কবি রবীন্দ্রনাথ
শ্যামল হুদাতী
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আপনার আবির্ভাব এক যুগান্তর। আমার কাব্যের প্রতি একটা ঝোঁক বেশি। সেই জন্য আমি কাব্যের দিকটা একটু আলোচনা করি। মানসী কবিতাগুলি রচিত হয়েছিল ১৮৮৭-৮৮ খ্রী.।
সর্বপ্রথম কাব্যগ্রন্থ যাতে আপনার সঙ্গে যেন একজন শিল্পী এসে যোগ দিয়েছিল । এখানে তিন প্রকার ভাবধারা বয়ে চলেছিল তিন রকম বিষয়কে অবলম্বন করে - প্রকৃতি, নারী ও স্বদেশ। প্রেম কবিতাই মানসীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই কবিতার লাইনগুলো কখনোই ভোলার নয় -
মনে হয় সৃষ্টি বুঝিয়ে বাধা নাই নিয়মনিগড়ে,
আনাগোনা মেলামেশা সবই অন্ধ দৈবের ঘটনা
"কড়ি ও কোমল" কবি লিখলেন - হৃদয় ডেকে ওঠে কিন্তু সাড়া নেই ত্রিভুবনে :
কে শুনছে শতকোটি হৃদয়ের ডাক।
নিশীথিনী স্তব্ধ হয়ে রয়েছে অবাক।
"সিন্ধুতরঙ্গ"-এর নাস্তিকতা আরো বেদনা। কবিতাটি এক নিদারুণ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে লেখা। এমন স্পষ্ট ঈশ্বর বিদ্রোহের কবিতা রবীন্দ্রনাথ খুব কমই লিখেছেন-
নাই তুমি, ভগবান, নাই দয়া, নাই প্রাণ-
জড়ের বিলাস।
আরো তিনি লিখলেন -
পাশাপাশি একঠাঁই দয়া আছে দয়া নাই -
বিষম সংশয়।
অতৃপ্তি ও বিষাদের কারণটা প্রমথ চৌধুরীর পত্রোত্তরে কবি বলেছেন - 'একেকবার আমার মনে হয় আমার মধ্যে দুটো বিপরীত শক্তির দ্বন্দ্ব চলছে । একটা আমাকে সর্বদা বিশ্রাম এবং পরিসমাপ্তি দিকে টানছে। আরেকটা আমাকে কিছুতেই বিশ্রাম করতে দিচ্ছে না।
... একাধিক কর্মের প্রতি আসক্তি আর একদিকে চিন্তার প্রতি আকর্ষণ'।
কবি প্রেমিক সন্ধান করেছেন তাঁর প্রেয়সীর মধ্যে এমন এক পরিপূর্ণ সৌন্দর্য যা তা মানবিক সত্তাকে ছাপিয়ে বহুদূর প্রসারিত। এ খোঁজার কোন শেষ নেই, এযাত্রার কোন পথ জানা নেই তাঁর - লিখলেন:
অকূল সাগর মাঝে চলেছে ভাসিয়া
জীবন তরণী ধীরে লাগিছে আসিয়া
তোমার বাতাস ।
"মানসী"র অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা 'বিদায়' এই ব্যথার প্রকাশ আশ্চর্য সুন্দর। কবিতাটাই অবশ্যই মানসী প্রিয়াকে ই সম্বোধন করে লেখা এবং আমাদের বুঝতে পারি কবির মনে মানসীকে পাওয়ার ব্যাকুলতা যতখানি তার চেয়ে গৃহকর্মকরতা রক্ত মাংসের মানুষটিকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা অনেক বেশি গভীর।
লিখলেন-
অবশেষে যবে একদিন,
বহুদিন পরে ,তোমার জগৎ মাঝে
সন্ধ্যা দেখা দিবে দীর্ঘ জীবনের কাজে
প্রমোদের কোলাহলে শ্রান্ত হবে প্রাণ
মিলায়ে আসিবে ধীরে স্বপ্ননসমান
চির রৌদ্র দগ্ধ সেই কঠিন সংসার,
সেই দিন এইখানে আসিয়ো আবার।
"মানসসুন্দরী" কবিতা কবিরমানসে ঈশ্বর চেতনার বিকাশ বুঝতে পারা যায়। যাকে সম্বোধন করে লেখা তিনি স্বয়ং কাব্যলক্ষ্মী। মানসসুন্দরী যদিও নারীরূপ-প্রকৃতপক্ষে তা নিরাকার এবং নিঃসীম। কবি এখানে সৌন্দর্যের খুঁজছেন নারীর দেহ মনের লীলায় প্রকৃতির বর্ণ-গন্ধের বৈভবে।
'নিরুদ্দেশ যাত্রা'য় রাত্রির ছায়ায় রহস্যের বাতাবরণ আরও নিবিড় হয়ে উঠেছে, মনে হয় দুর্ভেদ্য অন্ধকারে সমুদ্রের মাঝখানে মস্ত কিছু ঘটবে হয়তো সেই অপরিচিতা হাত বাড়িয়ে পরশ করবেন। অবশ্য এমনও হতে পারে যে ঘন অন্ধকারে তার নীরব হাসিটুকুও অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিছুই দেখা যাবে না তখন অকুল সিন্ধুর উত্তাল তরঙ্গে সোনার তরী ডুবে যেতেও পারে। অনেক ঝড় তুফান আলো অন্ধকারের মাঝখানে কোন এক অজানা তীরে গিয়ে ভিড়বে:
সংশয়ময় ঘন নীল নীর
কোন দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর,
অসীম রোদন জগত প্লাবিয়া
দুলিছে যেন।
মানসী রচনার কয়েক বছর পূর্বে একটা মৃত্যু শোকে কবির মনের যে নৈরাশ্য সৃষ্টি হয়েছিল তারই প্রতিক্রিয়ায় 'হৃদয়ের ধন' এ লিখলেন:
নাই, নাই, কিছু নাই, শুধু অন্বেষণ-
নীলিমা লইতে চাই আকাশ ছাঁকিয়া।
কাছে গেলে রূপ কোথা করে পলায়ন,
দেহ শুরু হাতে আসে - শ্রান্ত করে হিয়া।
সোনার তরীতে নিরুদ্দেশ যাত্রা লক্ষ্যবস্তুর কাছে আমাদের নিয়ে গেলেন। কিন্তু চিত্রায় এসে আমরা একাধিক মানসপ্রবাহের সঙ্গমস্থল যেন খুঁজে পাই। স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে জীবনদেবতা ঈশ্বর নন - এই অন্তর্যামী কবি প্রতিভাই কবির জীবন দেবতা।
এক জায়গায় লিখেছেন-
গলায়ে গলায়ে বাসনার সোনা
প্রতিদিন আমি করেছি রচনা
তোমার ক্ষণিক খেলার লাগিয়া
মূরতি নিত্য নব ।
ক্ষণিকা আমার মতে প্রাক গীতাঞ্জলি পর্বের সবচেয়ে স্বার্থক রচনা। গুরুতম ভাবের সঙ্গে লঘুতম ভঙ্গির মিতালি ঘটানো হয়েছে এইখানেতে। চমৎকারভাবে লিখেছন -
অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি এলে সুখের বন্দরেতে
জলের তলে পাহাড় ছিল লাগলো বুকের অন্দরেতে
গীতাঞ্জলি পর্ব তোমার প্রতিভার শ্রেষ্ঠ ফসল বলে আমি মনে করি। ভক্তি কাব্যেও আমার অ-ভক্ত মন মুগ্ধ। দুঃখের বেশেই দেবতা নেমে আসেন ভক্তের দ্বারে-
দুখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে ।
যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় করে ধরিব হে
গীতাঞ্জলি তে ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে একজন কবির এক বা একাধিক অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। অনুভূতির প্রকাশ যদি সুন্দর হয়ে থাকে তবে কেন আমাদের মন তাতে সাড়া দিতে পারবে না?
মানসিক গ্লানি সত্ত্বেও কবির মনে গভীর তলে আদর্শনিষ্ঠা, মূল্যবোধ ও ধর্ম বিশ্বাস বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ধর্ম বিশ্বাস বলতে কোন নির্দিষ্ট ধর্মমতের প্রতি আনুগত্য ছিল না - তার আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে পাওয়া কঠিন সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা। তিনি যেমন কোন প্রাচীন বা প্রচলিত ধর্মমতকে সম্পূর্ণ নিজের বলে স্বীকার করতে পারেননি আবার তার জীবনের তথা কাব্যের কোন এক পর্যায়ে অভিব্যক্ত ধর্মচিন্তা বা আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে তার সমস্ত জীবনের পক্ষে মেনে নিতে তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল। 'পত্রপুট' এ তিনি লেখেন -
সকল মন্দিরের বাহিরে
আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল
দেবলোক থেকে মানবলোকে,
আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষে
আর মনের মানুষে আমার অন্তরতম আনন্দে।
আমার মতে "শিশুতীর্থ" রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ গদ্য কবিতা। এই দশ পৃষ্ঠার ঠাস বুনন রচনায় আছে মহাকাব্যের সুবিস্তৃত পটভূমি,আছে অনুভব , আছে বলিষ্ঠ ভাষা র গভীর ঝংকার। ভাবতে অবাক লাগে যে এমন আশ্চর্য সার্থক কবিতা প্রথমে লেখা হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়। মিউনিকে যীশুখ্রীষ্টের জীবন লীলা অবলম্বনে রচিত একটা প্যাশন প্লে দেখে কবি অনুপ্রেরণা লাভ করেন পরে তা বাংলায় রূপান্তরিত হয় অনুদিত বলা যায় কারণ দুটোর ভাব ও বিষয়বস্তু একই।
পরিশেষ আর পুনশ্চ প্রকাশিত হয় ১৩৩৮-৩৯ সালে। পরিশেষ নাম শুনলে মনে হয় বইখানা যেন কাব্য ধারার সমাপ্তি ঘোষণা। তুমি হয়তো বুঝাতে চেয়েছিলে যে এটাই শেষ কাব্যগ্রন্থ এবং এরপর কবি কর্ম থেকে অবসর গ্রহন করবেন। প্রণাম কবিতাটিতে সেই ইঙ্গিত রয়েছে।
রবীন্দ্র সংগীতগুলো সরল, সুমিষ্ট ও প্রাণস্পর্শী। ধর্ম সঙ্গীতগুলো তান লয় স্বরযোগে যখন গীত হয় তখন মনে হয় বুঝি স্বর্গ হতে যে সকল সংগীত আকাশে ভেসে ধীরে ধীরে পৃথিবীতে এই সংসার দাবদাহে দগ্ধ মানবদের শান্তি দেবার জন্য নেমে এসেছে।
"তমস ঘন ঘোরা গহন রজনীর"
আপনার প্রণয় সংগীতগুলো সুমধুর ভাবে হৃদয়-তন্ত্রী আঘাত করে,প্রাণে বিশুদ্ধ প্রেমের সঞ্চার করে।
আমার প্রাণের মাঝে তেমন করে
নাচে তোমার প্রাণ
আমার প্রেমে তেমনি তোমার প্রেমের
বহুক না তুফান ।
গীতাঞ্জলিতে বহু সংখ্যক রোমান্টিক প্রেমের ও প্রকৃতি অনুরাগের গান আছে যাতে ভক্তির ছোঁয়া লাগে-
"শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু,হে প্রিয়",
"যে রাতে মোর দুয়ারগুলি",
"আরো আঘাত সইবে আমার",
"কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না",
"ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো",
"আমারে দিই তোমার হাতে"।
কিছু নিছক প্রেমের গান-
"আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে"
"আজি বারি ঝরে ঝর ঝর"
"আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে "
"এসো হে এসো, সজল ঘন বাদল বরিষনে"
কবির লেখা গানে ভক্তি এবং প্রেমের কিংবা ভক্তি এবং প্রকৃতি অনুরাগের কিংবা তিনটেরই সংগম ঘটেছে। যেমন,
"মেঘের পরে মেঘ জমেছে"
"আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার"
"পথ চেয়ে যে কেটে গেল কত দিনে রাতে"
"ও আমার মন যখন জাগালি না রে"
"আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা"
এরকম বহু সংখ্যক গান আমাদের খুবই পরিচিত। গীতাঞ্জলি বলতে এইসব গানের কলি সর্বাগ্রে মনে আসে। প্রেমের অথবা প্রকৃতি অনুরাগের মধ্যেই ভক্তিভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এইসব গানে। গানে আনন্দ ও বেদনা আছে, ভরসা ও নৈরাশ্য আছে, বিস্ময় ও রহস্যবোধ আছে, আর সর্বোপরি আছে ভক্তি।
গীতাঞ্জলি বলতে স্পষ্টতই ঈশ্বর প্রেমের কবিতা বা গান। এর অধিকাংশ গান শুনে আমি মুগ্ধ হই আপনার সুরের ঝরনা তলায়। এমনকি সুর বাদ দিয়ে শুধু কবিতার রূপে পাঠ করলেও মনে গভীরভাবে সাড়া দেয়।
কঠিনতর বেদনায় তিনি লিখলেন -
আরো আঘাত সইবে আমার সইবে আমারো,
আরো কঠিন সুরে জীবনতারে ঝংকারো।
ভয় করার সত্যিই কিছু নেই ,এগিয়ে গিয়ে বুক পেতে নিতে হবে সব কটি বাণ - লিখলেন ,
ও নিঠুর,আরো কি বাণ তোমার তূণে আছে?
তুমি মর্মে আমার মারবে হিয়ার কাছে ?
দেবতাকে একান্ত না পাওয়ার দুঃখ। লিখলেন,
তুমি যদি না দেখা দাও
করো আমায় হেলা
কেমন করে কাটে আমার
এমন বাদল বেলা।
গগনচুম্বী প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে কুন্ঠা কারোরই ছিলনা। বাংলা কাব্যে একনতুন মেজাজ ও আঙ্গিকের প্রবর্তক হওয়া সত্বেও বাংলা কাব্য কে একক সাধনায় এক নব উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন যার নাগাল পাওয়া অনুজ কবিদের পক্ষে অভাবনীয় । অনুজ কবিরা রাজপথ দিয়ে কিছুদূর এগোতে না এগোতেই বুঝতে পারলেন ওই পথ তারা আর যাই পান একান্ত নিজের গলার সুরটা খুঁজে পাবেন না। কল্লোল ও পরিচয় যুগের কবিরা শিক্ষা পেয়েছিলেন ঐ পাঠশালাতেই, তাদের চোখ-,কান ,কণ্ঠ ,মন, তৈরি হয়েছিল আপনার সুরের ঝরনা তলায় ।
---------------------------
শ্যামল হুদাতী
মোবাইল নম্বর- ৯৮৩১৮০০১৯১
Whatsapp 9831800191
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন