ঋ তু ব দ ল
টি টেবিলের উপর বাংলা ম্যাগাজিনটা প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রুপা বলে উঠল, না না আমি পারিনি, পারিনি এভাবে সবার সামনে চিৎকার করে বলতে .....
টেবিলের অপর প্রান্তে খবরের কাগজে মুখ ঢেকে থাকা ব্যক্তিটি খানিকটা অনুযোগের ভঙ্গিতেই মুখ তুলে আবারও পড়ায় মন নিবেশ করে। সুরুপা আপন মনে বলে যায়,
-ওই বয়সে আমার সে সাহস ছিল না, কারও থাকে না। আমি মধ্যবিত্য ঘরের মেয়ে, তায় ওরা উচ্চবর্ণ বনেদি ব্রাহ্মণ। অনেক অনেক চেষ্টা করেছিলাম ----- কিন্তু-----
-তবে সে জন্য আমার মনে কোন ক্ষোভ নেই। বরং আমি এখন অনেক সুখি। তুমি আমার জীবন বদলে দিয়েছ গো,
এবার খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকায় ঋতিক, আসলে তুমি ভীরু, তুমি নিজের অধিকার আদায় করে নিতে পারনি,
- হয়ত তাই। অসম্ভব শান্ত দেখায় রুপাকে। -আসলে জোর করে কোন কিছু পেতে চাইনি গো, তাতে হয়ত পাওয়া হয়, কিন্তু লজ্জা লুকানোর জায়গা থাকে না।
- একসময় তুমি প্রতিবাদ করেছিলে।
-হ্যাঁ, তখন আমার বিশ্বাস ছিল, মানুষ জন্মানোর পরে তার পরিচয় সে নিজেই তৈরি করে, কিন্তু দেখলাম কেউ কেউ জন্মসুত্রে পাওয়া পরিচয়টি আজীবন যক্ষের ধনের মত আগলে বেড়ায় ,অহংকারে তার মাটিতেই পা পড়ে না।
-কিন্তু, অরূপ কে যে তুমি ভীষণই ভাল বাসতে, ঋতিক সিগারেট ধরায়। এক সুখ টান দিয়ে বাতাসে ধোঁয়া ছেড়ে সে আবারও বলে, তুমি এই ত সেদিন পর্যন্ত বলতে, সে ভীরু, কাপুরুষ, অহংকারি, তোমাকে পাওয়ার বা চাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা তার নেই।
সুরুপা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পদক্ষেপে তাদের বাগানের দক্ষিণ দিকটায় ঠিক যেখানে নীল জবার গাছটা আছে তার নিচে গিয়ে উবু হয়ে বসে। প্রায় কুঁকড়ে আসা ফুলটির পাপড়ি ধরে টেনে ছাড়াতে ছাড়াতে আনমনে বলে- হ্যাঁ ঠিক তাই। সব দোষ তার, আর কেউ না জানুক তুমি ত জান, একদিন সব ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়ে ছিলাম। অথচ সে... এখন মেনে নিতে অসুবিধে হয় - সবি ভবিতব্য। হয়ত তাই, উদাসিন ঋতিক বলে, জানো তো মানুষ যখন ভেসে যায় তখন সামনে যা পায় তাকে সম্বল করেই বাঁচার চেষ্টা করে।
-বিপদে যে আশ্রয় দেয় সে ত শুধু মানুষ নয় গো বিপদতারন নারায়ন।
-কিন্তু আমি ত তোমার নারায়ন হতে চাইনি রুপা। আমি রক্তে মাংসের মানুষ, আমি সুখের ঘর বাঁধতে চেয়ে ছিলাম...
আমি জানি তুমি আমাকে নিয়ে সুখি হতে পারনি। তাই ত সেদিন তোমাকে বলেছিলাম - আমাকে আমার পথ বেছে নিতে দাও।
তোমার পথেই তো তোমাকে নিয়ে পোঁছে দিতে চেয়েছিলাম ... মনে মনে বলে ঋতিক । রুপা আপন মনেই বলে যায় একটা ঝড় সব শেষ করে দিল, সব শেষ করে দিল ...
ঋতিক সিগারেটটা অ্যাষ্টের মুখে গুজে দিয়ে বলে, ঝড়ের পরেই নেমে আসে মহা প্রশান্তি , তুমি ভেবো না । যা হয় সে তো ভালোর জন্যই , তাই না?
রুপা মনে মনে ভাবে, আমি মেয়ে মানুষ। মেয়েদের কষ্ট সইবার শক্তি যে কি অপরিসীম তা তুমি বুঝবে না । তোমার নিয়ে আজকাল বড় ভাবনা হয় । তারপর গ্রীবা উঁচু করে হঠাত সে বলে উঠে- তুমি কি তবে ঠেকেছও?
ঋতিক উদাসিন ভাবে উত্তর , না সে তো আমি কক্ষনো বলিনি রুপা।
সুরুপা বাগানের কোনে ফুটে থাকা লিলিকে আদর করতে করতে বলে এক সময় মনে করতাম আমি হেরে গেছি, ক্রমশ হেরে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি গভীরে অনেক অনেক নীচে, সেখানে কেউ নেই, শুধু ধোঁয়া, চারিদিক অন্ধকার.....
সে
মুখ তুলে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে ঋতিকের একেবারে পায়ের নিচে এসে বসে বলে, তুমি
আমাকে সম্মান দিয়েছ, ঘর দিয়েছ সন্তান দিয়েছ। একজন মেয়ে মানুষের আর কী চাই?
ঋতিক রুপাকে তুলে মুখের দিকে চেয়ে থাকে, তোমার আর কিছুই চাওয়ার নেই?
না। না চাইতেই তুমি যা দিয়েছ, তাই বা কজন পায়?
-তোমার কোন আক্ষেপ নেই?
- সুরুপা মৃদু হাসে, চল এবার ঘরে চল, এর পর হিম পড়বে।
- হাঁ , চল সিগারেটটা শেষ করে আসছি। সুরুপা বলে, জগত সংসারের কোন কিছুই তোমার আমার নিয়মে চলে না, সে চলে তার আপন খেয়ালে, সেখানে আমরা কত তুচ্ছ।
-তুমি হয়ত ঠিকই বলছ, তবু মানুষের দুঃখের অন্ত নেই। কোন কিছু তেই সে সন্তুষ্ট হয় না কেন বলতে পার?
-কে বলেছে মানুষ সন্তুষ্ট নয়, সুখি নয় !
- তবে যে ...
আচ্ছা অনেক হয়েছে, এবার চল , সন্ধ্যে হয়ে এল।
- তুমি চল ,আর একটু হাঁটি । এসময়টা এখানে হাঁটতে বড় ভাল লাগে।
সুরুপা আর দাঁড়ায় না, গুছের খানেক কাজ পড়ে আছে, ছেলে মেয়েরা ফিরবে, তাদের জলখাবার তৈরি সান্ধ্যা পুজাপাঠ - কিছুই তো সারা হয়নি।
সুরুপা চলে গেলে ঋতিক আপন মনে বিড়বিড় করে - সবি ভবিতব্য, সময় আমাকে আজ অনেক কিছু শিখেয়েছে। বাগানের চারিদিক এলোমেলো ভাবে পায়চারি করতে করতে সে আকাশ দেখে। নীলাভ আকাশটা ছড়িয়ে আছে মাথার উপর মস্ত এক চাঁদোয়ার মত, ছোটও ছোটো মেঘ ফুলে আর বেশি সুন্দর মনে হয় আকাশটাকে । আজ হালকা গোলাপি শাড়ি আর কালো ব্লাউজে অপূর্ব লাগছিল রুপাকে। এত লাবণ্যময়ী ওকে আর কক্ষনো মনে হয়নি কেন কে জানে। কানের পাশ দিয়ে নেমে আসা চুলেরগুছ চোখ বন্ধ করে সে অনুভব করতে পারে। সে আপন খেয়ালে উপরে চোখ তোলে -মাথার উপর দিগন্ত জোড়া আকাশ , পায়ের নিচে সবুজ গালিচার মত ঘাস , বাগান ময় ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো ফুল পরিদের বিচরণ - সব চলছে তার আপন খেয়ালে। এর তো কোন ব্যতিক্রম হয় না কখনো। ভালবাসা রাগ-অভিমান , পাওয়া-না পাওয়া, সুখ-দুঃখ কোনকিছুই কি মানুষের হাতে থাকে? মলিন হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার সারা মুখে। পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে আবারও জ্বালিয়ে নেয় একটা। ইদানিং সিগারেট খাওয়াটা তার বেড়ে গেছে। এ নিয়ে রুপা সবসময় ঝগড়া করে। এই ঝগড়াটা সে বেশ উপভোগ করে । মনে মনে সে অরুপকেই খোঁজে হয়ত বা, তাকে পেলে দেখিয়ে দিতে পারত যে, রুপা কে বিয়ে না করে সে ঠকেছে...
সুখ টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে বাগানে পায়চারি করে আগের মতই। বিকেলের পড়ন্ত আলো এসে পড়েছে বাড়ীর পশ্চিম দেওয়ালে- ঠিক যেখানে বুদ্ধি করে রুপা ম্যাগ্নিফায়িঙ গ্লাস টা বসিয়েছে। রুপা সাইন্সের স্টুডেন্ট ছিল, পড়া শোনায় বরাবরই ভালো, ওর বুদ্ধির তারিফ করতে হয় । পড়ন্ত সূর্যের আলোয় এসময় বাগান খানি ঝলমল করে, আলোকিত হয়ে ওঠে চারিদিক ।
তাই প্রায় প্রত্যেক দিনই ওরা এ সময় এখানে আসে । রুপা এখন ওর ছেলে মেয়েদের জন্য টিফিন বানাবে। ওকে দেখে কি অসুখী মনে হয় ?
- কী গো এবার চলে এস। এরপর যে হিম পড়বে। রূপা বারান্দা থেকে চিৎকার করে ।
- আসছি। তুমি দাসুদা কে দিয়ে আমার চা টা বরং পাটিয়ে দাও...
-কিন্তু কার্ত্তিকের হিম পড়লে তোমার যে আবার মাথা ধরে ...
- না না ও তুমি ভেবো না। চা খেয়েই আমি আসছি, চিৎকার করে জানায় ঋতিক। আজ বড় ভালো লাগছে তার । তাছাড়া এ বয়সে এটুকু হাঁটাহাঁটি ও ভালো।
রুপা আর কথা বাড়ায় না।
কি এক অচেনা দুটো পাখি কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসে এখনো লেজ দোলাচ্ছে , ঋতিক বামহাতের তালুর উপর ডান হাতের কনুইটা রেখে বেশ আমেজ করে সিগারেট টানতে থাকে । পাখী দুটো একমনে ক্রমাগত ডেকে চলেছে । ঋত্বিক আনমনা হয়ে পড়ে । ওদের তো ঘর বাঁধার কথা ছিল । সে কি তবে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ? অরুপের কথা এই এত বছর পরে ও সে ভুলতে পারেনি কেন ? তবে কি সে ভুল করেছে ? এক ভয়ানক পাপ বোধ আজ ও তাকে কুরে কুরে খায় । অরুপরা বনেদি ব্রাম্ভন, উচ্চবিত্ত , সুরুপা দের সঙ্গে তাদের হয়ত মিলে না । তবু তো ওরা ভালবেসে ছিল। হয়ত স্বপ্নও দেখেছিল ঘর বাঁধবে । একটা ঝড়... আঃ , ভয়ানক এক চিৎকার ... সে এই পচিশ বছর ধরে মাথার ভিতর বয়ে বেড়াচ্ছে। সুরুপার মত গরিব শিডুউল কাস্ট মেয়ে কে ওরা কখনই ঘরের বউ করতে পারবে না , সেটা হয়ত অই বয়সে ওরা বুঝতে পারে নি ।
চোখ বন্ধ করে এখন ও সে দেখতে পায়। নিস্তব্ধ গঙ্গা ,বয়ে চলেছে দিগন্ত প্লাবিত করে । অনাদিকাল থেকে এই বয়ে চলার কোন বিরাম নেই। কখন কে এসে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল , বাঁচল কি মরল কে তার হিসাব রাখে ?
ভয়ংকর মাতালের মত ছুটে চলেছে, যেন সর্বনাশের খেলায় মেতে উঠেছে সে। একটি মেয়ে , কত আর হবে এই উনিশ কি কুড়ি , তাজা টগবগে স্বপ্নে বিভোর, এক দৃষ্টে চেয়ে আছে অশান্ত গঙ্গার দিকে । সে দূর থেকে ঠিক ভেবে ছিল , হাঁ ঐ তো ঝাঁপিয়ে পড়ল , তারপর বিকট চিৎকার - বাঁচাও ... বাচাও... এক মুহূর্ত দেরি করে নি সে , কোন কিছু না ভেবেই লাফিয়ে পড়ে ছিল , আকড়ে ধরে বাঁচিয়ে ছিল ডুবন্ত মেয়ে টিকে।
তারপর কত সংবর্ধনা কত লেখালেখি! মিডিয়া- প্রচার যত বড় হয়েছে সে ও তত ছোট হয়েছে।
ঋত্বিক তো চেয়েছিল সে ফিরে যাক মা বাবার কোলে, ফিরে পাক হারিয়ে যাওয়া ঘর , শুধরে নিক মুহূর্তের আবেগ, কিন্তু না, সুরুপাই আর ফিরে যেতে চাই নি । তার অতীত জীবন নিয়ে সেও আর আগ্রহ দেখায় নি।
তার ত তিন কূলে কেউ নেই, তাই একরকম রুপার জন্য -ই এই নির্জন পাহাড়ি দেশেই লোক চক্ষুর অন্তরালে তাদের ঘর বাঁধা , ...
- দাদাবাবু , তোমার চা, দাশু চায়ের পেয়ালা টেবিলে রাখতে রাখতে বলে, বউদি মনি কইলেন, হিম পড়ছে দাশুদা, তোমার দাদাবাবুকে ডেকে নিয়ে এস এবার।
- হা, তুই চল , আমি চাটা শেষ করেই আসছি।
- আচ্ছা, দেরি করনি যেন।
দাশু দা চলে যায়। ঋতিক এখন চেয়ারে এসে বসে। সিগারেটের মুখ টা অ্যাশটের মুখে গুজে দিয়ে চা য়ের পেয়ালার ঢাকনা খোলে। হালকা ধোঁয়া উঠা চায়ে চুমুক দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয় সে। নাম মনে না পড়া মেয়েটির কথা সে কোন দিন ভোলেনি। তার হাল্কা হাসি, বাঁকা চাহনি , যা সে এত বছরেও রুপার মধ্যে দেখেনি। রুপা অরুপের জন্য পাগল ছিল। আর তার হাসিনা কি এখনো তার কথা ভাবে?
কার্তিকের কুয়াশায় ঢাকা বাংলোটা বড় আবছা মনে হয়। কৃষ্ণচূড়ার ডালে সেই পাখি দুটো কে এখন আর দেখা যায় না। কখন যে তারা উড়ে গেছে কে জানে ! হালকা শীতের এই আবেশ তার বড় ভালো লাগে । সে অসুস্থ, তাকে নিয়ে রুপার ভাবনার শেষ নেই। রুপার পাঠানো চায়ের উষ্ণতায় সে মুখ ঢাকে। রুপার হাতে বসানো চাঁপা ফুলের গন্ধে সে বুক ভরে শ্বাস নেয়। রুপার ধারনা এক দিন ঋতুবদল হবেই। সেই পথের দিকে চেয়ে সে আজো দিন গোনে.........
==============
*চিত্রাঙ্কনঃ শিউলি মণ্ডল, বীরভূম।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন