হৃদয়ে শুধুই রবীন্দ্রনাথ
বীরেন্দ্র নাথ মহাপাত্র
রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকটি বাঙালীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন । প্রত্যেকের অন্দরমহলে তাঁর অবস্থান নিয়মিত ও গভীর । ইনি ইংরাজী ১৮৬১ সাল হইতে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত সশরীরে এই ইহলোকে বিচরণ করেছেন সসম্মানে । ওনার বয়স যখন আট বছর তখন থেকেই কাব্য রচনা শুরু ।
' আম স্বত্ব দুধে ফেলি,
তাহাতে কদলি দলি
সন্দেশ মাখিয়া তাতে,
হাপুস হুপুস্ শব্দ,
চারিদিক নিস্তব্ধ
পিপীলিকা কাঁদিয়া যায় পাতে, এই প্রথম কবিতাটিতে মুগ্ধ হয়ে ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকা নাথ ওনাকে সন্মানিত করেছিলেন ।মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মাকে হারান,তাই ওনার ছেলেবেলা ভৃত্যদের অনুশাসনে কেটেছিল ।
তিনি অসংখ্য কবিতা, গান, কাব্যগ্রন্থ, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, পত্রসাহিত্য, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য বাউল গান রচনা করেছেন । তাঁর নশ্বর দেহ ইহজগতে নেই কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন সারা বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষের তথা সারা বিশ্বের মানুষের মনের মণিকোঠায়। তিনি ভারত ও বাংলা দেশ এর জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, আবার শ্রীলঙ্কা ও।
ছোটবেলা থেকেই তিনি একাধিক বাউলের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি অনুভব করেছিলেন সৃষ্টি কর্তার অপরূপ সৃষ্টি। বাউলদের জীবনের টানাপোড়েন, ঘাত- প্রতিঘাত তাঁকে আকৃষ্ট করে। বাউল গানই - মানব প্রেমের প্রচারক - এটা বিশ্বাস করতেন বলেই তিনি সৃষ্টি করেছেন বহু অনবদ্য বাউল গান । যেমন - ' এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে ---', ' আমার প্রানের মানুষ আছে প্রানে ------, ' দেখেছি রূপসাগরের মনের মানুষ ----, ' গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা ----, ' পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে ----, এই সব বিখ্যাত গান ওনার অনবদ্য সৃষ্টি ।
প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ ছাড়া বাউল, সাধারণ মানুষ,অন্যায়ের প্রতিবাদ, জন্মদিন, মৃত্যুদিন, অবসর যাপনের দিন ভারতবর্ষ - সবেতেই আছেন সর্ব প্রথম ছোট গল্প 'ভিখারিনী'র গল্পকার, প্রভূত অনেক ছোট গল্প, বাংলা সাহিত্যে তিনি যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা চিরস্মরণীয় ও শাশ্বত ।
উপন্যাস 'নৌকাডুবি', 'চোখের বালি', 'গোরা', রাজর্ষি', 'ঘরেবাইরে' পাঠকের কাছে বিশেষ ভাবে সমাদৃত ।
নাটকে 'বিসর্জন', 'রাজরানী' , 'রক্তকরবী', 'ডাকঘর', 'অচলায়তন' প্রভৃতির সঙ্গে, 'ডাকঘর' নাটকে তোমার সঙ্গে যে পরিচয়, সেই পরিচয়ের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছি জীবন চর্চায় । তিনি বলেছেন - 'আছে দুঃখ,আছে মৃত্যু, বিরহ - দহন লাগে, তবু ও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে '।
নৃত্য নাট্য 'শ্যামা ', চিত্রাঙ্গদা ', বিশেষ ভাবে স্মরনীয়। বিশেষ করে নতুন করে চিত্রাঙ্গদা'তে নতুন করে গীতিনাট্যে নৃত্য নাট্যে রবীন্দ্রনাথ কে আবিষ্কার করি ।
কাব্যের ছন্দে,রাত্রির আসরে তারারা আলপনা দেয় 'নৈবেদ্য', সে তো আপনি এক প্রসাদের পাত্র যার পাঠে পৃথিবী তার প্রদক্ষিণের গতি শ্লথ করে শুনবে বলে ।
কবিতার বাতায়ন তাঁর কোন দিবসই পরিপূর্ণতা পায় না, যেমন 'ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে --
ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে ----, ফাল্গুনের প্রথমদিনে , ভালবাসার দিনে তাই কবির গানেই আশ্রয় ।
' বিবসনা ' কবিতায় বলেন -
' ফেলো গো বসন ফেলো,ঘুচাও অঞ্চল
পরো শুধু সৌন্দয্যের নগ্ন আবরণ ।"
এর চেয়ে চূড়ান্ত নগ্নতার আশ্লেষ রবীন্দ্র কাব্যে আর মেলে না ।
রবীন্দ্র নাথ স্ত্রী মৃণালিনীর মধ্যে স্বপ্নের প্রেমিকাকে খুঁজে না পাওয়ার বেদনা ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কবিতায় -
" আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে
তার পরনে ঢাকাই শাড়ি,কপালে সিঁদুর ।"
আবার বর্ষার গভীর প্রকৃতিতে মন ছল ছল করে ওঠে অজান্তেই - " এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘন বরিষায় - ,'
স্বপ্ন জয়ের এ সাহস সবই কিন্তু তাঁর " নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ' তে বর্ণনা করেছেন ।
মনে প্রশ্ন জাগে ' কবিতার ' অমিত লাবণ্য কোন রাস্তার বাঁকে প্রথম দেখে অন্যকে ?
কবিতাকে তিনি উনিশ শতকের ভাব বন্ধন এবং ভাষা বন্ধন থেকে মুক্ত করে আধুনিকতার বিশ্ব সভায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন। 'শ্রাবণী', 'সোনার তরী', চিত্রা', 'চৈতালি ', 'কল্পনা', থেকে শুরু করে লিখে গেছেন ' বলাকা ', পূরবী ', শ্যামলী , পুনশ্চ ', শেষ লেখা ', প্রভৃতি ।
"গীতাঞ্জলী' কাব্যকে ইংরাজী তে অনুবাদ করে ১৯১৩ সালে বিশ্ব বিখ্যাত নোবেল প্রাইজ পান । ১৯২৪ সালে ৬৩ বছর বয়সে এসে তিনি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো নামের আর্জেন্টাইন বিদেশিনীর দেখা পেয়েছিলেন । মিলারিও এ দুইমাস থাকতে হয় কবিকে । সেখান থেকে ফিরেই উনি লিখে ফেলেন ' পূরবী ' কাব্য গ্রন্থ ,উৎসর্গ করেন বিজয়াকে । এ কেউ নন উনি ওকাম্পো । ওনাকে ভালবেসে নাম রেখেছিলেন ,৩৪ বছর বিদেশিনীকে দেখে ভালবেসে ছিলেন মুদ্ধতায় লিখে ফেলেন " বিদেশী ফুল " কবিতাটি,
" কি তোমার নাম, হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তরে, নামেতে কী হবে ,---------- হে বিদেশী ফুল, আমি কানে কানে শুধানু আবার, ভাষা কি তোমার ।"
ওকাম্পো ' গীতাঞ্জলী ' পড়ে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি রবীন্দ্রনাথ ও ঈশ্বর কে প্রায় কাছাকাছি ভাবতে শুরু করেছিলেন । শুধু ব্যক্তিপর্যায়ে নয় সমস্ত ইউরোপের এক আত্মিক মহা সংকটের কালে গীতাঞ্জলীর শান্ত - সমাহিত সঙ্গীতের বাণী ছিল একটি অন্য রকম প্রশান্তির জায়গা ।
আবার ছোটদের সঙ্গে সম্পর্ক ,' জল পড়ে পাতা নড়ে, কিংবা যুগান্তর কারী গুণাবলী ' কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি নিয়ে, ওনার বিশ্বভারতীর পরিবেশ, ওই স্বপ্নের কোপাই নদীর ধারে। না - না এটা তো বৈশাখ নয় পৌষ মাস,তাইতো ' আমাদের ছোট নদী
চলে আঁকে বাঁকে ,
বৈশাখ মাসে তার
হাঁটু জল থাকে , বামদিকে সোনা ঝুড়ি আর ডানদিকে প্রান্তিককে রেখে একটু এগিয়ে সেই কোপাই নদী ।
এবারে আর নয়, তাই কবি গুরু তোমায় প্রনাম জানাই, আর অজান্তে গেয়ে উঠলাম,
" তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম" --- ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন