মানুষই পারবে মানবতার অসুখ সারাতে
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
জীবন,
যাপন, জীবিকা- আজ সময়ের আঘাতে সবটাই টালমাটাল। তবু সকল বিঘ্নকে ভ্রুকুটি
শানিয়ে, জীবন আবার বহমান হতে সচেষ্ট অনন্ত জীবনে, অমৃতের সন্ধানে। গত প্রায়
দুই বছর ধরে যেন আমরা নিজেদের সাথে লুকোচুরি খেলছি। রামায়ণের মেঘনাদ যেমন
আড়াল থেকে যুদ্ধে অংশ নিত, এও অনেকটা একই রকম। কোনোভাবে গোষ্ঠী সংক্রমণ
রুখতে লকডাউন করতে গিয়েই মানুষ আজ মানুষের থেকে দুরে সরে যাচ্ছে । একেকটা
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো । যোগাযোগ হয়ে উঠছে প্রযুক্তি-নির্ভর । শিশুদের মন
খারাপের শেষ নেই। মনে সীমাহীন সংশয়। এসবের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেটা হলো মানুষের মন ও মনন। রোজ এক ভয়, বন্ধু-বান্ধব,
স্বজনদের সাথে দেখা না হওয়া, ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদী ভয়ে পরিণত হচ্ছে । আর এ
থেকে জন্মাচ্ছে হতাশা, নেগেটিভ মানসিকতা, ডিপ্রেসন। ক্রমশ হতাশা গ্রাস
করছে জীবনের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে।
সম্প্রতি
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৫ বছর ধরে চলা একটা গবেষণার কথা এখানে
প্রাসঙ্গিক। বিভিন্ন বয়সের অনেকের কাছে সুখের সংজ্ঞা জানতে চাওয়া হয় ।
গবেষণা শেষে দেখা যায়, হ্যাপিনেস হচ্ছে Genuine human relationship,
সত্যিকারের মানবিক সম্পর্ক। সত্যিকারের সম্পর্ক যখন কারো সাথে থাকে, সেই
ব্যক্তি বিত্তবান হোক না হোক, আমরা তার সাথে সুখী হই। স্বামী-স্ত্রীর
মধ্যে কেউ হয়তো সারা পৃথিবীর কাছে ভালো, কিন্তু নিজে শান্তি পান না। কারন
তার জীবনসাথীর সাথে দু'দন্ড মনের কথা বলতে পারেন না । নিজেকে তিনি আর
অনুপ্রাণিত করতে পারেন না । এই জেনুইন সম্পর্ক থাকা দরকার আমাদের একের
সাথে অন্যের , প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের। করোনা-পরবর্তী এই সময়ে আমরা এই
সম্পর্কের অভাবে ও নিরাপত্তাহীনতার অসুখে আক্রান্ত।মানবাধিকার নিয়ে আমরা
সরব হই, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করি, সভা সমাবেশ আয়োজন করি, আবার সেই
অধিকারকেই ভুলুন্ঠিত করতে পিছপা হইনা। জন্মগত ভাবেই মানুষ স্বার্থপর। আর
আজকের এই বিপদ সংকুল মুহূর্তে সে আরো আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে । আমরা
মানবিক হওয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছি । ধর্মীয় কূপমন্ডুকতা বিবেককে কুঁড়ে
কুঁড়ে খাচ্ছে । আবার কখনো দেখি মানুষকে মানুষেরই এই অসুখে পাশে দাঁড়াতে ।
ত্রাণ বিতরণ করতে, ওষুধ তুলে দিতে । আবার এরই মধ্যে দেখি বেনোজল কিছু কম
নেই। ছবি ছাপিয়ে ব্যাক্তিগত ইমেজ তৈরি ও প্রতিষ্ঠা লাভের বাসনা , বিবেকের
টুঁটি চেপে ধরে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অধরাই রয়ে যায়। মানবিক
সম্পর্ক সুনিশ্চিত করাই যেখানে মানবিক ধর্ম, সেখানে এর লঙ্ঘনই হলো অসুখ।
মানুষের
জন্য ধর্ম, মানুষের জন্যই রাজনীতি। তাই যেখানে মানুষের উপরে ধর্ম ও
রাজনীতি গুরুত্ব পায় আ'র মনুষ্যত্ব লঙ্ঘিত হয়, সেখানেই তো মানবতার অসুখ।
যখন
রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রাণ নিমেষেই চলে যায়, তখন এ
অসুখ রাষ্ট্রের, রাষ্ট্র ব্যবস্থার; বকলমে আমার আপনার সকলের। মুখে খাবার
তুলে দিতে না পেরে সপরিবারে আত্মঘাতী হবার পাপবোধের শরিক হয়ে ওঠার অসুখও
আমাদের সকলের। যারা দিন-রাত পাত করে শহর নগর সড়ক সেতু ইমারত গড়ে তুলেছে,
তাদের ঘাম,রক্ত ও শ্রমের মূল্য দিতে না পারাটা আমাদের তথা গোটা সমাজের
অসুখ। এই অতিমারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের যে ব্যর্থতার চিত্র তুলে
ধরেছে বারংবার।
জীবন
ও জীবিকার সংকট যখন সামনে এসে দাঁড়ায় , তখন সংক্রমণের ভয়কে অগ্রাহ্য করে
বাইরে বেরিয়ে আসাটাও আজ সামাজিক অসুখ, কারন আমরা মানুষের ন্যুনতম চাহিদাটাও
এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও সুনিশ্চিত করতে পারিনি । এই ব্যর্থতার দায়
আমাদের, আমাদের রাষ্ট্রব্যাবস্থার , আমাদের সমাজের। আবার এরই মাঝে রুপোলি
ঝিলিক দেখি নবপ্রজন্মের মধ্যে। আমরা আবার আশায় বুক বাঁধি। একদিন সব ঝড়
থেমে যাবে, নতুন প্রভাত আসবে নতুন সূর্যের হাত ধরে।
...................................
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
কোচবিহার
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন