আমরা ভুলেই গেছি কোমল হৃদয় মেয়েটিকে একবার ও সেই দীপধারিনী সেবাময়ীকে শ্রদ্ধা জানালাম না তার দ্বিশত জন্মবর্ষপূ্র্তিতে।
200 বছর আগে মেয়েদের সব দেশেই সব কাজেই ছিল বাধার দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর। সেই পরিবেশেও মেয়েটি নিজের ও অন্য মেয়েদের জন্য একটি অসাধারণ স্নেহ মাখা স্বাধীন বৃত্তির স্বপ্ন দেখেছিল।
তার স্বপ্ন ছিল সেবা দিয়ে অসুস্থ ব্যক্তিদের আরোগ্য করে তোলা। তিনি সারা পৃথিবীর মেয়েদের জন্য একটি সেবামূলক বৃত্তির পথ খুলে দিয়ে গেছেন। সমাজে অবহেলিত লাঞ্ছিত নারীরা শুশ্রুষাকারিনীর বৃত্তিতে এসে নিজেদের মনের মত কাজ ও সম্মান খুঁজে পেয়েছে। অবহেলিত কত নারী মর্যাদা লাভ করেছে।
তিন্নি করুণাময়ী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, তার জন্ম হয়েছিল1820 সালে। এই 2020 তে তার 200 বছর পূর্ণ হল। এই অবসরে তাকে একটু সম্মান করি একটু স্মরণ করি।
ফ্লোরেন্সের পিঠা ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ার অঞ্চলের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। ধনবান পিতা মাতার ঘরে ফ্রেন্ডস তাদের ডারবিশায়ারে বাড়িতে যত্নে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। লেখাপড়ায় ফ্লোরেন্সের খুব আগ্রহ, সেকালে মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করার রেওয়াজ ছিল না সে দেশে ও, ফ্লোরেন্স যুগের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে গেলেন শিক্ষাদিক্ষায় ।
গৃহকোণে এমন আরামের জীবন থেকে মুক্তি চেয়ে ছিলেন ফ্লোরেন্স। উজ্জল এক আলোকময়
জগতের সাথে যুক্ত হতে ফ্লোরেন্স শুশ্রূষা বিদ্যা শিখতে চেয়ে ছিলেন, সে যুগে মেয়েদের শুশ্রূষা বিদ্যা শিক্ষা বা শুশ্রুষাকারীর কাজ করা ছিল নিন্দনীয় বিশেষ করে এমন সম্ভ্রান্ত ঘরে।
আর্ত পীড়িতের সেবা কখনো নিন্দনীয় হতে পারে না, পীড়িতের সেবা কাজে ই মেয়েদের অন্তরের মুক্তি, এমনটা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন ফ্লোরেন্স পিতা-মাতাকে। শান্ত নম্র ধীর স্থির ফ্লোরেন্স নিজের অন্তরে বুনে চলা সেবা মহান ব্রত এই ভাবনা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার কথা ভাবতে পারেনি।
অবশেষে তাদের 17 বছরের শিক্ষিতা সুন্দরী কন্যার মহান ভাবনার কাছে হার মানলেন
পিতা মাতা। সম্মতি মিলল হাসিমুখে।
পিতা মাতার আশীর্বাদ নিয়ে মাত্র 17 বছর বয়সে ফ্লোরেন্স চললেন জার্মানিতে শুশ্রূষা বিদ্যা শিখতে। গভীর মনোযোগ দিয়ে শিখলেন এই বিদ্যা এবং হাসপাতাল পরিচালনা পদ্ধতি। প্রাণ আনন্দে ভরপুর, শিক্ষার সম্পূর্ণ হতে ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন।
ফ্লোরেন্স ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন নগরীর
এক হাসপাতাল পরিদর্শিকা কাজ পেয়ে চলে গেলেন। ফ্লোরেন্সের যখন 34-35 বছর বয়স অভিজ্ঞতার পূর্ণ ঝুলি দিয়েছে তাকে আত্মবিশ্বাস আর মর্যাদাবোধ। সালটা 1854 এমন সময় রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের যুদ্ধ বাঁধে। ইতিহাসে এই যুদ্ধ ক্রিমিয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। ইংল্যান্ড তুরস্কের পক্ষে যোগ দিয়ে অনেক সৈন্য পাঠিয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে এই যুদ্ধ চলে এবং ইংরেজ পক্ষে বহু সৈন্য হতাহত হয়েছিল।
আহত সৈনিকদের জন্য সেখানে না ছিলো কোনো ভালো হাসপাতাল না ছিল ভালো শুশ্রুষাকারী,
ফলে যুদ্ধে যত সৈনিক মারা যেত তার চেয়ে বেশি সৈনিক মারা যেত হাসপাতলে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে।
এইসব মর্মান্তিক খবর পেয়ে মর্মাহত ফ্লোরেন্স রণাঙ্গনে গিয়ে আহত সৈনিকদের সেবা করতে চাইলেন। ব্রিটিশ সরকার এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন।এক ইংরেজ মহিলার এই সেবা ব্রতের
কথা শুনে সমগ্র ইংরেজ জাতি চমৎকৃত হয়েছিল।
এমনকি মহারানী ভিক্টোরিয়া নিজে এসে ফ্লোরেন্স কে তারেই সদিচ্ছার জন্য আশীর্বাদ করেছিলেন।
সেবা কাজে অভিজ্ঞতায় ভরপুর ফ্লোরেন্স 38 জন শুশ্রুষাকারী র একটি দল নিয়ে তুরস্কের স্কুটারি হাসপাতলে এসে পৌঁছালেন। এখানে হাজার খানিক আহত সৈনিকদের দুরবস্থা দেখে তিনি গভীর দুঃখ পেয়েছিলেন। এত জন রোগীর চিকিৎসা ও শুশ্রূষা করার উপযোগী ঔষধ ও সরঞ্জাম সেখানে ছিলনা। সৈন্য বিভাগের তেমন আর্থিক সঙ্গতি ও ছিল না। তাই ফ্লোরেন্স তার দেশবাসীর কাছে সাহায্যের এক আকুল আবেদন পাঠিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের জনসাধারণ ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গুলি এই সেবাব্রতীর
আবেদনে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিলেন।
অপূর্ব সাফল্য! চার মাইল স্থান জুড়ে 8 টি ওয়ার্ড নিয়ে জে স্কুটারি হাসপাতাল ছিল বিভীষিকার রাজ্য ফ্লোরেন্স মাত্র 10 দিনে সেই হাসপাতালের অবস্থা-ব্যবস্থার আমুল সংস্কার
করেছিলেন। তিনি আহত রোগীদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছিলেন। ফ্লোরেন্স নিজের হাতে গুরুতর আহত সৈনিকদের শুশ্রূষা করতে ন,
ক্ষত পরিষ্কার করে ব্র্যান্ডেজ বেঁধে দিতেন, ঔষধ খাওয়াতেন ।
এ সময় ফ্লোরেন্স দিনে কুড়ি ঘন্টা করে কাজ করতেন। গভীর রাত পর্যন্ত তিনি লন্ঠন হাতে নিয়ে ওয়ার্ডে গিয়ে সৈনিকদের সঙ্গে স্নেহ ভরা কথা বলে তাদের কষ্ট লাঘব করতেন। আহত সৈনিকদের কাছে ফ্লোরেন্স ' দীপ মাতা' ।( lady with the lamp) নামে পরিচিত ছিলেন।
অনেক আহত সৈনিক এই দীপ মাতার স্নেহের স্পর্শের আশায় অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করতো, তার মধুর ব্যবহারে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা য় নত হত তার ছায়ার সামনে।
টানা দুটি বছর নিবিড় উদ্যমে সেবা কাজ করেন । দু'বছর পরে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ইংল্যান্ডের ফিরে এলে তাকে শ্রেষ্ঠ নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। এই যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় হয়, ইংল্যান্ডের জয় যেন ফ্লোরেন্সের জয় শুশ্রুষাকারী দলের জয়, সেবাব্রতী মেয়েদের জয়।
শ্রেষ্ঠ নাগরিকের সম্মান ফ্লোরেন্স চাননি,
চেয়ে ছিলেন সারা পৃথিবীর মেয়েদের জন্য একটি সম্মানজনক সেবামূলক বৃত্তির পথ।
সেই সম্মান তিনি পেয়েছিলেন। ফ্লোরেন্সের তত্ত্বাবধানে শুশ্রূষা বিদ্যা শিক্ষার প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লন্ডনে। তিনি সারা পৃথিবীর মেয়েদের একটি মর্যাদাপূর্ণ বৃত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন পৌনে দুই শত, বৎসর আগে।
যখন এদেশে বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষা নারীর মর্যাদার জন্য কঠিন লড়াই করছেন তখন লন্ডনে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মেয়েদের বৃত্তি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন। একই সালে জন্ম দুজনের বিদ্যাসাগর ও ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
অভিজাত বংশের মেয়ে বলে নয় তার কঠিন সেবা কাজে অনমনীয় থেকে তিনি রাজ আনুকূল্য লাভ করেন যাতে পৃথিবীর মেয়েরা সম্মানীয় আসনে আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
দীর্ঘায়ু ফ্লোরেন্স 1910 সাল অবধি সুস্থ শরীরে সেবা কাজের উন্নয়নে নিয়োজিত ছিলেন।
শ্রদ্ধা জানাই তাকে।
আনন্দময়ী মুখোপাধ্যায়
অনামিকা
1/67, এম এম এম রোড
কলকাতা 700074
---
Shared using
https://www.writediary.com/getapp
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন