আগুন-পাহাড়ের ইতিকথা
-ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়
ঘুমন্ত বসতিতে হঠাৎ জেগে উঠেছে এক দানব। অন্ধকারের বুক চিরে সে বেরিয়ে এসেছে উত্তপ্ত আগুনের জ্বলন্ত বিভীষিকা নিয়ে। একটা বিশাল ড্রাগন যেন তার বিশাল হাঁ বিস্তার করে উদ্গিরণ করে চলেছে আগুনের অন্তহীন স্রোত। শীতকালে অন্ধকার রাস্তার ধারে টায়ার পুড়িয়ে শরীর গরম করার দৃশ্য যারা দেখেছে খানিকটা সেই রকম। তবে আগুনের পরিমাণ এখানে পাহাড় প্রমাণ বিশাল। এতই বিশাল যে তা কল্পনার বাইরে।
এটা এতক্ষণে সবাই নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে যে এই দানবটি হল আসলে একটি বিশাল পাহাড়ের মুখ দিয়ে লেলিহান শিখা বিস্তার। আগুন পাহাড়ের চুড়োর মুখটি হঠাৎ ফেটে গিয়ে উত্তপ্ত গলিত লাভা আর বিশাল পরিমাণ গ্যাস বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। এই গ্যাস যেমন কিছু পরিমাণে অদাহ্য তেমনি বেশ কিছু পরিমাণে দাহ্য। এই দাহ্য গ্যাস প্রচন্ড উত্তাপে প্রজ্জ্বলিত হয় অর্থাৎ জ্বলতে থাকে আর জ্বলতেই থাকে। এক্ষেত্রে ড্রাগনের মুখ হল ফেটে যাওয়া পাহাড়ের চুড়ো। আর তার মুখ দিয়ে বেরোন আগুনের হলকা হল প্রজ্জ্বলিত এই গ্যাসের স্তূপ। ড্রাগন একটি কল্পিত বিষয় হলেও এটি একটি হৈ চৈ ফেলে দেওয়া বাস্তব।
মনে করা যাক একটি হাঁড়িতে দুধ ফুটছে। কিন্তু কেউ নজর না দেওয়ার ফলে দুধ উথলে উঠছে। হাঁড়ির মুখের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসছে সেই বায়ুভরা দুধের ফেনা। প্রথমে ফুলে বেলুনের মত হল তারপর সেটা ফেটে ক্রমে গড়িয়ে যেতে লাগল হাঁড়ির চারপাশ দিয়ে। খুব ঠান্ডা হলে দেখা যাবে হাঁড়ির গায়ে শক্ত হয়ে সর জমে আছে। সেই সঙ্গে উড়তে লাগল প্রচুর ধোঁয়া (জলীয় বাষ্প ও বাতাস)।
আগ্নেয়গিরির অগ্নি উদ্গিরণ খানিকটা একই ঘটনা। তবে হাঁড়ির দুধ উঠলে যাওয়া ঘটনাটি ঘটে আমাদের অসাবধানতায় আর এটি খুব সামান্য। এতে ক্ষতি নিতান্তই সামান্য কিছু দুধের অপচয়। এই ক্ষতি ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক এবং অতি ক্ষুদ্র স্থানে সীমিত। বড় জোর দুধ পোড়ার গন্ধে আশপাশের কিছু মানুশ বিরক্ত আর বিব্রত হতে পারে।
কিন্তু আগ্নেয়গিরির অগ্নি-উদ্গিরণ একটি স্বাভাবিক ও ভৌগোলিক ঘটনা। এটি অতি বিশাল আর ভয়াবহ আর এর ক্ষতি সুদূর বিস্তৃত। এই ঘটনার উৎপত্তিস্থল ভূগর্ভ। মাটির নিচে গভীর ভূগর্ভে জমে থাকা গ্যাসের পুঞ্জ, গলিত ধাতু ও শিলা ইত্যাদি প্রচন্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে ওপরের দুর্বল শিলা ফাটিয়ে উঠে পড়ে একটি তৈরি করা সুড়ঙ্গ পথে পাহাড়ের ওপরের চুড়োর মুখে। সেটাকেও ফাটিয়ে ঠিক উথলে পড়া দুধের মতই গড়িয়ে পড়তে থাকে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে। সঙ্গে থাকে ধোঁয়া আর আগুনের পাক। বিশাল উত্তাপ আর আলোর ঝলক। আর উড়ন্ত ছাই। মাটির ওপর দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত গড়িয়ে যায় এই উত্তপ্ত ঘন তরল বা বলা যায় অর্ধঘন তরল যাকে লাভা বলা হয়। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার জমি পুড়ে ছাই হয়। বনভূমি বিনষ্ট হয়। জলা শুকিয়ে যায়। মাঠের ফসল পুড়ে যায় আর জমি হয় অনুর্বরা। লাভার স্রোত ঠান্ডা হয়ে কঠিন আকারে জমা হয়। ঠিক যেমন হাঁড়ির গায়ে শক্ত হয়ে জমা হয় দুধের সর। এই পাথরের মত কঠিন লাভার স্তর ভেদ করে ভেতরের মাটি খুব শক্ত। তাই চাষ-আবাদ করা সম্ভব নয় আর। চাষের জমিও রুক্ষ আর বন্ধা হয়ে যায়।
মনে রাখতে হবে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত স্বাভাবিক ঘটনা হলেও তা ভৌগোলিকও বটে। অর্থাৎ যে কোনো স্থানের যে কোনো পাহাড় ফেটে অগ্নুৎপাত হয় না। স্থানের ভৌগোলিক অবস্থান অনেকাংশে এর জন্যে দায়ি। অগ্নুৎপাত যেমন পাহাড়ের চুড়োয় হতে পারে তেমনি হতে পারে সমতলেও। এমন কী হতে পারে সাগরের গভীর জলেও। সেই বিষয়ে আসছি পরে কিন্তু তার আগে বলে নিই কটা কথা।
যে সমস্ত পাহাড়ের মুখ থেকে অগ্নুৎপাত হয় তাদের বলে আগ্নেয়গিরি বা volcano. গলিত ধাতব স্রোতকে বলে লাভা। তবে লাভা যখন ভূগর্ভে থাকে তখন তাকে বলে ম্যাগমা। এই ম্যাগমা জ্বালামুখ দিয়ে গড়িয়ে লাভা হয়ে ছড়িয়ে আর গড়িয়ে পড়ে। পাহাড়ের চুড়োর যে ফাটা মুখ দিয়ে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে তাকে বলে জ্বালামুখ বা crater.
আগ্নেয়গিরির প্রকারঃ
প্রধানত তিন ধরণের আগ্নেয়গিরি দেখা যায়। প্রথম, জীবন্ত বা Active. এগুলি থেকে যে কোনো সময় বা মাঝে মাঝেই অগ্ন্যুৎপাত ঘটে থাকে। হাওয়াইয়ান দ্বীপের কিলাউইয়া, ভূমধ্য সাগরে মাউন্ট এটনা (একশ নয় বছর উদ্গীরণ করে নি), গুয়েতেমালার সান্তা মারিয়া (একশ এক বছর উদ্গীরণ করে নি), মাউন্ট নিয়ামুরা গুয়া আফ্রিকার একটি ভীষণ জীবিত আগ্নেয়গিরি।
দ্বিতীয়, নিদ্রিত বা সুপ্ত বা Dormant. এগুলি থেকে দীর্ঘকাল কোনো অগ্ন্যুৎপাত হয় নি। আবার কবে হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হবে না এমন কোনও ভরসাও নেই। ইয়েলোস্টোন নামে আগ্নেয়গিরিটির প্রায় সাত লক্ষ বছরেও কোনও অগ্নুৎপাতের রেকর্ড নেই। টোবার তিন লক্ষ আশি হাজার। সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াসের নাম অনেকেই শুনে থাকবে। ৭৯ খৃষ্টাব্দে যে আগ্নেয়গিরিটি শেষ অগ্নি উদ্গিরণ করে হারকুলেনিয়াম আর পম্পেই নামে দুটি বিশাল শহর ধ্বংস করেছিল যা উদ্গিরণের আগে কিন্তু উদ্যান আর আঙ্গুর লতায় সুন্দর ভাবে সুন্দর প্রাকৃতিক শোভায় শোভিত ছিল।
তৃতীয়, মৃত বা extinct. এই জাতীয় আগ্নেয়গিরিগুলি সম্পূর্ণ অকেজো। এরা আর কখনোই উদ্গিরণ করবে না। সেইজন্যে এদের মৃত নাম দেওয়া হয়। এই সব পাহাড়ের পাদদেশে এমন কী ওপরেও গজিয়ে উঠতে পারে বসতি। জ্বালামুখ সম্পূর্ণ বন্ধ। হয়ত আগাছা জঙ্গলে পরিবৃত। তবে এ সত্ত্বেও কিন্তু এই জাতীয় আগ্নেয়গিরিকে বিশ্বাস করা যায় না। হয়ত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আবার হঠাৎ অগ্নি উদ্গিরণ হল। এই ব্যবধান হাজার হাজার বছরও হতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এমন বহু মৃত আগ্নেয়গিরি আছে। তাছাড়াও আছে জার্মানিতে হোয়েন্টোয়াইল, নিউ মেক্সিকোতে শিপ রক, নেদারল্যান্ডে আছে জুইডোয়াল ভলক্যানো, স্কটল্যান্ডে আছে এডিনবার্গ ক্যাসল।
উদ্গিরণের কারণ (cause of eruption):
গভীর ভূগর্ভে যখন ম্যাগমা নামে অতি উত্তপ্ত গ্যাস ও গলিত ধাতু ও শিলা ইত্যাদির একটি বিশাল মাপের সঞ্চয় প্রচন্ড চাপের ফলে তার ওপরের কোনও দুর্বল মাটি পাথরের স্তরকে ফাটিয়ে দেয় তখন সে একটি সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করে বাইরে বেরোবার পথ খোঁজে। সাধারণত এটি একটি পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করার চেষ্টা করে আর যতই উঠতে থাকে ততই তা অধিক বিস্তৃতি লাভ করে। অর্থাৎ একটি cone বা মোচার মত আকার ধারণ করে। ম্যাগমার তরল ও অর্ধতরল যখন জ্বালামুখ দিয়ে বেরিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে থাকে তখন তাকেই লাভা বলা হয়।
উদ্গিরিত সামগ্রী (erupted matters):
মূলত জ্বলন্ত গ্যাস, পোড়া ছাই আর গলিত ধাতু ও অন্যান্য সামগ্রী। শেষোক্ত সামগ্রীগুলিকে বলে লাভা (lava). জ্বলন্ত গ্যাস তৈরি করে আগুন আর আলো। ছাই উড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে আকাশে আর আশে পাশে। লাভার স্রোত জ্বালামুখ থেকে গড়িয়ে নামতে থাকে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে। তবে ছাই মানে শুধু হালকা উনুনের ছাইয়ের মত মনে করলে খুব ভুল হবে। এই ছাইয়ের মধ্যে বড় বড় পাথরের টুকরোও থাকতে পারে যেগুলো প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার দূরেও ছিটকে গিয়ে পড়তে পারে।
ম্যাগমার গ্যাসীয় উপাদানঃ
ম্যাগমায় বেশ কিছু গ্যাসীয় পদার্থ থাকে। মূলত এই সমস্ত গ্যাসীয় পদার্থের চাপেই ম্যাগমা পাথরের স্তরকে ফাটিয়ে দেয়। যেমন করে উথলে ওঠা দুধ তার ওপরের সরকে ফাটিয়ে দেয়। এই গ্যাসগুলির মধ্যে যেমন থাকে অদাহ্য গ্যাস তেমনি কিছু থাকে দাহ্য গ্যাসও। সালফার ডাই অক্সাইড ও কার্বন ডাই অক্সাইড উপস্থিত থাকে এবং এরা অদাহ্য। উপস্থিত থাকে হাইড্রোজেন আর কার্বন মনোক্সাইড যারা দাহ্য গ্যাস। এগুলি ছাড়াও থাকে হিলিয়াম, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড, হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড ও হাইড্রোজেন সালফাইড। শেষোক্ত গ্যাসগুলির পরিমাণ অবশ্য খুব কম। কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন প্রভৃতি দাহ্য গ্যাসগুলির জন্যে সৃষ্টি হয় প্রচন্ড আগুনের শিখা ও উত্তাপ। কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড অদাহ্য গ্যাসগুলি প্রচন্ড উত্তাপে আয়তনে বৃদ্ধি পেয়ে সৃষ্টি করে বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণের ফলেই, এমনকি, বড় বড় পাথরের খন্ডও বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিটকে পড়ে।
আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণ ও পরিবেশ দূষণঃ
ম্যাগমার মধ্যে উপস্থিত গ্যাসগুলি বাইরে বেরিয়ে এসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হাইড্রোজেন আর কার্বন মনোক্সাইড জ্বলার সময় বাতাস থেকে প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন শোষণ করে। ফলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ হঠাৎ হ্রাস পায়। নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড এবং হাইড্রোজেন দহনে উৎপন্ন জলীয় বাষ্প বাতাসে গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। আমরা সকলেই জানি এই দুটি গ্যাসই হল সবচেয়ে বড় গ্রীন হাউস গ্যাস আর গ্রীন হাউস গ্যাসের বৃদ্ধির অর্থ বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি। তবে এটি নিতান্তই প্রাকৃতিক ঘটনা বলে মানুষ নাচার। তবে অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে মানুষ যেমন ভাবে লড়াই করে ঠিক তেমন ভাবেই এর সঙ্গেও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে মানুষকেই। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বন্ধ করা হয়ত সম্ভব নয় তবে এর কুপ্রভাব হ্রাস করার চেষ্টা সে কিন্তু চালিয়ে যেতেই পারে।
ম্যাগমার ধাতব ও রাসায়নিক উপাদানঃ
আগেই বলেছি ম্যাগমা হল অতি উচ্চ চাপ ও তাপে রক্ষিত কঠিন, তরল ও আধা-তরল আর গ্যাসের মিশ্রণ। ভূগর্ভ হল বালি, পাথর আর নানা ধাতুর সঞ্চয়। সুতরাং ম্যাগমায় এগুলি মিশ্রিত থাকাই স্বাভাবিক। বালি অর্থাৎ সিলিকা বা সিলিকন ডাই অক্সাইড, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন অনেক বেশি পরিমাণে (যেহেতু এগুলি হল রক বা শিলার মূল উপাদান), সামান্য পরিমাণ সোডিয়াম ও পটাশিয়াম। আর গলিত সালফার। বিশেষ ভাবে যে অঞ্চলের ভূগর্ভে সালফার বা গন্ধকের প্রচুর সম্ভার আছে। সালফার অধাতু হলেও তার সঞ্চয় কিন্তু ভূ-গর্ভেই। এমন কী গভীর সমুদ্রতলের ভূগর্ভেও সালফার পাওয়া যায়। ম্যাগমার গড় তাপমাত্রা ৮০০ থেকে ১২০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই বিশাল পরিমাণ তাপাংকের কারণেই সমস্ত কিছু বিগলিত হয়ে ম্যাগমায় উপস্থিত থাকছে। স্বয়ং ভূগর্ভই কিন্তু এই উত্তাপের স্রষ্টা।
অগ্নুৎপাতের কুফলঃ
একটা মারাত্মক কুফল যে পরিবেশ দূষণ তা তো আগেই বলেছি। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ দুই ভাবেই উষ্ণতা বৃদ্ধি হয়। প্রবল উত্তাপ নিয়েই তো বেরোয় লাভাস্রোত। দ্বিতীয়তঃ দাহ্য গ্যাসগুলির দহনে তাপ উৎপন্ন হয়। এগুলি হল তাপের প্রত্যক্ষ উৎপাদন। গ্রীনহাউস গ্যাসগুলির উৎপাদন হল পরোক্ষ ফল। উড্ডীয়মান ছাই, শিলা আর জ্বলন্ত লাভাস্রোত গড়িয়ে আসার ফলে জনপদ ও কৃষিজমি ধ্বংস। ব্যাপক প্রাণহানি। এগুলি শুধু সাময়িক নাও হতে পারে।
আকাশে বিভ্রাটঃ
ছাই শুধু আশেপাশেই নয় আকাশে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অঞ্চলে মাটি থেকে অনেক উঁচুতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে আকাশে ওড়া উড়োজাহাজের গতি ব্যাহত হতে পারে। ঊর্ধে উৎক্ষিপ্ত ছাই প্রচন্ড একটি তাপমাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয় আকাশে। সেই উচ্চ তাপমাত্রায় এরোপ্লেনের টারবাইনের বহিরাংশ গলে গিয়ে টারবাইন ব্লেডে জড়িয়ে গিয়ে ব্লেডের ঘূর্ণন ব্যাহত করে আর এরোপ্লেনের গতিকে বিপন্ন করে। ১৯৮২ সালে ইন্দোনেশিয়ার একটি আগ্নেয়গিরি মাউন্ট গালুংগুং-এর (Mount Galunggung)উদ্গিরণ, ১৯৮৯ সালে আলাস্কার মাউন্ট রেডাউট (Mount Redoubt)-এর উদ্গিরণ এই সমস্যাটিকে বিজ্ঞানীদের ভাবতে সচেষ্ট করে। ইন্টারন্যাশন্যাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (International Civil Aviation Organization (ICAO)নামে আন্তর্জাতিক বিমান চালনা প্রতিষ্ঠানটি নটি ভলক্যানিক অ্যাশ এডভাইসরি কেন্দ্র (Volcanic Ash Advisory Center (VAAC) স্থাপন করে আগ্নেয়গিরি থেকে নিঃক্ষিপ্ত ছাই পরিলক্ষণের জন্যে। এই কেন্দ্রগুলি নিয়মিত আকাশের ধোঁয়ার মেঘ পর্যবেক্ষণ করে পাইলটদের তা জানায় এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কী করণীয় তার উপদেশ দেয়। ১৯১০ সালে আইসল্যান্ডের একটি ভয়াবহ ভল্ক্যানিক ইরাপশনে উত্থিত ছাই থেকে ইউরোপে বিমান চলাচল ভীষণ ভাবে ব্যাহত হয়।
উদ্গিরণ কি শুধু পাহাড় থেকেই হয়? সব পাহাড় কি উদ্গিরণ-প্রবণ? উদ্গিরণ পাহাড়ের আকারঃ
এটা অবশ্যই ঠিক নয় যে কেবলমাত্র পাহাড় থেকেই উদ্গিরণ হবে। দুর্বল পৃষ্ঠ সমন্বিত সমতল ভূমিও উদ্গিরণ-প্রবণ হতে পারে। আবার এটাও ঠিক যে, যে সমতল পৃষ্ঠে উদ্গিরণ পর পর সংঘটিত হয়ে যায় সেই লাভা ও অন্যান্য জিনিসের স্তূপ জমতে জমতে সেটি একটি পাহাড়ে পরিণত হতে পারে। সব পাহাড় উদ্গিরণ-প্রবণ নয়। অতএব সব পাহাড় আগ্নেয়গিরি নয়।
কিছু বিশেষ ধরণের আগ্নেয়গিরি বা অগ্নি-উদ্গিরণঃ
১) সাগর গভীরে উদ্গিরণ (Submarine eruption or under water eruption): উদ্গিরণ প্রকৃতপক্ষে হয় ভূপৃষ্ঠে যেখানে দুর্বল একটি ভেন্ট বা নির্গম পথ পাওয়া যায়। এই নির্গম পথ দিয়ে ম্যাগমা চেম্বার ফেটে বেরোন ম্যাগমা নির্গত হয়। সাধারণত এই ভেন্ট পাহাড়ের নিচে পাওয়া যায় বটে তবে গভীর সমুদ্রতলে পেতে কোনও বাধা নেই। যদি তাই হয় তো উদ্গিরণ সেখানেই ঘটতে পারে। এগুলিকেই বলে সাগর-গভীর উদ্গিরণ। সাগরের তলদেশে বিশাল পরিমাণ জলের উপস্থিতির জন্যে অনেক সময় উদ্গিরণ অনুভূত না হতেও পারে। সাগর জলের প্রচন্ড চাপে এই উদ্গিরণ বেশ কিছুটা প্রতিহত হয়। নির্গত বাষ্প আর গ্যাসগুলি বায়ুমন্ডলে পৌঁছানোর সুযোগ পায় না কারণ তারা জলে মিশে যায়। নির্গত লাভা মুহূর্তে ঠান্ডা জলের সংস্পর্শে এসে সাগরতলে গড়াবার সুযোগ পায় না। তারা জমাট বেধে খন্ড খন্ড আকার ধারণ করে এই খন্ডগুলি অনেকটা মাথার বালিশের মত আকার ধারণ করার জন্যে এদের পিলো লাভা বা pillow lava নামে অভিহিত করা হয়। একটা কথা মনে রাখতে হবে পাহাড়চুড়োয় জ্বালামুখে যে উদ্গিরণ হয় সেই লাভা সহজেই পাহাড়ের গা বেয়ে একটানা প্রবাহে (continuous flow) গড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু সাগরের গভীর তলদেশে জলের বিশাল চাপ এই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বায়ুমন্ডলে এটি ঘটতে পারে না। যদিও জলে একটি কম্পন সৃষ্টি হয় আর যার কম্পাংক যথেষ্ট বেশি। জলের নিচের কম্পন মাপা হয় হাইড্রোফোন নামক যন্ত্রে। তাই এই যন্ত্রের সাহায্যে সহজে ধরা পড়ে সাগর-গভীর উদ্গিরণের অস্তিত্ব।
২) হিমবাহ-অভ্যন্তর উদ্গিরণ (Subglacial volcanoes): হিমবাহের নিচে উৎপন্ন ম্যাগমার উদ্গিরণ যখন হয় এবং যখন তা বরফের চাদরের ওপর দিয়ে গড়ায় তখন উচ্চ তাপে নিচের বরফ গলে যায় আর ওপরের লাভাস্তর ভেঙ্গে খন্ড খন্ড হয়ে যায়। আর ক্রমে জমা হতে থাকে। এইভাবে বারবার হওয়ার ফলে পাহাড়চুড়াটি প্রায় সমতল আকার ধারণ করে। এগুলিকে বলে টেবিল পাহাড় বা table mountain বা টুয়া (tuya). এগুলি আইসল্যান্ডে বেশি দেখা যায়। বৃটিশ কলোম্বিয়াতেও কিছু দেখা যায়।
৩) মাড ভলক্যানো (mud volcano): আশ্চর্যের বিষয় এই যে এই ধরণের উদ্গিরণে কোনও আগুন বা উত্তপ্ত লাভা কিছুই নির্গত হয় না। পরিবর্তে ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক গ্যাস এবং মাটি উপচে পড়ে এই ছিদ্রমুখের চারপাশে। আর এই মাটির স্তূপ কাদায় পরিণত হয় কারণ কিছু জলও বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। এই ধরণের উদ্গিরণ নিতান্ত নিরীহ প্রকৃতির আর খুব ধীর। এগুলি সাধারণত সামুদ্রিক উপকূলে তৈরি হয় যেখানে সামুদ্রিক প্রাণি ও উদ্ভিদ প্রচুর পরিমাণে মাটির নিচে পচতে থাকে আর প্রচুর জৈব গ্যাসের সৃষ্টি হয়। এই জৈব গ্যাসের প্রচন্ড চাপে একটি ছিদ্রমুখ (vent) তৈরি হয় আর এই গ্যাস বেরিয়ে আসে। চাপে এর সঙ্গে বেরিয়ে আসে প্রচুর মাটি আর জল। আন্দামানে বারাটাং বলে একটি দ্বীপে এই প্রকারের একটি মাড ভলক্যানো আছে।
আগুন-পাহাড় আর তার অগ্নি উদ্গিরণের কথা বলে শেষ করা যায় না। কিন্তু এটা কিন্তু মনে রাখা ভাল এই বিষয়ে নিরন্তর চলেছে গবেষণা। তাই যত কথাই লিখি না কেন এই প্রবন্ধে এটি কিন্তু কখনোই সম্পূর্ণ হবে না। অপেক্ষা করেই থাকবে এর বুকে নিত্য নতুন গবেষণালব্ধ কিছু লিপিবদ্ধ করার আশা অথবা আশংকা নিয়েই।
==================================
DR. ARUN CHATTOPADHYAY
181/44 G.T.Road (Gantir Bagan)
P.O.Baidyabati
Dist. Hooghly (PIN 712222)
Mobile 8017413028