Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

ছবি
  সূচিপত্র  প্রবন্ধ-নিবন্ধ-মুক্তগদ্য-ভ্রমণকথা মেল্লক গ্রামের মদনগোপাল জীউর মন্দির ।। সায়ন মণ্ডল কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার ... হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। উজান... আমার রবীন্দ্রনাথ ।। সত্যেন্দ্রনাথ পাইন বৈকালিক বৈশাখ ।। ছন্দা দাম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার ।। পাভ... মে দিবস : অধিকারহরণ ।। শ্যামল হুদাতী শরীর ও মনের সুস্থতা ।। রতন বসাক মানুষ কী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিকট ভৃত্যমাত্র? ।।... আমাদের পরিবেশ ভাবনা ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত বিশ্বপ্রেম ।। আরতি মিত্র টান ।। মনোরঞ্জন ঘোষাল স্রষ্টার নিষ্ঠা ।। শংকর ব্রহ্ম বেগুনিয়া : বাংলার মন্দির স্থাপত্য ।। সু... ।। গল্প ।। বিকেল বাঁচাও আন্দোলন ।। সুবীর ঘোষ রাখে হরি তো মারে কে ।। সমীর কুমার দত্ত বিভ্রান্ত ।। রানা জামান সম্পর্ক ।। মাখনলাল প্রধান  ধারা মাস ঝরা মাস ।। প্রদীপ কুমার দে গল্পের মত অবিশ্বাস্য সত্য ।। বন্দনা সেনগুপ্ত ধর্মরাজ, লাখাই আর ডমরু সর্দারের গল্প... ভূতের বাচ্চা ।। নবী হোসেন নবীন গোধূলিবেলায় ।। সুচন্দ্রা বসু বিয়ে ।। রেজাউল করিম রোমেল ঘোড়ার ডিমের গল্প ।। প্রবোধ কুমার মৃধা নাত জামাই ।। সুদামক

নিবন্ধ ।। নজরুলের খাদ্যকাহন এবং হাস্যরসবোধ ।। পিয়াংকী

নজরুলের খাদ্যকাহন এবং হাস্যরসবোধ 

পিয়াংকী 


"কাজী নজরুল ইসলাম, শ্রীযুক্ত গোপাল চন্দ্র সেন এবং মৌলবী সিরাজউদ্দিন আহমদ এই তিনজনেই আজ ৪০ দিন হইল অনশনব্রত অবলম্বন করিয়াছেন......কাজী নজরুলকে অনশনের পঞ্চম দিনে নাকের ভিতর দিয়া জোর করিয়া খাদ্য দেওয়া হইয়াছিল কিন্তু তাহার ফলে তাহার নাকের ভিতর দিয়া রক্ত পড়িতে থাকে, তারপর হইতে কাজী নজরুল প্রায় অনশনেই আছেন....যে কোনো মুহূর্তে চরম দুঃসংবাদ আমাদের কানে আসিয়া পৌঁছাইতে পারে........." [২৩ শে মে, ১৯২৩, আনন্দবাজার , সম্পাদকীয় ]

এরকমই, অনশন যখন তুঙ্গে তখন গুরু রবীন্দ্রনাথের তারবার্তা আসে,"give up hunger strike, our literature claims you"
অবশেষে বিরজাসুন্দরী দেবীর হাতে লেবুজল খেয়ে কবি অনশন ভঙ্গ করেন দীর্ঘ ঊনচল্লিশ দিন পর।

নজরুল। এক ব্যতিক্রমী চরিত্র, বাঙালির মেধা মনন কালিকলমের সাথে আন্তরিক যুক্ত একজন সরল মানুষ, একজন দ্রোহের কবি। তাঁর জন্মতিথি সামনেই । অন্তরের সবটুকু শ্রদ্ধাঞ্জলি তাঁর চরণে অর্পণ করে লিখতে বসেছি কবির খাদ্য অভ্যাস নিয়ে। খাদ্য অভ্যাস বলব নাকি খাদ্য অনীহা এটা ভাবতে ভাবতে খুঁজে পাই তার এই খাদ্য অনশন সংক্রান্ত কিছু খবর।কোথায় যেন মনে হয় খাদ্যরসিক মানুষ আর যাই করুন না কেন অনশন করে না খেয়ে দিনযাপন করতে পারবেন না,যদিও মতামত ব্যক্তিগত। আপাতদৃষ্টিতে সরল এই মানুষটির প্রিয় খাবার বলতে দুটো জর্দা দেওয়া পান আর পেয়ালা পেয়ালা চা। দু'টো কেন বললাম আসলে কবি এতটাই পানভক্ত ছিলেন যে যখনই মুখে পুরতেন একসাথে দুটো। কবি বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এই পান সাজিয়ে গুছিয়ে কৌটোয় পুরে দিতেন কবিস্ত্রী প্রমীলাদেবী। খাবার ব্যাপারে এত সাধারণ ছিলেন নজরুল যে শোনা যায় প্রকাশকরা কয়েক খিলি জর্দাপান আর কয়েক কাপ চা দিয়ে বন্ধ ঘর থেকে  নিমেষেই বের করে আনতে পারতেন কালজয়ী সমস্ত সাহিত্য সৃষ্টি। নজরুল গবেষক আসাদুল হক-এর বলা কথা অনুযায়ী এত সাধারণ এবং স্বল্প আহারী মানুষ যিনি বিরিয়ানি পোলাও কোর্মা তো পছন্দ করতেনই না এমনকি গরুর মাংসও ছিল তার অপছন্দের তালিকায়।
 বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নেয়া কবি বিদ্রোহ লিখেছেন সোনার কলমে,লিখেছেন হাজারো গান কবিতা নাটক,লড়েছেন চরমতম দারিদ্র্যের সাথে। হয়তো সেই অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে তাঁর এই অতি সাধারণ জীবন যাপন। খাদ্য অন্বেষণ করেছেন অন্যভাবে,বেঁচে থাকার রসদের জন্য নিজের তৈরি মহলে সর্বদা ডুবে থেকেছেন সৃষ্টির গভীরে। সেই-ই ছিল তাঁর আসল খাদ্য। 

কবির পালিত কন্যা শান্তিলতাদেবীর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কবি জর্দাপান আর চা ছাড়া  পছন্দ করতেন ঝিঙেসুক্তো এবং পোস্তবাটা দিয়ে পাকা হলুদ কৈ মাছের রসা। অল্প তেল মশলায় রান্না করা মুগডাল মুসুরডালও খেতেন তৃপ্তি সহকারে। মাংসের মধ্যে মুরগী বা খাসি,কষা করে রান্না হলে গরম ভাতে খেতেন মজা করে, কিন্তু তাঁকে যারা সামনাসামনি দেখেছে সকলের কথা একই দিকে নির্দেশ করে যে খাবারের প্রতি বিশেষ কোনো লোভ ভালোবাসা ছিল না

১৯৪২এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মানসিকভাবে স্থিরতা হারিয়ে কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর বাকশক্তি হারিয়ে যায়,১৯৫৩ সালে Pic's Disease ধরা পড়ে। এইসময় থেকে তাঁর প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসে। নরম গলা ভাত আর সবজিই হয়ে যায় প্রধান খাদ্য।সহজে হজম হয় এমন খাবারই প্রধানত তাঁকে দেয়া হত তখন।  সেই সময়ও তার শৈল্পিক মন এমন স্থানেই থেকে গিয়েছিল যে সবজির শেপ বা আকৃতি দেখে খাবার মুখে তুলতেন। ব্যাঁকাত্যাড়া হলে থালা  সরিয়ে দিয়ে নিজের অপছন্দ বোঝাতেন। ঠিক এই কারণেই কবিপত্নী প্রমীলাদেবী নিজে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েও খুব কষ্ট করে কবির রান্নার সবজি কাটতেন,আর রান্নার পর ভাঙাচোরা টুকরোগুলো পাশে সরিয়ে সম্পূর্ণ সুন্দর করে সাজিয়ে কবিকে নিজে হাতে খাইয়ে দিতেন। কতটা প্রেম থাকলে এভাবেও স্বামীর জন্য ভাবা যায় তার প্রকৃত উদাহরণ প্রমীলাদেবী। নজরুল গবেষকদের মুখ থেকে এটাও জানা যায় নাস্তা বা ব্রেকফাস্টে কবির পছন্দ ছিল ওমলেট পরোটা। কোনোদিন সকালে বেরোনোর আগে নাস্তা রেডি না হলেও ছিল না রাগ ক্ষোভ। দু'খিলি পানই ভরসা সারাদিনের ব্যস্ততায়।

খাদ্যরসিক না হলে কি হবে কবি ছিলেন কাব্যরসিক।' নতুন খাবার ' কবিতায় তাঁর লেখা অবাস্তব সব রান্নার নাম শুনলে না হেসে থাকা মুশকিল 
"কম্বলের অম্বল
কেরোসিনের চাটনি,
চামচের আমচুর-
খাইছ নি নাৎনি?

আমড়া- দামড়ার
কান দিয়ে ঘষে নাও,
চামড়ার বাটিতে
চটকিয়ে কষে খাও!

শেয়ালের ন্যাজ
গোটা দুই প্যাঁজ
বেশ করে ভিজিয়ে,
ঘুট্ করে খেয়ে ফেল!

মুখে কোন কথা এল? 
কি মজার চীজ্ই এ?
ঝুমকো লতার পাতা
লাল পুতুলের মাথা

বেঁধে কারো টিকিতে,
ঢেঁকিতে বেশ করে
পাঁড় দিয়ে তার পরে
খেয়ো মেখে সিকিতে!

দাদার গায়ে কাদা
সাথে ছেঁচা আদা
খুব কষে মাখিয়ে,
বেরালীর নাকে
কিংবা কারু টাকে-
খেয়ো দেখি নেচি করে পাকিয়ে!"

...কত কী অবাক করা ঘটনা। প্রাণোচ্ছল জীবনরসে সিক্ত মানুষ ছিলেন বলেই হয়ত বুক বাজিয়ে লিখেছেন,"চির বীর /চির উন্নত মম শির"।

শিশুসুলভ মনের অধিকারী এই মানুষটি চলতি  কথাকেই ছন্দে বেঁধে দিতেন অবলীলায়। এই যেমন,যদি ছোটদের বিখ্যাত "লিচুচোর" কবিতার পেছনের গল্প খুঁজি তাহলে দেখব সে সময়কার একজন খ্যাত শিশু সাহিত্যিক ছিলেন আলি আকবর। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকও লিখতেন তিনি। সেই তিনিই একটি পান্ডুলিপি নজরুলকে পড়তে দিলেন, মতামত দিতে বললেন। কবি সেই পান্ডুলিপি পড়ে সরাসরি তাঁকে বলে বসলেন যে বাচ্চাদের উপযুক্ত লেখা হয়নি। এমনকি কবি নিজে একটি ছড়া লেখার ইচ্ছাও প্রকাশ করলেন। আকবর সাহেবের সনির্বন্ধ অনুরোধে নজরুল লিখলেন,"বাবুদের তালপুকুরে,হাবুদের ডালকুকুরে,সে কি বাস করলে তাড়া,বলি থাম একটু দাঁড়া..."

অতিপরিচিত " খুকি ও কাঠবিড়ালি" কবিতার আড়ালের গল্পও খানিক মজা হাসির। কবি নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে আছেন। পাশেই পেয়ারা গাছ। ডাসা ডাসা পেয়ারা ফলে আছে। কবি দেখছেন অঞ্জলি নামে একটি ছোট্ট মেয়ে ঐ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে অনেকক্ষণ ধরে,অনুনয়-বিনয় করে কি যেন চাইছে। কবি বুঝতে পারছেন না,শেষ পর্যন্ত উঠে গিয়ে দেখেন গাছে কেউ নেই, অঞ্জলিকে জিজ্ঞেস করায় সে বলে গাছে একটা কাঠবিড়ালি ছিল এবং সে ওই কাঠবিড়ালির কাছেই পেয়ারা চাইছিল।এই কথোপকথন কবির মনে এত প্রভাব বিস্তার করে যে একটা জলজ্যান্ত কবিতাই উপহার পায় বাংলা শিশু সাহিত্য ভান্ডার। সেই কালজয়ী সৃষ্টির দু'লাইন... "কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী! পেয়ারা তুমি খাও?/ গুড়-মুড়ি খাও! দুধ-ভাত খাও? বাতাবি লেবু? লাউ?..." 

জীবনবোধ লড়াই সংগ্রাম বিদ্রোহ যার রক্তের প্রতি বিন্দুতে সেই কবির বুকেই আবার সবুজ সবুজ গাছ  মজা হাসি। আসল কথা হল জীবনের সোমরস পান করেছেন তিনি আঁজলা ভরে,তুলে এনেছেন কালোত্তীর্ণ প্রবাহ।আজ তাঁর চরণ কমলে আমার বিনীত শ্রদ্ধাটুকু রেখে গেলাম।

===============
Piyanki Mukherjee 
Ichapur 






মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৫তম সংখ্যা ।। জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ মে ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত