কবিরুল
সাত বছর হয়ে গেছে। কলিঙ্গ আর অবন্তি সুখে সংসার করলেও মাঝে মাঝে সংসারে একটু আধটু অশান্তি লেগেই আছে। দুজনে অনেক মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেছে। এখন ইদানিং সম্পর্কটা অন্য দিকে মোর নিতে চলেছে। অশান্তির মেঘটা ক্রমশঃ কালো আকার ধারণ করছে।
কলিঙ্গ স্বচ্ছল ব্যবসায়িক পরিবারের ছেলে। প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করে। পারিবারিক ব্যবসা এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। যৌথ পরিবার ভাগ হওয়াতে ব্যবসার কলেবর ছোট হয়ে গেছে। আয় আগের তুলনায় অনেক কমেছে। আনুপাতিক হারে বেড়েছে ব্যয়ের পাহাড়।
এদিকে কলিঙ্গের অফিসের অবস্থা ভাল নয়। কোম্পনীর শেয়ার পড়তে শুরু করেছে। কোম্পানীর বর্তমান অবস্থা কলিঙ্গের ব্যবসার মতন। প্রতিদিনই চলছে কর্মী ছাঁটাই। হিউজ ব্যয়ভার কমাতে কোম্পানী এখন স্টাফদের টার্মিনেশন লেটার ধরাতে বাধ্য করছেন।
কলিঙ্গের কপালের চিন্তার ভাঁজটা দিনকে দিন পুরু হচ্ছে। দুদিন আগেই ওর দুই কলিগকে ররখাস্ত করেছে কোম্পানী। ওর নিজের চাকরি এখন থাকে কি না সেটাই ভাবার বিষয়।
কদিন আগেই বসের সাথে এই ব্যাপারে হালকা খটমট লেগেছিল। মেজাজ হারিয়ে বসকে দু চার কথা শুনিয়ে দিয়েছে। তাই মনের অবস্থা ভাল নয়। রাগ করে অফিস যায়নি। অফিস থেকে ফোন এলেও রিসিভ করেনি।
আজ অবন্তির সাথে কলিঙ্গের অশান্তি এই নিয়ে চরমে উঠল।
" সারাদিন বাড়ির মধ্যে বসে থেকে কর টা কি ? অফিসটা তো করতে হবে নাকি ? " অবন্তি চায়ের কাপটা দিয়েই একটু কথা শোনাল।
" অফিস করিনা মানে ? এতদিন তো সব ঠিক ঠাক ছিল। একটু সমস্যা হয়েছে। তাই..... "
কলিঙ্গের কথা শেষ না করেই অবন্তি বলে ওঠে , " জানোই তো প্রাইভেট কোম্পানী। একটু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হয়। এ তো তোমার ব্যবসা নয়। যখন খুশী টাকা নিয়ে ওড়ালাম। প্রাইভেট কোম্পানী। অনেক চাপ মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। মাঝে মাঝে বসের মন জুগিয়ে চলতে হয়। "
" আজকাল কিছু বলতে গেলেই অনেক কথা বল। জ্ঞান দাও খুব। তুমি এ সবের মানে কি বুঝবে। সারা জীবন বাবার পয়সার ফুটানি করে গেলে। এখন আমার সংসারে এসে বরের পয়সার ফুটানি করছ। যদি হিম্মত থাকে একটা ছোট চাকরি করে দেখাও না। তখন বুঝব। সারা জীবনে তো বাবা আর দাদাদের মাথায় বসে থেকেছ। একটা কাজও করতে হয়নি। নিজে দু চার আনা রোজগার করলে বুঝতাম। "
" একদম মুখ সামলে কথা বলবে। বাপ তুলবে না। আমার যদি আমার পাশে থাকত তাহলে আমাকে আজ এই দিনটা দেখত হত না "
" আলাদা হতে কে বলেছিল ? তোমার কথা ভেবে , তোমার সুখের কথা ভেবে আমি আমার পরিবার ছেড়েছি। নিজের ঘর ভেঙ্গে আলাদা হয়েছি। দিনের পর দিন তোমার চাহিদা মিটিয়েছি। দামী গাড়ি। ভাল ফার্নিচার , শপিং কোন কিছুই বাদ রাখিনি। এমনকি তোমার মন জোগাতে কলকাতার পস এলাকাতে ফ্ল্যাট বুকিং করেছি। বেশ তো ছিলাম। একটা ভাল চাকরি করতাম। মোটা টাকার মাইনের লোভে তুমি আমাকে বাধ্য করেছিলে ঐ চাকরি ছেড়ে নতুন কাজে যোগ দিতে। সারা জীবন তোমার মতকে প্রাধান্য দিতে আজ আমার এই অবস্থা। তোমার উচ্চাশা , অহংকার সব কিছু শেষ করে দিয়েছে।" কলিঙ্গ রাগে গজ গজ করে ওঠে।
সংসারে যখন অভাব দেখা দেয়। তখন জানালা দিয়ে সকল সৌন্দর্য্য পালায়। অথচ একদিন এই সৌন্দর্য্য সুখের টানে অবন্তি ভেসে গিয়েছিল।
******************
কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়তেই কলিঙ্গের সাথে আলাপ। বেশ হ্যাণ্ডসাম স্মার্ট কলিঙ্গকে দেখে অবন্তি চোখ ফেরাতে পারেনি। কলিঙ্গের কলেজে , এলাকাতে বিপুল পলুলারিটি ওকে আকৃষ্ট করেছিল। আলাপ করার ইচ্ছে থাকলেও হয়নি। একদিন সুযোগটাও এসে গেল।
শ্রাবণ মাস। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। অবন্তির কলেজের ক্লাস শেষ হতেই বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে। অনেক্ষণ স্ট্যাণ্ডে থেকেও কোন বাসের দেখা পায়নি। তখন কলিঙ্গ ওকে ওদের গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
তারপর থেকে প্রায়ই কলিঙ্গের গাড়িতে করে কলেজে আসত। এর পর থেকেই দুজনের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।
একই কলেজে পড়ত দুর্নিবার। মালদার গরীব পরিবারের ছেলে। দারুণ মেধাবী। মেধার জোরেই ভাল কলেজে ভর্তি হয়েছিল। দুর্নিবারের সাথে আলাপ ভর্তির দিন থেকেই। তারপর থেকে দুজনের দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
দুর্নিবার অবন্তিকে বিভিন্নভাবে হেল্প করত। পড়াশোনা ছাড়াও আরো অনেক ব্যাপারে দুর্নিবার ছিল অবন্তির পরামর্শদাতা। পরিবারের অনেক ছোট খাটো সমস্যা দুর্নিবারকে বললে ও নিমেষে সমাধান করতে পারত। দুর্নিবার মনে মনে অবন্তিকে ভালবাসত। তবে কোনদিন বলতে পারেনি।
অবন্তি ভাল মেয়ে। পরোপকারী। তবে ওর উচ্চাশা ছিল প্রবল। মনের মধ্যে অহংকারের মেঘ জমেছিল প্রচুর। ওর অহংকারটা ও কাউকে বুঝতে দিতে চাইত না। তবে মাঝে মাঝে বেগতিক দেখলেই সেটা বেরিয়ে আসত।
দুর্নিবার ওর স্টেটাসটা জানত না। একদিন জানতে পারল ওর বোন বিদিশার জন্মদিনে।
বিদিশার জন্মদিনে দুর্নিবার সামান্য একটা ডেয়ারী মিল্কের ক্যাডবেরী আর গোলাপের তোড়া এনেছিল। রাজমিস্ত্রীর ছেলে দুর্নিবারের কাছে সেটাই অনেক। দুর্নিবার বুঝতে পারেনি। ঐ সামান্য উপহারটা নিয়ে জল এতটাই গড়াবে।
অবন্তি এই নিয়ে অনেক কথা শোনায়। যেটা দুর্নিবার আশা করেনি।
" এত বড় একটা পার্টিতে এসেছ। অথচ সামান্য একটা উপহার হাতে। তুমি জান , তোমার ঐ উপহারের জন্যে আমার সন্মান কোথায় গেল ? যদি পয়সা না থাকে শুধু হাতে আসতে। কিংবা আমার কাছে ধার নিতে। আমি ভাবতেই পারিনি তোমাদের মালদার মানুষের মন অত ছোট। লজ্জায় আমার কাটা যাচ্ছে। " অবন্তি ঝাঁঝিয়ে উঠল।
" বিশ্বাস কর অবু , আমার কাছে ওটাই অনেক। তাছাড়া আমার টাকা ছিল না। যে কটা টাকা টিউশনি করে পায় তাতে আমার খরচ চলে না। সামান্য কিছু টাকা বাড়ি থেকে আসে। তাও সব মাসে আসে না। আমি জানতাম না তোর পরিবার এতটাই উন্নত । " দুর্নিবারের চোখ ছল ছল করে।
" তুই কি ভেবেছিলিস হাভাতে পরিবার ? সবাইকে নিজের দিক দিয়ে বিচার করিস তাই না ? এবার থেকে নিজের আচরণগুলো বদলাস। কলকাতাতে পড়তে এসেছিস। এটা তোর মালদার সেই গ্রাম নয়। এটা একটা বিশাল মাপের শহর। নিজের মাপটাই এখানে আসল। "
" অবু , আমি অতটা ভাবিনি। তোর সাথে মিশে তোর মাপটা ধরতে পারিনি। আজ বুঝলাম। পরের বার দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি রাজমিস্ত্রীর ছেলে। বালি , সিমেন্ট , ইট , পাথর নিয়ে কারবার। ছোটবেলাতে বাবার সাথে বাবাকে কাজে সাহায্য করেছি। অনেক পরিশ্রম করেছি। তাই ওইটুকুই আমার সীমা। "
" সারা জীবন ঐ বালি কাদা মেখে থাকতে হবে। আর এগোতে হবে না। "
এরপর দুর্নিবার আর অবন্তিকে কোন কিছু বলার সুযোগ দেয়নি। দুর্নিবার আসতে আসতে ওর সান্নিধ্য এড়িয়ে চলত। তবে বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিল। ও কি ভাগ্যিস বলে ফেলেনি যে ও অবুকে ভালবাসে।
দুর্নিবার না পারলেও কলিঙ্গ পেরেছিল। কলিঙ্গ একাই প্রোপোজ করেছিল। ভালবাসা কখনো কখনো সমানে সমানে হয়। বড়লোকের ছেলে কলিঙ্গের প্রেমে পড়তে তাই অবন্তির অসুবিধা হয়নি।
তবে দুর্নিবারের সাথে কলিঙ্গের একটা সখ্যতা ছিল। সেটা কলেজ মেট হিসেবে। কলেজের চৌহদ্দির বাইরেও ছিল তার আনাগোনা।
অবন্তির কাকার বিয়েতে কলেজের সব বন্ধুরা ইনভাইটেড হলেও দুর্নিবারকে নিমন্ত্রণ করেনি। কারণ একটাই। যদিও কলিঙ্গ বুঝিয়েছিল অনেক করে।
" সবাইকে ইনভাইট করলি , দুর্নিকে বলতে পারতিস। ও কি ভাববে বলত ? "
" আসলে আমার না ঠিক খেয়াল ছিল না। এখন হাতে সময় নেই। এখন বললে ও রাগ করবে। তাছাড়া ও আমার পিসিমণির ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে আসেনি। তাই আর ......"।
কলিঙ্গের সাথে আট বছরের প্রেম চলার পর দুজনের বিবাহ হলেও , অবন্তির বাড়ি থেকে অনেক আপত্তি ছিল। তাই ওর পরিবারের কেউ এই বিয়েটা মেনে নেয়নি। অবন্তি পরিবারের সাথে ঝামেলা করে বিয়েটা করে।
আত্মাভিমানী অবন্তির অহংকারও ছিল। কলিঙ্গের মতন ও বিশাল বড়লোকের নবাব নদ্দিনী। তাই শ্বশুড় বাড়িতে অন্যের হুকুম শুনবে কেন ?
চার বছর ঘুরতেই আলাদা হতে হয়। ভাল ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতে শুরূ করে।
দুর্নিবারের সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। কলিঙ্গের বিয়েতে আসার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারেনি। মা ঐ সময় মারা গিয়েছিল। পরে জানতে পারে দুর্নিবার একটা ভাল চাকরি পেয়েছে। কর্নাটকে আছে। ঐ টুকুই শেষ খবর।
সপ্তাহ দুই যেতে না যেতেই কলিঙ্গ ঐ অফিসের চাকরিটা হারাল। বসের সাথে গণ্ডগোলটাই কফিনে শেষ পেরেক পুঁতল। কাজ হারিয়ে বাড়িতে বসে থেকে থেকে কলিঙ্গ খিটখিটে হয়ে গেছে। এদিকে বাবার বাসাতে ফেরার সব পথ বন্ধ। কারণ অবন্তি। নতুন কাজ পেতেও সময় লাগবে। অনেক জায়গাতেও যোগাযোগ করছে।
অবন্তির ভাড়া ফ্ল্যাটে মন টেকেনা। নতুন কেনা ফ্ল্যাটে যাবার জন্যে মন ছটফট করছে। ফ্ল্যাটের পেমেন্টও অনেক বাকি থেকে গেছে। বাবার কাছে হাত পেতেও কোন লাভ নেই। বাবাকে এখন দাদা আর বিদিশাই দেখাশোনা করে। সুতরাং ......
ফ্ল্যাটের পেমেন্ট ঠিক মত না দিলে ফ্ল্যাট যেকোন কারণে হাত ছাড়া হতে পারে।তাই অবন্তি আর দেরী করেনি। নিজেই ঠিক করল প্রোমোটারের সাথে দেখা করবে।
প্রোমোটারের সাথে দেখা করতেই আর এক ঝামেলা। প্রোমোটারদের যে সুপ্রীম বস তিনি আজ আসছেন। বিজনেস মিটিং আছে। তাই সকলে উনাকে নিয়ে ব্যস্ত। অবন্তিকে অগত্যা অনেক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া কোন রাস্তা নেই।
অবন্তির চোখের সামনেই একটা বিশাল বহুল গাড়ি চলে গেল। সাথে কিছু হেভী ওয়েট লোক। বোঝাই যাচ্ছে বেশ হাই প্রোফাইল মিটিং।
পাকা তিন ঘন্টা ঠাঁই বসে থাকার পর অবন্তি একটা ছোট চিরকুট পাঠাল একজনের হাত দিয়ে প্রোমোটারকে।
প্রোমোটারের হাতের ঐ চিরকুট দেখে সুপ্রীম বস একটু আনমোনা হয়ে গেলেন। হাতের লেখাটা ভীষণ ভীষণ চেনা। ষোল বছর আগের একটা ছবি চোখের সামনে ভাসছে।
মিটিং শেষ করেই ডেকে নিলেন অবন্তিকে।
অবন্তি এসি ঘরে পা রাখতেই বুকটা কেঁপে উঠল। চোখের সামনে যাকে দেখছে সে সেই রাজমিস্ত্রীর ছেলে কলেজ মেট দুর্নিবার ঢালী। নামকরা বিজনেস ম্যান। আচার আচরণে অহংকারের লেশ মাত্র নেই।
" কেমন আছ ? কলিঙ্গ ভাল আছে ? কাকু কাকিমা , বিদিশা ? " বলেই অরেঞ্জ জুসটা এগিয়ে দিল।
" আছে। তুমি কেমন আছ ? একদম বদলে যাওনি। শুনেছি চাকরি করছিলে। এখন তাহলে ...... " অবন্তি আমতা আমতা করেও কথা শেষ করতে পারল না।
" চাকরিও করি। সাথে ব্যবসাটাও। অবু , তোমার মনে আছে। তুমি বলেছিলে না 'সারা জীবন বালি কাদা মেখে কাটাতে হবে। সেটাই সত্যি হল। আসলে রাজমিস্ত্রীর ছেলে তো , সমীকরণটা বুঝি। "
" কেন লজ্জা দিচ্ছ ? আমি আমার শাস্তি পেয়ে গেছি। " বলেই কেঁদে ফেলল।
**********
একবছর কেটে গেছে।
কলিঙ্গরা নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে। সামনের ঊইকে নতুন চাকরিতে জয়েন করছে। স্যালারী ভাল।
দুর্নিবারের ফার্মে কলিঙ্গ কাজের জন্যে দরখাস্ত করতেই দুর্নিবার ওর ঠিকানাতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ওর বর্তমান অবস্থাটা। তাই দিল্লী থেকে ছুটে চলে এসেছে। দুর্নিবার জানত কলিঙ্গ ফ্ল্যাটের টাকা সহজে পরিশোধ করতে পারবে না।
তাই আর দেরী করেনি। নিজের ফার্মেই ওকে কাজ দিয়েছে। আর ফ্ল্যাটটাও অনেক অনেক অনেক কম দামে দিয়ে দিয়েছে।
একেবারে ফ্রীতে দিতে পারত। দেয়নি। দিলে অবন্তি , নিজের ভালবাসা , কলিঙ্গকে ছোট করা হয়। তাই যৎসামান্য কিছুতে বিক্রি করেছে।
বাকিটা উপহার। একটা দামী গিফ্ট দিতে পারেনি। সেদিন দিল।
অবন্তির কিছু করার নেই। চোখের জলে অহংকার আগুণ কিছুটা নিভল।
=========০০০=========
কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক)
85, Kalibari Road, Nalta
Near Air Port Auto Stand
PO: Italgachha
Kolkata -28
North 24 Parganas
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন