Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

ছবি
  সূচিপত্র  প্রবন্ধ-নিবন্ধ-মুক্তগদ্য-ভ্রমণকথা মেল্লক গ্রামের মদনগোপাল জীউর মন্দির ।। সায়ন মণ্ডল কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার ... হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। উজান... আমার রবীন্দ্রনাথ ।। সত্যেন্দ্রনাথ পাইন বৈকালিক বৈশাখ ।। ছন্দা দাম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার ।। পাভ... মে দিবস : অধিকারহরণ ।। শ্যামল হুদাতী শরীর ও মনের সুস্থতা ।। রতন বসাক মানুষ কী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিকট ভৃত্যমাত্র? ।।... আমাদের পরিবেশ ভাবনা ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত বিশ্বপ্রেম ।। আরতি মিত্র টান ।। মনোরঞ্জন ঘোষাল স্রষ্টার নিষ্ঠা ।। শংকর ব্রহ্ম বেগুনিয়া : বাংলার মন্দির স্থাপত্য ।। সু... ।। গল্প ।। বিকেল বাঁচাও আন্দোলন ।। সুবীর ঘোষ রাখে হরি তো মারে কে ।। সমীর কুমার দত্ত বিভ্রান্ত ।। রানা জামান সম্পর্ক ।। মাখনলাল প্রধান  ধারা মাস ঝরা মাস ।। প্রদীপ কুমার দে গল্পের মত অবিশ্বাস্য সত্য ।। বন্দনা সেনগুপ্ত ধর্মরাজ, লাখাই আর ডমরু সর্দারের গল্প... ভূতের বাচ্চা ।। নবী হোসেন নবীন গোধূলিবেলায় ।। সুচন্দ্রা বসু বিয়ে ।। রেজাউল করিম রোমেল ঘোড়ার ডিমের গল্প ।। প্রবোধ কুমার মৃধা নাত জামাই ।। সুদামক

প্রবন্ধ ।। নজরুলের সংক্ষিপ্ত জীবনী ।। সৌভিক দে

নজরুলের সংক্ষিপ্ত জীবনী

সৌভিক দে


বিংশ শতকের শুরুতে বাংলা সাহিত্যের আকাশ রবীন্দ্রছটায় উদ্ভাসিত। তখনই ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, সম্পূর্ণ স্বকীয় ভাষা, মেজাজ, ভাব নিয়ে। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জৈষ্ঠ্য তাঁর জন্মদিন। অগ্নি ও বীণা, রুদ্র ও মধুরের এমন সার্থক সমাবেশ বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগেও যেমন বিরল ছিল, পরেও তাই। এই উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কের কারণে নজরুল ইসলামকে নিয়ে নির্মোহ মূল্যায়ণ করতে আমরা ব্যর্থ হই! কী দ্রোহে, কী প্রেমে, বাঙালির হৃদয়ে তাঁর আসন চিরস্থায়ী। কাজী নজরুলের জীবন কাহিনী নাটক সিনেমার কাহিনীর চাইতেও অবিশ্বাস্য, বিস্ময়কর, করুণ! সঙ্কীর্ণ, একদেশদর্শী সাম্প্রদায়িক/ধর্মীয় দৃষ্টিকোন দিয়ে বিচার করলে নজরুলকে কোনকালেই বোঝা যাবে না।

কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম গ্রন্থঃ অগ্নিবীণা (১৯২২ খ্রিঃ)। তাঁর বাজেয়াপ্ত গ্রন্থাবলীঃ যুগবাণী (১৯২২), বিষের বাঁশী (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪), দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬), রুদ্রমঙ্গল (১৯২৬), প্রলয় শিখা (১৯৩০), চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০)। তাঁর পত্রিকা সম্পাদনাঃ দৈনিক নবযুগ, ধূমকেতু, লাঙল। নজরুল ইসলামের সাহিত্যচর্চার কালঃ ১৯১৯ থেকে ১৯৪২ খৃষ্টাব্দ(২৩ বছর)। তাঁর চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনাঃ গিরীশচন্দ্র ঘোষের 'ধ্রুব', শৈলজানন্দের 'পাতালপুরী' এবং রবীন্দ্রনাথে 'গোরা' উল্লেখযোগ্য। নজরুল ইসলামের গানের প্রথম রেকর্ড প্রকাশঃ ১৯২৫ খৃষ্টাব্দ(শিল্পী হরেন্দ্রনাথ দত্তের কণ্ঠে 'জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেল্ছে জুয়া' ও 'যাক পুড়ে যাক বিধির বিধান সত্য হোক' গান দুটি রেকর্ড করা হয়)।

নজরুল ইসলাম যতদিন মানসিক ও শারীরিক ভাবে সুস্থ্য, আত্মবিশ্বাসী, সংগ্রামী ছিলেন অন্তত ততদিন তিনি কোন ধর্মের ধার ধারেননি, এটা ঐতিহাসিক সত্য! তিনি জন্মেছিলেন ব্রিটিশ ভারতে, ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে, তিনি ভারতীয়। তাঁর জন্মদিনের ইংরেজি তারিখ নিয়ে নানা মত আছে, তবে বাংলা তারিখ একটিই। বাংলাদেশের হীন রাজনীতির খপ্পরে পড়ে তাঁকে বিকৃত করা হয়, তাতে সামাজিক-সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিণত হয় বিভীষিকায়! তিনি পাকিস্তান আইডিয়ায় কখনোই আস্থাবান ছিলেন না। পাকিস্তানকে 'ফাঁকিস্তান' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর কাঙ্ক্ষিত, স্বপ্নের দেশ ছিল স্বাধীন বাংলা; অবিভক্ত পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা নিয়ে অসাম্প্রদায়িক এক বাংলাদেশ! 

১৩০৬ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণের পর, পাঁচ বছর বয়স থেকে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। তারপর বর্ধমান জেলার মাথরুন হাই স্কুল, ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুর স্কুল, সবশেষে শিয়ারশোল রাজ হাই স্কুল। তিনি জন্মেছিলেন এক অসীম, অপরিমেয় প্রতিভা নিয়ে। দরিদ্র পরিবারে তিনি বেশিদিন থাকতে পারেননি। তাঁর বয়স যখন বছর বারো তখন তিনি বাড়ি ছাড়েন! গাঁয়ের মসজিদে ইমামতি করা, রুটির দোকানে কাজ, লেটো দলে গান লেখা, দারোগার বাড়িতে ফাই ফরমাশ খাটার কাজ - এসব বহুল আলোচিত, জানা কথা! নজরুল কোন তারিখে সৈন্য বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে নজরুল ছিলেন হাবিলদার। তবে তাঁর জীবনীকার ও স্মৃতি লেখকেরা এই তারিখ ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বলে উল্লেখ করেছেন। ১৯৪২ সাল থেকেই তাঁর অসুস্থ্যতার সূত্রপাত। ক্রমে তা দুরারোগ্য, কঠিন হয়! দেশে বিদেশে চিকিৎসার বহুবিধ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

এই উদার, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল মানুষটিকে তাঁর জীবনে কম ঝড়, ঝঞ্ঝা সামাল দিতে হয়নি। ১৯২১ সালের ১৭ই জুন সৈয়দা খাতুন (নার্গিস) এর সাথে প্রথম বিবাহ বিয়ের আসরেই ভেঙে যায়, তার পেছনে অনেক ইতিহাস, অনুমান মিশ্রিত কাহিনী শোনা যায়। ১৯২৪ খৃষ্টাব্দের ২৫ এপ্রিল ২২ বছর বয়সী নজরুল বিয়ে করেন ১৬ বছর বয়সী আশালতা সেনগুপ্তকে(পরে নজরুল তাঁর নাম দেন প্রমীলা)। ধর্মান্তর ছাড়াই হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের নর নারীর বিয়ে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে এই ভারতবর্ষে! নজরুলের শাশুড়ি গিরিবালা দেবী সব সময়ই মেয়ে এবং জামাইয়ের সংসারে থেকে তাঁদের অভাবের, অনিশ্চয়তার সংসারকে আগলেছিলেন। স্ত্রী, শাশুড়ির ধর্মীয় আচার/সংস্কারে নজরুল কোনোদিন বাধ সাধেননি! নজরুলের বাড়িতে কালী মূর্তি স্থাপিত ছিল। তাঁদের প্রথম সন্তানের নাম রাখেন 'কৃষ্ণ মহম্মদ'(জন্মাষ্টমীর দিনে জন্ম তাই) - দুই ধর্মের সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষায় হয়ত! স্ত্রীর অসুস্থতা, প্রথম পুত্র কৃষ্ণ মহম্মদের অকাল মৃত্যু, দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম খালেদের(বুলবুল) ৪ বছর বয়সে মৃত্যু, সংসারের অর্থাভাব, মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা - এসব কিছু মিলিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে ছিলেন।     

তাঁর রচনার উচ্চ মানের কদর তৎকালীন মুসলমান সমাজ করতে পারেনি! কদর তো দূর-অস্ত, তাঁকে তারা বরং কাফের ঘোষণা করে তাদের ভঙ্গুর ঈমান রক্ষা করেছিলেন! তখনই হিন্দু সমাজ জ্ঞানে, শিক্ষায় অনেকখানি এগিয়ে। নজরুলের মূল্যায়ণ হিন্দু সাহিত্য রসিকেরাই করতে পেরেছিলেন। সে কথা নজরুল প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে এক চিঠিতে জানিয়েওছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর অসুস্থ্যতায়, দুঃসময়ে তিনি তাঁর মুসলমান বন্ধুদেরও কাছে পাননি। এগিয়ে এসেছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের সচেতন মানুষেরা। তাঁদের মধ্যে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ সবাই আছেন। এমনকি যে সজনীকান্ত দাস 'শনিবারের চিঠি'তে নজরুলের কাব্য নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপে তাঁকে অস্থির করে তুলতেন তিনিও অসুস্থ্য নজরুলের পাশে এসে দাঁড়ান! 

নজরুল ছিলেন বেহিসেবী, উচ্ছ্বল, উদ্দাম, অসীম প্রাণশক্তিতে ভরপুর, ফুর্তিবাজ একজন মুক্ত মানুষ। আয় যা করতেন, ব্যয় করতেন তার চাইতে অনেক বেশি। তিনি ধার করে দামী গাড়ি কিনেছিলেন। যখন গ্রামোফোনের সঙ্গে তিনি জড়ালেন, সাফল্য পেয়েছিলেন বিপুল। আয় করেছেন প্রচুর। দিনরাত গান লিখেছেন, সুর করেছেন, শিল্পীদের গান তুলে দিয়েছেন। তাঁর গান রেকর্ডে গেয়েছেন - কে মল্লিক, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ইন্দুবালা দেবী, আঙ্গুরবালা দেবী, কমলা ঝরিয়া সহ সেকালের সব বিখ্যাত/জনপ্রিয় শিল্পীরা। সেই সময়টাতে রবীন্দ্রনাথের গানের চাইতে নজরুলের গান বেশি আলোচিত, জনপ্রিয় ছিল। নজরুলের স্বভাবেই হিসেব করে চলা, বুদ্ধি করে ম্যানেজ করার ব্যাপারটা ছিল না। তাই একসময়ে প্রচুর আয় করলেও তা তিনি পরিবারের প্রয়োজনের সময়ে ব্যয় করতে পারেননি। 

এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ আমি না করে পারছি না : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গোরা' উপন্যাস থেকে ছবি বানিয়েছিলেন নরেশচন্দ্র মিত্র। 'দেবদত্ত ফিল্ম'-এর প্রযোজনায় তা মুক্তি পায় ১৯৩৮-এর ৩০ জুলাই। ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাতে বাধা কম আসেনি। ছবি মুক্তির আগে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল, তা দেখে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড আপত্তি তুললেন। 'গোরা' ছবির প্রিন্ট আর একটা ছোট প্রজেক্টর সঙ্গে করে, গাড়ি নিয়ে নজরুল সোজা রবীন্দ্রনাথের কাছে শান্তিনিকেতনে হাজির। নজরুলকে দেখে তো কবি মহাখুশি। নজরুল ছবি সংক্রান্ত সমস্যার কথা খুলে বললেন কবিকে। বাঁধন সেনগুপ্ত 'রবীন্দ্রনাথের চোখে নজরুল' রচনায় লিখেছেন, সব শুনে কবি রীতিমতো বিস্মিত ও অসন্তুষ্ট হয়ে নজরুলকে বলেছিলেন, ''কী কাণ্ড বলতো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরেন? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশী বুঝবে! আমার গানের মর্যাদা ওরা বেশী দিতে পারবে?'' কবির মন্তব্য শুনে নজরুল আশ্বস্ত হলেন। বললেন, তবু কবির লিখিত অনুমতি দরকার, নইলে ছবি মুক্তি পাবে না। তিনি ছবির প্রিন্ট ও প্রজেক্টর নিয়ে এসেছেন, রবীন্দ্রনাথ ছবি দেখে যা লেখার লিখে দিন। শুনে কবি বলেছিলেন, ''ছবি দেখাতে চাও সকলকেই দেখাও, সবাই আনন্দ পাবে। আপাতত দাও কিসে সই করতে হবে।'' 

১৯৩৮ সাল থেকেই কবিপত্নী প্রমীলা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তাঁকে সুস্থ্য করতে কবি সব রকম চেষ্টাই করেন। ১৯৪২ খৃষ্টাব্দ থেকে নজরুল ধীরে ধীরে অসুস্থ্য, মানসিক ভারসাম্য হারান, এক পর্যায়ে বদ্ধ উন্মাদের মত হয়ে যান। চিকিৎসায় কাজ হয়নি কিছুই। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় পরিবারের পরম(একমাত্র) নির্ভরতার মানুষটি, অর্থাৎ কবির শাশুড়ি গিরিবালা দেবী নিরুদ্দেশ হন! তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া যায় না! তিনি স্বেচ্ছায় কোথাও চলে গেছেন, বা দাঙ্গার মধ্যে পড়ে মারা গেছেন কিছুই জানা যায় না!
 
অসুস্থ্য নজরুলের চিকিৎসা, তাঁর পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে সে সময় অনেকে এগিয়ে এসেছিলেন। তৈরি হয়েছিল বেশ কয়েকটি কমিটি। সেসব কমিটিতে মুসলমান সদস্য সংখ্যা ছিল লজ্জা পাবার মত কম! একেবারে সংবিৎহারা হয়ে যাবার আগে নজরুলের খুব বড় একটি আশা/ভরসার জায়গা ছিল এ কে ফজলুল হক। তিনিও তাঁকে হতাশই করেছেন। যতটুকু, যা তিনি করেছিলেন তা কবির প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য!

এক পর্যায়ে ১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক দেশ ভাগ হ'ল। উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনার নজরুল ছিলেন সব সময়ই মুসলমানদের চোখে 'অমুসলিম-কাফের'! কিন্তু ধর্ম ভিত্তিক দেশভাগ, অর্থাৎ সীমাহীন রেষারেষি, ঘৃণা, অবিশ্বাস আর প্রতিহিংসা নিয়ে একদা এক পরিবার যুযুধান দু'টি পরিবারে পরিণত হ'ল! নব সৃষ্ট মুসলমান গরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প সংস্কৃতি সংগীতের মানবিক ও দর্শনগত ক্ষেত্রটি হয়ে গেল এক; পশ্চিম বঙ্গে রয়ে গেল প্রকৃত বঙ্গীয় সংস্কৃতি! অর্থাৎ আবহমান কালের বাঙালি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির যে উত্তরাধিকার বাংলার মানুষ ধারণ করে এসেছে, তার সঙ্গে নব্য পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের কর্তা ব্যক্তিদের পরিচয় নেই। আবার পরিচয় কিছু থাকলেও, তার প্রতি সম্মান বোধ তো ছিলই না!

নজরুলের জীবনী লেখক গোলাম মুরশিদের ভাষায়, ''তাঁকে মুসলমান-রবীন্দ্রনাথ হিসেবে খাড়া করার একটা সক্রিয় প্রয়াস ছিল পূর্ব পাকিস্তানে।'' নজরুলের রচনায় যেসব 'অমুসলিম' শব্দ, কথা রয়েছে তা কাট/ছাট করার আয়োজন চলে। এসব উদ্যোগ আয়োজনে কবি গোলাম মোস্তফা(বিশ্বনবী খ্যাত) অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নজরুলের তখন এসব বুঝবার ক্ষমতাই নেই! অসুস্থ্য, নির্বাক, অসহায় কবি নজরুলকে নানা রূপে, নানা উপায়ে পাকিস্তানের স্বার্থে ব্যবহারের প্রাণপণ চেষ্টার কোন কমতি দেখা যায় না! মুসলমান নজরুল আসলে হিন্দু রবীন্দ্রনাথের চাইতেও বড় প্রতিভা - এরকম প্রচার চলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়! সাধারণ অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত মানুষ সেসব বিশ্বাস করতে শুরু করে! এই প্রসঙ্গে জানাই - একদা বাংলাদেশের অন্যতম প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, "মুসলমানদের মুক্তি ঘটেনি। তারা তাদের অতীত ইতিহাস ও মহাপুরুষদের সম্পর্কে সত্য প্রকাশ করতে দেয় না।"

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে বা বলা যেতে পারে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রি ইন্দিরা গান্ধীর কৃপায় কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন জোড় করে আটকে রাখার দরুণ বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারী করা হয়। সেই বছরই নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট(১২ভাদ্র, ১৩৮৩) তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে ঢাকায় সমাধিস্থ করা হলে সাংস্কৃতিক মনষ্ক পশ্চিম বঙ্গবাসী মানসিক আঘাত পায়। নজরুলের এই পরিণতি ভারতের সাহিত্য-প্রেমী, সঙ্গীত-প্রেমী বাঙালি সমাজ মেনে নিতে পারেনি।

গ্রন্থসূত্র :
(১) কাজী নজরুল ইসলাম, স্মৃতিকথা, মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ।  
(২) বিদ্রোহী রণক্লান্ত - নজরুল জীবনী, গোলাম মুরশিদ, প্রথমা প্রকাশন।
(৩) নজরুল-জীবনী, অরুণকুমার বসু, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৫তম সংখ্যা ।। জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ মে ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত