Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

ছবি
  সূচিপত্র  প্রবন্ধ-নিবন্ধ-মুক্তগদ্য-ভ্রমণকথা মেল্লক গ্রামের মদনগোপাল জীউর মন্দির ।। সায়ন মণ্ডল কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার ... হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। উজান... আমার রবীন্দ্রনাথ ।। সত্যেন্দ্রনাথ পাইন বৈকালিক বৈশাখ ।। ছন্দা দাম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার ।। পাভ... মে দিবস : অধিকারহরণ ।। শ্যামল হুদাতী শরীর ও মনের সুস্থতা ।। রতন বসাক মানুষ কী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিকট ভৃত্যমাত্র? ।।... আমাদের পরিবেশ ভাবনা ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত বিশ্বপ্রেম ।। আরতি মিত্র টান ।। মনোরঞ্জন ঘোষাল স্রষ্টার নিষ্ঠা ।। শংকর ব্রহ্ম বেগুনিয়া : বাংলার মন্দির স্থাপত্য ।। সু... ।। গল্প ।। বিকেল বাঁচাও আন্দোলন ।। সুবীর ঘোষ রাখে হরি তো মারে কে ।। সমীর কুমার দত্ত বিভ্রান্ত ।। রানা জামান সম্পর্ক ।। মাখনলাল প্রধান  ধারা মাস ঝরা মাস ।। প্রদীপ কুমার দে গল্পের মত অবিশ্বাস্য সত্য ।। বন্দনা সেনগুপ্ত ধর্মরাজ, লাখাই আর ডমরু সর্দারের গল্প... ভূতের বাচ্চা ।। নবী হোসেন নবীন গোধূলিবেলায় ।। সুচন্দ্রা বসু বিয়ে ।। রেজাউল করিম রোমেল ঘোড়ার ডিমের গল্প ।। প্রবোধ কুমার মৃধা নাত জামাই ।। সুদামক

গল্প ।। বয়সকাল ।। দীপক পাল

বয়সকাল

দীপক পাল


প্রতিদিন নরেনবাবু প্রায় সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে বাজার সেরে রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগটা রেখে এক কাপ গরম চা আর সেদিনকার খবরের কাগজটা বগলদাবা করে বাড়ির দক্ষিণ দিকের লাল বারান্দায় এসে আরাম করে বসেন। তারপর চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে আরাম সূচক শব্দ বার করেন মুখ দিয়ে। আজকেও চায়ের সাথে পকেট থেকে একটা বিড়ির বান্ডিল ও দেশলাইয়ের বাকস বার করে পাশে রাখলেন রোজকারের মতো। খবরের কাগজের প্রথম পাতার এপিঠ ওপিঠে পুরোটাই বিজ্ঞাপন।আর শেষ পাতাটার পিছনের পাতায় পুরোটাতেই বিজ্ঞাপন নরেনবাবুর এটা একদম ভালো লাগে না। আপন মনে বলেন ব্যবসাটা তোমরা খুব ভালই করছো গাছেরও খাচ্ছ আবার তলারো কুড়োচ্ছ।পাতাটা উল্টোলেন। প্রথম, থুড়ি, দ্বিতীয় পাতায় যে পাতা থেকে পাঠকরা পড়তে শুরু করে সেই পাতাটা সামনে মেলে ধরলেন। দেখেন গোটা পাতা জুড়ে রাজনৈতিক চাপান উতোরের খবর আর মারপিট আর খুনোখুনির খবর। নরেন বাবু বিরক্ত  হয়ে একেবারে খেলার পাতায় চলে গেলেন। কাল থেকে শুরু হচ্ছে ৫০ ওভারের একদিনের ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটের ম্যাচ। নরেন বাবু খুব মন দিয়ে পড়লেন। তারপর কাগজটা ভাঁজ করে রাখলেন। চা বিস্কুট খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। দারোয়ান কে ডেকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন সব। বারান্দার শেষ দিকটা হেলান দেবার মতো করে তৈরি করা। তিনি আর একটা বিড়ি ধরিয়ে সেখানে হেলান দিয়ে বসলেন। বিড়ি টানা শেষ করে সেটাকে নিভিয়ে ফুটপাথে ফেলে দিলেন দেখলেন, নিবারণ বাবু হাতে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজারে যাচ্ছেন। তাকে দেখে নরেনবাবু হাঁকলেন,


- '
কি নিবারণ বাবু বাজারে চললেন?'
- '
তবে কি আমি এই ব্যাগ নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি? আপনি কি বারান্দায় বসে আছেন?'
- '
আহা চটছেন কেন? আপনার শ্বশুর শাশুড়িতো বহুদিন আগেই গত হয়েছেন, তাই নাবাজারে যাচ্ছেন কিনা সেটাই জিজ্ঞেস করলাম। আমার অন্যায় হয়েছে।'

- ' হয়েছেই তো। ইচ্ছে করে এমন কথা বলেন কেন?'


গজ গজ করতে করতে তিনি চলে গেলেন। পেছন পেছন সুভাষ বাবু ব্যগ নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন,
- '
কি নরেনবাবু, দিলেন তো নিবারানবাবুকে ক্ষেপিয়ে।'
- '
যে ক্ষ্যাপে তাকে তো ক্ষ্যাপাতেই মজা, তাই না।'
- '
তা যা বলেছেন একদম ঠিক।' তিনি পা বাড়ালেন


           
নরেনবাবু আর একটু নিচে নেমে হাত দুটো মাথার নিচে আড়াআড়ি ভাবে রেখে চোখ বন্ধ করলেন। মনে মনে ভাবলেন, সেই কবে বাবার হাত ধরে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে এসে উঠেছেন। তখন সে ক্লাস সেভেনে পড়ে। কাছাকাছি হওয়ায় স্কুল পাল্টাতে হয়নি তার বাবা  কাস্টমসে চাকরি করতেন। ধীরে ধীরে তিনি মাধ্যামিক ও উচ্চ মাধ্যমিক খুব ভালো ভাবে পাশ করলেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করতেই বাবা অফিস থেকে একটা অ্যাপ্লিকেশন ফরম নিয়ে এসে নরেনবাবুকে দিয়ে ফিলাপ করিয়ে অফিসে জমা দিলেন। এদিকে কলেজেও ভর্তি হলেন। কিন্তু কাস্টমসের পরীক্ষাতেও বসলেন। নাম উঠলো লিস্টে। ইন্টারভিউ দিয়ে  চাকরিও পেয়ে গেলেন

 

বাবার ইচ্ছায় চাকরিতে জয়েন করলেন। যদিও তার অত তাড়াতাড়ি চাকরিতে ঢোকার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু বাবার দুর-দর্শিতার কোনো তুলনা ছিলনা। কয়েক বছরের মধ্যে তাকে বিবাহ দিয়ে দিলেন। কিন্তু নাতির মুখ তিনি দেখে যেতে পারলেন না। মা বাবা কেউনা। দুজনেই প্রায় এক বছরের মধ্যে গত হলেন। যাই হোক নরেনবাবু একদিন হঠাৎ করে একটা ইংরেজ সাহেবের কাছ থেকে তার মোটরসাইকেলটা বেশ সস্তায় কিনে নিলেন। সাহেব দেশে ফিরে যাবে তাই বিক্রি করে দিলো। মোটরসাইকেল পেয়ে নরেন বাবুর অফিসে যাতায়াত খুব সুবিধে হলো। তখন অত মোটরসাইকেল, স্কুটার ইত্যাদির তেমন চল ছিল না কারও বাড়িতে মোটর গাড়ি থাকা মানে তাদের বড়লোক মনে করতো সবাই। এমনি করে চলছিল বেশ ভালই। এর মধ্যে দুই ছেলে আর এক মেয়ে হলো তার। তারা সব পিঠোপিঠি এবং তাদের মধ্যে খুব মিলমিশ। মোটের ওপর খুব সুখী সংসার নরেন বাবুর। কিন্তু হঠাত একদিন অফিসে যাওয়ার পথে এসপ্লানেডে একজনকে বাঁচাতে গিয়ে একটা ডাবল ডেকারের সাথে জোর ধাক্কা লেগে গেলো। প্রচণ্ড চোট পেলেন তিনি। মোটর সাইকেলটা দুমড়ে মুচড়ে গেলো। তিনি জ্ঞান হারালেন। কে বা কারা তাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। তারা ব্যাগ ঘেঁটে বাড়িতে ও অফিসেও ফোন করে দেন। তিনি সে যাত্রায় বেঁচে যান কিন্তু কয়েক মাস হাসপাতালে থাকতে হলো। অপারেশন করে একটা পা ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছিল। অপারেশনের পর তার ওই পাটা মনে হয় ঠিক মত সেটিং হয় নি। সেট করতে হলে আবার অপারেশন করতে হতো। কিন্তু তিনি আর ও মুখো হন নি। এ জন্য তার মনে কোনো ক্ষেদ ছিল না। তিনি বরাবরই মজার ও রসিক প্রকৃতির


           
কাস্টমসে দীর্ঘ দিন চাকরির সূত্রে তার বেশ কিছু টাকা জমেছিল। অবসর নেওয়ার পর তিনি একজন ফার্মাসিস্টের সহায়তায় রাস্তার কাছে একটা ওষুধের দোকান খুললেন। সকালে একজন চাইল্ড স্পেশালিস্ট ও বিকালে একজন জেনারেল এম. ডি কে বসাবার ব্যবস্থা  করলেন কিছুক্ষণের জন্য। ওষুধের দোকান বেশ ভালো চলতে লাগলো। তার দুই ছেলে এখন দোকানটা চালায় ওরা দোকানটা আরও ভালো ভাবে চালাচ্ছে। তিনি প্রায় রোজই বিকালে দোকানে গিয়ে বসেন।ছেলেদের সাথে প্রয়োজনীয় কথা হয়। দরকার হলে একটু হেল্প করেন সন্ধ্যে হলেই ছেলেরা জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তিনি একসময় বাড়িও ফিরে আসেন। এমনিতে তার বিশেষ অসুস্থতা নেই, এক কোমরে ব্যথা ছাড়া। তবে গিন্নি মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওষুধের দোকানটা করে বেশ উপকার হয়েছে পরিবারের পক্ষে। ডাক্তার আর ওষুধ পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। পরিবার বলতে তিনি আর গিন্নি ছাড়া দুই পুত্র ও দুই পুত্র বধূ, বড়ো ছেলের ঘরে এক নাতি. এক সর্বক্ষণের দারোয়ান কাম জোগারে। এ ছাড়া দুজন ঠিকা কাজের লোক। একজন রান্না করে আর বাসন মাজে আর একজন ঘর দোর পরিষ্কার রাখে। ব্যাস এই।  বৌমারা শ্বশুর শ্বাশুড়িকে খুব যত্ন করে। নরেন বাবু ছেলে মেয়েদের খুব ঘটা করে বিয়ে দিয়েছেন। প্রচুর ব্যয় করেছেন সেই সময়


           
হঠাত তার খেয়াল হলো বেলা তো অনেক গড়িয়ে গেছে। তিনি বিড়ি আর দেশলাই হাতে নিয়ে উঠে পড়লেন দোতলায়। ওপরে উঠে দেখলেন রান্না করে রাঁধুনি চলে গেছে। রান্নাঘরের কোনে চেয়ারটা এখন খালি। মনিদিপা রান্না চলাকালীন ওই চেয়ারে বসে রান্নার তদারকি করেন
আর স্কুল ফেরত নাতির সাথে কথা বলেন। কথা মানে হৈ চৈ করা একপ্রকার। যে মেয়েটি ঘর দোর পরিষ্কার করে তাকেও বকা বকি করেন। নরেন বাবুর এসবে কোন মন নেই। তিনি গামছা নিয়ে স্নান ঘরে  ঢোকেন। স্নান করে বেরিয়ে দেখেন বড়ো বৌমা ছেলেকে খাওয়াচ্ছে আর তাকে গল্প বলছে। ছোট বৌমা এসে বললো,


- '
বাবা, আপনাকে খেতে দিয়ে দি? মা ও আপনার জন্য বসে আছে।'
- '
দাও, তবে সে কি এখন খাবে?
-'
মাকে ডেকে আনছি।'


           
ছোট বৌমা দৌড়ে গিয়ে স্ত্রী মনিদিপাকে ডেকে আনলো। মনিদিপা তার উল্টো দিকের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো। ছোট বৌমা দুজনের থালায় ভাত বেড়ে ভাতের একপাশে ডাল ঢেলে পাশে বেগুন ভাজা দিলো তারপর রান্নাঘরে গিয়ে তরকারি আর মাছের বটিগুলো থালার পাশে সাজিয়ে রেখে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলো।খেতে খেতে নানা প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কথা হলো খাওয়ার পরে নরেন বাবু উঠে গেলেন।  হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকলেন। একটু পায়চারি করে শুয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলেন তারপর জামা কাপড় পরে বেরিয়ে পলেন। একটু হেঁটে দোকানে গিয়ে বসলেন। সন্ধ্যে হয়ে গেলে ছেলেরা তাড়া দেয় ঘরে ফেরার জন্য। তিনি ফিরে এলেন বাড়িতে। চা টা খেয়ে একটু বারান্দায় বসেন। পাশের বাড়ির দোতলায় অন্দুলের এক জমিদার থাকেন। আগে খাজনা আনার লোক ছিল এখন জমিদারি যাওয়ায় আর খাজনা আসে না। তার রাসভারি চলাফেরায় আর ব্যবহারে জমিদার বলে বোঝাই যায়। কিন্তু তিনি সবার মামা বাবু। তার একটা বিশেষ গুন ছিল। ভীষন ভালো সরোদ বাজাতেন মামাবাবু। সন্ধ্যা হলেই এক তবলচি আসতো। তারপর ওনার সরোদ বাদন শুরু হতো। কি চমৎকার বাজাতেন তিনি। নরেনবাবু চোখ বন্ধ করে শুনতেন। সুরের মূর্ছনা চতুর্দিকে যেন ছড়িয়ে পড়ত। এমনি নরেনবাবুর সাথে মামাবাবুর খুবই কথাবার্তা হয়, কিন্তু কেউ কারও বাড়ি যান না। মামা বাবু কখনো সখনো দেবলেনে তার এক বন্ধুর কাছে যান। তিনিও কোথাকার এক জমিদার ছিলেন। সেখানে আসর বসতো একতলায়। রাস্তা থেকে দেখা যেত। তার আবার এক বিশেষ সখ ছিল। রাস্তার ঠিক উল্টো দিকে তার একটি চিড়িয়াখানা ছিল। তাতে নানা রকমের পাখি তো ছিলই এছাড়া ছিল দুটো ময়ূর, হরিণ আর একটা শিম্পাঞ্জি। খুব উঁচু করে লোহার রেলিং দিয়ে দেওয়া ছিল। রিলিংর ফাঁক দিয়ে সব দেখা যেত ঝুলে ঝুলে শিম্পাঞ্জির দোল খাওয়া ভল্ট দেওয়ার মতো নানা কসরত। মেজাজে খুব সিগারেট টানতো। জমিদারি যাওয়ার পরে মনে হয় তিনি সব বিক্রি করে দেন। শেষের কিছুটা জমি পাশের লাইব্রেরিকে দান করে দেন। মামা বাবু যেদিন তার বন্ধুর কাছে যান সেদিন কোঁচানো শান্তিপুরি ধুতি আর খুব দামী পাঞ্জাবি পরে আর হাতে একটা ছড়ি নিয়ে রাস্তা দিয়ে যখন যেতেন একটা ভারী মিষ্টি গন্ধ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ত


             
মামাবাবুর সরোদ বাদন কখন শেষ হয়ে গেছে তার খেয়াল নেই। চমক ভাঙলো ছোট বৌমার ডাকে
- '
আপনার ভাত বাড়ছি বাবা আপনি আসুন এখুনি।'
- '
হ্যাঁ চলো বৌমা। অল্প করে দিও। বয়স তো হলো।'
- '
আচ্ছা আপনি আগে আসুন তো।'


           
তিনি খাবার টেবিলে বসতেই নাতি দৌড়ে এলো এমনিতে ও সর্বক্ষণই দৌড়চ্ছে। তার জন্য পরে গিয়ে ব্যথাও পায় প্রচুর


- '
দাদু দাদু কালকে আমাদের স্কুল ছুটি, কি মজা।'
- '
কেনো কেনো ছুটি কেন?'
- '
কাল আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস। আমার সকালে পড়া হয়ে গেলে তোমার সাথে খেলবো, কেমন?'
- '
কিন্তু আমার যে দাদু কোমরে বড্ড ব্যথা।'


           
বড়ো বৌমা তার কাছে ছুটে এলো
- '
না বাবা আপনি ওর কথা একদম শুনবেন না। এই তুই এখান থেকে গেলি। না হলে পড়তে বসাবো আবার।'


           
অমনি অপু ছুট্টে পালিয়ে গেলো। নরেনবাবু বললেন,
- '
আহা কেনো বকছো। কালকের ব্যাপার কালকে।'
- '
না বাবা আপনি একদম পাত্তা দেবেন না ওকে। আপনার তো বয়স হচ্ছে নাকি।'
- '
আচ্ছা ঠিক আছে।' খেয়ে মুখ ধুয়ে উনি ঘরে গেলেন।'


           
পরদিন সকালে নিচের লাল বারান্দায় বসে চা পান করতে করতে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আজকে একটু দেরি হয়ে গেছে বাজার করতে। কাগজের সামনের পাতাটা একটু পড়ে তিনি একেবারে খেলার পাতায় চলে গেলেন। কাগজ পড়তে পড়তে দেখলেন ব্যাগ হাতে নিবারণ বাবু বাজারে যাচ্ছেন। ভাবলেন মজা করা যাক


- '
ও নিবারণ বাবু, ব্যাগ হাতে নিয়ে তো বাজারে যাচ্ছেন, অফিসে নিশ্চয়ই যাচ্ছেন না। বাজারের ব্যাগ নিয়ে কি কেউ অফিসে যায়? অফিসের ব্যাগতো হয় আলাদা রকম, কি বলেন তাই না?'


           
কথাটা শুনেই নিবারণ বাবু রাগে রাস্তা থেকে ফুটপাথে উঠে একেবারে নরেন বাবুর সামনে দাঁড়ালেন
- '
বয়সতো আপনার আশি অনেকদিন পেরিয়ে গেছে তাও আপনার এত ইয়ার্কি আসে কি করে লজ্জা করেনা?'


- '
কিসের লজ্জা? বয়স তো একটা সংখ্যা মাত্র।  আর আমি কি ছেলে ছোকরাদের সাথে ইয়ার্কি করতে গেছি? আমি করছি আমার সমবয়সী বন্ধুর সাথে। সেটা নিশ্চয় কোনো অন্যায় নয়, কি বলেন? আপনি কি নিজেকে বুড়ো ভাবেন নাকি?'
- '
কেন বুড়ো ভাববো নাআশি পেরিয়ে যাওয়া লোক কি জোয়ান নাকি বুড়ো খোকা, এ্যাঁ?'
- '
জোয়ান না হলেও অন্তত মনে মনে নিজেকে অন্তত বুড়ো ভাববো না। রোজ মশাই কাক ভোরে মর্নিং ওয়াক করি, দোকান বাজার করি আর বিকালে দোকানে বসি সেটা জানেন। কেনো ভাববো আমি বুড়ো বলুন?'
- '
যান যান মশাই আপনার মাথায় কিছু গন্ডগোল আছে নির্ঘাত, আপনি পাগল।'


           
গজ গজ করতে করতে নিবারণ বাবু বাজারের ব্যগটাকে জোরে জোরে দোলাতে দোলাতে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এক মর্নিং ওয়াকের বন্ধু তাপস মাইতি বাজার করে ফিরছিলেন। তিনি এসে বললেন,


- '
আপনি কি নিবারণ বাবুকে কিছু বলেছেন? দেখছি উনি রেগে গিয়ে আপন মনে বকতে বকতে চলেছেন, ‘বুড়ো হয়ে ভীমরতিতে ধরেছে। আশি পেরিয়ে যাওয়া বুড়ো নিজেকে জওয়ান ভাবছে। পাগল।'

- ' ক্ষ্যাপাকে ক্ষ্যাপাতে মজা। নিবারণ বাবু আসলে খুব সাধাসিধে লোক বোকা, তাই একটুতেই রেগে যান।'

- ' ঠিক বলেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হলো নিবারণ বাবু, আপনাকে কেউ কিছু বলেছে? উনি যেন আমাকে দেখতে পাননি আমার কথা শুনতেও পাননি বক বক করতে করতে পাশ দিয়ে চলে গেলেন। কি আর বলি। আমি এখন চলি নরেন বাবু বড় দেরি হয়ে গেছে।'


- '
হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন। কাল আবার সকালে দেখা হবে।'


           
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম করে উঠে পড়লেন। বসে থেকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর গিন্নি মনিদিপাকে ডেকে বললেন এক কাপ কড়া করে চায়ের ব্যবস্থা করতে


- '
ওমা, কেন এত তাড়াতাড়ি?'
- '
শরীরটা কেমন যেনো ম্যাজম্যাজ করছে।' নরেনবাবুরকপালে একটু হাত দিয়ে বললেন,
- '
সত্যিই তো, কপালটা গরম গরম লাগছে। দাঁড়াও দেখছি।মনিদিপা উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলো। আবার কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলো। বললো,
- '
ছোট বৌমা টের পেয়ে আমায় বললো, আপনি মা বাবার পাশে যান আমি সবার জন্য চা বানিয়ে আনছি এই ওষুধটা দিলো চায়ের সঙ্গে খাবার জন্য।'
- '
আবার ওষুধ কেন?'
- '
জানিনা বাবা, বলেছে যখন খেয়ে নিও।'


           
দু কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকলো ছোট বৌমা। চায়ের ট্রে টা বিছানার ওপরে রেখে নরেনবাবুর কপালে হাত দিয়ে বললো,


- '
এখনও তেমন জ্বর আসেনি, তবে আসতে পারে, গা ম্যাজ ম্যাজ করছে যখন। চায়ের সাথে ওষুধটা মনে করে খেয়ে নেবেন কেমন। ' মনিদিপা বললেন,


- '
তোমার চা কই? তুমি চা খাবে না?'
- '
আমি দিদির সাথে বসে আরাম করে গল্প করতে করতে খাবো।' ছোট বৌমা চলে গেলো। মনিদিপা বললেন,


- '
আজ আর তোমার বাইরে যেতে হবে না। সন্দীপের সাথে কথা বলে নিও, না হতো ওরা আবার চিন্তা করবে আর কালকে মর্নিং ওয়াকে ও যেতে হবে না।'


           
চা আর ট্যাবলেট খেয়ে শরীরটা কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ ঝরঝরে হয়ে উঠলো। বসে বসে কিছুক্ষণ স্ত্রীর সাথে বাক্যালাপ করলেন, তারপর মনিদিপা এক সময় উঠে গেলো। জানলা দিয়ে তিনি দেখলেন মামা বাবুর স্ত্রী খুব ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন। তিনি খুব সুন্দরী এবং ফর্সা ঘোমটা টেনে চলেন। পেছনে পেছনে চলে একটা চাকর।সপ্তাহে বড়ো জোর একবার সেই প্রাক্তন জমিদার বাবুর বাড়ি যান। তার স্ত্রীর সাথে তার সই। আবার সন্ধ্যার মধ্যে সেই চাকরের সাথে ফিরে আসেন। হাঁটা চলার মধ্যে বেশ মার্জিত আভিজাত্য। কিন্তু মামাবাবুর ছেলে মেয়েদের মধ্যে সেটা বোঝা যায় না। তারা যে খুব একটা ঘর থেকে বেরোয় সেটা না। স্কুলের গাড়িতেই তারা যাতায়াত করে কিন্তু বাবা মায়ের মতো আভিজাত্য প্রকাশ পায় না এবার মামাবাবুর তবলচিকে আসতে দেখা গেলো বায়া-তবলা নিয়ে রিক্সায়। তার কিছুক্ষণ পড়ে মামা বাবুর সরোদের মূর্ছনা ছড়িয়ে পরে চতুর্দিকে। নরেন বাবু চুপ করে শুনছেন শুয়ে শুয়ে। একসময় নাতি এসে ডাকলো,


- '
দাদু দাদু, তোমাকে দিদুন খেতে ডাকছে।'


           
তিনি সরোদ বাদন শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন টের পান নি। নাতিকে বললেন,
- '
তোমার খাওয়া হয়ে গেছে দাদু ভাই? '
- '
আমার খাওয়া হয়ে গেছে, পড়াও হয়ে গেছে।'
-' 
বেশ বেশ চলো আমিও খেয়ে নি।'


           
খাওয়ার পর তিনি পায়চারি করছেন অভ্যাসমত
ফার্মেসি থেকে বড়ো ছেলে ফোন করলো,
- '
বাবা তোমার শরীর কেমন আছে এখন?'
- '
ভালো, কেন? '
- '
বাবা দীপের বাবা এইমাত্র মারা গেছে খবর পেলাম।'
- ' 
দীপের বাবা, মানে নিবারণ বাবু।'
- '
সে কিরে, কিভাবে মারা গেছে জানিস?'


- '
সকালবেলা বাজার থেকে এসেই  তিনি নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীপ ডাক্তার আনার কথা বললে তিনি নাকি বলেন, ডাক্তার ডাকতে হবে না, আমার কিছুই হয়নি, আমি এখনও বুড়ো হয়ে যাই নি। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। তোর অফিসের দেরি হয়ে যাবে তুই রেডী হয়ে যা। আমার কিছু হবে না। দীপ অফিসে যাওয়ার তোর জোর করছিল। বেরোবার আগে দেখে গেলো যে বাবা উঠে বসেছে। ভালই মনে হলো বাবাকে দেখে কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করতে বলেছিল ভালো আছে এদিকে কারও সাথে কথা বলছিল না সেরকম। হ্যাঁ হুঁ বলে চালিয়ে দিচ্ছিলো। খেয়ে দেয়ে ঘরে ঢুকতে যেতে  চৌকাঠে হোচট খেয়ে পড়ে যান।  কোনোমতে ধরাধরি করে খাটে শুইয়ে দেওয়া হয়। ফোন করে দীপকে জানানো হয়। এক ডাক্তারকে কোনোমতে রাজী করিয়ে আনা হয়। কারণ ওই সময় ডাক্তার পাওয়া খুব মুস্কিল ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, ‘দেরি হয়ে গেছে, উনি আর বেঁচে নেই।  এক ঘন্টা পরে আমার চেম্বারে কাউকে পাঠিয়ে দেবেন, ডেথ সার্টিফিকেটটা দিয়ে দেবো।'


           
নরেন বাবু টেলিফোনটা রেখে ধপ করে বসে পড়লেন বিছানায়। জ্বর জ্বর ভাবটা যেন আবার ফিরে এলো। মনে মনে ভাবলেন নিবারণ বাবুর মৃত্যুর জন্য তিনি কিছুটা দায়ী নন তো। তিনি ভাবলেন তার ইয়ার্কি নিবারণ বাবু খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন। ইয়ার্কিটা মোটে বোঝেননি তিনি। হায় ভগবান। নরেন বাবুকে ভেঙ্গে পরতে দেখে মনিদিপা তার পাশে এসে বসলেন


- '
তোমার বন্ধু বলে তুমি খুব আঘাত পেয়েছ বুঝেছি কিন্তু অন্য দিকে দেখতে গেলে ওনার তো বয়স হয়েছে তাই না বলো?'


- '
ঠিক বলেছো মনি তুমি। সময় হলে সবাইকে একদিন যেতে হয়। ঐসব সংখ্যা টংকা বলে কোনো লাভ নেই।মনে কোনো দুশ্চিন্তা না রাখলেই হলো। যা হবার তাতো হবেই।'



                       -
০-০-০-০-০-০-০-০-

Dipak Kumar Paul,
DTDC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata-700104.

 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৫তম সংখ্যা ।। জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ মে ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত