ভগবান কই কাছাকাছি! এক-এক দেব-দেবীর নামের মধ্যে তারক, বিপদভঞ্জন, বিঘ্নশাশিনী, বিপত্তারিণী, দুর্গতিনাশিনী, অভয়দায়িনী, ত্রিপুরারি, মধুসূদন, ত্রিভুবনপালিনী, অসুরদলনী, বরাভয়প্রদায়িনী, ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু ইত্যাদি কত কত বিঘ্ননাশক বা কল্যাণকর বিশেষণ প্রয়োগ করে এসেছি আমরা যুগ যুগ ধরে; অথচ আজ যখন দুনিয়াজুড়ে প্রায় প্রতিটি দুয়ারে প্রবল বিক্রমে করাঘাত করছে করোনারূপ এক মহামারি, কোথায় অশুভবিনাশকারী দেববিক্রম, কোথায় জগৎব্যাপী মঙ্গলময় রূপ – কোথায় আশ্বাসের অভয়বাণী! সত্যিকার মহিমাপ্রকাশের এমন সুযোগে কোথায় তাঁরা!
আমাদের অজানা নয় যে কেবল মন্দির-মসজিদ-গির্জাদিই ঈশ্বরের আবাস নয়। তবু আমাদের বিশ্বাস এক আর বাস্তব অর। তাই বা বলি কী করে! আমাদের বিশ্বাসও সবসময় সে কথা বলে বা মনে রাখে কি? প্রতিটি মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের আবাস বলা হয়, উপনিষদ বলছে 'সোহম' –আমিই সে অথচ আমরা দেখছি গত অর্ধ শতকে কী হারে বাড়ল মূর্তিপূজা, দেবার্চনা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জাঁকজমক! ঘরোয়ার নিয়মনিষ্ঠতা থেকে বারোয়ারির উৎসবসর্বস্বতা। পাঁজিপুথির দিনক্ষণকে ছাপিয়ে কত দূর তার বিস্তার! এমনকি সে দিনক্ষণের আগে থেকেও। মন্দিরও এখন বাড়িতে বাড়িতে বিস্তারমান; পাড়ার, গ্রামের বা গ্রামের বাইরের বহুধাবিস্তৃত ক্ষেত্রেরগুলো তো রইলই। এই পাড়াগাঁয়ে দশক চারেক আগে আমরা ভাবতেই পারিনি ঘরে ঘরে ঠাকুরথানে নিত্যভোগের কথা। মন্দির-মসজিদ নির্মাণ অনেকটা প্রেস্টিজের পর্যায়েও পড়ে বই-কি – অমুক অমুক গ্রামে বা পাড়ায় আছে আর আমাদের এখানে একটা না থাকলে চলে! পুজো দিতে আমাদের সেই সেখানে যেতে হবে! পাড়ার নতুন বউটি মুখ বেঁকিয়ে বলে, বাব্বা, তা তোমাদের পাড়ায় এট্টা মন্দির কি থান নি – এট্টু পুজো দিতি যেতি হবে সেই সে পাড়ায়! ভুভনজোড়া আসন জেনেও, নিজের আরও আরও কাছে পেতে দিয়েছি একখানা আসন। অন্তরঙ্গ, নিজস্ব। কিন্তু নিভৃত, নিজস্ব হলে তবু খানিক বাঁচোয়া ছিল, তা এমন জ্ঞানপাপীর কুসংস্কারের পর্যায়ে রয়ে যাচ্ছে, এমন কৌশলী ব্যাবসার কাছে আত্মসমর্পণ করে চলেছে উত্তরোত্তর। কী বিপুল সম্পত্তি পচছে দেবতার নামে আর জীবিকার ভাবনাহীন কতকগুলো নিষ্কর্মার পেট ভরাচ্ছে বংশপরম্পরায়! এদিকে শরীর বাঁচাতে বিজ্ঞানের কাছে ছোটা, যাকে আমরা প্রায় কিছুই দিই না। বিজ্ঞান-আন্দোলনটাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শেষ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। আজ গভীরতম সংকটে পড়ে বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হলে, সে কতটা কী করে উঠতে পারবে? গভীর দুঃশ্চিন্তা এসব নিয়েই।
ঈশ্বর কি আর নিজে হাতে কিছু করেন, তিনি মানুষকে দিয়েই করান বলা হয়। এও অজানা নয় যে, মানুষ দেবতাকে প্রিয় করেন, প্রিয়েরে দেবতা। এসব বিশ্বাস বলবতী যেমন তেমনই কম বলবতী নয় এই বিশ্বাসও যে, মানুষের ক্ষমতা জাগতিক আর ঈশ্বরের ক্ষমতা অতিজাগতিক বা অলৌকিক। এমন চরমতম দুঃসময়ে সেই অতিজাগতিক, সেই অলৌকিক ক্ষমতাই তো অভয় দিতে পারত মানুষকে। মূর্তির অভয় মুদ্রা, ধর্মের বইয়ের অভয় বাণী কি কেবল মূর্তি বা বাণীমাত্রই হয়ে থাকবে! অলৌকিক ক্ষমতা যদি সত্যিই থাকবে তবে তা এত কৃপণ কেন! কেন ঈশ্বরপ্রেরিত ত্রাণকর্তা দূতেদের সমগ্র জীবন থেকে তা অতি কষ্ট করে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হয়! তাও বেশির ভাগ তাঁদের প্রয়াণের পরে!
তারও কারণ বিদ্যমান বই-কি! জীবিতাবস্থায় এমন এক সফল দৃষ্টান্তের প্রচার সহস্র সহস্র অসফলতার পথ প্রশস্ত করতে পারে, কারণ জগতে কোনও সংকট, কোনও ব্যাধি ইত্যাদি একক নয়। ফলে সেই অবতার বা বাবাজির অলৌকিক ক্ষমতাবাজিতে পড়ে যেতে পারে চোনা আর তাতে করে তাঁর অবতারত্বের দফারফা ও শিষ্য-প্রশিষ্যদের বাজার শেষ হয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই প্রয়াণের পরে অলৌকিকত্বের প্রচারই নিরাপদ, প্রমাণ দেওয়ার দায় বা ঝক্কি নিতে হয় না।
তো আজ এই মহা মহাসংকটের ক্ষণে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সেই ঈশ্বরেরই তো দরকার ছিল আপন ক্ষমতা প্রয়োগে সমগ্র বিশ্ববাসীকে – তাঁর সন্তানদেরকে বিপন্মুক্ত করার। দিকে দিকে বাধ্যত-মুমূর্ষু সন্তানের – বিশেষত অজস্র ভক্ত-সন্তানের – হাহাকার, কাতর আর্তি আর তিনি থেকে যাচ্ছেন নির্বিকার! ভক্তাধীন ভগবান এ কথা কে না জানে! তো সেই ভক্তদের তাঁর প্রতি ভক্তি অটুট রাখতে, অ-ভক্তদের আপন মাহাত্ম্যের প্রতি সন্দেহহীন আকর্ষণ জাগাতে এই-ই তো ছিল সুবর্ণ সুযোগ। হ্যাঁ, এমন সুযোগ স্বয়ং অমর দেবতাদের দিব্যজীবনেও তো খুব একটা আসে না। আর এটা তো স্বতঃসিদ্ধ যে একবার দেশের কর্ণধার হয়ে যাওয়া মানে তিনি যেমন কেবল তাঁর সমর্থনকারীদের কর্ণধার নন – অসমর্থনকারীদেরও, তেমনই ঈশ্বরও কেবল আস্তিকের নন – নাস্তিকদেরও তিনি ত্যাগ করতে পারেন না। বরং আপন প্রত্যক্ষ মহিমার গুণে নাস্তিকদেরকেও তাঁর প্রতি সত্যিকার আস্থাশীল করে তোলাই সর্বগুণান্বিত হিসাবে ঈশ্বরের প্রকৃত পরীক্ষা। রক্ষাকর্তা ঈশ্বর থাকতে একেবারেই-অনভিপ্রেত এমন সুযোগ কোন ফাঁক দিয়ে তৈরি হয়, সেও এক মহাপ্রশ্ন অবশ্য। এ জন্ম, আগের জন্ম, তার আগের চোদ্দো জন্মের পাপের দোহাই দিয়ে এড়ানো যাবে না সে প্রশ্ন।
মানুষই তো লড়ছে। মুশকিল হল, সগুণ ঈশ্বরকে দিয়ে যখন আর মুশকিল আসান সম্ভব হয় না তখন তাঁর মানবরূপের কীর্তন করা হয়। এ একটা পরিচিত কৌশল। আমরা কিন্তু দেখছি, পৃথিবীজুড়ে প্রায় দুশো দেশে লাখের কাছাকাছি ঈশ্বর যেন ইতিমধ্যে অসহায়ের মতো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন (তাঁদের অনেকেই ছিলেন একান্তভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী তাঁদের নিজের মতো করে, অনুমান করি যে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগে পর্যন্ত কত কাতরভাবে ঈশ্বরকে স্মরণ করেছিলেন তাঁরা) আর কয়েক লাখ ঈশ্বর আক্রান্ত হয়ে ঈশ্বরেরই নাম নিচ্ছেন; সে ঈশ্বর কেবল কল্পিত নয়, রক্তমাংসের মানুষও; আর আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছেন অগণ্য – তাঁদের বিশ্বাস যাই হোক, ভরসা সেই রক্তমাংসের মানুষ আর প্রকৃতি ও প্রকৃতিদত্ত উপাদানের উপরেই। আমরা তো জানি, মানুষই দেবতা গড়ে/তাহারই কৃপার পরে/করে দেবমহিমা নির্ভর।
কল্যাণবোধের অংশে ঈশ্বরবিশ্বাসীদের সঙ্গে কম ভাবনার মিল নেই আমাদের। আমরা ভুলি না যে আমাদের অনেকেরই উদ্ভব ঈশ্বরবিশ্বাসের ঘরেই আর এখনও আত্মীয়স্বজন নিয়ে আমাদের অনেকের বৃহত্তর পরিবারও মূলত ঈশ্বরবিশ্বাসী। কিন্তু তবুও আজ বিশ্বমানবের চরম সংকটের এই দিনে এইসব কথা আবার বড় বেশি করে মনে হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অনেক ঈশ্বরবিশ্বাসীরও আজ একই আশঙ্কার কথা মনে হচ্ছে, তবে তাঁরা সেটা বলতে পারছেন না এই যা। এই বাস্তবটাও স্বীকার না করে উপায় নেই যে, ঈশ্বর আজও অগণিত মানুষের সান্ত্বনারই আর এক নাম। সেই জায়গাটা ভরাট করাও বড় চাট্টিখানি কথা নয়। এটাও উড়িয়ে দেওয়ার নয় যে সে সান্ত্বনা সান্ত্বনামাত্রই। সেই সুবিশাল স্থানটি আমরা যেন চোরাবালি দিয়ে ভরাট করতে না যাই। স্বখাতসলিলেই যেন ডুবে না মরি গড়পড়তা।
আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব রেহাই দিক সে আমাদের, এদিকে করোনা কিন্তু এনে দিয়েছে অকারণ ঈশ্বরসর্বস্বতার মোহ কাটানোর এক বড় সুযোগ। মানুষের আশাতেই আছি।