Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

ছবি
  সূচিপত্র  প্রবন্ধ-নিবন্ধ-মুক্তগদ্য-ভ্রমণকথা মেল্লক গ্রামের মদনগোপাল জীউর মন্দির ।। সায়ন মণ্ডল কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার ... হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। উজান... আমার রবীন্দ্রনাথ ।। সত্যেন্দ্রনাথ পাইন বৈকালিক বৈশাখ ।। ছন্দা দাম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার ।। পাভ... মে দিবস : অধিকারহরণ ।। শ্যামল হুদাতী শরীর ও মনের সুস্থতা ।। রতন বসাক মানুষ কী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিকট ভৃত্যমাত্র? ।।... আমাদের পরিবেশ ভাবনা ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত বিশ্বপ্রেম ।। আরতি মিত্র টান ।। মনোরঞ্জন ঘোষাল স্রষ্টার নিষ্ঠা ।। শংকর ব্রহ্ম বেগুনিয়া : বাংলার মন্দির স্থাপত্য ।। সু... ।। গল্প ।। বিকেল বাঁচাও আন্দোলন ।। সুবীর ঘোষ রাখে হরি তো মারে কে ।। সমীর কুমার দত্ত বিভ্রান্ত ।। রানা জামান সম্পর্ক ।। মাখনলাল প্রধান  ধারা মাস ঝরা মাস ।। প্রদীপ কুমার দে গল্পের মত অবিশ্বাস্য সত্য ।। বন্দনা সেনগুপ্ত ধর্মরাজ, লাখাই আর ডমরু সর্দারের গল্প... ভূতের বাচ্চা ।। নবী হোসেন নবীন গোধূলিবেলায় ।। সুচন্দ্রা বসু বিয়ে ।। রেজাউল করিম রোমেল ঘোড়ার ডিমের গল্প ।। প্রবোধ কুমার মৃধা নাত জামাই ।। সুদামক

ছোটগল্প ।। রণাদা ।। ভুবনেশ্বর মন্ডল

রণাদা

ভুবনেশ্বর মন্ডল



প্রায় বছরখানেক ময়ূরাক্ষী নদীর বাঁধের দিকে যাওয়া হয়নি। নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় বিকেলের ভ্রমণ একরকম বন্ধই ছিল। আমি আর সুমিত দুই বন্ধু মিলে সাইকেল নিয়ে বিকেল বেলার মনোরম বাতাস উপভোগ করতে প্রায়ই নদী পাড়ে যেতাম। কিছুকাল বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকায় ওদিকে যাওয়া হয়নি। প্রায় বছরখানেক পর একটু অবকাশ পেয়ে একাই বেরিয়ে পড়লাম সাইকেল নিয়ে। আমাদের ছোট্ট শহরটা পেরিয়ে পূর্বদিকে প্রায় দুই কিলোমিটার গেলেই একটা শ্মশান পড়ে। শ্মশান সংলগ্ন এলাকায় বেশ কিছু ছিটে বেড়ার ঘর তৈরি হয়েছে। এখানে গরিব মানুষেরাই থাকে। শহর এলাকায় জায়গার দাম অনেক। সেখানে মাথা গোঁজার জায়গা কেনার ক্ষমতা এদের নেই। তাই বেছে নিয়েছে শহর ছাড়িয়ে এতটা দূরে এই শ্মশানের কাছাকাছি এলাকা। অনেক কম দামে এখানে জায়গা পাওয়া যায়। অনেকে আবার নদীবাঁধের ফাঁকা সরকারি জায়গাগুলোতেও ঘর বানিয়ে ফেলেছে। এখানেই একটা ছিটে বেড়ার ঘর আমার বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল। সে ঘরে থাকতো তিনটে প্রাণী। স্বামী, স্ত্রী এবং একটা এক বছরের বাচ্চা মেয়ে। বাড়ির মালিকের নাম রণজয়। আমার পূর্ব পরিচিত। আমি ওকে রনাদা বলতাম। আসলে আমাদের দুজনের বাড়ি ছিল একই গ্রামে। আমি এখন কর্মসূত্রে এই শহরে এসেছি প্রায় ৩০ বছর। রনাদা এসেছিল তারও আগে। গ্রামে ভিটেমাটি সামান্য যা কিছু ছিল সব বিক্রি করে রনাদা এসেছিল এই শহরে ওর বউকে নিয়ে। এখানে এসে প্রথমে মাঠের দিকে বস্তি এলাকায় একটা ছোট্ট টালির ঘর বানিয়ে ছিল। দু কামরার ঘর। ওদের দুটো ছেলে জন্মায় এ শহরে এসেই। রণাদা প্রথমদিকে মুদিখানার দোকানে মালপত্র ওজন করে দেওয়ার কাজ করতো। যৎসামান্য আয়ে কোনরকমে সংসার চলত। তারপর ভাবলো আয় একটু বাড়াতে হবে। নিজে স্বাধীনভাবে কিছু করতে হবে। কিছু জমানো টাকা ছিল। তাই দিয়ে কিনে ফেলল একটা ভ্যান রিকশ। ভাড়াতে লোকের মালপত্র বইতো। তবে আগের থেকে আয় কিছুটা বেড়েছিল। তবে সব দিন সমান রোজগার হতো না। এরমধ্যে ছেলেদুটো বড় হল, ওরা মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাস করল। রনাদা ভাবল যাক এবার একটা হিল্লে হবে। ছেলের দুটো যদি রোজগার করতে পারে সংসারটা দাঁড়াবে। একা আয় করে সংসার চালাতে নাকানি চোবানি খেয়েছে এতদিন। কিন্তু চাকরি বাকরির বাজার তো খুব খারাপ। সরকারি চাকরি পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। ছেলেদেরকে যে ছোটখাটো ব্যবসা করে দেবে সে রকম টাকা-পয়সাও হাতে নেই। তাই ঠিক করল রাস্তার ধারে একটা সবজির দোকান করবে, তাতে পুঁজিও বেশি লাগবে না। ও নিজে রিকশ ভ্যান টানবে আর ছেলে দুটো সবজি বিক্রি করবে। কাঁচামালের ব্যবসাতে লাভ মন্দ হয় না। মাসখানেকের মধ্যে রাস্তার ধারে সবজির দোকান খুলে ফেলল একটা। ছেলে দুটো ওখানে বসে এবং সবজি বিক্রি করে। এখন রণাদার সংসারের আয় অনেকটা বাড়লো। বড় ছেলের বয়স ২৬ আর ছোটটার বয়স ২৪ যখন হলো তখন রনাদা ও তার বউ ঠিক করল ওদের বিয়ে দেবে। ওদের এবার সংসার পেতে দেওয়া দরকার। দুজনে রোজগার করতে শিখেছে। মাস দুয়েকের মধ্যে বিয়েও ঠিক হয়ে গেল।  এখন বেকার ছেলেদের বিয়ে দেওয়া বেশ সমস্যা। কিন্তু রণাদার সমস্যা হয়নি। দুই ছেলেই পাড়ার দুটি মেয়েকে প্রেম করতো। তারাও গরিব পরিবারের মেয়ে। অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় একই পর্যায়ের। ছেলে মেয়েদের যখন মন আছে তখন আর বাবা-মায়েরা আপত্তি করেনি। ফাল্গুন মাসে রনাদার জোড়া ছেলের বিয়ে হয়ে গেল। অল্পস্বল্প লোকজন খাওয়ানো হলো। বিয়েতে কোন আড়ম্বর অবশ্য ছিল না। আড়ম্বর করার মতো আর্থিক অবস্থাও দুটি পরিবারের নেই। বেশ চলছিল সংসার। বছর দুয়েক পরেই রনাদার সংসারে নেমে এলো বিপর্যয়। বৌদি মানে রনাদার বউ মিনতি হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ল। পেটে অসম্ভব যন্ত্রণা। সারা শরীর হলুদ বর্ণ হয়ে যেতে লাগলো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তারবাবু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন কেস জটিল। সম্ভবত ওনার লিভার ক্যান্সার। রনাদার মাথায় বজ্রাঘাত । সংসারটা এই সবে মাত্র দাঁড় করিয়েছে, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই এই দুরারোগ্য অর্থ ক্ষয়কারী রোগ। মিনতি বৌদিকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেও ডাক্তার বাবুরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালেন যে ওনার ক্যান্সারই হয়েছে। এবং এটা লাস্ট স্টেজ। পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রমণ। আর কিছু করার নেই। রনাদা হাল ছেড়ে দিয়ে বউকে বাড়ি নিয়ে এলো। পাড়ার লোকে বলল ভালো মন্দ যা খেতে চাও খাওয়াও। যে কটা দিন বাঁচে এভাবেই বাঁচুক। মাস ছয়েক যেতে না যেতেই মিনতি বৌদি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। এই ছয় মাসে রনাদা মন শক্ত করে ফেলেছিল। বউ মারা যাওয়ার পর সে বড় একা হয়ে গেল। দুই ছেলে তাদের ব্যবসা ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বৌদির মৃত্যুর সময় রনাদার বয়স ছিল প্রায় ৫৬ বছর। এখন আর সংসারে ভালো লাগেনা। কাজকর্মে উৎসাহ পায় না। দিন দিন শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মাথা ঘোরে। রিকশভ্যান টেনে মাল বয়ে বেড়ানোর মতো আর শারীরিক সক্ষমতাও নেই। ছেলেরা বলল আমরা তো বড় হয়েছি । যাইহোক ছোটখাটো একটা ব্যবসা করছি। তোমার শরীরের অবস্থাও ভালো দেখছিনা। তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। আমরা দুই ভাই ঠিক সংসার চালিয়ে নেব। তুমি বাড়িতেই থাকো। ইতিমধ্যে রনাদার দুই ছেলে রবিন আর রতনের দুটি সন্তান হয়েছে। বড় ছেলের মেয়ে আর ছোটটির একটি পুত্র সন্তান। ছেলেরা বাবাকে বলে তুমি নাতি নাতনিদের নিয়ে আনন্দ করে বাড়িতেই সময় কাটাও। বরং পারলে বাড়িতে বৌমাদের টুকিটাকি একটু সাহায্য করো। বাচ্চা দুটোকে যদি একটু দেখাশোনা কর তাহলে ওদের উপকার হবে। রনাদা বউ মারা যাওয়ার পর প্রায় বছর তিনেক ছেলেদের সংসারে নাতি নাতনিদের নিয়ে সময় কাটাতে লাগলো।

               কিন্তু মানুষের জীবনে কখন যে কি ঘটে আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। মানুষের মন, মনস্তত্ত্ব বড়ই জটিল এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। রনাদার এখন কাজ নেই ,সব সময় ঘরেই থাকে। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। মাঝে মাঝে বউ মিনতির জন্য মন খারাপ করে। মিনতি তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। এর আগেও গ্রামে থাকতে রণাদার প্রথমবার বিয়ে হয়েছিল আশালতার সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের দু'বছর পেরোতে না পেরোতেই আশালতার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যায়। এর পেছনে ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনা ছিল রনাদার মা হরিমতির। হরিমতি আশালতার উপর অতিরিক্ত খবরদারি করত। প্রতি পদে লাঞ্ছনা করত। আশালতাকে হরিমতি দাসী বাঁদির মত অপমান করত, গালাগাল দিত। খাওয়া পরা নিয়ে খোঁটা দিত। এমনকি ছেলে রনাকে দিয়ে শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত করাতো। হরিমতির কাজ ছিল সব সময় বউ এর বিরুদ্ধে ছেলের কানে ফুসমন্ত্র দেওয়া। মায়ের কথা রণাদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো। মা যেভাবে তাকে চালাতো, সেভাবেই সে চলতো। এর পেছনে রনাদার একটা স্বার্থ ছিল। হরিমতির নামে বিঘে দুয়েক জমি ও বাস্তুভিটেটা  রনাদার বাবা লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন ‌। এটুকুই ছিল তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি । রনাদারা ছিল তিন ভাই। হরিমতি মাঝেমধ্যেই রণাকে ভয় দেখাত যদি রনা তার কথামতো না চলে তাহলে তাকে সম্পত্তির ভাগ দেবে না, অন্য দু ভাইয়ের নামে সম্পত্তি লিখে দেবে। তাই রনা মায়ের কথার বাইরে কাজ করতে পারত না। হরিমতি নিজের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ছেলে এবং বৌমার সম্পর্কটাকে একেবারে বিষিয়ে দেয়। দিনরাত অত্যাচারিতা হতে হতে একসময় আশালতা সংসারের আশা ছেড়ে দেয়। ততদিনে আশালতা গর্ভবতী। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে থাকার মতো অবস্থাও নেই। গর্ভবতী অবস্থাতেও তাকে সহ্য করতে হতো শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন। শেষ পর্যন্ত যখন আর সহ্য করতে পারল না তখন আশালতা চিরদিনের মত শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করে বাবার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিল। হরিমতি এটাই চেয়েছিল।ছয় মাস যেতে না যেতেই হরিমতি আবার রণাদার বিয়ে দিল মিনতির সঙ্গে। নতুন সংসার পাতলো রনা। বউকে তাড়ানোর পুরস্কার স্বরূপ হরিমতি জমি ও বাস্তু ভিটের কিছুটা অংশ রনার নামে লিখে দিলো। মাস ছয়েক পরে ঠিক রনাদার দ্বিতীয় বিয়ের সময় বাপের বাড়িতে আশালতা জন্ম দিল এক কন্যা সন্তানের। রণাদা আর কোনদিন আশালতা ও তার মেয়ের খবর রাখেনি। এই ৬০ বছর বয়সে এসে মিনতির মৃত্যুর পর আশালতার কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে রনাদার। এখন ওর মনে হয় আশালতার সঙ্গে সেদিন হরিমতি এবং সে চরম অন্যায় করেছিল। সে মহাপাপ করেছিল। তার একটা মেয়ে হয়েছে এ কথাও সে শুনে ছিল। ওরা এখন কেমন আছে, কি অবস্থায় আছে রনাদা জানেনা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে আশালতার কাছে ও তার মেয়ের কাছে যেতে। ওদেরকে একবার চোখের দেখা দেখতে চায়। আশালতার উপর যে অন্যায় ও অত্যাচার সে করেছে সেই পাপেই হয়তো আজ মিনতির মৃত্যু হল। একটা পাপ বোধ মাঝে মাঝেই নিঃসঙ্গ রনাদাকে তাড়া করে। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। নিজের হাতেই সে সব শেষ করে দিয়েছে।

                 এরকম মানসিক বিপর্যয় ও টানাপোড়নের মধ্যে থাকলেও রনাদা যখন রাতে বিছানায় ঘুমোতে যায় তখন একটা পাশ বালিশকে আঁকড়ে ধরে বিছানায় ছটফট করে। মনে হয় পাশ বালিশটাই যেন মিনতি। একা শোয়া তো বিয়ের পর থেকে কোনদিন অভ্যাস ছিল না। একটা মেয়ে মানুষ পাশে থাকতো। মেয়ে মানুষের গায়ের গন্ধ নাকে না এলে ওর ঘুম আসতো না। এক সময় আশালতার সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক না থাকলেও দৈহিক সম্পর্ক ছিল। অনেক সময় আশালতার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও দেহ খিদে মেটাতো। রণাদার মতো মানুষের কাছে মেয়ে মানুষ তো পুরুষের ভোগের বস্তু। তাই সে আশালতার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কে মূল্য না দিয়ে তাকে এক প্রকার জোর করেই সম্ভোগ করতো। তারপর ওর জীবনে এল মিনতি। মিনতি সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্য বিষিয়ে যায়নি। কারণ দ্বিতীয় বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় মা হরিমতি। সুতরাং ওদের দাম্পত্য জীবনে বিষ ঢালার মত বিষধর কালসাপ হরিমতির মত আর কেউ ছিলনা। বেশ চলছিল সংসার। রনাদা মায়ের দেওয়া সামান্য জমিতে চাষাবাদ করত। যখন নিজের জমিতে চাষের কাজ থাকতনা তখন লোকের বাড়িতে মজুর খাটত। কিন্তু অন্য দু ভাইয়ের সঙ্গে এক সময় শুরু হয় পারিবারিক বিরোধ। সে বিরোধে রনাদা এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে যে গ্রাম ছেড়ে পালাবার পরিকল্পনা করে। কিছুদিনের মধ্যেই নিজের অংশের জমি ও বাস্তুভিটে বিক্রি করে বউ মিনতি কে নিয়ে চলে আসে এই মফঃস্বল শহরে। তারপর থেকেই শুরু করে মুদিখানার দোকানে কর্মচারীর কাজ। ঘর বাঁধে শহরের প্রান্তে এই বস্তি এলাকায়। তারপরের ইতিহাস নিয়েই আমরা এখন কথা বলছি‌। মিনতির সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে রণাদার কোথাও ফাঁক ছিল না। রণাদার বরাবরই দেহ ক্ষুধাটা মাত্রাতিরিক্ত। এখানে এসেও পাড়া পড়শিদের সুন্দরী ,সুঠাম বউ বিটিদের দেখলে ওর ভেতরে একটা লালসা জেগে উঠত। একাধিক নারী সঙ্গ করার বাসনাও জাগত। কিন্তু ইচ্ছে হলেও সবকিছু তো আর করা যায় না, সামাজিক লজ্জা, বদনাম , শাস্তির ভয়ও তো একটা আছে। তবে মিনতি স্বামীর মনের এই ছুকছুকির আঁচ পেয়েছিল। তাই স্বামীকে একটু চোখে চোখে রাখত। মিনতির মৃত্যুর পর এই ষাট বছর বয়সেও রনাদার দেহ  ক্ষুধাটা এখনও যেতে চাইছে না। রাত গভীর হলে একটা আদিম জন্তু ওকে ভড় করে। বিছানায় ছটফট করে। মেয়ে মানুষের গন্ধ পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোন উপায় নেই। দু এক সময় নিজেকে মনে মনে ধিক্কারও দেয়। এই বুড়ো বয়সে ভীমরতি কেন?

            একদিন দুপুরবেলা রনাদা ঘরের বারান্দায় নাতি নাতনিকে নিয়ে বসেছিল। বড় বৌমা অমিতা তখন উঠোনের বাথরুম থেকে স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে ঘরে এলো। ওর দেহের অনেকখানি অনাবৃত। সুপুষ্ট বক্ষদেশ ভিজে কাপড়ের জন্য অনেকটাই উন্মুক্ত । হঠাৎই রণাদার চোখ চলে যায় অমিতার বুকের দিকে । অমিতা সেটা লক্ষ্য করে অপ্রস্তুত বোধ করে। লজ্জা পেয়ে গামছা দিয়ে বুকটা ঢেকে নেয় এবং দ্রুত ঘরে চলে যায়। বৌমার কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় রণাদাও ইতস্তত বোধ করে। যাইহোক এই নিয়ে বৌমা আর কোন কথা বলেনি। এখন মাঝে মাঝে কেন জানিনা রনাদা বৌমার স্নানের সময়টার জন্য অপেক্ষা করে। স্নানসিক্ত অমিতার দেহটা দেখার জন্য ভিতরে ভিতরে একটা আকর্ষণ অনুভব করে। চক্ষু লজ্জা বশত নানা অছিলায় অতি সংগোপনে ওঁত পেতে বসে থাকে। তবে এই নিয়ে মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বও হয়। বৌমা তো মেয়ের মত সুতরাং তার সঙ্গে এমন আচরণ করা ঠিক হচ্ছে না। ছেলেরা যদি জানতে পারে তাহলে তার বাড়িতে থাকাও সমস্যা হবে। ওকে কেউ আর বিশ্বাস করবে না। তাই মনকে নানাভাবে সংযত করার চেষ্টা করে। কিন্তু কি আশ্চর্য বৌমায়ের স্নানের সময় হলেই ওর মনের মধ্যে ঝড় ওঠে। কে যেন ওকে জোর করে আড়ালে আবডালে যেতে বাধ্য করে।‌ এরকম বেশ কিছুদিন হওয়ার পর সংসারে একটা বিশ্রী কান্ড ঘটে যায়। অমিতা তার স্বামী রবিনকে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে বলে তোমার বাবার নজর খুব খারাপ। তাই প্রতিদিনই স্নান করার সময় আড়াল থেকে আমাকে দেখে। রবিন প্রথমদিকে ব্যাপারটাকে অতটা পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল হয়তো কোন কারণে তাকিয়ে ফেলেছে। অমিতা মেয়ের তুল্য। এরকম হওয়া অসম্ভব। কিন্তু এরপর নানা অছিলায় রনাদা বৌমা অমিতার হাত স্পর্শ করতো, ওর চোখের ভাষাতেও থাকতো কু ইঙ্গিত। তাই শেষ পর্যন্ত অমিতা রবিনকে জানায় রবিন যদি কিছু ব্যবস্থা না করে তাহলে অমিতা বাপের বাড়ি চলে যাবে। এরকম বাজে লোকের সঙ্গে সে এই পরিবারে থাকতে পারবে না। রবিন এবার নড়ে চড়ে বসে। ভাই রতনকেও গোপনে ব্যাপারটা জানায়। তারপর দুই ভাই মিলে কিছুদিন বাবাকে পরীক্ষা করে দেখে। তারা বুঝতে পারে যে অমিতার অভিযোগ মিথ্যা নয়। সে নির্জলা সত্য কথা বলছে। তাই দুই ভাই মিলে বাবাকে শাসায়, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ভয় দেখায়। রনাদা ছেলেদের কাছে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে। এবং বলে বৌমা তার নামে মিথ্যে অভিযোগ করছে, তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। এরপর বেশ কিছুদিন রনাদা চুপচাপই থেকে যায়। সংসার স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু রনাদার ঘাড়ে যে আদিম ভূতটা চেপেছিল তার মৃত্যু হয়নি। আবার সে একই কাণ্ড ঘটাতে থাকে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই রবিন এবং রতন বাবাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। এবং স্পষ্টই জানিয়ে দেয় যে তার মত কুলাঙ্গারের স্থান এ সংসারে নেই। রনাদা ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেয় ময়ূরাক্ষী নদী পাড়ের শ্মশানের কাছাকাছি এই ছিটে বেড়ার ঘরে। শরীরে আগের মত তেমন শক্তি নেই কিন্তু পেটের জন্য আবার রিকশভ্যান টানতে শুরু করে। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। নিজে রান্না করে খায়। এভাবে আর চালাতে পারছিল না। তাই মনে মনে ঠিক করে যেমন করেই হোক তাকে আবার একটা বিয়ে করতে হবে। একটা বউ থাকলে রান্নাবান্না করে দেবে আর সেই সঙ্গে তার দেহের খিদেও মেটাবে। কপাল গুনে মিলে গেল একটি ভাত ছাড়া মেয়ের সন্ধান। মেয়েটির আর কেউ ছিলনা। থাকতো মামার বাড়িতে। বয়স প্রায় ৪০ এর কাছাকাছি। চেহারা একেবারে সাধারণ। গায়ের রং কুচকুচে কালো। সামনের দুটি দাঁত পড়ে গেছে। যাইহোক মেয়েটির সঙ্গে একদিন দেবস্থলে বিয়ে হয়ে গেল রণাদার। দুজনেরই গতি হল।ওকে নিয়ে এই ছিটেবেড়ার ঘরে দিন কাটাতে লাগল রনাদা। বছরখানেক পরে মেয়েটি জন্ম দিল একটা কন্যা সন্তানের। মেয়েটা দেখতে বাবার মত। গায়ের রঙও রনাদার মত ফর্সা। যেন ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো। নতুন বউ এবং মেয়ের ভরণপোষণের জন্য রনাদা এখন রিকশভ্যান টানে। কোনরকমে পেটের ভাত জোগাড় করে । ঠিক এরকম অবস্থাতেই আমি ও সুমিত নদীর বাঁধে বেড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম রনাদাকে। ওকে এখানে দেখে অবাক হয়ে বলেছিলাম - কি ব্যাপার রনাদা তুমি এখানে? তোমার সঙ্গে ওই মেয়েটিই বা কে? রণাদা একটু ইতস্তত করে বলেছিল ওটা আমার নতুন বউ। মানে তুমি আবার বিয়ে করেছ? আমি তো জানতাম তোমার ছেলে বউ আছে, তা সত্ত্বেও আবার বিয়ে করলে কেন? রনাদা বলে - বুঝলিরে ভাই সব কপাল! আমার আগের বউটা ক্যান্সারে মারা গেছে। তারপর ছেলেরা আমাকে সংসার থেকে তাড়িয়ে দিল। তাই শ্মশানের ধারে এই ছিটে বেড়ার ঘর বেঁধে মাথা গুঁজলাম। সারাদিন রিকশভ্যান টানি। প্রতিদিন রান্নাবান্না করার সময় পেতাম না ।কোনদিন কপালে খাবার জুটতো খাবার কোনদিন জুটতো না। তাই বাধ্য হয়েই বিয়ে করলাম। তাতে তোরা খারাপ ভালো যা বলবি বল। এছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। বললাম তা তোমার ছেলেরা তোমাকে তাড়িয়ে দিল কেন? রণাদা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর বলল সে অনেক কথা। পরে কোনদিন সময় হলে আসিস বলব। ওখানেই একটা চালা ঘরে চায়ের দোকান ছিল। আমি আর সুমিত চা খাচ্ছিলাম।  বউ আর মেয়েকে নিয়ে রণাদা ওখানে এসেছিল। হত-দরিদ্র অবস্থা, দেখলেই বোঝা যায়। ওদের দুজনকে চা বিস্কুট খাওয়ালাম। বাচ্চা মেয়েটাকে কিছু খাবার কিনে দিলাম। আসার সময় ১০০ টাকার একখানা নোট ওর হাতে তুলে দিয়ে বললাম কিছু কিনে খেও রনাদা। রনাদা আমার মাথায় হাত রাখল। দেখলাম ওর চোখে জল চিকচিক করছে। আর কিছু বললাম না। সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। বললাম আজ আসি, পরে আবার দেখা হবে। তারপর সাইকেল নিয়ে আমি আর সুমিত বাড়ি ফিরলাম। তারপর প্রায় বছরখানেক আমি এই শহরের বাইরে ছিলাম আমার ব্যবসার কাজে। রনাদার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন গ্রীষ্মকাল, তাপমাত্রা এত বেড়েছে যে ঘরে টেকা দেয়। দুদিন হল বাড়ি ফিরেছি। বিকেলের দিকেও প্রচন্ড গরম। তাই সুমিতকে বললাম চল নদীর বাঁধের দিকে একটু ঠান্ডা হাওয়া খেয়ে আসি। বেরিয়ে পড়লাম দুই বন্ধু মিলে। ঠিক শ্মশানটার কাছে এসেই মনে পড়ে গেল রনাদার কথা। একই গ্রামের মানুষ। কেমন আছে একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। ৫০ মিটার হেঁটে গিয়েই পাকা রাস্তার ধারে নদীর বাঁধ ঘেঁষে রনাদার ছিটে বেড়ার সেই ঘর। ওখানে হাজির হলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি ঘরটা আছে কিন্তু কোন মানুষ নেই। ঘরটা প্রায় ভেঙে পড়েছে। বাইরে টিনের দরজায় একটা ছোট্ট সস্তা দামের তালা লাগানো। চারিদিকে লতা গুল্মের জঙ্গল। দেখে অবাক হলাম। বাড়িঘর ছেড়ে রনাদা গেল কোথায় ?
দেখে মনে হচ্ছে এখানে আর মানুষ থাকে না। আশপাশের দু একজনকে জিজ্ঞেস করলাম ওদের কথা। জানা গেল মাস সাতেক আগে রণাদা হঠাৎই হার্টঅ্যাটাকে মারা গেছে। রণাদা মারা যাওয়ার পর মাস খানেক বউটা এখানেই ছিল। কিন্তু খাবে কী? পাড়া পড়শিরাও গরিব। তারা দু চার দিন ডেকে খাইয়েছে। কিন্তু চিরদিন তো কেউ দায়িত্ব নেবে না। সঙ্গে বছর দেড়েকের বাচ্চা মেয়ে। ওই বাচ্চা মেয়েকে বাড়িতে একা রেখে লোকের বাড়িতে কাজ করে খাওয়াও বউটার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া একটা নিরাপত্তার ব্যাপারও আছে। একলা মেয়ে মানুষ ঘরে থাকলে রাতবিরেতে অনেক দুষ্টু লোক ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেও পারে। তাই নিরুপায় বউটা চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেছে তার মামার বাড়ি। এর বেশি আর পাড়াপড়শিরা তাদের খবর জানে না। কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগলো । বিষন্ন মনে আমি আর সুমিত বাড়ি ফিরে এলাম। পরে রনাদা কেন ছেলেদের সংসার ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল সে কথাও জেনেছি। তা শুনে খারাপও লেগেছিল। তবে এটাও ভেবেছি মানুষের জীবন ও মনস্তত্ত্ব বড় রহস্যময়। সে রহস্য ভেদ করাও বড় কঠিন। সাদা-কালো ,আলো-অন্ধকারে বোনা মানুষের জীবন। রণাদার মুখটা এখন কেবলই মনে পড়ছে। মনে পড়ছে ওর অসহায় বউ ও মেয়েটার কথা। জীবনের স্রোত মানুষকে কোথায় যে নিয়ে যায় আমরা কেউ জানি না।

________________________________________________


ভুবনেশ্বর মন্ডল
সাঁইথিয়া লেবুবাগান
পোস্ট -সাঁইথিয়া
জেলা -বীরভূম
পিন নাম্বার ৭৩১২৩৪





 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৫তম সংখ্যা ।। জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ মে ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত