Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

ছবি
  সূচিপত্র  প্রবন্ধ-নিবন্ধ-মুক্তগদ্য-ভ্রমণকথা মেল্লক গ্রামের মদনগোপাল জীউর মন্দির ।। সায়ন মণ্ডল কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার ... হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। উজান... আমার রবীন্দ্রনাথ ।। সত্যেন্দ্রনাথ পাইন বৈকালিক বৈশাখ ।। ছন্দা দাম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার ।। পাভ... মে দিবস : অধিকারহরণ ।। শ্যামল হুদাতী শরীর ও মনের সুস্থতা ।। রতন বসাক মানুষ কী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিকট ভৃত্যমাত্র? ।।... আমাদের পরিবেশ ভাবনা ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত বিশ্বপ্রেম ।। আরতি মিত্র টান ।। মনোরঞ্জন ঘোষাল স্রষ্টার নিষ্ঠা ।। শংকর ব্রহ্ম বেগুনিয়া : বাংলার মন্দির স্থাপত্য ।। সু... ।। গল্প ।। বিকেল বাঁচাও আন্দোলন ।। সুবীর ঘোষ রাখে হরি তো মারে কে ।। সমীর কুমার দত্ত বিভ্রান্ত ।। রানা জামান সম্পর্ক ।। মাখনলাল প্রধান  ধারা মাস ঝরা মাস ।। প্রদীপ কুমার দে গল্পের মত অবিশ্বাস্য সত্য ।। বন্দনা সেনগুপ্ত ধর্মরাজ, লাখাই আর ডমরু সর্দারের গল্প... ভূতের বাচ্চা ।। নবী হোসেন নবীন গোধূলিবেলায় ।। সুচন্দ্রা বসু বিয়ে ।। রেজাউল করিম রোমেল ঘোড়ার ডিমের গল্প ।। প্রবোধ কুমার মৃধা নাত জামাই ।। সুদামক

শ্রুতিনিটক ।। বাঙালির আইকন রবিঠাকুর ।। অনিন্দ্য পাল

বাঙালির আইকন রবিঠাকুর 

অনিন্দ্য পাল


গিন্নি: ও গো শুনছো! যাও না বাজারটা করে আনো না। এরপর তো রান্না করতে আমার কালঘাম ছুটবে! 
কর্তা: আজ বাজার না করলেই কি নয়? 
গিন্নি: কেন? আজ কি আমাদের উপোস না কি? কোনও উৎসব আছে বোধহয়! 
কর্তা: গিন্নি ভুলে গেছ আজ বাঙালির সবচেয়ে বড় আইকনের জন্মদিন!  
গিন্নি: এমন কার জন্মদিন? যার জন্য বাজার করাও বন্ধ? 
কর্তা: আরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। আজ তো ২৫শে বৈশাখ। 
গিন্নি: ওহ্, ভুলে গেছি একদম! এই হেঁসেল টানতে টানতে… 
মৃত্তিকা (কন্যা): কিন্তু বাবা কবে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? 
কর্তা: সেটাও জানিস না? এই তোরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা সিনেমা আর্টিস্ট, 
ক্রিকেট প্লেয়ারদের জন্মকুণ্ডলী মুখস্থ রাখিস কিন্তু রবিঠাকুরের কথাই ভুলে যাস! শুনে রাখ, ১২৬৮ সনের ২৫শে বৈশাখ (১৮৬১ সালের ৮ মে) তিনি এসেছিলেন বাংলার মাটিতে। কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর সারদা দেবীর কোল আলো করে এলেন সেদিন। সে সময় ছিল বাংলার 'সুবর্ণ যুগ'। সে যেন একটা যুগ সন্ধিক্ষণ। সিপাহী-যুদ্ধের পর তখন বাংলাদেশের মনে একটা নতুন উত্তোরণের সৃষ্টি হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমর "মেঘনাদবধ" কাব্য মিত্রাক্ষর ছন্দের শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কবি রঙ্গলাল তাঁর 'পদ্মিনী' কাব্যে ঘোষণা করেছেন, 
    
              স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, 
                                            কে বাঁচিতে চায়, 
                দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় রে 
                                            কে পরিবে পায়। 

                  দিনেকের স্বাধীনতা স্বর্গসুখ তায় রে, 
                                                  স্বর্গসুখ তায়। 
 দীনবন্ধু মিত্রের "নীলদর্পণ" নাটকে এই সময়েই বিদেশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্রকণ্ঠে উঠেছিল বিদ্রোহধ্বনি। 
গিন্নি: উহ্, এই তীব্র গরমে জন্মেও কত কি যে করে গেছেন বাঙালির জন্য - সত্যি ভাবা যায় না! বাঙালি আর বাঙলা ভাষার জন্য তিনি যা রেখে গেছেন আজও সেই সম্পদ ভাঙিয়েই বেঁচে আছে বাঙালি। আর গ্রীষ্মের দাবদাহে কবি কখনও বিচলিত হতেন না। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের নিদারুণ গ্রীষ্মে যখন পুকুর-কুয়ো সব শুকিয়ে কাঠ, অসহ্য উত্তাপে আশ্রমবাসী যখন দরজা-জানালা বন্ধ করে বীরভূমের পাথুরে লালমাটি ছুঁয়ে আসা তীব্র তাপিত আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নিরুপায় গৃহবন্দী, ক্লান্ত কয়েকটা গরু কোনও বড় গাছের ছায়ায় বসে চোখ বুজে জাবর কাটছে, সেই দাবদাহের দুপুরে উদয়নের সমস্ত জানালা-দরজা খুলে মনের আনন্দে টেবিল চেয়ারে বসে লেখালিখিতে মগ্ন থাকতেন কবি। 
মৃত্তিকা: কিন্তু তিনি এত কিছু লিখলেন জীবনে- যা আমরা একটা জীবনে পড়েই শেষ করতে পারব না। ৫২ টা কাব্যগ্রন্থ, ৩৮ টা নাটক, ১৩টা উপন্যাস, ৩৬টা প্রবন্ধ, ৯৫ টা ছোটগল্প, প্রায় ২২০০ গান( যার মধ্যে ১৯১৫টি গান গীতবিতানে সংকলিত হয়েছে)। 
শুধু তাই নয় তাঁর আঁকা ছবির সংখ্যা আড়াইহাজারেরো বেশি। সারা জীবনে দশ-বারো হাজার চিঠি লিখেছেন। 
কর্তা: বিশ্বকবি যে শুধু লিখেছেন তা নয়, বিভিন্ন সময়ে বিদেশি লেখক-কবিদের সৃষ্টির অনুবাদও করেছেন। বহুভাষাবিদ কবিগুরু ইউরোপীয় সাহিত্যে ভিকতর উগো, শেলি, আর্নেস্ট মায়ার্স, অব্রে দ্য ভের, পি বি মার্স্বন, মুর, মিসেস ব্রাউনিং, রসেটি সুইন বার্ণ, জার্মান ভাষার হাইনরিখ হাইন এবং গ্যেটের বিভিন্ন লেখার অনুবাদ করেছিলেন।১২৯৪ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের অনুবাদ করা গ্যেটের 'ফাউস্ত' উপহার দিয়েছেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে। 
গিন্নি : আচ্ছা উনি কি তবে শুধু বিদেশি লেখকদের লেখা অনুবাদ করেছেন? দেশীয় অন্য ভাষার কোনও লেখা কি অনুবাদ করেন নি? 
কর্তা: কেন করবেন না? অবশ্যই করেছেন। বেদ, উপনিষদ, মনুসংহিতা, কালিদাস-ভবভূতি, পালি-প্রাকৃত কবিতা এবং বিদ্যাপতির মৈথিলি রচনার অনুবাদও করেছেন তিনি। 
মৃত্তিকা: বাবা, রবিঠাকুর নিজে তো স্কুলে পড়াশোনা করেন নি। কিন্তু শুনেছি তিনি নাকি দেশের শিক্ষা নিয়ে অনেক কিছুই ভেবেছিলেন। 
গিন্নি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষা সম্পর্কে খুব গভীর চিন্তা করতেন। প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা নিয়ে তাঁর একটি মন্তব্যের কথা আমার মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, 
"ভারতবর্ষ যে সাধনাকে গ্রহণ করেছে সে হচ্ছে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে চিত্তের যোগ, আত্মার যোগ অর্থাৎ সম্পূর্ণ যোগ। কেবল জ্ঞানের যোগ নয়, বোধের যোগ। কেবল ইন্দ্রিয়ের শিক্ষা নয়, কেবল জ্ঞানের শিক্ষা নয়, বোধের শিক্ষাকে আমাদের বিদ্যালয়ে প্রধান স্থান দিতে হবে। " 
          ভারততীর্থ কবিতায় এই প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, 
    "দিবে আর নিবে, মিলাবে, মিলিবে, যাবে না ফিরে।"-- আমরা ভিখারির মত শুধু হাত পেতেই নেব না, আমাদের জ্ঞান আর মেধার সঞ্চয় দিয়ে তা কিনে নেব পশ্চিম থেকে বা অন্য কোন সমৃদ্ধশালী দেশ থেকে। 
      তিনি একজায়গায় বলেছেন, 'নিজের ভাষায় চিন্তাকে ফুটিয়ে তোলা সাজিয়ে তোলার আনন্দ গোড়া থেকেই পেয়েছি। তাই বুঝেছি মাতৃভাষায় রচনা অভ্যাস সহজ হয়ে গেলে তারপরে যথাসময়ে অন্য ভাষা আয়ত্ত করে সেটাকে সাহস পূর্বক ব্যবহার করতে কলমে বাধে না।" 
কর্তা: তবে শুধু শিক্ষার কাঠামো আর বিস্তার সম্পর্কে তিনি ভেবেছিলেন এমনটা কিন্তু নয়। মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারেও রবিঠাকুর যে ভেবেছিলেন তার প্রমাণ আমরা পাই এই সোচ্চার মন্তব্য থেকে, "বিদ্যা যদি মনুষ্যত্ব লাভের উপায় হয় এবং বিদ্যালাভে যদি মানব মাত্রেরই সহজাত অধিকার থাকে, তবে নারীকে কোন নীতির দোহাই দিয়া সে অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইতে পারে বুঝিতে পারি না। " আরও বলেছেন, "বিদ্যার দুটো ভাগ আছে। একটা বিশুদ্ধ জ্ঞানের অন্যটা ব্যবহারের। যেখানে বিশুদ্ধ জ্ঞান সেখানে মেয়ে-পুরুষের পার্থক্য নাই।" আবার গুরুকুল বা আশ্রমিক শিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতনে তিনি বিশ্বভারতী গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এই সময় এক জায়গায় কবি বলেছেন, "এই যে স্কুলের বন্ধন ছিন্ন করিয়া মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে তিনমাস স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়াছিলাম, ইহাতে ফিরিয়া আসিয়া বিদ্যালয়ের সহিত আমার সংসার বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল। এই শেষ বয়সে বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া তাহার শোধ দিতেছি। এখন আমার আর পালাইবার পথ নাই।" 
মৃত্তিকা: আচ্ছা মা, শুনেছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গীতাঞ্জলি'র পাণ্ডুলিপি নাকি কোথাও হারিয়ে গেছিল? একথা কি সত্যি? 
গিন্নি: হ্যাঁ, এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেটা ১৯১২ সালের কথা। ওই বছরের ১৫ই জুন তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী এবং পারিবারিক বন্ধু সৌমেন্দ্র দেববর্মণকে সঙ্গে নিয়ে ডোভার থেকে ট্রেনে লন্ডনে যাচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল শিল্পী উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের মারফৎ কবি ডব্লু বি ইয়েটস-এর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে গীতাঞ্জলি-র ১০৩টে কবিতার ইংরেজি অনুবাদের একটা সংকলনের ভূমিকা রচনার অনুরোধ করা। ব্লুমসবেরি-র একটা হোটেলে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। লন্ডনে এসে তাঁরা ভূগর্ভস্থ রেল টিউব ধরে হোটেলে পৌঁছলেন। পরের দিন সকালে রোদেনস্টাইনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বার হবার আগে হঠাৎ তাঁরা বুঝলেন যে যে অ্যাটাচিতে সেই অমূল্য পাণ্ডুলিপিটা ছিল সেটা পাণ্ডুলিপি সমেত খোয়া গিয়েছে। 
মৃত্তিকা: (একটু আঁতকে উঠল) তাহলে কি সেটা আর পাওয়া যায়নি? তাহলে আবার করে কবিকে অনুবাদ করতে হয়েছিল? 
কর্তা: আরে না না। সকালে হারিয়ে যাওয়ার কথা বুঝতে পেরেই রথীন্দ্রনাথ সবচেয়ে আগে পুলিশে খবর দিতে চাইলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাকে লন্ডন টিউবের 'লস্ট প্রপার্টি' বিভাগে খোঁজ করে দেখতে পরামর্শ দিলেন। এবং সৌভাগ্যের বিষয়, রথীন্দ্রনাথ সেই 'লস্ট প্রপার্টি' বিভাগে খোঁজ নিয়ে অক্ষত পাণ্ডুলিপি সমেত অ্যাটাচিটা পেয়ে গেছিলেন। যদিও ১৯১০ সালেই গীতাঞ্জলি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়ে গেছিল। সেটারই অংশ বিশেষ এর জন্য ১৯১৩ সালে তিনি পেলেন নোবেল পুরস্কার, যেটা আজ ও ভারতীয় সাহিত্যে একমাত্র নোবেল পুরস্কার। যদিও ১৯৭১ সালে নোবেল পুরস্কারের নমিনেশনে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম একেবারে প্রথম দিকেই ছিল। তবে তিনি নোবেল পেলেন না, পুরস্কার ঘোষণার আগেই তিনি মারা যান, সম্ভবত সেই কারণেই পেলেন না নোবেল পুরস্কার। 
মৃত্তিকা: কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনেকেই তো বলেন যে তিনি ইংরেজদের বন্ধু ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর নাকি কোনো ভূমিকাই ছিল না! 
গিন্নি: স্বদেশী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন ভূমিকা ছিল না একথা একেবারেই ঠিক নয়। তিনি যে এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তার অনেক প্রমাণ আছে। যেমন, ১৯০৫ সালের ২৫ শে আগস্ট বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কলকাতা টাউন হলে যে বিরাট সভা হয়, রবীন্দ্রনাথ সেখানে তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ "অবস্থা ও ব্যবস্থা " পাঠ করেন। সেই সভায় ভীড় এত বেশি হয়েছিল যে অনেক লোক টাউন হলে ঢুকতেই পারেন নি। সেকারণে একসপ্তাহ পরে আর এক জায়গায় সভা করা হয়েছিল। তারপর প্রায় প্রতিদিনই এরকম সভা হত এবং রবীন্দ্রনাথ বহু সভাতেই যোগ দিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করতেন বা বক্তৃতা করতেন। নতুন নতুন গান ও লিখেছিলেন সেই সময় যেগুলো ওই সমস্ত সভায় গাওয়া হচ্ছিল।  ১৬ই অক্টোবর বিকেলেই বাগবাজারে পশুপতি বসুর বাড়িতে আর একটা সভা হয়েছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বক্তৃতা করেন। মূলত তাঁর আবেগময় আহ্বানেই জাতীয় ভান্ডারের জন্য ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহীত হয়। 
            এছাড়াও ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার কথা ঘোষিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন মনীষী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সহযোগীতায় রাখীবন্ধন উৎসবের পরিকল্পনা করেন। সমস্ত বাঙালি জাতি এই উৎসবে অংশ গ্রহণ করেছিল। বঙ্গভঙ্গ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এবং তারপরেও কয়েক বছর সমান তালে এই উৎসব পালিত হয়েছিল। এই উৎসবে গাইবার জন্য তিনি লিখেছিলেন এই গানটি, 
"বাঙলার মাটি বাঙলার জল 
বাঙলার বায়ু বাঙলার ফল 
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।..." 
স্বদেশী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ নানা দিক থেকে তাঁর সহযোগ দিয়েছিলেন। সভাসমিতিতে বক্তৃতা, সাময়িক পত্রিকায় প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প প্রভৃতির মাধ্যমে দেশবাসীর মনে যথেষ্ট উৎসাহ আর উদ্দীপনা তিনি সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 
কর্তা: তাই বলে এটা ভেবো না যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অপমান আর আঘাত পাননি। সম্মানও যেমন পেয়েছেন, অপমান আঘাতও খুব একটা কম পাননি। অনেক ভালোবাসা আর সম্মানের পাশাপাশি তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে চরম অপমান, কদর্য সমালোচনা, যেগুলোকে অকৃপণ নিন্দা বলাই বোধহয় ভালো। ছিদ্রান্বেষী এবং পরশ্রীকাতর কিছু মানুষ তাঁকে রক্তাক্ত এবং আহত করেছে বারবার, যদিও তাঁর আসন টলাবার এই সব চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে।তিনি, বাঙালির গর্ব তথা ভারতের গর্ব এই মহান মানুষটি আজও পৃথিবীব্যাপী চর্চার বিষয়। 
একটু পিছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে  রবীন্দ্রযুগে কেমন সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন কবিগুরু। প্রথমেই উঠে আসে যার নাম, তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। 
দ্বিজেন্দ্রলালও সে সময়ে যথেষ্ট জনপ্রিয় নাট্যকার, কবি এবং গীতিকার ছিলেন। প্রথম দিকে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর বেশ ভালো সম্পর্কের কথা জানা যায়। কিন্তু সেই দ্বিজেন্দ্রলাল যখন বিভিন্ন প্রবন্ধে বার বার রবীন্দ্রনাথের লেখার নিন্দা করেন, অবাক হতে হয় বৈকি। রবীন্দ্র কবিতার প্রতি প্রধানত দুটি অভিযোগ এনেছিলেন তিনি, দুর্বোধ্যতা এবং অশ্লীলতা। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা অস্পষ্ট এবং অস্বচ্ছ। তাঁর চিন্তার মধ্যে গভীরতা নেই। তাঁর কবিতার নীতিহীনতা কলুষিত করেছে সমাজকে। দ্বিজেন্দ্রলালের ভাষায় " তাঁহার ' তুমি যেওনা এখনই', ' কেন যামিনী না যেতে জাগালে না ' ইত্যাদি গান লম্পট বা অভিসারিকার গান। " আবার ' সোনার তরী ' কবিতার যে সমালোচনা তিনি করেছেন তাকে বাংলা সাহিত্যের একটা শ্রেষ্ঠ হাউলার বলাই যায়। দ্বিজেন্দ্রলাল একেবারে কোমর বেঁধে নেমে ছিলেন, তিনি এই কবিতা সম্পর্কে বললেন, " 'সোনার তরী ' একটি অর্থহীন কবিতা "। তিনি লিখলেন ' কৃষক ধান কাটিতেছে বর্ষাকালে, শ্রাবণ মাসে ' এল বরষা ' কী রূপ? বঙ্গদেশে আষাঢ় মাসেই বর্ষা আসে। তাহার পর ' এক খানি ছোট ক্ষেত ' হইতে' রাশি রাশি ভারা ভারা ' ধান হইয়াছে! ক্ষেত বড়ই উর্ব্বরা!  ক্ষেতের চারিদিকে 'বাঁকা জল করিছে খেলা'। ক্ষেতখানি তার একটি দ্বীপ। তবে এ চর জমি, এসব জমিতে ধান হয় না। এসব জমি শ্রাবণ ভাদ্র মাসে ডুবিয়া থাকে, শীতকালে নদীগর্ভ হতে বাহির হয়। ... পরপারে তরুছায়া মসীমাখা মেঘে ঢাকা গ্রামখানি ছবিখানি রবিবাবুর ভক্তদের নিশ্চয়ই বড়োই ভালো লাগিয়াছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মেঘে ঢাকা গ্রামে তরুছায়া হয় না ...রৌদ্র হলেই ছায়া হয়। ... রবিবাবুর অন্ধভক্তগণ বলিবেন, আঃ ওসব ধরিতে নাই। '
দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথকে ব্যক্তিগত আক্রমণও কম করেননি। ' আনন্দ বিদায় ' নামে একটা প্যারোডি বা প্রহসন নাটিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর তীব্র ব্যঙ্গ আর ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল-এর জীবনীকার দেবকুমার রায়চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল এই নাটিকার প্রথম অভিনয় চলাকালীন যথেষ্ট অপমানিত হন রবীন্দ্রঅনুরাগীদের কাছে । শুধু তাই নয়, প্রথম রাতের সেই অভিনয় বন্ধ করে দিতে হয়। স্টার এর পিছনের দরজা দিয়ে তাঁকে বার করে আনা হয়, বিক্ষুব্ধ দর্শকদের হাত থেকে রক্ষা করতে। আর, সেই নাটক দ্বিতীয় বার মঞ্চস্থ হয়নি। যে দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথকে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি বলে মেনে নিয়েছিলেন, সেই তিনিই কেন হঠাৎ এত রবীন্দ্রবিরোধী হয়ে উঠলেন, তার সঠিক কারণ বোঝা খুবই মুশকিল। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর, ফলে রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক খ্যাতি তিনি দেখে যেতে পারেন নি। তবে রবীন্দ্রনাথ নিজে কখনও দ্বিজেন্দ্রলালের এই রকম আচরনের বা আক্রমণের সরাসরি উত্তর দেননি বা প্রতি আক্রমণ করেননি, তবু, লেখক, সে রবীন্দ্রনাথই হোন না কেন, আহত হতেন অবশ্যই। তিনি লিখেছেন, 'কটাক্ষ যতই ক্ষুদ্র হউক ,তাহারও বিদ্ধ করিবার ক্ষমতা আছে।' 
এর পর যাঁর কথা বলতে হয়, তিনি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি। ইনিও রবীন্দ্রনাথকে বিদ্ধ করেছেন। বঙ্গদর্শনে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস 'চোখের বালি ' প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে সুরেশচন্দ্র প্রশ্ন তুলেছিলেন - 'বঙ্গদর্শন' সম্পাদনা করার যোগ্যতা রবীন্দ্রনাথের আছে কী? তিনি এমনটাও বলেছিলেন, 'যে বঙ্গদর্শনের বক্ষে একদিন বঙ্কিমবাবুরও বাংলা ভাষার সুবিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠতম নভেল ' বিষবৃক্ষ ' ও ' চন্দ্রশেখর ' প্রকাশিত  হয়েছিল, তাহাতেই আজ রবিবাবুর ' চোখের বালি ' বাহির হইতেছে। রবিবাবু এমনতর লম্বা ও কুৎসিত উপন্যাসে হাতদিয়া ভালো কাজ করেন নাই। ' তিনি আরও অভিযোগ করলেন, " 'চোখের বালি ' রবীন্দ্রনাথের মৌলিক রচনা নয়, এটি পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় -এর 'উমা ' থেকে নেওয়া। সুরেশচন্দ্রের মতে ," 'বঙ্গদর্শনে ' 'চোখের বালি' বাহির হওয়া বন্ধ হলেই ভালো হয়। 'চোখের বালি ' বঙ্গদর্শনের মুখে চুনকালি মাখাইয়া দিয়াছে। '
এরপর বলতে হবে, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের কথা। 'ভারতবর্ষ ' নামে একটা মাসিকপত্রে ' সাহিত্য সমালোচনার মাপকাঠি ' নামে একটা প্রবন্ধে রাধাকমল মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে ' উপন্যাস - এর সম্পর্কে লেখেন, " রবীন্দ্রবাবুর 'ঘরে বাইরে 'র কোনো আদর্শ নাই, শুধু পাওয়া গেছে উদ্দাম কাম প্রকৃতির পোশাকি রূপ। '
রবীন্দ্রনাথের সর্বব্যাপী বিচরণে তটস্থ হয়ে বা বলা যায় অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে থাকা লেখক গোষ্ঠীর এক সংগঠন "কল্লোল " সরাসরি রবীন্দ্র বিরোধীতার পথে হেঁটেছিল। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছিলেন ' সম্মুখে থাকুন বসে, পথ রুধি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর '- এদের মতে, রবীন্দ্র রচনায় আধুনিকতা নেই, তাঁর কাহিনীর বিষয় ছিল উঁচু তলার মানুষ, সমাজের নিম্নবর্গের কথা তাঁর রচনাতে নেই। 
বুদ্ধদেব বসু একসময় বলেছিলেন , রবীন্দ্রনাথের রচনায় কোনও মৌলিকতা নেই, গোটাটাই ইউরোপ থেকে ধার করা, বা চুরি করা। 
এই প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কথা না বললে হবে না। ১৯৬১ সালে ' কোয়েস্ট ' নামে একটা পত্রিকায়, মন্তব্য করেন, ' রবিন্দ্রনাথ ও তার ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী বেপরোয়া ভাবে পরস্পরের প্রেমে পড়েন। স্কেন্ডাল ঢাকার জন্য বাড়ির লোকেরা রবীন্দ্রনাথের বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা খারাপের দিকে যেতেই রবীন্দ্রনাথের বৌঠান আত্মহত্যা করেন। 
"অবতার" নামে একটা পত্রিকায় প্রচার করা হয় রবীন্দ্রনাথ, যৌবনে কুৎসিত যৌন রোগে ভুগে ছিলেন।  এই ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ এতই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যে এর প্রতিবাদে তিনি কলম ধরেন। আসলে যখন তাঁর সাহিত্যের সমালোচনা করে কিছু করা যায় নি, তখন ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন নিন্দুকের চাঁদমারি। জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরও সমানে চলেছে এই আক্রমণ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর, তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় প্রায় ৭০ বছর পর নিত্যপ্রিয় ঘোষ 'নোবেল পুরস্কারের রহস্য ' প্রবন্ধে লেখেন ' রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তি রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব প্রসূত নয়, এক বিদেশির তদ্বির প্রসূত। এই বিদেশি হলেন সুইডেনের যুবরাজ এবং তিনি ১৯১২ সালে কলকাতায় এসে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন।' এ অভিযোগের ফলে রবীন্দ্রনাথকে ছোট করা গেছিল কিনা সে একটা  গবেষণার বিষয় হতে পারে বটে কিন্তু নিত্যপ্রিয় ঘোষ যে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 
আর একজন অত্যন্ত কঠোর রবীন্দ্র সমালোচক ছিলেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী। ইংরাজি সাহিত্যের অত্যন্ত পন্ডিত, এই মানুষটি বার বার রবীন্দ্রনাথ কে আক্রমণ করেছেন। এমনকি এও বলেছেন ,যে বই এর জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান, সেটা একটা পুস্তিকা মাত্র। আর বইটির অনুবাদে যে ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তার না আছে গভীরতা না আছে সাহিত্যমূল্য - ওগুলো খেলার শব্দ মাত্র। তাঁর আরও একটা মন্তব্য বুঝিয়ে দেয়, তিনি রবীন্দ্রনাথকে কতটা কুনজরে দেখতেন, তিনি বলেছেন " রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর পুরোদস্তুর অভিনেতায় পরিণত হয়েছিলেন। " 
মৃত্তিকা: অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে দেশবাসীর জন্য, জাতির জন্য যত অবদানই কবিগুরুর থাক না কেন, নিন্দুকের দল তাঁকেও ধারাল সমালোচনায় ফালাফালা করেছেন। হায় রে ভারতবর্ষ! 
গিন্নি: হ্যাঁ, সেটাই। যে মানুষটার সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদের মত সাধারণ মানুষের একটা জীবন যথেষ্ট নয়, তাকেও আমরা ছাড়িনি আঘাত দিতে। আরও দুঃখ কি জানিস - আজকের এই ইঁদুর দৌড়ের যুগে, এই 'এ আই' স্মার্টফোনের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে কোলকুঁজো হয়ে পড়া আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম বাঙালির প্রথম আইকন, এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এই মানুষটির সৃষ্টিকে সেভাবে জানলোই না, বুঝলোই না। রবীন্দ্রনাথ বলতে সাধারণ বাঙালির কাছে এখন সর্বসাকুল্যে দশ-পনেরটা গান আর কয়েকটা কবিতাই বোঝায়। কিন্তু সেটা যে একটা বিপুল সমুদ্রের বুকে কয়েক ফোঁটা জলের মত, তা আমরা বুঝি না। আধুনিক প্রজন্মের একটা বড় অংশের কাছে তাই তিনি শুধু এই পঁচিশে বৈশাখের পালনীয় কর্তব্যের মধ্যেই আটকে পড়েছেন। অথচ তিনি তো থেকে যেতেই চেয়েছিলেন এই পৃথিবীতে, আমাদের মধ্যে -- 
" মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। 
এই সূর্যকরে পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।" 

============

অনিন্দ্য পাল 
প্রযত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর  
পোঃ-- চম্পাহাটিি 
পিন - ৭৪৩৩৩০ 
থানা -- সোনারপুর 
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা  
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত  

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৫তম সংখ্যা ।। জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ মে ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত