথায় পরামর্শ নেবো জানিনা, নিজের বাস্তব জ্ঞান নেই, এতো টাকা কোথায় পাবো। এই অবস্থায় ছেলেকে ভূবনেশ্বরে ইন্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করলাম । ইলেকট্রনিক্স এণ্ড টেলিকমিউনিকেশন নিয়ে ভর্তি হলো।
তখন পদ্মাখাস্তগীর কলকাতা হাইকোর্ট এ চীফ জাস্টিস হয়েছিলেন। উনি এগিয়ে আসলেন। বললেন, ' তুমি অনেক ভালো ভালো হাতের কাজ করো তো, একটা একজিবিশান করো,' আমি আমার বাড়িতে আমার জিনিস নিয়ে একজিবিশান করলাম, উনি ইনোগরেট করে দিলেন। ৩ দিনের একজিবিশনের শেষে ফটোগুলো নিয়ে ছেলেকে হস্টেলে রাখতে ট্রেনে - শ্লিপার ক্লাশে উঠে বসলাম। পুরী এক্সপ্রেস। রাত্রি ১০ টায় ছাড়ে , সকাল ৫ টায় ভূবনেশ্বরে পৌঁছে যায়। ট্রেনে উঠে ছেলে আমাকে বলছে, ' মাম্মি, আমরা খুব গরীব হয়ে গেছি, না? ' শ্লিপার ক্লাসে যাচ্ছি! ' .. সামনের উল্টো দিকের বেঞ্চে একটা অল্প বয়সী মেয়ে বসে সব শুনছিলেন। তারপর ছেলে এক্সজিবিশনের ফটো গুলো বার করে আমরা ২ জনে দেখছিলাম। হঠাৎ ২ টো ফটো হাত ফসকে নীচে পড়ে গেলো। সামনের মেয়েটি ফটো ২ টো কুড়িয়ে নিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিলো। আমরা বিছানা করে শুয়ে পড়বো, মেয়েটি আমার ফটোগুলো দেখতে চাইলো। দেখার পরে আমাকে জিগেস করলো , 'এতো রখম জিনিষ কাদের তৈরী। আমার নিজের হাতে তৈরী বললাম। বলল- আমি বুবু সাহা। অক্সফাম এ কাজ করি। আমার বন্ধুর ভদ্রকে একটা এনজিও আছে, ওখানে আপনি হাতের কাজ শেখাবেন? '
সেই শুরু। কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া, কোনো প্রফেশনাল ট্রেনিং ছাড়া, নিজের বাড়ির মা , ঠাকুরমার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে ট্রেনিং শুরু করলাম। তারপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
শর্ ঢঙ এ বলি। ভূবনেশ্বরে ৯০০০ স্কোয়ার ফিট জমি কিনে একটা ট্রেনিং কাম প্রডাকশন সেন্টার শুরু করলাম। অনেক বড়ো লড়াই লড়ে অনেক চ্যালেঞ্জ এর মধ্য দিয়ে বিরাট বিরাট সাফল্য পেতে পেতে দীর্ঘ জীবন কাটাতে থাকলাম। গভর্ণমেন্টের এনামেল জিজাইনার হয়ে অল ইণ্ডিয়াতে ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট করে বেড়াতে লাগলাম। এদিকে গভর্ণমেন্টের বিভিন্ন সেক্টার থেকে ট্রেনিং পেতে থাকলাম শর্ট টার্ম, লংটার্ম ইাত্যাদি। আমি ট্রেনিং এর পরে সব স্টুডেন্টসদের মার্কেট সাপোর্ট দিতে থাকলাম। ওড়িষার একমাত্র স্প্যাস্টিক স্কুলেও ট্রেনিং দিলাম। তারপর এলো সেই দিন। সমাজের একদম নিচুতলার মানুষরা এসটি এসসি কর্পোরেশনের মাধ্যমে এমন কি স্ক্যাভেঞ্জার দের ও ট্রেনিং দিতে শুরু করলাম। ১০০% সাকসেস।
আমার মা র অনুরোধে কলকাতাতেও কাজ শুরু করলাম। দেখলাম বড্ড পলিটিক্স।
তখন আমি প্রেসিডেন্সি জেল, লিলুয়া হোম নিয়ে কাজ শুরু করলাম। কতো যে অসহায় মানুষ পাশে এসে সাহায্য চাইতো- একসময়ে ভুলেই গেলাম আমার সেই অতীত-
যেদিন টিনএজ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম ট্রেনে উঠেছিলাম। ট্রেন চলতে যখন শুরু করলো, আমার মাথাটা তখন ঘুরছিলো, পা এর তলার মাটি সরে যাচ্ছে মনে হচ্ছিলো। .. এখন আমি নিজেই তো একটা ইনস্টিটিউট ! সকলে বলে। আমাকে ওড়িসা গভর্মেন্ট ওনেক কিছু দিয়েছে। একটা আই টি আই পেলাম।৮ টা স্ট্রিম। নেটে ঘুরতে লাগলো 'স্তুতি আই টি সি'!
বললাম না- ওই যে আমার জীবনের আপস এণ্ড ডাউন-.আমার মামণি (মা) বেঁকে বসলেন- জীবনের শেষের দিকে এসে আমাকে কলকাতায় সব কিছু গুটিয়ে ফিরে আসতে বললেন। ।
আমার ছেলে তখন খুব দাঁড়িয়ে গেছে। ওর বিয়ে হয়ে গেছে এম বি এ পাস মেয়ের সঙ্গে। একটা নাতি আর একটা নাতনী। মিষ্টি সংসার। বৌমার ও অলএলং ফার্স্ট রেজাল্ট। সিনিয়ার পোস্ট এ চাকরী করে।
আমার ছেলেও আইটির একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাকরি করছে।
..
এই হলো আমার জীবন।
একবার এতো টাকা ট্যাক্স দিলাম যে মোদি গভর্ণমেন্ট আমাকে ব্রোঞ্জ সার্টিফিকেট দিয়েছেন।
কলকাতার পুরো পশ্চিমবঙ্গের হ্যাণ্ডলুম আর হ্যাণ্ডিক্রাফ্টস এর আর্টিজেনদের নিয়ে আমি আমার হাসব্যাণ্ডের নামে 'অশোক কুমার সরকার মেমোরিয়াল এওয়ার্ড ' গিভিং সেরিমণি করেছি ইন কোলাবরেশান উইথ ইণ্ডিয়ান মিউজিয়াম, কোলাবরেশন উইথ ইজারসিসি , হ্যাণ্ডিক্রাফ্ট কর্পোরেশনের সহযোগিতায় প্রগ্রাম করছিলাম। শরীর খারাপ হেতু কিছু বছর কাজটা বন্ধ আছে। আবার আপনাদের ইন্সপিরেশান পেয়ে কাজ শুরু করবার ইচ্ছায় রইলাম। ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন