Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

ছবি
  সূচিপত্র  প্রবন্ধ-নিবন্ধ-মুক্তগদ্য-ভ্রমণকথা মেল্লক গ্রামের মদনগোপাল জীউর মন্দির ।। সায়ন মণ্ডল কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার ... হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। উজান... আমার রবীন্দ্রনাথ ।। সত্যেন্দ্রনাথ পাইন বৈকালিক বৈশাখ ।। ছন্দা দাম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার ।। পাভ... মে দিবস : অধিকারহরণ ।। শ্যামল হুদাতী শরীর ও মনের সুস্থতা ।। রতন বসাক মানুষ কী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিকট ভৃত্যমাত্র? ।।... আমাদের পরিবেশ ভাবনা ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত বিশ্বপ্রেম ।। আরতি মিত্র টান ।। মনোরঞ্জন ঘোষাল স্রষ্টার নিষ্ঠা ।। শংকর ব্রহ্ম বেগুনিয়া : বাংলার মন্দির স্থাপত্য ।। সু... ।। গল্প ।। বিকেল বাঁচাও আন্দোলন ।। সুবীর ঘোষ রাখে হরি তো মারে কে ।। সমীর কুমার দত্ত বিভ্রান্ত ।। রানা জামান সম্পর্ক ।। মাখনলাল প্রধান  ধারা মাস ঝরা মাস ।। প্রদীপ কুমার দে গল্পের মত অবিশ্বাস্য সত্য ।। বন্দনা সেনগুপ্ত ধর্মরাজ, লাখাই আর ডমরু সর্দারের গল্প... ভূতের বাচ্চা ।। নবী হোসেন নবীন গোধূলিবেলায় ।। সুচন্দ্রা বসু বিয়ে ।। রেজাউল করিম রোমেল ঘোড়ার ডিমের গল্প ।। প্রবোধ কুমার মৃধা নাত জামাই ।। সুদামক

প্রবন্ধ ।। রবীন্দ্রনাথের স্বাধীনতাপ্রিয়তা ।। অরুণ চট্টোপাধ্যায়


রবীন্দ্রনাথের স্বাধীনতাপ্রিয়তা

ড. অরুণ চট্টোপাধ্যায়


স্বাধীনতা জিনিসটা এমনই যা কমবেশি সব মানুষেরই প্রিয়। কারণ স্বাধীনতার অর্থ সম্পূর্ণভাবে নিজের বশীভূত থাকা আর নিজের ইচ্ছানুযায়ী যা ইচ্ছা মত করা। মানুষ এটা চায় কারণ এটার মধ্যে সে একটা আনন্দ আর আত্মপ্রসাদ অনুভব করে।  

শুধু মানুষই যে স্বাধীনতা চায় তা নয়। স্বাধীনতা চায় মানবেতর প্রাণী পর্যন্ত। গৃহপালিত পশুপাখীরাও যত খাদ্য-পানীয় বা আদর দেওয়া হোক না কেন পালাবার সুযোগ পাওয়া মাত্র তারা এর সদব্যবহার করতে ছাড়া না। তবে কেউ কেউ পরাধীনতাকে কিছু সীমা অবধি মানিয়ে নিতে পারলেও বাকি কেউ কেউ একেবারেই তা পারে না।

কিছু মানুষ যেমন স্বাধীনতা চায় তেমনি আবার কিছু মানুষ স্বাধীনতা কেড়ে নিতেও চায়। স্বাধীনতা হরণ করতে চায় যারা তারা অন্যের সম্পদ আর সুবিধা নিজের করে পাবার জন্যেই এ কাজ করে তা নয়। স্বাধীনতা যারা হারায় তাদের দুঃখ কষ্ট দেখে এই স্বাধীনতা হরণকারীরা মনে মনে একটা বিরাট আনন্দ আর আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। অর্থাৎ বিনা কারণেই বা শুধু নিজে আনন্দ পাওয়ার জন্যেই অনেকে অন্যার স্বাধীনতা হরণ করে। কারণ অন্যকে বশীভূত করাটাও অনেকের কাছে বেশ একটা আনন্দের বিষয়।

স্বাধীনতা কিন্তু মানুষের এক জন্মগত অধিকার। এই বোধ আমাদের ছিল বলেই পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আর সেই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বলেই আমরা বহু কাঠখড় পুড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতা তো জয়নগরের মোয়া নয় যে মাথা থেকে নামিয়ে হাঁড়ি খুলে হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া যাবে। আগেই বলেছি স্বাধীনতা যারা হরণ করে তারা নিজেদের এক বা একাধিক স্বার্থেই তা হরণ করে। সেই স্বার্থের ঢাকনা ভেঙ্গে হাঁড়ি থেকে স্বাধীনতা বার করে আনতে হয়। আনতে হয় কথাটার থেকে বলা ভালো ছিনিয়ে আনতে হয়। কারণ স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় আর এই জিনিসটা কেউ কাউকে দিয়ে দেয় না। এই কাজের জন্যে ছল, বল, কৌশল শুধু নয় লাগে দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা চেতনাও। স্বাধীনতা জিনিসটা আদতে কী সেটা যারা জানে না তারা স্বাধীনতা হারানোর দুঃখ আর লাঞ্ছনা অনুভব করে না। আর শুধু নিজে জানলেই হবে না জানাতে হবে দেশের সব মানুষকে। আমরা যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পড়েছি তারা জানি এই আন্দোলনের দুটো ভাগ ছিল- সংগঠন (organization)  আর সংঘটন (operation)  বা বাস্তবায়ন (implementation)  সংগঠন শুধু লোক দিয়েই হয় না হয় বেশির ভাগ মাথা দিয়ে অর্থাৎ মাথার বুদ্ধি দিয়ে। কারণ সবাইকে একত্র করা আর পরাধীনতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেবার জন্যে সবাইকে অনুপ্রাণিত আর অনুপ্রেরিত করতে হয়। এই শেষোক্ত দুই কাজে সবচেয়ে বেশি কাজ ছিল যারা সৃষ্টি করেন অর্থাৎ কবি ও সাহিত্যিক তাদের ওপর। একজন স্রষ্টা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন যথাযথ ভাবেই।

সাধারণত শৈশব কালে মানুষ বড়দের থেকে একটু বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। যেমন বড়দের যে দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয় ছোটদের তা করতে হয় না। তবে তাদেরও একটা দায়িত্ব পালন করতে হয় আর সেটা হল বড়দের আদেশ, উপদেশ আর নির্দেশ পালন করা। অবশ্য এর বিনিময়ে বড়দের কাছ থেকে নানা উপহার, উপঢৌকন, আদর এইসব পেয়ে থাকে।

রবীন্দ্রনাথের মন শিশুকাল থেকেই নিষেধ মানার ক্ষেত্রে ঘোর বিরুদ্ধে ছিল। অবশ্য মনে মনে না মানলেও কার্যত মানতেই হত। কারণ তখকার আমলে বড়দের আদেশ মানব না বলে কেউ রেহাই পেত না। এর একটা কারণ বলা যেতে পারে এই ভাবে। তখনকার দিনে বাড়ির বড়দের সঙ্গে বাড়ির ছোটদের একটা আবশ্যিক দূরত্ব পালন করতে হত। এই দূরত্ব যেমন বাহ্যিক তেমনি ছিল মানসিক। ছোটরা যেমন বড়দের ভয় পেত বেশি তেমনি বড়রাও ছোটদের মনের খবর খুব কম রাখার সুযোগ পেতেন। ছোটদের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা কম আর তাই কৌতূগল বেশি। তাই তারা তাদের বিচরণ ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য পরিসর যায় যেটা প্রায়শই বড়রা বড়ত্বের সুবাধে নাকচের তালিকায় রাখে।

বিশেষ আভিজাত্যপূর্ণ কোনও বিরাট পরিবারে তখন শিশুরা চাইলেই বাবা মা বা অন্যান্য গুরুজনদের নিকট সান্নিধ্যে আসতে পারত না। বলতে গেলে শিশুকালে তাদের বাড়ির দাসদাসীদের পরিচর্যার পরিবেশে থাকতে হত। একটি অভিজাত আর বৃহৎ পরিবারের ক্ষুদ্র সদস্য হিসেবে বালক রবীন্দ্রনাথও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। শিশুরা বা ছোটরা বড়দের শাসনের গন্ডী না ডিঙোতে পারলেও বড়দের শাসন যে অনেক সময় তার নিজের সীমা অতিক্রম করত তা রবীন্দ্রনাথের বহু লেখাতেই পাওয়া যায়।

এবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কথায় আসি। বিদ্যালয়ের পরাধীনতার গন্ডী আর শাসন তাঁর ভাল লাগত না একেবারে। তাঁর বহু রচনায় এর প্রমাণ মেলে। শিশু ভোলানাথ গ্রন্থের 'শিশুর জীবন' কবিতায় কবি লিখছেনঃ

"ছোট ছেলে হওয়ার সাহস

     আছে কি এক ফোঁটা,

         তাই তো এমন বুড়ো হয়েই মরি।

তিলে তিলে জমাই কেবল

        জমাই এটা ওটা,

           পলে পলে বাক্স বাক্স বোঝাই করি।

কালকে-দিনের ভাবনা এসে

আজ দিনেরে মারলে ঠেসে

     কাল তুমি ফের পরদিনের বোঝা।"

অর্থাৎ বড়রা শুধুই চিন্তিত ভবিষ্যৎ নিয়ে। শিশুদের এই চিন্তা নেই। বস্তুত ভবিষ্যৎ নিয়ে তারাই চিন্তা করে যাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু ধ্যান ধারণা আছে। কিন্তু শিশুদের এগুলো আসবে কী করে? জীবনের বেশির ভাগ অংশের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার তাদের শূন্য। তাই তাদের ভাবনা পাক খায় শুধু বর্তমানকে ঘিরে। তারা শুধু বর্তমানের মজা, আনন্দ আর দুঃখ নিয়েই মশগুল। ভবিষ্যতের ভাবনায় তাদের মন খারাপ করে থাকতে হয় না।

ছেলেবেলার স্বাধীন চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থের আর এক কবিতায়ঃ

        "ছুটির হাওয়ায় ঘুর লাগাল বুঝি!

  যা-কিছু সব চলেছে ওই

      ছেলেবেলার রথে

          যে-যার আপন দোসর খুঁজি খুঁজি।

গাছে খেলা ফুল-ভরানো

ফুলে খেলা ফল-ধরানো,

           ফলের খেলা অঙ্কুরে অঙ্কুরে।

স্থলের খেলা জলের কোলে,

জলের খেলা হাওয়ার দোলে,

            হাওয়ার খেলা আপন বাঁশির সুরে।"

তালগাছ কবিতায় আর এক প্রস্থ স্বাধীনতার ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেনঃ

"তালগাছ  এক পায়ে দাঁড়িয়ে

        সব গাছ ছাড়িয়ে

             উঁকি পাড়ে আকাশে।

মনে সাধ,     কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়

        একেবারে উড়ে যায়;

             কোথা পাবে পাখা সে?

তাই তো সে  ঠিক তার মাথাতে

          গোল গোল পাতাতে

              ইচ্ছাটি মেলে তার, 

মনে মনে   ভাবে,  বুঝি ডানা এই,

         উড়ে যেতে মানা নেই

               বাসাখানি ফেলে তার।"

তারপর আবার কবি সঙ্গে সঙ্গে বাস্তববাদীও হয়ে উঠেছেন। স্বাধীনতা মানে তো যা ইচ্ছা করা তা নয়। কোথাও একটা বাঁধন তো দরকার আর অবশ্যই আছে সেটা। কবির উপলব্ধিঃ

"তার পরে   হাওয়া যেই থেমে যায়,

           পাতা - কাঁপা থেমে যায়,

                ফেরে তার মনটি-

যেই ভাবে,    মা সে হয়  মাটি তার,

         ভালো  লাগে আরবার

              পৃথিবীর কোনটি।"

অর্থাৎ মায়ের কোল হল শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। ভালবাসার বাঁধন যেখানে আছে সেখানে মানুষ স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না কিছুতেই।

আজ থেকে দেড়শ বছরেরও আগে বালক রবীন্দ্রনাথের যেটা মনে হত সেটা হল রবিবার আর ছুটি নিয়ে। আজকের দিনেও সবাই রবিবারের পথ চেয়ে সাগ্রহে অপেক্ষা করে। কারণ ছুটির এই দিনটি অন্যান্য দিনের বাঁধাধরা রুটিনের মধ্যে নেই। রবিবার কবিতায় তিনি লিখলেনঃ

"সোম, মঙ্গল বুধ এরা সব

     আসে তাড়াতাড়ি,

  এদের ঘরে আছে বুঝি

       মস্ত হাওয়া – গাড়ি?

রবিবার সে কেন,   মা গো,

    এমন দেরি করে?

সে বুঝি মা তোমার মত

      গরিব – ঘরের মেয়ে?"

স্বাধীনতা হারানোর দুঃখ কি আমরা বিগত কয়েক বছর আগে পাই নি। কয়েক বছর আগের করোনাকালের গৃহবন্দিত্বের সেই দিনগুলোর দুঃখস্মৃতি তো আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। কবিও বহুকাল আগে যেন অনুভব করে ছিলেন বেদনা। তাই লিখেছিলেনঃ

'দাও খুলে দাও সখী, ওই বাহুপাশ-

চুম্বন-মদিরা আর করায়ো না পান।

কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস-

ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান। ----'

কয়েক বছর অতিমারির প্রকোপে যেমন আমরা ছিলুম গৃহবন্দিঅতিমারি না হলেও অন্য কোনও এক মারির কবলে পড়ে গৃহবন্দি ছিল ছোট্ট অমলও। বাতায়নের ফাঁক দিয়ে আসা বাতাস আর ঝাঁপিয়ে পড়া এক ঝলক আলো তার কাছে ছিল মুক্তির আশ্বাস। দূরের এক ফালি নীল আকাশ ছিল স্বপ্নের স্বর্গ আর পাশ দিয়ে সুর করে ডাকতে ডাকতে যাওয়া এক দইওয়ালার সুর 'দই চাই, দই। ভাল দই' ছিল তার কাছে দেবদূতের কন্ঠ

ছোট্ট অমলের এই ডাক ভাল লাগে। এই ছোট্ট ডাক যেন তাকে নিয়ে যেতে চায় সুদূর এক মুক্তির রাজ্যে। তার ছোট্ট মনটা প্রসারিত হয়ে হতে চায় একটা বিশাল পাহাড়ের মত। হতে চায় নদীর স্রোতের মত গতিশীল। পাতার ফাঁক দিয়ে গলে যাওয়া এলোমেলো বাতাসের মত দামাল। সেই পাঁচমুড়ো পাহাড়ের ওপারে শ্যামলী নদীর ধারে পুরোন বড় বড় গাছের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লাল রঙের রাস্তার ধারে এক গ্রামে। যেখানে পাহাড়ের ধারে গরু চরছে সব সবুজ মাঠে। মেয়েরা লাল শাড়ি পরে কলসি মাথায় করে নদীর জল নিয়ে যায়। গয়লার মেয়েরা গাইয়ের দুধ দুয়ে তার থেকে দই করে। সেই দই বাঁকে করে রাস্তা দিয়ে বয়ে নিয়ে যায় দইওলারা। এমনি করে সুর তোলেঃ দই চাই, দই। ভাল দই।

এই সুর খুব ভাল লাগে অমলের। এই সুর যেন আকাশে উড়ন্ত বা গাছের ডালে বসে পাখির গাওয়া গানের মত মিষ্টি। পাখি যেমন মুক্ত, তেমনি মুক্ত এই দইওলা। তাই তো অমলের দইওলা হতে ইচ্ছে করে। কারণ দইওলা রাস্তা দিয়ে যেখানে খুশি যেতে পারে। নেই কবিরাজের নিষেধ, নেই প্রহরীর ভ্রূকুটি। সে পুঁথি পড়ে পন্ডিত হতে চায় না। সে শুধু খোঁজে পাঁচমুড়ো পাহাড়ের তলায় দইওলার সেই গ্রামযেখানে সে পাবে এক মুক্তির সন্ধান।  

তবে একদিন মুক্তি এসেছিল অমলের। কবিরাজের নির্দেশে খোলা জানলাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাজার বসান ডাকঘর থেকে তার নামে রাজার কোনও চিঠি আসে নি। তবু মুক্তি এসেছিল। রাজা আসেন নি তবে পাঠিয়েছিলেন তাঁর রাজকবিরাজকে। এসেছিলেন সেই সময়ে যখন অমল মুক্ত হয়ে উড়ে গিয়েছিল মহাকাশে

তবে সুধা এসেছিল। যে রোজ প্রত্যুষে তার জন্যে রোজ ফুল আনত। যে ঘুম অমলকে দেখিয়েছিল এক চিরমুক্তির পথ সেই ঘুম ঘুমিয়ে পড়ার পর সুধা এসেছিল।

"সুধা। অমল।

রাজকবিরাজ। ও ঘুমিয়ে পড়েছে।

সুধা। আমি যে ওর জন্যে ফুল এনেছি- ওর হাতে কি দিতে পারব না?

রাজকবিরাজ। আচ্ছা দাও তোমার ফুল।

সুধা। ও কখন জাগবে?

রাজকবিরাজ। এখনই, যখন রাজা এসে ওকে ডাকবেন।

সুধা। তখন একটি কথা ওকে কানে কানে বলে দেবে?

রাজকবিরাজ। কি বলব?

সুধা। বোলো যে, 'সুধা তোমাকে ভোলে নি'।"  

আজকের এই দিনগুলোতে যেন আমাদের প্রত্যেকের অমলের মত দইওলা হতে হয়ত মন চায়। হলাহলে বিষাক্ত প্রকৃতির বুকে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে এসে দাঁড়ায় অমৃতের ফুল হাতে সুধা। অমলকে সে বলতে চায়, সুধা তোমাকে ভোলে নি।

এটা ঠিক যে অমলের মত মুক্তি আমরা চাই না। আমরা তো মানব সম্পদকে রক্ষা করতে চাই। আমরা যে আমাদের চির বহমান অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে পারি না। তাই কবিরাজের নিষেধ আমাদের মানতেই হবে। প্রহরীর ভ্রূকুটিকে অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের প্রত্যেকের একক জীবন যে পাকে পাকে জড়িয়ে আছে প্রত্যেকের তরে। ব্যষ্টির সুরক্ষা সমষ্টির তরে। তাই আমাদের এই গৃহবন্দিত্বকে মেনে নিতে হয়। কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে কেমন ভাবে রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ শিশু অমল হয়ে অমলের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলেন। উপলব্ধি করেছিলেন তার অসহায়তাকে। কত বছর আগে লেখা ডাকঘর নাটকে অমলের সেই বন্দীত্ব দশা আমাদের চোখে জল এনে দেয়। প্রতিটি চরিত্র যেন জীবন্ত হয়ে ভাসে আমাদের চোখের ঠিক সামনে। উপলব্ধির সাম্রাজ্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক মহা সম্রাট।  

রবীন্দ্রনাথ স্বাধীনতাপ্রিয় না হলে শুধু বিনোদনমূলক সাহিত্য-সৃষ্টিতেই থেমে থাকতেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হতেন না। শুধু পুরুষ নয় গৃহের গৃহলক্ষ্মীদের অর্থাৎ মহিলাদের স্বাধীনতার চেতনা দেবার উদ্দেশ্যে লিখতেন না "বাংলার মাটি বাংলার জল" গান আর সবাইকে অনুপ্রাণিত আর সামিল করতেন না রাখিবন্ধন উৎসবে। এই রাখি শুধু বন্ধন নয় ঐক্য আর সুরক্ষাদানের প্রতিশ্রুতির প্রতীক।  ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন না বা নৃশংস অমানুষ জেনারেল ডায়ারের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে। পরিত্যাগ করতেন না তাদের দেওয়া উপাধি নাইটহুড।

আজ রবীন্দ্রনাথ নেই। কিন্তু তাঁর জীবন আর স্মৃতি আমাদের কাছে আছে এক পরম সম্পদ হয়ে। তাঁর লেখনী সৃষ্টি করেছে অনেক অমূল্য সৃষ্টি। বিশালত্ব আর গভীরতায় তারা মহাসাগরের সঙ্গে তুলনীয়। আশাহীন মৃতপ্রায় মানুষের ওপর সিঞ্চন করেছেন স্নিগ্ধ আশাবারি। ভীত সন্ত্রস্তকে যুগিয়েছেন সাহস। যুগের পরে যুগ ধরে তিনি হয়ত থাকবেন সংকট মোচনের এক মহা প্রতীক হয়ে।

'সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান,

সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মান।'

তাই আজও স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ একটা বড় আশ্বাস।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৫তম সংখ্যা ।। জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ মে ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত