google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re নিবন্ধ ।। সৃষ্টির ভুবনে নজরুল স্বাধীন সম্রাট ।। শেফালী সর - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪

নিবন্ধ ।। সৃষ্টির ভুবনে নজরুল স্বাধীন সম্রাট ।। শেফালী সর

 সৃষ্টির ভুবনে নজরুল স্বাধীন সম্রাট

শেফালী সর

 রাঢ় বাংলার চুরুলিয়া  গ্রামে দুখু মিয়া ওরফে নজরুল মাটির ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দারিদ্র ও কঠিন সংগ্রামের মধ্যে তার জীবন অতিবাহিত হয়েছে। 'দেশ পরিবেশ ও সমাজের অবস্থা কেমন ছিল বা নজরুলের আবির্ভাবে সেই পরিবেশের কি পরিবর্তন ঘটেছিল- প্রসঙ্গক্রমে এই প্রশ্ন জাগে।  একটি গানের প্রথম কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করলে ওই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।' বাজলো কিরে ভোরের সানাই নিদ মহলার আঁধার পুরে।, শুনছি আজান গগনতলে অতীত রাতের মিনার চূড়ে।' একটি অতীতমুখী নিদ্রিত জাতির মধ্যে নজরুলের আবির্ভাবকে 'নিদ্ মহলার আঁধার পূরে আজান ধ্বনির উপমাতেই প্রকাশ করা চলে।বাঙালি মুসলমান সমাজে নজরুল ইসলামের জন্ম। ফজরের আজানে নিদ্রা অপেক্ষা প্রার্থনা শ্রেয় এই কথা বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ জাগরনের আহ্বান থাকে। এই কি বাঙালি মুসলমান সমাজের জাগরণের সূচক। একটি ঘুমন্ত জাতি বা সম্প্রদায়য়ে তো সৃজনশীল প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে না! কিন্তু বাঙালি সমাজে জন্মগ্রহণ করেও মক্ত ব, মাজার, মসজিদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে অতিবাহিত হলেও লেটো বা কবিদলের অনুষ্ঠানে বালক নজরুলের অংশগ্রহণ তাকে ঐতিহ্যের ভিন্নস্তরে নিয়ে গিয়েছিল। চা রুটির দোকানে, পুলিশের দারোগা সাহেবের চাকুরী তাকে শ্রমজীবী সমাজের অভিজ্ঞতা এনে দেয় কৈশোরেই।বিশেষত করাচির করাচির সেনানিবাসে অবস্থান নজরুলের জন্য ছিল প্রকৃত শিক্ষা জীবন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে পরিচয়, ব্রিটিশ অফিসারদের  দেখা, প্রথম মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সমকালীন ইতিহাসে জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে নজরুলকে দুই থেকে আড়াই বছরের সৈনিক জীবনের মধ্যে এক গ্রামীণ কিশোর থেকে নব ইতিহাসের  এক সচেতন যুবকে পরিণত করেছিল। নজরুলের ব্যক্তিত্ব গঠনে তার সৈনিক জীবন সবচেয়ে বেশি কার্যকর। নজরুল করাচি সেনা নিবাসী রচিত ' বাঁধন হারা 'র ৬ নম্বর কিস্তিতে লিখেছিলেন:- আগুন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনা- এই অষ্টধাতু দিয়ে আমার জীবন তৈরি হচ্ছে, যা হবে দুর্ভেদ্য, মৃত্যুঞ্জয়, অবিনাশী। আমারে পথ শাশ্বত  সত্যের পথ, বিশ্ব মানবের জনম জনম ধরে চাওয়া পথ, আমি আমার আমিত্বকে এই পথ থেকে মুখ ফেরাতে দেব না। "

ধর্ম সম্পর্কে অমন সহিষ্ণুতার কারণে নজরুল সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক হতে পেরেছিলেন। বাঙালি জাতির প্রধান দুটি শাখা হিন্দু ও মুসলমান, যার একটি কে বাদ দিলে বাঙালি খন্ডিত হয়ে যায়, বাঙালি থাকেনা। নজরুল বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে আজও প্রথম ও শেষ বাঙালি কবি কারণ তার আগে অপর কোন কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ এমন সম্পূর্ণরূপে বাঙালি ঐতিহ্যের পরিচর্যা করেননি। নজরুল তার কবিতায় প্রচুর মিথ বা পুরাণ ব্যবহার করেছেন কিন্তু তা অতীতের মহিমা প্রচারের জন্য নয়। তিনি অতীতের বর্তমানতায় বিশ্বাস করতেন। নজরুলের প্রেমের কবিতার পরিচয় দিতে গিয়ে আমরা ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির পরিচয় পেয়েছি। নজরুলের বিদ্রোহী ও আধ্যাত্মিক সত্তার মতো প্রেমিক সত্তার পরিচয় পেয়েছি ' বাঁধন  হারা'তে। তিনি শুধু বিদ্রোহী কবি ছিলেন না বেদনারও কবি ছিলেন। ' রাজবন্দীর জবানবন্দিতে ' সত্য সম্পর্কে নজরুল বলেছেন-" সত্য স্বয়ং প্রকাশ, তাহা কি কখনো কোন রক্ত আঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করিতে পারেনা আমি সেই চিরন্তন স্বয়ং প্রকাশের বীণা। যে বীনায় চির সত্যের বাণী ধ্বনিত হয়েছিল, আমি ভগবানের হাতের বীনা। বীনা ভাঙলে ও ভাঙতে পারে কিন্তু ভগবানকে ভাঙবে কে? এ কথা ধ্রুব সত্য।" বস্তুত নজরুল আত্মজীবনী লিখেননি বটে, কিন্তু আত্ম উন্মোচন করেছেন রাজবন্দীর জবানবন্দিতে।

"বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। আমি সেনা দলের তূর্য বাদকদের একজন। এই হল আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু আমি এই দেশের এই সমাজের নই, আমি সকল দেশের সকলমানুষের। সুন্দরীর ধ্যান ও তার স্তব গান আমার উপাসনা ও আমার ধর্ম। যে কুলে যে সমাজে যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।" নজরুলের এই বলিষ্ঠ উচ্চারণ থেকেই বোঝা যায় নজরুল নিজের মত, পথ ও লক্ষ্য সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত ছিলেন। নজরুলের শিল্পী সত্তার এক অজানা রূপের পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে বনগাঁ সাহিত্য সভায় প্রদত্ত সভাপতির ভাষণ থেকে। তিনি বলেছিলেন আমার সাহিত্য সাধনা বিলাস ছিল না। আমি আমার জন্মক্ষণ থেকে যেন আমার শক্তি আমার অস্তিত্বকে খুঁজে ফিরেছি। জীবনে কোনদিন কোন বাঁধনকে সহ্য করতে পারলাম না। কোন স্নেহ ভালোবাসা  আমায় বুকে টেনে রাখতে পারল না। এই পরম তৃষ্ণা যে পরম সুন্দরের তা আমি বুঝতে পারিনি। আমি কবি যশ প্রার্থী হয়ে জন্মগ্রহণ করিনি। আমি আমার অস্তিত্বকে, আমার শক্তিকে খুঁজতে এসেছিলাম  এই পৃথিবীতে। " ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির এক বিশেষ অধিবেশনে সভাপতিির ভাষণে বলেছিলেন,-" যদি বাঁশি আর না বাজে, আমি কবি বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারই বলছি - আমায় ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি - আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম -- সিপিএম পেলাম না বলে আমি প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। " এই বিদ্রোহী কবিকে প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহীর মর্যাদা দিতে পারিনি আমরা।

-----------------:--------------------

                     শেফালি সর 
                        জনাদাঁড়ি 
                         গোপীনাথপুর 
                   পূর্ব মেদিনীপুর 
                      ৭২১৬৩৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন