কবিগুরু আর স্বামীজীর চোখে মানুষ
প্রদীপ কুমার দে
কলমে মানুষের জয়গান করতে গিয়ে ফিরে চললাম অতীতে, যখন এক মানুষ অন্য মানুষের চোখে সমাজে পরিচিতি পেয়েছিল ক্রীতদাসের ভুমিকায়। ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য আরো নানাবিধ বিভূষণে বিভূষিত ছিল তারা। জাতপাতের দায়ে তাদের সেই অসহায়ত্ব বুঝিবা ঈশ্বরের বুকেও আঘাত করেছিল। স্বয়ং ঈশ্বরও তা চায়নি। তিনি এই সুন্দর পৃথিবী গড়ে কোটি কোটি জীবনে প্রানের সঞ্চার করেছিলেন, মানবজন্ম দিয়ে সবচেয়ে সুন্দর উন্নত জীবন গড়ে ছিলেন, চেয়েছিলেন সুন্দর সৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা হতে কিন্তু তার সেই সৃষ্ট প্রানের মানুষই নিজের স্বার্থে নিজদের মধ্যে বিভাজন তৈরী করে দিল।
বহু যুগ পার হয়ে গেল মানুষের সাথে মানুষের এই মানবজাতির জন্মসূত্রে বিভেদ বহাল রইল। অসহায় মানুষ মেনে নিল, ভেবে নিল এ বুঝি তাদের ভবিতব্য।
স্রষ্টার ইচ্ছে ছিল অন্য তাই তিনি এই ধরায় অবতীর্ণ হলেন। ঈশ্বরকে দৃষ্টির মধ্যে আনার চেষ্টা ব্যতিরেকেই আমরা রক্ত মাংসের মহামানদের স্বাক্ষাত ভগবান হিসেবে পেয়ে গেলাম। আজ সেই তিনজন মানব ভগবানের কথাই লিখতে চলেছি এই মানবপ্রেম নিয়ে আমার সামান্য ক্ষমতায় কিন্তু প্রবল মানসিক ইচ্ছায়।
এই ত্রয়ীরা হলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণদেব আর স্বামী বিবেকানন্দ।
মানুষের মনের কথা তুলে ধরলেন এরা তিনজনই তাদের স্ব স্বভূমিকায়।
সূচনায় আমি উইকিপিডিয়ার সাহায্য নিলাম বিষয়টিকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরার পূর্বে যাতে সকলের কাছে এই বিষয়ে সম্যক ধারণা তৈরী হয়।
চণ্ডালিকা হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক বাংলা ভাষায় রচিত একটি উল্লেখযোগ্য নৃত্যনাট্য। এটি ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত তাঁরই নাটক চণ্ডালিকার কাহিনী অবলম্বনে একই নামে রচনা করেন এই "চণ্ডালিকা" নামক নৃত্যনাট্যটি। মানুষের মনের কথা তুলে ধরতে যে সমাকালীন সমাজদর্পণ তিনি কলমে আনেন তা হল ......
বৌদ্ধ সাহিত্যের কাহিনী থেকে 'চণ্ডালিকা'র মূল ভাবটি গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই নৃত্যনাট্যের ঘটনাস্থল শ্রাবস্তী নগরী। প্রভু বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আনন্দ এক গ্রীষ্মের প্রখর দুপুরে বিহারে ফিরে যাওয়ার সময় তৃষ্ণা বোধ করেন। তিনি দেখতে পেলেন একজন তরুণী কুয়ো থেকে জল তুলছে। সে এক চণ্ডালকন্যা, তার নাম প্রকৃতি। তার কাছে জল চাইলেন আনন্দ। কিন্তু তাকে তো সবাই চণ্ডালকন্যা বলে অস্পৃশ্য মনে করে। তাই সংকোচভরে প্রকৃতি আনন্দকে জানায় যে, সে চণ্ডালকন্যা আর তার কুয়োর জল অশুচি। আনন্দ তাকে বলেন যে, তিনি যে মানুষ, প্রকৃতিও সেই মানুষ। সব জলই তীর্থজল, যা তৃষ্ণার্তকে তৃপ্ত করে, স্নিগ্ধ করে। আনন্দের এই ব্যবহারে, সেইসঙ্গে তাঁর রূপে মুগ্ধ হল প্রকৃতি। নিজের জীবন সম্পর্কে ভাবনা বদলে গেল তার। এ যেন তার নতুন জন্ম। তার হাতের এক গণ্ডূষ জল গ্রহণ করে আনন্দ তার জীবনের সমস্ত অপমান ধুয়ে দিয়ে দিল। আনন্দকে পেতে চাইল প্রকৃতি।
কিন্তু সমাজের কিছু বিভেদমূলক নিয়মে তাঁকে পাবার কোনো উপায় না দেখে সে তার মায়ের সাহায্য চাইল। তার মা জাদুবিদ্যা জানত। মন্ত্র পড়ে এবং জাদুশক্তির জোরে তার মা শেষ পর্যন্ত আনন্দকে টেনে আনল তার মেয়ের কাছে। তার মা প্রকৃতিকে তার মায়াদর্পণে দেখতে বলল আনন্দকে। প্রকৃতি দর্পণে দেখল কিন্তু আনন্দের ক্লান্ত, ম্লান রূপ দেখে সহ্য করতে পারল না প্রকৃতি। কোথায় গেল তাঁর সেই দীপ্ত উজ্জ্বল, স্বর্গের আলোর মতো রূপ! সে পা দিয়ে ভেঙে ছড়িয়ে ফেলল তার মায়ের মন্ত্রের সমস্ত উপকরণ। তারপর প্রকৃতি ও তার মা দু'জনেই ক্ষমাপ্রার্থনা করল আনন্দের কাছে। তাদের এই নতুন উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই শেষ হয় রবীন্দ্রনাথের 'চণ্ডালিকা'র কাহিনী। ১৩৪৪ সালের ফাল্গুন মাসে 'চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্য' নামে পুস্তিকা আকারে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ইংরেজীর ৭ মে ১৮৬১ আর বাংলার ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ সন আর বিদায় ৭ আগস্ট ১৯৪১ বঙ্গাব্দ ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক হিসেবে তাঁকে পাই, বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয় রবীন্দ্রনাথকে। "গুরুদেব", "কবিগুরু" ও "বিশ্বকবি" প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প, ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সারাজীবন তিনি মানুষের যে জয়গান গেয়ে গেছেন তার স্বাদ যে বড় অমৃত সমান!
এর অনেক আগেই এসেছেন অবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেব। রামকৃষ্ণ পরমহংস হলেন ভারতীয় বাঙালী যোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু। রামকৃষ্ণদেব ধরায় অবতীর্ণ হন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬ এবং ইহলোক ত্যাগ করেন ১৬ আগস্ট ১৮৮৬ সনে।
অদ্বৈত বেদান্ত মতে সাধনা করে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন রামকৃষ্ণ। অন্যান্য ধর্মীয় মতে, বিশেষত ইসলাম ও খ্রিস্টীয় মতে সাধনা তাকে "যত মত, তত পথ" উপলব্ধির জগতে উন্নীত করে। পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক গ্রামীণ উপভাষায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে প্রদত্ত তার ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণ জনমানসে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বল্পশিক্ষিত হলেও রামকৃষ্ণ বাঙালি বিদ্বজ্জন সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সম্ভ্রম অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৭০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দু পুনর্জাগরণের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তৎসঙ্গে সংগঠিত করেন একদল অনুগামী, যার মধ্যে বিবেকানন্দ এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। যাকে দিয়েই তিনি মানবহিতৈষী নানান কাজ করিয়ে নিলেন ঠিক যেন সেই মানুষকে দিয়েই মানুষের উপকার করিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে ।
প্রসঙ্গত স্বামী বিবেকানন্দ জন্মে ছিলেন ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ এবং দেহ ছাড়েন ৪ জুলাই ১৯০২। ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হিন্দুধর্ম তথা ভারতীয় বেদান্ত ও যোগ দর্শনের প্রচারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় প্রদত্ত চিকাগো বক্তৃতা,যার মাধ্যমেই তিনি পাশ্চাত্য সমাজে প্রথম হিন্দুধর্ম প্রচার করেন।
মানুষই ঈশ্বর। এ আমার কথা নয়, জাগতিক ব্যাখা। স্বামীজী সারাজীবন দিয়ে প্রমান করে দিয়েছিলেন যে মানুষ সবার উপরে তার মধ্যেই ঈশ্বর বিদ্যমান। মানুষ নিজেই ঈশ্বর। এই কথা যেন সে মনে রাখে তাহলে আলাদা করে ভগবান খুঁজতে যাওয়র প্রয়োজন নেই। এই কথাটি তার উদার কণ্ঠে উদ্ভাসিত হয়েছিল বার বার। শুনিয়েছিলেন সেই মূল মন্ত্র,
" বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর। জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর "
কোথা খুঁজচ্ছো ঈশ্বরকে?
-- জীবে প্রেম করে যেইজন,সেইজন্য সেবিছে ঈশ্বর ......
স্বামীজী মানুষের মধ্যেই ভগবানকে দেখতে পেয়েছিলেন। প্রতিটি হৃদয়েই দেবতার বাস তা তিনি জানতেন। ঈশ্বর স্বয়ং এই চরাচর জগৎ তৈরী করে মানুষ সৃষ্টি করেছেন এই পৃথিবীর বুকে। আর তাকে দিয়েই তাঁর সমস্ত কাজ করিয়েও নেন। তার মধ্যেই তিনি থাকেন ঠিক যেমনটি ভাবে পিতা তার সন্তানের মধ্যে থাকেন।
আত্মা তাই অবিনশ্বর। আত্মার মৃত্যু নাই। আত্মাই ঈশ্বর। ঈশ্বর অমর যে... আত্মাও তাই।
স্বামী বিবেকানন্দের গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ দেবও এই কথার মূল হোতা ছিলেন। তিনিও মানব ধর্মকে বড়ধর্ম ভেবেছিলেন তাইতো প্রতিটি মানুষের প্রতিটি ধর্মকে অনুধাবণ করে সকলকে একই গ্রন্থিতে গাঁথতে চেয়েছেন, এবং তা ব্যাখ্যায়িত করে উদার কন্ঠে গেয়েছেন ধর্মীয় মেরুকরণের গান যা প্রতিটি ধর্মই মানুষের মুক্তির পথ। সব ধর্মের একই লক্ষ্য, পথ যদিও অনেক, ভিন্ন ভিন্ন।
নদী যেমন অনেক কিন্তু তারাই আবার সবাই মিলে যায় ওই এক সাগরের জলেই। যত মত তত পথ। সব পথই ঈশ্বরকে গিয়ে ছোঁয়। ঈশ্বরই শেষ কথা!
জীব মানেই শিব। জীবে প্রেম শিবের সেবা। এত বড় মূল্যায়ন আর বোধহয় আগে কোন মনীষী করেনি। অনেকে মানবধর্মের জয়গান লিখেছেন কিন্তু স্বামীজী মানুষকে একেবারে সরাসরি ভগবানে উন্নত করেছেন। এত প্রেম এত ভালবাসা সে কি শুধুমাত্র তত্ত্ব কথা অথবা বাণী কিংবা ভাষণ, তা তো নয়, এ যে একেবারেই সকলকে আপন করে নেওয়ার বড় ইচ্ছে বা তাগিদ যা তারই হৃদয় থেকেই উৎসারিত হয়েছিল সেদিন। এতদিন সকলে শুনেছি ভগবানের গুনগান এখন উনি মানুষের জয়গান গাইলেন। পাপের ভয় দেখিয়ে ধর্মবিশ্বাস অথবা ভগবান বিশ্বাস বড় অন্যায়। ঈশ্বর কখনোই চান না তুমি পুজোয় ডুবে থাকো, তুমি তোমার কাজ করে যাও।
ওঠো জাগো, মানুষের সেবা করো।
তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনিই বলেছেন, ফুটবল খেলতে আর সুস্থ সবল হতে যাতে দেশের আর মানুষের তা কাজে আসে। মানবজাতির উদ্দেশ্যে বললেন, ধ্যানে নিমগ্ন থাকো এবং তোমাদের অন্তরের ঈশ্বরকে জাগ্রত করো তাহলেই তুমি সব পারবে। মানুষ কিই না পারে? ঈশ্বর তাই চান। উনি তোমাকে দিয়েই সব করিয়ে নেবেন। তাইতো তিনি উদার কণ্ঠে বলেছেন,
"উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত"
মানুষকে যে ভাবে অবজ্ঞা করা হয় তা তার হৃদয়ে আঘাত করেছিল।
তিনি তাই বলেছিলেন,
-- " আমরা ছেলেবেলা হইতে ভুল শিক্ষা পাই যে, আমরা দুর্বল ও পাপী। সমাজের এই ভুল শিক্ষার শিকারে মানুষ দিন দিন দুর্বল হইতে দুর্বলতর হইয়াছে; আসলে তারা সেই অমৃতের সন্তান— বাল্যকাল হইতেই তাহাদের মস্তিষ্কে এমন শিক্ষা দেওয়া উচিত যা তাকে যথার্থ সাহায্য করবে, সবল করবে এবং সেটাই যথার্থ সামাজিক কল্যাণ হবে। দুর্বলতা ও কর্মশক্তিলোপকারী চিন্তা যেন তাহাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ না করে। সৎ-চিন্তায় নিজের মনকে সর্বদা বলতে হবে—"আমি সেই, আমিই সেই" ; মনে যেন তাই দিনরাত্রি ইহা সঙ্গীতের মতো বাজে আর মৃত্যুর সময়েও "সোহহং, সোহহং" বলেই দেহ থেকে মুক্তি পায়। জগতের অনন্ত শক্তিই যে তোমার ভিতরে। যে কুসংস্কার তোমার মনকে আবৃত করে রেখেছে তা ছেড়ে সাহসী হও । সত্যকে জানো, জীবনে কাজে লাগিয়ে চরম লক্ষ্যে পৌঁছে যাও - "উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত" ।।
-------
তথ্যসূত্র -
গুগল উইকিপিডিয়া
অধ্যাপক সত্যব্রত দাশগুপ্তের গ্রন্থ - গোরা ও রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দ ও শ্রীরামকৃষ্ণ।
----
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন