Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

প্রবন্ধ ।। রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ ও সাহিত্যচর্চা ।। রণেশ রায়

রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ ও সাহিত্য চর্চা

রণেশ রায় 

আমরা রবীন্দ্রভাবনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসম্পর্ক আলোচনা করার জন্য রবীন্দ্রভাবনা নিয়ে কয়েকটা কথা বলে নেব। আদিম বন্য সমাজে প্রকৃতির দুটি রূপ দেখা যায়----ভয়ঙ্কর  ধ্বংসাত্মক একটা রূপ আরেকটা অনিন্দ সুন্দর স্রষ্টার রূপ। জল বায়ু  আগুন প্রভৃতি হল প্রকৃতি যাদের প্রত্যেককে ধ্বংসের আর সৃষ্টির রূপে দেখা যায়।  মানুষ ভয়ে শ্রদ্ধায় প্রকৃতিকে তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করে।  প্রকৃতির উপাসনায় ব্রতী হয়।   এর থেকে উদ্ভব হয় সনাতনী শাশ্বত ধর্মের।  এর পর মানুষ ভাবতে শুরু করল প্রকৃতিকে অনুশাসনে রাখে এক চেতনা যা সর্বশক্তিমান। এই কল্পিত সর্বশক্তিমানের প্রতি অর্ঘ্য দান করাই হল পূজা।এই চেতনা তথা সর্ব শক্তিমান ক্ষমতাই হল ব্রহ্ম বা  পরমেশ্বর। রবীন্দ্রনাথ এই পরমেশ্বরকে তাঁর কল্পলোকে  বসিয়ে তাকে  ঈশ্বর বলে বিবেচনা করেছেন  যা প্রকৃতিকে পরিচালনা করে। তাঁর  প্রতি ভক্তিভরে  নিজের অন্তর্লোকে  তাকে   নিবেদন করা, তাকে সৌন্দর্যের আনন্দলোকে নিজের অন্তর্দৃষ্টি  দিয়ে দেখাই হলো রবীন্দ্রনাথের ভক্তিবাদ, ঐশ্বরিক প্রেম। এখানেই রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রেম মানবপ্রেম ঐশ্বরিকপ্রেম একবিন্দুতে মিলেছে। এই বিশ্বলোককে নিজের মনের কল্পলোকে প্রতিষ্ঠিত করে সেই কল্পলোকের আলোয় জীবনকে জীবনবোধকে উপলব্ধি  করাই  হল রবীন্দ্র মানস রবীন্দ্র ভাবনা।   তাই কবি বলেন, 


"সেই সত্য যা রচিবে তুমি,

ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি

রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।"" 


রবীন্দ্র মানস সনাতনী ধর্ম ও শিল্পবিপ্লবত্তোর পশ্চিমি ভাবধারার রোমান্সের সঙ্গে হেগেলের কল্পলোকের ভাববাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন রোমান্টিক যুগের পাশ্চাত্যের কবিকূল   শেলী ওয়ার্ডসওয়ার্থ বায়রন প্রমুখের  উত্তরসূরি। 


বাংলা সাহিত্য জগতের আনাচে কানাচে রবীন্দ্র ভাবনা রবীন্দ্র দর্শনের অবাধ বিচরণ। সাহিত্য চর্চায় তিনি এক বহুমুখি ব্যক্তিত্ব। রবি ঠাকুরকে আমরা পাই সাহিত্যের আঙিনার প্রতিটি বিভাগে। কবিতা, গল্প,  উপন্যাস, নাটক, নৃতি নাট্য, গান ----- কোথায় নয়? সর্বত্র। তাঁর জীবন দর্শন প্রতিভাত হয় সাহিত্যের প্রতিটি বিভাগের মাধ্যমে। রবীন্দ্র দর্শন রবীন্দ্র ভাবনা প্রকৃতি প্রেম পূজা  সামাজিক ন্যায় বোধ সব কিছুকে  বেষ্টন  করে  থাকে তার নিজ মহিমায়।


কবি প্রকৃতিকে এ মহাজগতের সর্বশক্তিমান চিরন্তন সত্য বলে জেনেছেন যা মানব জগত ও  বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে রক্ষা  করে থাকে। প্রকৃতির অনিন্দ সুন্দর রূপকে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষ সব যুগে সবার কাছে। তিনি জানেন মানুষ নশ্বর। ১০০ বছর পর তিনি এই বৈচিত্রময় প্রকৃতির কোলে থাকবেন না। সেটা তাঁর আপশোষ। কিন্তু বহমান এ জীবনে তিনি চান প্রকৃতির এই সৌন্দর্য রাশি যেন আগামী দিনেও প্রজন্মের কাছে অনুভূত হয় আজের মত। তিনি কবিতাটায় কথার ছটায়  শব্দের মাধুরিতে প্রকৃতির স্বরূপ তুলে ধরেছেন। তাই তিনি কবিতাটায় লেখেন:


  

 আজি হতে শতবর্ষ পরে

কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি

      কৌতূহলভরে--

   আজি হতে শতবর্ষ পরে।

আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের

      লেশমাত্র ভাগ--

আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,

   আজিকার কোনো রক্তরাগ

অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে

      তোমাদের করে

   আজি হতে শতবর্ষ পরে।


তিনি প্রকৃতিকে দেখেছেন ঋতু বৈচিত্রে ঋতু পরিবর্তনের  রহস্যের মধ্যে---- গ্রীষ্মের উষমতায়, তাঁর দহনে, কালবৈশাখির তান্ডবে আবার তারই মধ্যে সৃষ্টির মহিমায়। তিনি তাকে দেখেছেন বর্ষার বিরহে তার প্লাবনে। শরতের আগমনী গানে। তাঁর শরৎ ঋতুর ওপর গানে প্রকৃতি পূজার উৎসবের সঙ্গে একাত্ম হোয়ে এক পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করে এই ভৌতিক জগত যার সঙ্গে মেলে এসে মানুষের এক মনন এক আধ্যাত্মিক আনন্দানুভূতি। তিনি পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করতেন না। প্রকৃতির মহাশক্তিতে  বিশ্বাসী, প্রকৃতি পূজারী ছিলেন তিন। প্রকৃতির কর্তৃত্বের ওপর ছিল তাঁর অগাধ আনুগত্য। তিনি ছিলেন প্রকৃতির উপাসক যেখানে প্রেম পূজা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হোয়ে জীবনকে করে তুলেছে মানবধর্মে বলিয়ান যা তাঁর জীবন দর্শনে এক মানবতা বোধ। প্রকৃতিকে রক্ষা করা মানুষের অধিকার সম্মান বোধ তুলে ধরা আর  প্রকৃতি পূজা মানব ধর্মের প্রতি আনুগত্য তাঁর জীবন দর্শনকে এক বিন্দুতে মিলিয়েছে।


এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। 

তাপস নিঃশ্বাস বায়ে  মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।।

যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,

অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।।


তিনি তাঁর কবিতায় গানে বৈশাখের তাণ্ডব রূপ দেখেন যা ধ্বংসের বার্তা বাহক একই সঙ্গে এক শুভ আগমন বার্তা। আমরা শেলীর Ode to The West Wind কবিতায় প্রকৃতির এই রূপ পাই। একই সঙ্গে তাঁর প্রেমের ধারণা মূর্ত হয়ে ওঠে বর্ষার ওপর লেখা কবিতা গানে। বিরহের এক নৈসর্গিক প্রেমের প্রকাশ তাতে। নিচে অসংখ্য গান কবিতার মধ্যে একটা তুলে ধরা হলো আংশিক। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ে গানে বর্ষার জয়গান সোনা যায়। বর্ষাকে তিনি প্রেম বিরহের বার্তবাহী বলে তুলে ধরেছেন।  বর্ষায় তিনি প্রানোচ্ছল এবং একই সঙ্গে বিরহ বেদনায় কাতর। তিনি লেখেন কোন এক  বর্ষার দিনে:


এমন দিনে তারে  বলা যায়

         এমন ঘনঘোর বরিষায়।

         এমন দিনে মন খোলা যায় ----

এমন মেঘস্বরে     বাদল-ঝরোঝরে

         তপনহীন ঘন তমসায় ।। 


শরৎ কবির কাছে উৎসব কাল। প্রকৃতির শুভ্র পোশাকে পূজার ডালি নিয়ে তার আগমন। এ দুর্গোৎসব হতে পারে হতে পারে ফসল কাটার নবান্ন উৎসব। তিনি গেয়ে ওঠেন:


আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা।

নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই-- লুকোচুরি খেলা॥

আজ    ভ্রমর ভোলে মধু খেতে--   উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে;

আজ    কিসের তরে নদীর চরে চখা-চখীর মেলা॥

ওরে    যাব না আজ ঘরে রে ভাই, যাব না আজ ঘরে।

ওরে,    আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেব রে লুট ক'রে॥

যেন    জোয়ার-জলে ফেনার রাশি    বাতাসে আজ ছুটছে হাসি,

আজ    বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা॥


তিনি তাঁর গান কবিতায় বসন্তের আগমনী গান গান। বসন্ত তাঁর কাছে প্রেমের বার্তা বাহক। পুরোনোর বিদায়ে নতুনের বার্তা তাঁর বসন্ত রাগে:


আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। 

            তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে 

            কোরো না বিড়ম্বিত তারে। 

             আজি    খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো 

             আজি    ভুলিয়ো আপোনপর ভুলিয়ো,

             এই        সংগীত-মুখরিত গগনে

              তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো। 

এই         বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে 

দিয়ো      ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে। 


রবির প্রেমবোধ তাঁর গানে গল্পে নাটকে শাশ্বত হয়ে উঠেছে। দৈহিক সম্পর্কের উর্ধে সে দেহাতীত। প্রেম হল দুজনের মধ্যে এক মিলন গ্রন্থি। তা প্রকৃতি মানুষের মধ্যে হতে পারে মানুষে মানুষে হতে পারে। দৈহিক সম্পর্কের ব্যাপার থাকে বলে নরনারীর মধ্যে প্রেম দেহাতীত ছাড়াও দৈহিক প্রয়োজনে এক ভিন্ন মাত্রা পায়। কবির দেহাতীত আদৰ্শ  প্রেমের ধারণা মূর্ত হোয়ে ওঠে শ্যামা নৃত্য  নাট্যে যেটা তিনি কবিতার আদলেও তুলে ধরেন। উত্তীয় শ্যামার প্রেমে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে শ্যামার অনুরোধে চোর অপবাদ নিজের ঘারে তুলে নিয়ে। কবি দেখান এই বিশুদ্ধ প্রেম প্রেমিক প্রেমিকাকে সর্বস্ব ত্যাগ করতে অনুপ্রাণিত করে। এই ত্যাগের মধ্যে দিয়ে প্রেম হয়ে ওঠে দেহাতীত অবিনশ্বর যা এই বৈষয়িক সব ক্ষুদ্র স্বার্থকে অতিক্রম করে।  উত্তীয় নিচের কথামালায় সে প্রেমের স্বরূপ তুলে ধরে গেয়ে ওঠেন:


আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান---

          তুমি জান নাই, তুমি জান নাই,

তুমি জান নাই তার মূল্যের পরিমান।

                 রজনী গন্ধ্যা অগোচরে

কেমনে রজনী স্বপনে ভরে 

                     সৌরভে,

    তুমি জান নাই, জান নাই

তুমি জান নাই, মরমে আমার ঢেলেছ তোমার গান


এবার আমরা রবীন্দ্রপ্রেমের স্বরূপ আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের কাব্যধর্মী উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ আর নাটক ‘রক্ত করবী’ ধরে  আলোচনায় আসব। আগেই বলে রাখি এই দুটি বইতেই তিনি দেহাতীত এক নৈসর্গিক বিমূর্ত প্রেমের মাহাত্ম তুলে ধরেছেন যা মানুষের আনন্দের উৎস, মুক্তির দিশা বলে কবি মনে করেন। একই সঙ্গে এই প্রেমবোধ উৎসারিত হয় মানবতার দর্শনকে কেন্দ্র করে যেখানে ক্ষুদ্র আত্মস্বার্থের পরিসর খুব সীমিত বা অনুপস্থিত, যাকে জয় করতে প্রেরণা যোগায় রবীন্দ্রনাথের নৈসর্গিক আধ্যাত্বিক প্রেম বোধ যা অবহেলিত হয় মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থ বোধে বৈষয়িক তাগিদে। জীবনের পাওয়া না পাওয়ার বৈষয়িক হিসেব রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্বিক প্রেম বোধকে অস্বীকার করে। রবীন্দ্রনাথের এই প্রেমবোধ ভাববাদে আপ্লুত   যে ভাববাদ রবীন্দ্রদর্শনের অনুরাগী।


তিনি তাঁর কবিতায় মানুষের সহজাত সৌন্দর্য আর আনন্দ বোধকে একাত্ম করে তুলেছেন কবিতায়। প্রকৃতির সহজাত সৌন্দর্য আর মানুষের সহজাত স্বতঃস্ফূর্ত প্রানোজ্বল আনন্দবোধ এক সূত্রে বাঁধা পড়ে যখন তিনি লেখেন:


আজি এ প্রভাতে রবির কর

কেমনে পশিল প্রাণের পর,

কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!

না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।

জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, ওরে উথলি উঠেছে বারি,

ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া  রাখিতে নারি


এবার আসা যাক ‘শেষের কবিতা’য়, রবীন্দ্রনাথের অতীন্দ্রিয় শাশ্বত এক আধ্যাত্মিক প্রেমের ধারণায়। উপন্যাসে দুটি চরিত্র----নারী ও পুরুষ, লাবণ্য আর অমিত। অমিত লাবণ্যক বন্যা বলে সম্বোধন করত। দুজনে এক আত্মীক বন্ধনে নিজেদের বেঁধেছে যা সহজাত নৈসর্গিক। বস্তুজগতের কোন বাধ্যবাধকতায় এ প্রেম নিজেকে বাঁধে না। এ এক  স্বতঃস্ফূর্ত সহজাত শাশ্বত প্রেম যা দেহাতীত। অথচ দুজনেই জানে এই ইহজগতে নশ্বর এ বৈষয়িক জীবনে দৈহিক বন্ধনের তাগিদ থাকে, তার প্রয়োজন থাকে। বিবাহের মাধ্যমে তার প্রয়োজন মেটে। আর এই বিবাহ বন্ধনের থেকেও উৎসারিত হতে পারে এক দেহাতীত প্রেম। আবার সেটা নাও হতে পারে কারণ বৈষয়িক প্রয়োজনে এই প্রেম ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে যেতে পারে যা মানুষকে মুক্তির নিশানা দেখাতে পারে না, পরস্পরের অধিকার শ্রদ্ধার স্বীকৃতি পায় না সে অনুষ্ঠানিক প্রেমে।

 

পরে জানা যায় যে কেতকীর সঙ্গে অমিতের এক বৈষয়িক প্রেম সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্র ধরে কেতকী  দাবি করে তাদের ভালোবাসার এক বৈষয়িক  সম্পর্ক যা বিবাহে পরিণতি পেতে পারে । বন্যা সেটা মেনে নেয়। সে জানত অমিতের সংগে তার প্রেম দেহাতীত যার দৌলতে তারা নদীতে অবাধে সাঁতার কাটে মুক্ত আকাশে ভেসে বেড়ায়। আর কেতকীর প্রেম সংসার জগতের খেয়া বায়।



অমিত কেতকীকে  বিয়ে করে। তার স্বীকারোক্তিতে সে বলে:

কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই; কিন্তু সে যেন ঘড়ায়-তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইল দিঘি; সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।’

সাংসারিক প্রয়োজনে লাবণ্যের বিবাহ ব্যবস্থা শোভনলালের সঙ্গে । সে অমিতকে চিঠি পাঠিয়েছে যাতে তাঁদের দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কটা ধরা পরে। বন্যার বিয়েতে  অমিতের নিমন্ত্রন। কারও কোন ক্ষোভ নেই কারণ তারা জানে তাদের প্রেম এক বন্ধনহীন গ্রন্থি। বিবাহ বন্ধনে তারা তাকে বাঁধতে পারে না। চিঠির একটা অংশ তুলে দিলাম যা রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক প্রেমের স্বরূপ তুলে ধরে:


কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে

বসন্তবাতাসে

অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,

ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,

সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে

তোমার প্রাণের প্রান্তে; বিস্মৃতিপ্রদোষে

হয়তো দিবে সে জ্যোতি,

হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নের মুরতি।

তবু সে তো স্বপ্ন নয়,

সব চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়—

সে আমার প্রেম,

তারে আমি রাখিয়া এলেম

অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে।

পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে

কালের যাত্রায়।

হে বন্ধু, বিদায়।


রবীন্দ্রনাথে গানের মধ্যে দিয়েও শাশ্বত এই প্রেমের সুর:


সেদিন দুজনে দুলেছুনু বনে,   ফুলডোরে বাঁধা ঝুল না। 

সেই স্মৃতিটুকু কভু ক্ষণে ক্ষণে   যেন জাগে মনে, ভুলো না ॥

সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জানো--   আমারি  মনের প্রলাপ জড়ানো,

  আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা ॥

  যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে।

  দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কী মহা লগনে।

এখন আমার বেলা নাহি আর,    বহিব একাকী বিরহের ভার--

  বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার সে রাখী খুলো না, খুলো না ॥


‘রক্তকরবী’ রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতীক ধর্মী বহুমাত্রিক নাটক যেখানে একটা শোষণ ব্যবস্থার চরিত্র যেমন উন্মোচিত হয়েছে তেমনি তার বিরুদ্ধে  অসহায় মানুষের বিক্ষোভ তুলে ধরা হয়েছে। তাদের অসহায় অবস্থাটা নাটকে প্রাণ সঞ্চার করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানব প্রেমের নৈসর্গিক রূপটা। দুটি প্রতীকী চরিত্র কেন্দ্রীয় চরিত্র বলে বিবেচিত ----- যক্ষ  আর নন্দিনী। নন্দিনীর প্রেমিক রঞ্জন নাটকে পার্শ চরিত্র। যক্ষ  পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় রাজতন্ত্রী শাসনের প্রতিভূ যে  শোষণ ও নিপীড়ণের মাধ্যমে শাসন চালায়। আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর সাহায্যে রাজার শাসন চলে।  আর খেটেখাওয়া মানুষ তাদের ক্ষোভ বিক্ষোভ থাকলেও রাজার শাসন মেনে নিতে বাধ্য। এই ব্যবস্থায় রাজা থেকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যন্ত্রে পরিণত হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই শোষণমূলক চরিত্রটা রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেন যদিও বংশানুক্রমে তিন অভিজাত জমিদার পরিবারের সন্তান যে পরিবার শিক্ষা জীবন যাপন নানা দিক দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের অনুগ্রহ পেয়ে থাকত । তৎসত্বেও তৎকালীন  শাসন ও শোষণকে তিনি যে তুলে ধরেছেন সেটা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সন্দেহ নেই। এই নাটকে এক নারী চরিত্র নন্দিনী প্রেমের প্রতীক হয়ে মুক্তির দিশারী হিসেবে নাট্যমঞ্চে আবির্ভুত হন। তিনি তাঁর প্রেম বোধের সাহায্যে নিপীড়িত মানুষের মধ্যে এক অধিকার বোধ আত্মসম্মান  বোধ জাগিয়ে তোলেন যা তাদের নিজেদের যন্ত্র নয় মানুষ  বলে ভাবতে শেখায়। নন্দিনী এই শোষণমূলক ব্যবস্থাকে ঘৃণা  করলেও তার অবসানে সক্রিয় থাকলেও তাঁর প্রেম বোধ এই ব্যবস্থার প্রতিনিধি যক্ষরাজ আর তার রক্ষীবাহিনী আমলা সবার  হৃদয় জয় করে তাদের রাজতন্ত্রের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁদের এসব কাজ থেকে নিরস্ত করে। সব মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে প্রেম বোধ মানবতা বোধ।  রঞ্জন নন্দিনীর প্রেমিক। তাদের মধ্যেকার আধ্যাত্মিক প্রেম বোধ জেগে ওঠে সব স্তরের মানুষের মধ্যে। আর এই প্রেমই পারে সমাজের শোষণ নিপীড়নকে আটকাতে বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন। এটা বলতে গিয়ে তিনি এই শাসন ব্যবস্থা আর ভাড়াটে শাসক সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেন। দেখান সবার মধ্যে প্রেমের সঞ্চালন মানব মুক্তির দিশারী হতে পারে।  তাতে এই ব্যবস্থায় মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার সঞ্চার হয়  সে বিচ্ছিন্নতা দূর হয়। বরং এই ব্যবস্থাটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারই সৃষ্ট রাজা আর তাঁর পরিষদবর্গ থেকে।


পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষকে মানুষ থেকে মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। যক্ষ পুরীতে সোনাখনিতে কর্মরত মানুষের জীবন ধারণ তাঁদের বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোভের তাড়নায় প্রকৃতির ওপর আক্রমণ যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় গৃহীত নীতি। রবীন্দ্রনাথ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এই প্রকৃতি লুঠ যে পুঁজিবাদী সভ্যতাকে  পাল্টা আঘাত করবে তা রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেন, তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন যা তাঁর সাহিত্য চর্চায় ভাষা পেয়েছে। আজ সভ্য সমাজে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় কার্যত সভ্যতার বিপর্যয় ডেকে এনেছে। পৃথিবীকে  ধ্বংসের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। এই ব্যাপারটা রবীন্দ্র দর্শনে প্রতিভাত হয় যেটা তিনি বিভিন্ন গল্প প্রবন্ধ উপন্যাসে তুলে ধরেন।


সমাজ জীবনে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা তাঁর সাহিত্য চর্চার অন্যতম উপাদান। এই ব্যবস্থায় সমাজে অর্থনৈতিক শোষণের ফলে যেমন ন্যায় নীতি বিঘ্নিত হয় তেমনি ধর্মের নামে অধর্মের অনুশাসন সামাজিক আচরণ ধর্মের নামে কুসংস্কারের প্রবর্তন সমাজ ও পরিবারে লিঙ্গগত বৈষম্য ন্যায় নীতি প্রবর্তনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। পুরুষ প্রধান সমাজে পরিবারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া রীতি নীতি নারী নির্যাতনের হাতিয়ার।শোষণ মূলক সমাজের শোষণ কায়েম রাখতে সামাজিক ধর্মীয় বিভিন্ন রীতিনীতি প্রবর্তিত হয়। রবীন্দ্র নাথ সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের সাথী হতে চেয়েছেন নারী স্বাধীনতার প্রবক্তা হয়ে উঠেছেন। তার কবিতা গল্পে সব ধরনের সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছেন। আমরা দু একটা কবিতা উপন্যাস ধরে রবীন্দ্রনাথের এক সমাজ সংস্কারক চরিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করব।


এবার রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য চর্চার আরেকটা দিক তথা মানুষের জীবন জীবিকার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি  তাঁর ‘ঐকতান’ কবিতা দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি তাঁর নিজের অভিজাত সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, সেটা তাঁর কাছে ছিল একটা বিরম্বনা। এই বিরম্বনা বোধ তাঁকে কতটা ব্যথিত করত তা আমরা কবিতাটার কয়েক লাইন পড়লেই বুঝতে পারি:


সবচেয়ে দুর্গম যে মানুষ আপন অন্তরালে,

তার পূর্ণ পরিমাপ নাই বাহিরের দেশে কালে। 

সে অন্তরময়,

অন্তর মিশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়।

পাইনে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার;

বাঁধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি জীবন যাত্রার। 

চাষী ক্ষেতে চালাইছে হাল,

তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল---

বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার। 

তারই পরে  ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার। 

অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানে চির নির্বাসনে 

সমাজের উচ্চমঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে। 

মাঝে মাঝে গেছি আমি ওপাড়ার প্রাঙ্গনের ধরে;

ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে। 

জীবনে জীবন যোগ করা 

না হলে, ব্যর্থ হয় গানের পসরা। 

তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা ---

আমার সুরের অপূর্ণতা।

 

কী সহজ ভঙ্গিমায় কবিতার ছন্দে সাহিত্যের কথা মালায় এঁকেছেন দরিদ্র সাধারণ মানুষের নানা ধরণের জীবিকা তাঁদের দৈনন্দিন জীবন যাপন। তাদের জীবিকা ও জীবন যাপনের সঙ্গে তিনি তাঁর কলমের জোরে একাত্ম হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর সামাজিক অবস্থার জন্য এরই মধ্যে নিপিড়িত মানুষের সঙ্গে তাঁর যে  সহজাত দূরত্ব সেটা গোপন করেন নি। গভীর বিড়ম্বনা সত্বেও তা দ্বিধাহীন ভাবে তুলে ধরতে সংকোচ করেন নি।


পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরিবারে মহিলাদের অসহায় নিপিড়িত অবস্থাটা তিনি তুলে ধরেন তাঁর ‘স্ত্রীর পত্র’ নামক গল্পে। গল্পটা যেন তাঁর লেখায় তিনি বলে যাচ্ছেন তাঁর ঘরে বসে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সামনে রেখে। মেয়েদের এই দুরবস্থা তাঁর মত অভিযাত পরিবারের মা বৌদের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি তেমনি তাঁদের পরিবারে নিয়োজিত পরিচালিকাদের ক্ষেত্রেও ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও সত্যি। এর জন্য তিনি দুই মহিলা চরিত্র মেজ বৌ আর বিন্দুকে উপস্থিত করেছেন। পরিবারে সমাজে মহিলাদের স্বাধীন সত্তা স্বীকার করা হয় না। ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ম অনুসরণ করে মহিলাদের চলতে হয় ঘরের চার দেওয়ালে আবদ্ধ থেকে, পরিনারের অনুশাসন পুরুষের কর্তৃত্ব মেনে। আর শ্রমিক কর্মী হিসেবে যে মেয়েরা কাজ করে তাঁদের ক্ষেত্রেও রোজগেরে হলেও পরিবারের অনুশাসনে চলতে হয়। তাঁদের শিক্ষা স্বাস্থ্য বিয়ে জীবন যাপন সব কিছুতেই পরিবারের লৌহ শৃঙ্খল অনুশাসন। গল্পে বাড়ির মেজবৌ পরিবারের চোখে বেয়ারা কারণ সে নিজ পরিচয়ে নিজ সত্তায় বাঁচতে চায়। পরিবারের বেঁধে দেওয়া গৃহস্থালীর মধ্যে নয়। তাঁর সাহিত্য চর্চার প্রতি যে স্বাভাবিক আগ্রহ তা পরিবারের অনুশাসনে স্বীকৃত নয়। আরো মজার পরিবারের আনুগত্যে মহিলারা এমনভাবে অভ্যস্থ হয়ে যান যে তাঁরাই মেজ বৌয়ের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে পরিবারের অমঙ্গল বলে মনে করেন। পরিবারের মধ্যে মেয়েরাই হয়ে ওঠে মেয়েদের শত্রু। তারা নিজেরাই নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। বোঝে না যে এটা নারী সমাজের জন্য অসন্মান। পরিবারের অনুগত থেকে স্বামীও পরিবারের হয়ে ওকালতি করেন। মেজ বৌয়ের ক্ষেত্রে এর পরিণতি হল পরিবারের সঙ্গে তাঁর মানসিক বিচ্ছেদ। আর বিন্দুর ক্ষেত্রে পরিবারের অমান্য হলে তার পরিণতি আরো ভয়ঙ্কর কারণ সে নিম্নবর্গের মেয়ে মানুষ। তাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে পাগল ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। পালিয়ে এসে মেজবৌয়ের আশ্রয় নেয়। মেজ বৌ পরিবারের নীতি অগ্রাহ্য করে বিন্দুকে আশ্রয় দেবে তাকে তার মর্যাদা দেবে বলে ঠিক করে। সেটাতে পরিবারের সম্মানহানি হয়। মেজ বৌ তার তোয়াক্কা না করে সে পরিবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মেজ বৌএর প্রতি বিন্দুর ছিল অসাধারণ ভালোবাসা। আর তাঁর এই ভালোবাসা তাকে মেজোবৌয়ের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করে। দুই নারীর মধ্যে আধ্যাত্মিক প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়  যা পরস্পর দৈহিক যৌন সম্পর্কের উর্ধে। রবীন্দ্র দর্শনে যা মানব প্রেম। বিন্দু মেজবৌয়ের এই বিচ্ছিন্নতা সহ্য করতে না পেরে সে বাড়ি থেকে চলে এসে আত্মঘাতী হয়। মেজ বৌ এতে এতটাই ক্ষুব্ধ হয় যে আর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না বলে স্থির করে। সে তার স্বামীকে লেখা পত্রে এই গল্পের আদ্যপ্রান্ত লিখে তার নিজের সত্তা নিয়ে নিজের মত বাঁচবে বলে  জানায়। মেজ বৌয়ের এই জেহাদ রবিঠাকুরের কলমে নারী সমাজের জেহাদ বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সে আত্মসমর্পন নয় আত্মহত্যা নয় পুরুষ সমাজের বিরুদ্ধে  বিদ্রোহীনি এক নারী।

এবার আসা যাক রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি প্রবন্ধে। আমরা আগেই বলেছি রবিঠাকুর পুঁজিবাদী ব্যবস্হাকে তার শোষণ নিপীড়নের কারণে ঘৃণা করতেন। তার অবসান চাইতেন। তিনি মার্ক্সবাদী ছিলেন না তাই মাৰ্ক্সের শ্রেণী লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার অপসারণের কথা বিচার করেন নি। তবে সোভিয়েত বিপ্লবের মাধ্যমে জারের উচ্ছেদ ঘটলে তিনি সোভিয়েত বিপ্লবকে অভিনন্দন জানান। পরে সোভিয়েত রাশিয়ায় গিয়ে সেখানকার শাসন সরকারের জননীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তার ভিত্তিতে রাশিয়ার চিঠি নামক প্রবন্ধটি রচনা করেন। সোভিয়েত শাসনের ধনাত্বক ঋনাত্বক দুটি দিকই তুলে ধরেন। নতুন সোভিয়েত শাসন সেখানকার আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় যে বিপুল পরিবর্তন এনেছে তা তুলে ধরেন। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য শিক্ষা জীবিকার উন্নতির দুয়ার যে খুলে গেছে সেটা দেখান। শ্রমজীবী মানুষের নিয়মানুবর্তিতা তাঁদের শ্রমমুখী জীবনের প্রশংসা করেন তিনি। একই সঙ্গে সেখানকার শাসন ব্যবস্থায়  একটা যান্ত্রিকতা আছে বলে তিনি মনে করেন। আর বিশ্বজুরে ভাতৃত্বের বন্ধন যা মাৰ্ক্সের আন্তর্জাতিকতাবাদের ভিত্তি তা যে সমাজতন্ত্রের সাম্য ধারণার মধ্যে নিহিত আছে সেটা স্বীকার করেন। আর তখন পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার লড়াই শুরু হয় সোভিয়েতের নেতৃত্বে যেটা পৃথিবীর নিপিড়িত মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। রবীন্দ্রনাথ এই বিশ্ব ভাতৃত্বের লড়াইয়ের সাথী ছিলেন তাঁর সাহিত্যে যা তাঁর মানবতাবোধকে ভাষা দেয়, তার বার্তা পৌঁছে দেয়। রশিয়ার চিঠি এরই একটা প্রমাণপত্র বলে বিবেচিত।

রবীন্দ্রনাথের জীবন ভাবনা জীবন দর্শন গড়ে উঠেছে প্রেম সম্পর্কে তাঁর ধারণাকে কেন্দ্র করে ---- সে প্রেম একাধারে প্রকৃতি প্রেম মানব প্রেম সর্বশক্তিমান ঈশ্বর প্রেম। তাঁর কাছে সৃষ্টির উৎস নিহিত আছে প্রকৃতির বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে। এই ভৌতজগৎ ও তার বিবর্তন প্রক্রিয়াকে অবলোকন করে হৃদয় গহনে কল্পনার মালা গেঁথে যে সৌন্দর্য বোধের সৃষ্টি করা হয় মনোলোকে তাই রবীন্দ্র প্রেমে রূপ লাভ করে বলে মনে করা যেতে পারে। আর এখানেই তাঁর কল্পস্বর্গ আনন্দলোক যা তাঁর রোমান্টিকতা থেকে উদ্ভুত । আর এই আনন্দলোক তাঁর কল্পস্বর্গ সেজে ওঠে কল্পনার অবগাহে। এই আবহে নিজের মনের গভীরে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে অবলোকন করা তাকে নিজের মনলোকে প্রতিষ্ঠা করা তাকে এক অনাবিল সৌন্দর্য বোধে সাজিয়ে তোলাকে আমরা রবীন্দ্র প্রেম বলতে পারি। উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘রবীন্দ্র-পরিক্রমা’ কাব্য গ্রন্থে বলেন , ‘যে প্রেম বুভুক্ষিত দৃষ্টিতে দেহের চারিপাশে ঘুরিয়া মরে, ব্যক্তি-মানুষের বাস্তব দেহ-মন যাহার ভিত্তি, সেই আবেগময়, আত্মহারা, সাধারণ মানুষের প্রেম রবীন্দ্রনাথের প্রেম নয়।...প্রেম অসীম, অনন্তের ধন, আত্মার সম্পদ, দেহের সীমায় তাহাকে ধরা যায় না। দেহসম্বন্ধ বিরহিত, অপার্থিব সৌন্দর্যের নিবিড় অনুভূতি এক অনির্বচনীয় আনন্দরস।’

কল্পনার অবগাহে গড়ে তোলা এক নৈসর্গিক প্রেম বোধের আলোয় রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ দর্শন গড়ে উঠেছে। আর তাঁর সাহিত্য চর্চার ওপর এর প্রতিফলন দেখা যায়। তাই দেখা যায় ভাববাদে আপ্লুত তাঁর সাহিত্য চর্চা।

রবীন্দ্রনাথের জীবন বোধ গড়ে তোলায় সাহিত্য চর্চায় ডারুনের বিবর্তনবাদ  ও হেগেলের ভাববাদের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মাৰ্ক্সের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ। যদিও দুজনের জীবন ভাবনাই মানুষের কল্যানের অভিসারী। মনুষ্য সমাজের মুক্তির জন্য নিপীড়নমূলক পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অবসান দরকার বলে উভয়েই মনে করেন। মার্কস শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শক্তির সাহায্যে রাষ্ট্রব্যবস্থার উচ্ছেদকে একটা ঐতিহাসিক অনিবার্যতা  বলেন।  রাষ্ট্র শক্তিকে প্রেমের সাহায্যে মানুষের মন জয় করে উৎখাত করার ধারণাকে এক অলীক স্বপ্ন বলে মনে করা হয় মার্ক্সবাদী ভাবনায়। আর  রবীন্দ্রনাথ সেখানে তাঁর রোমান্টিক কল্পনার অবগাহে মানুষের মনের উৎকৃষ্টতার জাগরণ ঘটিয়ে লক্ষ্য সাধনে ব্রতী হওয়ার কথা বলেন তাঁর ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে ওঠা জীবনবোধের সাহায্যে যেখানে প্রেম শুভ এক মন জগৎ সৃষ্টিতে চালিকা শক্তি। সেই জন্যই দেখা যায় রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রেম এত গুরুত্বপূর্ণ।


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক