রবীন্দ্র-ভাবনায় যুদ্ধ ও বিশ্বশান্তি
চন্দন দাশগুপ্ত
"এক সময়ে, এই বিশ্বসৃষ্টির প্রথম যুগে সৃষ্টি ও প্রলয়ের দ্বন্দ্বনৃত্য চলেছিল----সৃষ্টি ও প্রলয়ের শক্তির মধ্যে কে যে বড়ো তা বুঝবার জো ছিল না.......তখন যদি বাইরে থেকে কেউ একজন পৃথিবীকে দেখতে পেত, তাহলে বলত এই বিশ্ব প্রলয়েরই লীলাক্ষেত্র, সৃষ্টির নয়........কিন্তু এই মহাপ্রলয়ের অন্তরে সৃষ্টির সত্যই গোপন হয়েছিল। যা বিনাশ করে, যা ভীষণ, বাইরে থেকে তাকে সত্য বলে মনে হলেও তা সত্য নয়----এই ভীষণ তান্ডবলীলাই সৃষ্টির ক্ষেত্রে চরম কথা নয়।" রবীন্দ্রনাথের লেখা 'প্রলয়ের সৃষ্টি' প্রবন্ধের এই অংশটি যেন আজকের দুনিয়ার চিত্রটিকেই তুলে ধরেছে। পারমাণবিক বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ আশঙ্কার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের চিন্তা যেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের ঐ বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। ১৯৩০ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর 'রাশিয়ার চিঠি' গ্রন্থের ৪নং চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া সম্পর্কে লিখেছেন : ".......অর্থসম্বল এদের সামান্য, বিদেশের মহাজনী গদীতে এদের ক্রেডিট নেই।.....অথচ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সকলের চেয়ে যে অনুৎপাদক বিভাগ সৈন্যবিভাগ----তাকে সম্পূর্ণরূপে সুদক্ষ রাখার অপব্যয় এদের পক্ষে অনিবার্য। কেননা, আধুনিক মহাজনী যুগের সমস্ত রাষ্ট্রশক্তি এদের শত্রুপক্ষ এবং তারা সকলেই আপন আপন অস্ত্রশালা কানায় কানায় ভরে তুলেছে।" এই উদ্ধৃতি থেকেই বোঝা যায়, বিশ্বশান্তি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গী তথাকথিত শান্তিপ্রিয় নির্ঝঞ্ঝাট 'অহিংসবাদী' অথবা 'নিরপেক্ষ শান্তিকামী'-র মতো ছিল না। তিনি জানতেন, সামরিক খাতে ব্যয় 'অনুৎপাদক' এবং সামরিক বিভাগ হল 'অনুৎপাদক বিভাগ'। তিনি দেখেছিলেন, সেই অনুৎপাদক বিভাগকেও 'সম্পূর্ণরূপে সুদক্ষ রাখার অপব্যয়' সোভিয়েত কে করতে হচ্ছে, তবুও তিনি একবারও এই অপব্যয়কে অন্যায় বলেননি, উল্টে সমর্থন করেছেন।
মনে রাখতে হবে, কোনও ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াকেই কারো মানসিকতা হিসেবে গণ্য করা অনুচিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারাবাহিক মূল প্রত্যয় কি ছিল, সেটি বিচার করে তবেই যুদ্ধ ও বিশ্বশান্তি সম্পর্কে তাঁর মানসিকতা অনুমান করা সম্ভব। শুধু কবিতা বা প্রবন্ধই নয়, নাটক-গল্প-উপন্যাস-গান সর্বত্রই তিনি যা বলেছেন, সেগুলিতে মিশে থাকা তাঁর মতবাদকে সঠিক পুনরুদ্ধার দীর্ঘ গবেষণার বিষয়। ঠিক সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির স্বপক্ষে ছিলেন-----শুধু এটুকু বললে সবটা বলা হয় না।
🌑
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন পরিধিতে সচেতন ভাবে দুটি বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ অবশ্য তিনি দেখে যেতে পারেননি।প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তিনি যুযুধান দু-পক্ষের কাউকেই মুক্তকন্ঠে সমর্থন করেননি : "......এবার যুদ্ধের বান ডেকে এসেছে, প্রলয়ের ঝোড়ো হাওয়া লেগেছে হিংস্র শক্তির হাজার হাজার পালের উপর।.......এ পক্ষেরই হোক আর ও পক্ষেরই হোক, জয় কামনা করব কার। জয় যে হিংস্র শক্তির......।" ( আমাদের অবস্থা )
প্রথম মহাযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথের লেখা 'গীতালি'র গান আর 'বলাকা'র কবিতা। বলাকার 'পাড়ি' কবিতায় তিনি দুর্যোগের মধ্য দিয়ে অভিযাত্রী নাবিককে মানব ইতিহাসের নায়ক হিসেবে কল্পনা করে বলেছেন, মানব সমাজের আপাত দুর্যোগের মধ্য দিয়েই ইতিহাস বিধাতার অনিবার্য সঞ্চরণ প্রত্যক্ষ করা যায়। মহাযুদ্ধের মাধ্যমে তিনি ঠিক আমাদের মধ্যে এসে পড়েছেন। কিন্তু তিনি কেন আসছেন ? এর উত্তরে কবি জানাচ্ছেন, মানুষ বহুদিন ধরে লাঞ্ছিত হচ্ছে, উৎপীড়িতের দুঃখের ভার সীমা ছাড়িয়েছে। আশাবাদী কবির বিশ্বাস, এবার একটা ওলটপালট হবে, সাম্রাজ্যবাদের অবসানে আসবে মানুষের প্রকৃত মুক্তি তথা বিশ্বশান্তি :
".....এ কুৎসিত লীলা যবে হবে অবসান
বীভৎস তান্ডবে।
এ পাপযুগের অন্ত হবে,
মনের তপস্বীবেশে
চিতাভস্ম শয্যাতলে এসে
নবসৃষ্টি ধ্যানের আসনে
স্থান লবে নিরাসক্ত মনে,
আজি সেই সৃষ্টির আহ্বান
ঘোষিছে কামান।" (জন্মদিনে ২১)
কিশোর বয়স থেকেই কবি বিশ্বমানবের অবমাননা-উৎপীড়নের কথা ভেবে চিন্তামগ্ন :
"......যা দেখিছ, যা দেখেছ, তাতে কি এখনো
সর্বাঙ্গ তোমার, গিরি, উঠেনি শিহরি ?
কি দারুন অশান্তি এ মনুষ্য জগতে
রক্তপাত, অত্যাচার, পাপ, কোলাহল
কত কোটি কোটি লোক, অন্ধ কারাগারে
অধীনতা শৃঙ্খলেতে আবদ্ধ হইয়া
ভরিছে স্বর্গের কর্ণ কাতর ক্রন্দনে।"
[কবি ও কাহিনী]
আর আশি বছরে পৌঁছে পরিণত মানসে লিখেছেন :
".....কোটি কোটি মানুষের শান্তি স্বাধীনতা
রক্তময় পদাঘাতে দিতেছে ভাঙ্গিয়া
তবুও মানুষ বলি গর্ব করে তারা
তবু তারা সভ্য বলে করে অহংকার।"
এ-থেকেই বোঝা যায়, দীর্ঘকাল পরেও কবির মানসিক গড়নের কোনও মৌল পরিবর্তন আসেনি।এর সাথে এটিও লক্ষ্যণীয় যে, শত দুঃখের মধ্যেও তরুণ কবির মনে যেমন হতাশা আসেনি :
".....পৃথ্বী সে শান্তির পথে চলিতেছে ক্রমে
পৃথিবীর সে-অবস্থা আসেনি এখনো
কিন্তু একদিন তাহা আসিবে নিশ্চয়।"
[কবি ও কাহিনী]
তেমনি পরিণত বয়সেও শান্তিবাদী কবি প্রত্যয়ে স্থির :
".......তরুণ বীরের তূণে
কোন্ মহাস্ত্র বেঁধেছ কটির 'পরে
অমঙ্গলের সাথে সংগ্রাম তরে।
রক্তপ্লাবন পঙ্কিল পথে
বিদ্বেষে বিচ্ছেদে
হয়তো রচিবে মিলনতীর্থ
শান্তির বাঁধ বেঁধে।" [ নবজাতক]
🌑
১৮৮১ সালের জুন মাসে, মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে রবীন্দ্রনাথের লেখা 'চীনে মরণের ব্যবসায়' শীর্ষক প্রবন্ধে দেখা যায়, তিনি শুধু যুদ্ধের বিরুদ্ধেই সোচ্চার নন, চীনদেশে নারকীয় তান্ডব ও পীড়নের মাধ্যমে উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের মুখোসকেও তিনি ছিন্নভিন্ন করেছেন, পাশব শক্তির বিরুদ্ধে চীনা জনগণের ক্রোধ ও ঘৃণার সাথে নিজের ক্রোধ ও ঘৃণাকে যুক্ত করেছেন।
পারমাণবিক বোমার নারকীয় বীভৎসতা নিশ্চয়ই কবি কল্পনা করতে পারেননি, কিন্তু পাশ্চাত্য দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, একটা সর্বনাশা যুদ্ধ আসন্ন। তাই 'বলাকা'র কিছু কবিতায় প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হবার আগেই তার পদধ্বনী শোনা গেছে :
".......এবার যে ওই এল সর্বনেশে গো।
বেদনায় যে বান ডেকেছে
রোদনে যায় ভেসে গো।
রক্তমেঘে ঝিলিক মারে
বজ্র বাজে গহন-পারে,
কোন্ পাগল ওই 'বারে বারে
উঠছে অট্টহেসে গো।
এবার যে ওই এল সর্বনেশে গো।"
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "......আমার এই অনুভূতি ঠিক যুদ্ধের অনুভূতিই নয়। আমার মনে হয়েছিল যে, আমরা মানবের এক বৃহৎ যুগসন্ধিতে এসেছি, এক অতীত রাত্রি অবসানপ্রায়। মৃত্যু-দুঃখ-বেদনার মধ্য দিয়ে বৃহৎ নবযুগের রক্তাভ অরুণোদয় আসন্ন।" বলাকার ৪-নং কবিতা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মূল্যায়ণ, "......তখনও য়ুরোপের মহাযুদ্ধের খবর এদেশে আসেনি---আমার চার নম্বর কবিতা লেখবার পর যুদ্ধের খবর পেলাম..... দারুণ প্রলয়ের সূচনা হোলো, যুদ্ধের শঙ্খ বাজলো।"
প্রথম মহাযুদ্ধকে কবি 'সর্বনাশ' হিসেবেই দেখেছেন, কিন্তু সে-সর্বনাশ তাঁর মতে ছিল 'অনিবার্য' :
".....ভাঙিয়া পড়ুক ঝড়, জাগুক তুফান,
নিঃশেষ হইয়া যাক নিখিলের যত বজ্রবাণ।"
কারণ, কবির আশা, এই যুদ্ধের শেষে মানবজাতি পৌঁছতে পারবে এক নতুন সৃষ্টির উপকূলে :
".......শুধু একমনে হও পার
এ প্রলয় পারাবার
নূতন সৃষ্টির উপকূলে
নূতন বিজয়ধ্বজা তুলে।"
তাছাড়া প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হতেই কবির দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছিল যে, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই একটি 'বৃহৎ রক্তাভ অরুণোদয় আসন্ন'------তিনি কি এই 'বৃহৎ রক্তাভ অরুণোদয়' বলতে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবকেই বোঝাননি ?
শান্তিবাদী ছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু 'অহিংসবাদী' ছিলেন না। 'হিংসা' যেখানে 'হিংস্রতা'-র সমার্থক, কবি অবশ্যই তার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু অন্যায়কারীর কবল থেকে আত্মরক্ষার্থে যে বলপ্রয়োগ করা হয়, কবি সবসময়েই তার সমর্থক ছিলেন। এজন্যই গান্ধীজি যে অর্থে অহিংসবাদী, রবীন্দ্রনাথ সে-অর্থে অহিংসবাদী নন। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি দৃপ্তকন্ঠে যুদ্ধঘোষণা করেছেন :
"......এবার সকল অঙ্গ ছেয়ে
পরাও রণশয্যা।"
রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে, সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের পেছনে আছে ধনতান্ত্রিক প্রয়োজন এবং সেই আদি প্রবৃত্তি----লোভ। তাই শোষিত মানুষের বাস্তব চিত্র লিপিবদ্ধ করে তিনি রাষ্ট্র-নেতাদের সাবধান করে বলেছেন যে, মানুষে-মানুষে নিদারুণ পার্থক্যের অবসান না ঘটালে সাম্রাজ্যলোভীদের রাজত্ব বিপ্লবের কষাঘাতে বিচূর্ণ হবে :
"......সিংহাসনতলচ্ছায়ে দূরে দূরান্তরে
যে রাজ্য জানায় স্পর্ধাভরে
রাজায় প্রজায় ভেদ মাপা
পায়ের তলায় রাখে সর্বনাশ চাপা।"
ন্যায়যুদ্ধে যে কবির আন্তরিক সমর্থন ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে আয়ারল্যান্ডের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি তাঁর সমর্থনে এবং সিরিয়া - মেসোপটেমিয়ায় জাতীয় আন্দোলন দমনের জন্য ভারতীয় সৈন্য প্রেরণের ঘটনায় তাঁর তীব্র প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে।
বিশ্বব্যাপী মারণযুদ্ধ চলাকালীন কবির হৃদয় যখন ক্ষতবিক্ষত, ঠিক সেই সময় তাঁর বন্ধু রোমাঁ রোলাঁ এই ধ্বংসের বিরুদ্ধে "Declaration of independence of thought"--এ সাক্ষর করার জন্য আহ্বান জানালেন। এ--প্রস্তাবে সানন্দে সম্মতিদান করে রবীন্দ্রনাথ সুদীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন। ১৯৩৫ সালের ডিসেম্বরে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ফ্যাসিবাদ--বিরোধী অধিবেশনে ভারতের ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রগতি লেখকদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রেরিত ঐতিহাসিক প্রতিবাদবাণীতে সাক্ষরকারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যক্তি ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। League Against Fascism and War এর ভারত কমিটিরও তিনি ছিলেন সভাপতি।
🌑
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জাপানের যুদ্ধোদ্যমকে "সভ্যতা প্রসারের প্রয়াস" রূপে বর্ণনা করে জাপানী কবি নোগুচি রবীন্দ্রনাথকে এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন----তাঁর সমর্থন লাভের আশায়। রবীন্দ্রনাথ তার উত্তরে যা লেখেন, তা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি লেখেন, কোনো দেশের স্বাধীনতাহরণই মানবিক শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। বোমাবারুদে বিধ্বস্ত করে কোনো দেশে সভ্যতা বিস্তারের চেষ্টা আদিকালের এক অসভ্য রীতি। আপন অভিরুচিসম্মত পথেই প্রত্যেক দেশ আত্মশক্তির পথে পা বাড়াবে। এর অন্যথা পৈশাচিক বর্বরতা মাত্র।
বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্যা Miss Rathbone এই সময় ভারতবর্ষ ও ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে এক বক্তৃতা করেন। অন্তিম রোগশয্যায় শুয়েও এর মোক্ষম জবাব দেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেন, নিজ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা শহীদ হন, তাঁদের উদ্দেশ্যে দূর থেকে ঢিল ছোঁড়া হল নির্লজ্জ কাপুরুষতা। আজকের মদমত্ত রণপতিরা যেদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন, তখনই শেষ হবে তাঁদের লীলাখেলা। কিন্তু সত্যনিষ্ঠ দেশসেবক ত্যাগব্রতী বীরেরা চিরকালের দীপ্তিতে দিগন্ত আলো করে থাকবেন। যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এমন সতেজ ও স্বতঃস্ফূর্ত উক্তি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে করতে পারতেন ?
শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী আগুনে পৃথিবীকে দগ্ধ হতে। দেখেছেন রণতান্ডবে বিধ্বস্ত হচ্ছে মানবসমাজ ও সভ্যতা, ছারখার হচ্ছে কোটি কোটি নিরপরাধ মানুষের জীবন ও সংসার। কিন্তু তখনও দৃঢ়চেতা কবিমানসে হতাশা আসেনি। তিনি বুঝেছেন, সেই পরিস্থিতিতে শান্তির বাণী শুনিয়ে লাভ নেই---একমাত্র পথ হল দানবতার বিরুদ্ধে মানবতার আপোসহীন সংগ্রাম। পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার আগে তাই যৌবনোচিত নির্ভীকতায় কবিকন্ঠে শোনা গেছে বরাভয় আর সংগ্রামী চেতনায় উদ্দীপ্ত সেই শাশ্বত আহ্বান :
"নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস---
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।"
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বশান্তি চেতনা কিন্তু কোনো নির্বীর্যের আত্মসমর্পণের মানসিকতা থেকে উদ্বুদ্ধ নয়, সে--শান্তি দুর্জয়, দুর্বার :
".....সেই বিনাশের প্রচন্ড মহাবেগে
একদিন শেষে বিপুলবীর্য শান্তি উঠিবে জেগে
মিছে করিব না ভয়।
ক্ষোভ জেগেছিল, তাহারে করিব জয়।"
শান্তিকামী কবির মানসিকতা বোঝা যায় চীনদেশ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যে :
"......অপরপক্ষে কোন কোন জাতি অপেক্ষাকৃত সহজে তাদের স্বভাবকে অনুসরণ করে বাহিরের চিত্তবিক্ষেপ থেকে শান্তিলাভ করে এসেছে। তারা বিবাদ করে, লড়াই করে মানুষের গৌরব সপ্রমাণ করতে চায়নি। বরঞ্চ লড়াই করাকে তারা বর্বরতা বলে জ্ঞান করেছে। চীন এর প্রধান দৃষ্টান্ত।" কবি আরো বলেছেন :
"......আমি এই কামনা করি, আমাদের পিতামহের মর্মস্থান থেকে উচ্চারিত এই বাণী আমাদের প্রত্যেকের ধ্যানমন্ত্র হয়ে জগতে শান্তির দৌত্য করতে থাক্।"
সাম্রাজ্যবাদীদের কুৎসিত লোভের থাবা এবং দুনিয়া জুড়ে ত্রাস সঞ্চারের অপচেষ্টার ফলেই যে আজ বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হয়ে পড়েছে এতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ প্রথম মহাযুদ্ধের সময়েই বলেছেন :
"........আমেরিকার রাষ্ট্রতন্ত্রে কুবের দেবতার চরগুলি যেসব কুকীর্তি করে সেগুলো সামান্য নয়।" ১৯৩৩ সালে লেখা 'কালান্তর' প্রবন্ধেও তিনি সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছিলেন তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার সঙ্গে :
"......ক্রমে ক্রমে দেখা গেল য়ুরোপের বাইরে অনাত্মীয় মন্ডলে য়ুরোপীয় সভ্যতার মশালটি আলো দেখাবার জন্য নয়, আগুন লাগানোর জন্য।"
ফ্যাসিষ্ট দানবের উত্থানের পেছনে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র-গোষ্ঠীর নীতিকেই রবীন্দ্রনাথ দায়ী করেছেন :
".......দেখলুম দূরে বসে ব্যথিতচিত্তে, মহীসাম্রাজ্যশক্তির রাষ্ট্রমন্ত্রীরা নিষ্ক্রিয় ঔদাসীন্যর সঙ্গে দেখতে লাগলো, জাপানের করাল দ্রংষ্ট্রাশক্তির দ্বারা চীনকে খাবলে খাবলে খাওয়া......দেখলুম, ঐ স্পর্ধিত সাম্রাজ্যশক্তি নির্বিকার চিত্তে এবিসিনিয়াকে ইটালির হাঁ করা মুখের গহ্বরে তলিয়ে যেতে দেখলো, মৈত্রীর নামে সাহায্য করলো জার্মানির বুটের তলায় গুঁড়িয়ে ফেলতে চেকোশেলাভাকিয়াকে.......।" ইটালি কর্তৃক অ্যাবিসিনিয়া দখলের প্রতিবাদে কবির লেখনী গর্জে উঠেছিল 'আফ্রিকা' কবিতায় :
"....এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করলো আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।"
চেকোশ্লাভাকিয়া নাৎসী বাহিনীর দখলে চলে গেলে "আহ্বান" কবিতায় কবিকন্ঠে বেজেছে বিষণ্ণতার সুর :
"....বিশ্বজুড়ে ক্ষুব্ধ ইতিহাসে
অন্ধবেগে ঝঞ্ঝাবায়ু হুঙ্কারিয়া আসে
ধ্বংস করে সভ্যতার চূড়া।
ধর্ম আজি সংশয়েতে নত
যুগ যুগের তাপসদের সাধনাধন যত
দানবপদদলনে হল গুঁড়া।"
তবুও কিন্তু কবি আশাবাদী। তাই তিনি নির্ভীক যুবসমাজকে আহ্বান জানাচ্ছেন :
".....তোমরা এস তরুণ জাতি সবে
মুক্তিরণ ঘোষণাবলী জাগাও বীরবরে
তোলো অজেয় বিশ্বাসের কেতু।
রক্তে রাঙা ভাঙন ধরা পথে
দুর্গমেরে পেরোতে হবে বিঘ্নজয়ী রথে
পরাণ দিয়ে বাঁধতে হবে সেতু।"
🌑
অনেকে রবীন্দ্রনাথকে ভাববাদী এবং এসকেপিস্ট বলেছেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয়, তাঁর বহু কবিতা থেকেই এমন অনেক ভাবনা বেরিয়েছে, যা বিশ্বের যেকোন দোর্দন্ডপ্রতাপ শাসকের সিংহাসনকেও টলিয়ে দিতে সক্ষম :
".....উপর আকাশে সাজানো তড়িৎ আলো
নিম্নে নিবিড় অতি বর্বর কালো
ভূমিগর্ভের রাতে---
ক্ষুধাতুর আর ভূরিভোজীদের
নিদারুণ সংঘাতে
ব্যাপ্ত হয়েছে পাপের দুর্দহন,
সভ্যনামিক পাতালে যেথায়
জমেছে লুটের ধন।"
বিভীষিকাময় যুদ্ধকে কবি অভিসম্পাত জানিয়েছেন 'সেঁজুতি', 'প্রান্তিক', 'নবজাতক', 'জন্মদিন'......প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের অজস্র কবিতায়। কবির ভাষায় :
"......ক্ষুব্ধ যারা, লুব্ধ যারা,
মাংস গন্ধে মুগ্ধ যারা, একান্ত আত্মার দৃষ্টি হারা
শ্মশানের প্রান্তচর, আবর্জনা কুন্ড তব ঘেরি
বীভৎস চিৎকারে তারা রাত্রিদিন করে ফেরাফেরি
নির্লজ্জ হিংসায় করে হানাহানি,
শুনি তাই আজি
মানুষ জন্তুর হুহুঙ্কার দিকে দিকে উঠে বাজি।"
১৯৩৭ সালে বোমারু বিমানের ধ্বংসলীলা ফুটে উঠেছে কবির সৃষ্টিতে :
"....এদিকে দানবপক্ষী ক্ষুব্ধ শূণ্যে
উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বৈতরণী নদীপার হতে
যন্ত্রপক্ষ হুংকারিয়া নরমাংসক্ষুধিত শকুনি
আকাশেরে করিল অশুচি......"
লক্ষ্যণীয়, এসব সত্ত্বেও যুদ্ধের ধ্বংসলীলার যথাযথ চিত্র তাঁর কাব্যে অনুপস্থিত একথা রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করে নিয়েই বলেছেন যে তিনি 'রসতীর্থ পথের পথিক' হলেও বীভৎসতার বাস্তব চেহারা তাঁর অচেনা নয়। কিন্তু সেই পরিচয়ের যথার্থ প্রকাশের ক্ষেত্র কাব্য নয়, কর্ম। তাই 'রোমান্টিকে'-র 'নবজাতক' কবিতায় শোনা গেছে :
"যেথা ঐ বাস্তব জগত
সেখানে আনাগোনার পথ
আছে মোর চেনা।
সেথাকার দেনা
শোধ করি----সে নহে কথায় তাহা জানি,
তাহার আহ্বান আমি মানি।
দৈন্য সেথা, ব্যাধি সেথা, সেথায় কুশ্রীতা,
সেথায় রমণী দস্যুভীতা
সেথায় উত্তরী ফেলি পরি বর্ম
সেথায় নির্মম কর্ম।"
🌑
মহাযুদ্ধ এবং বর্তমান সভ্যতার সমস্যাগুলির মূল কারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতাদর্শ প্রায় নির্ভুল হলেও এটি অস্বীকার করা যাবেনা যে, এইসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথটি তাঁর কাছে সুস্পষ্ট ছিল না। সাধারণ মানুষের শ্রেণীচেতনা, সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন, এবং সামাজিক- অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক বিপ্লবকে যে তিনি একেবারেই দেখতে পাননি, তা নয়। কিন্তু তিনি সম্ভবত এর উপর ঠিক আস্থা রাখতে পারেননি। অবশ্য এটাও ঠিক যে, মহাযুদ্ধের তৎকালীন সেই তান্ডবলীলার মধ্যে কোনোরকম বিপ্লবের সম্ভাবনাও তখন দেখা যায়নি। তাই সঙ্কট সমাধানের জন্য কবি মানুষের নৈতিক পুনরুত্থানের স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর মতে, কিছু 'মহান ব্যক্তিত্ব'-ই মানুষের সেই শুভবুদ্ধি ও নৈতিক চেতনার পুনরুত্থান ঘটাতে পারবে। লক্ষ্যণীয় বিষয়, এইসব 'মহান ব্যক্তিত্ব'-দের চেয়েও তিনি কিন্তু বিশ্বজোড়া কোটি কোটি সাধারণ মানুষেরই জয়গান করেছেন বেশি। তাই তিনি সাধারণ মানুষের সংগ্রামী মানসিকতার প্রতি সুদৃঢ় আস্থা নিয়ে ঘোষণা করেছেন : ".....মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব।.....মনুষ্যত্বের অন্তহীন, প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি......।"
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিষ্টদের সঙ্গে মিত্রপক্ষের সংগ্রামে ফ্যাসিজমই যে প্রধান এবং আশু শত্রু ( Principal and Immediate Enemy) এবং তাকেই যে আগে পরাস্ত করা দরকার এই মূল বিচারেও কবির বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবিরোধী কবিতাগুলি ছাড়াও তিনি ফ্যাসিষ্ট দেশ আর নেতাদের বিদ্রূপ করে কয়েকটি ছড়াও লিখেছিলেন, যেমন :
১] "ঐ শোনা যায় রেডিও তে বোঁচা গোঁফের হুমকি
দেশ বিদেশে শহরে গ্রামে গলাকাটার ধুম কি !"
গোঁ গোঁ করে রেডিওটা কে জানে কার জিত,
মেশিনগানে গুঁড়িয়ে দিল সভ্য বিধির ভিত।"
২] "মনে রেখো দৈনিক
চা খাইবে চৈনিক
গায়ে যদি বল পাও
হবে তবে সৈনিক
জাপানীরা যদি আসে
চিঁড়ে নিক দৈ নিক
আধুনিক কবিদের
যত পারে বই নিক।"
৩] "জাপানী জাপানী
তোমার হাড়েতে লাগিবে কাঁপানি
এখন যতই কর লাফানি ঝাঁপানি।"
জীবনের শেষ কয়েক মাস রবীন্দ্রনাথ খুবই অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু বার্ধক্য ও শারীরিক অসুস্থতাও তাঁকে কাবু করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পৈশাচিক বর্বরতা তাঁর অন্তিম জীবনকে
দুর্বিষহ করে তুলেছিল। জীবনসায়াহ্নে কবির লেখনীতে তাই শোনা গেছে কালবৈশাখীর গুরুগম্ভীর মেঘগর্জন। তাঁর বিখ্যাত 'সভ্যতার সঙ্কট' ঐ সময়েই লেখা।
বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যে-বুর্জোয়া সভ্যতার 'উন্মত্ত দানবিকতা' ও 'বর্বর নির্লজ্জতা' দেখে রবীন্দ্রনাথ ক্ষুব্ধ-ব্যথিত-ক্রুদ্ধ হয়েছেন, প্রতিবাদে ফেটে পড়তে চেয়েছেন, সেই 'সভ্যতার'-ই কাছে নিজের এবং মানবসমাজের গভীর ও ব্যাপক ঋণের কথাও তিনি ভুলতে পারেন না :
".......জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। কিন্তু আজ আমার বিদায়ের দিনে সে-বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।" আর ঠিক এইখানেই রবীন্দ্র মানসিকতায় এক জটিলতার হদিস পাওয়া যায়। কিন্তু এই ঘটনার কারণ কি ?
আসলে আধুনিক সভ্যতার জন্মভূমি ইউরোপ থেকে একদা যে মনুষ্যত্বের বাণী ছড়িয়ে পড়েছিল, শৈশবকালে তার সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়েছিল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। স্বভাবতই তখন তাঁর মনে হয়েছিল ভারতে ও প্রাচ্যদেশে হয়ত তারই পবিত্র ধারক ও বাহক রূপে ইংরেজ ও অন্যান্য পাশ্চাত্য জাতিগুলির আগমন ঘটেছে। পরবর্তীকালে সেই জাতিগুলির বীভৎস ও হিংস্র সাম্রাজ্যবাদী স্বরূপ উন্মোচিত হতে থাকে। নিজের সুদীর্ঘ জীবনে এই আশাভঙ্গের বেদনা এবং পরস্পরবিরোধী অভিজ্ঞতাই কবিকে প্রচন্ড দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের সম্মুখীন করেছে। মোহমুক্তি ঘটার সাথে কবির মর্মবেদনা ও ক্ষোভ ফুটে উঠেছে 'সভ্যতার সঙ্কট' প্রবন্ধের প্রত্যেকটি ছত্রে :
".......ভারতবর্ষ ইংরেজের সভ্যশাসনের জগদ্দল পাথর বুকে নিয়ে তলিয়ে পড়ে রইল নিরুপায় নিশ্চলতার মধ্যে। চৈনিকদের মতন এত বড়ো প্রাচীন সভ্য জাতিকে ইংরেজ স্বজাতির স্বার্থসিদ্ধির জন্য বলপূর্বক অহিফেন বিষে জর্জরিত করে দিলে এবং তার পরিবর্তে চীনের এক অংশ আত্মসাৎ করলে।.........য়ুরোপীয় জাতির স্বভাবগত সভ্যতার প্রতি বিশ্বাস ক্রমে কী করে হারানো গেল, তারই এই শোচনীয় ইতিহাস আজ আমাকে জানাতে হল....।"
আজ আমরা জেনেছি, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পরবর্তী উন্নততর পর্যায় বলেই পুঁজিবাদী সভ্যতারও কিছু ইতিবাচক দিক আছে। ঠিক একই ভাবে ইতিহাসের নিয়মেই পরবর্তীকালে সমাজবাদের জন্ম হয়েছে। হয়ত রবীন্দ্রনাথ সচেতন ভাবে এই সত্যটি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেন নি। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে এবং ১৯৩০ সালে সোভিয়েত ভ্রমণের সময় তিনি তাঁর সচেতন ও মানবতাবাদী নির্মোহ দৃষ্টির প্রভাবে এই সত্যের যথেষ্ট কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন। 'প্রলয়ের সৃষ্টি' প্রবন্ধে তাই তিনি লেখেন :
".......মানুষের ইতিহাসে এই দানবিকতাই কি শেষ কথা ? মানুষের মধ্যে এই যে অসুর এই কি সত্য ? .......এই সংঘাতের অন্তরে অন্তরে কাজ করছে শান্তির প্রয়াস সেকথা বুঝতে পারি যখন দেখি এই দুঃখের দিনেও কত মহাপুরুষ দাঁড়িয়েছেন শান্তির বাণী নিয়ে-----সেজন্য মৃত্যুকে পর্যন্ত স্বীকার করেছেন।"
দুটি আশ্চর্য যোগাযোগ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য। প্রথমটি হল, রুশ লালফৌজ প্রবল বিক্রমে বার্লিন অভিযান শুরু করে ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট----যেদিন বিশ্বকবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আর দ্বিতীয়টি হল রাষ্ট্রসঙ্ঘ কর্তৃক ১৯৮৬ সালকে 'আন্তর্জাতিক শান্তিবর্ষ' ঘোষণা-----যে বছর সারা ভারতবর্ষ তথা বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছিল বিশ্বশান্তির অগ্রদূত কবিগুরুর ১২৫ তম জন্মশতবার্ষিকী।
সোভিয়েটের অভিজ্ঞতা অর্জনের পরই শেষ বয়সে রবীন্দ্র-জীবনে একটি উত্তরণ ঘটছিল---ধীরে ধীরে ভাববাদী জগৎ থেকে তিনি নিশ্চিত ভাবে সরে আসছিলেন বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের দিকে---- হয়ত উপলব্ধি করেছিলেন এই পথেই আসবে প্রকৃত বিশ্বশান্তি। যুদ্ধ তাঁকে শুধু উদ্বিগ্নই করেনি, তাঁর সামগ্রিক মানসিকতা ও জীবনদর্শনকেও দ্রুত রুপান্তরিত করছিল। ১৯৪১ সালে তাঁর মহাপ্রয়াণের ফলে সেই গঠনের কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল। কিন্তু যেটুকু ভস্মাবশেষ তিনি রেখে গিয়েছেন, তা থেকেই বোঝা যায় জীবনের শেষ পর্যায়েও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসামান্য দূরদর্শী চিন্তার অধিকারী। আর এইজন্যই তিনি ফ্রয়েড, আইনস্টাইন, মার্কস প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত মণীষিদের সাথে একাসনে অধিষ্ঠিত থাকার উপযুক্ত যুগপুরুষ। নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, জীবনের শেষ অধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথই সেই মহামানব, যাঁর ভাবনা-চিন্তা আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করতে পারে। তাই নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আজ বিশ্বকবিরই কাঙ্খিত মুক্ত বিশ্বের পদধ্বনি শোনার প্রতীক্ষা আমাদের করতেই হবে।
=====================
চন্দন দাশগুপ্ত
সি/৩০/১, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, রিজেন্ট এস্টেট,
কলকাতা---৭০০ ০৯২
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন