Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। একই সূত্রে ।। রণেশ রায়

 

একই সূত্রে 

রণেশ রায়

শহরের উপকণ্ঠে একটা ছিমছাম পল্লী। তারই একপ্রান্তে একটা ছোট অর্ধ সমাপ্ত বাড়ি। বাড়িটাতে অভাবের ক্লেদ যেমন চোখে পড়ে না তেমনি প্রাচুর্যের আতিশয্য নেই। এ বাড়িতে গত প্রায় পনেরো বছর ধরে থাকেন এক মহিলা তাঁর চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে। মহিলার বয়েস যা অনুমান করতে পারি আর ছেলের বয়সের হিসেব থেকে বলা যায় মহিলা একটু দেরীতে বিয়ে করেছেন বোধ হয়। অবশ্য ধরে নিই যে ওনার এই একই ছেলে। আর সেটা প্রতিবেশীদের ধরে নেওয়ার কারণ আছে বৈকি। কারণ গত পনের বছরে এ বাড়িতে এমন কাউকে আসতে দেখা যায় নি যাকে দেখলে তাঁর বড় ছেলে বা বড় মেয়ে বলে মনে হতে পারে। এসব অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে ওনার বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ বছর। আরেকটা বিষয় হল যে এ বাড়ীতে এমন কোন প্রবীণ পুরুষ দেখা যায় নি যাকে ওঁর স্বামী বলে মনে হতে পারে। তবে পাড়ার অনুসন্ধিৎসু অনেকের মতে ওনার স্বামী ওনাকে ছেড়ে গেছেন । ছেড়ে গেছেন বললে ভুল হবে। ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ওদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকলেই সমালোচকদের ওনার সম্পর্কে অনুমানগুলো সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ভেবে তারা তৃপ্তি পান। সম্ভবনা নয় কেউ কেউ নিশ্চিত যে ওনাদের বিবাহ বিচ্ছেদই হয়েছে। এনারা কারণটাও জানেন। সেটা রসিয়ে কষিয়ে আড্ডায় বলেন। ঊষাদেবীর স্বামী নাকি খুব বেচারা মানুষ। নেহাতই ভালোমানুষ। আর ঊষাদেবী দাম্ভিক, অহংকারে পা পড়ে না। স্বামী এত ভালোমানুষ হলে কি চলে? পৌরুষ কোথায়? তাই মানানো চলে না। বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অন্তত ঊষাদেবীর তরফ থেকে।ওদের মতে আজ এর জন্য ঊষাদেবীকে ভুগতে হচ্ছে। এত ভালো রোজগেরে দেবতুল্য মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার ফল। বিচ্ছেদের গল্পে তাদের আলোচনার বিষয় বেশি প্রাণ পায় বলে তাদের ধারণা।এক এক জনের মুখে এক এক গল্প। আবার কেউ কেউ বলেন উনি মারা গেছেন। তবে হলপ করে কেউ কিছু বলতে পারেন না। নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে রঙ্গ রসিকতা করলেও কেউ কোনদিন সামনাসামনি ওনাকে জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পায় নি। কারণ মহিলা পাড়ায় বেশি মেশেন না। যেন একটু এড়িয়ে চলেন। দুচারজন যাদের সঙ্গে ওঁর আলাপ আছে, পথে দোকানে বাজারে দেখা হয়, দুচার কথা হয় তারাও কিন্তু ওনাকে কেন জানি না এসব কথা জিজ্ঞাসা করেন না। বা করতে ভরসা পান না। অবশ্য আমি যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয় ঊষাদেবীর চেহারায় এমন একটা ব্যক্তিত্ব বা বিশেষ কিছু আছে যা তাঁকে অন্যেদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। সব মিলিয়ে যেন একটা রহস্য না হোক অস্বাভিকতা জড়িয়ে আছে। পাড়ার সবাই এ নিয়ে তেমন মাথা না ঘামালেও কৌতূহলী মানুষের তো বঙ্গ সমাজে অভাব নেই। তাই অনেকের কাছে কবির 'সাল বনের এই দুরত্ব' একটা আলোচনার বিষয় তো নিশ্চয়। তবে সবার কাছে যেটা বিশেষ ভাবে কৌতূহলের সেটা হল বাড়িতে বসে ঊষাদেবী নিয়মিত গানের রেওয়াজ করেন। ছেলে সঙ্গে সঙ্গত করে। আর এটা তিনি খুব নিষ্ঠাভরেই করেন।বাড়ীর পাশ দিয়ে গেলে তাঁর গানের গলায় আকৃষ্ট হতেই হয়। তিনি সন্ধ্যার দিকে নিয়ম করে বের হন। সঙ্গে প্রায়ই ছেলে থাকে। আবার ছেলেকে নিয়ে ফেরেন। আমরা অনেকেই ভাবি ছেলেকে হয় তো পড়াতে নিয়ে যান। কিন্তু ওই যে কৌতূহলী মানুষেরা! তারা রোজই উনি কোথায় যান তা নিয়ে নিত্য নতুন গবেষণার ফল প্রকাশ করেন ঠিক আজের কভিড ১৯ এর ভ্যাকসিন এর মত। তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। তবে এই অনুসন্ধানে যে ফলরসের উদ্ভব হয় তাতে নেশার উপাদান আছে অস্বীকার করা যায় না। আড্ডায় সে 'সোম' রসের নেশা থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না।

মায়ের পরিচয় পেলেন। এবার ছেলের পরিচয় না পেলে ওই দুজনের খুদে সংসারের সামগ্রিক পরিচয়টা পাওয়া যায় না। দুজনে যে দুজনের পরিপূরক। ছেলেটি ছিমছিমে রোগা লম্বা। চোখ মুখে একটা উজ্জ্বলতা ধরা পড়ে। চোখের ইশারায় যেন নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলে। চোখে অজস্র প্রশ্ন জড়িত কোনোটারই যেন ও উত্তর পায় না। এমনিতে মিশুকে হলেও ঘরে মায়ের সাথে সময় কাটে। ক্লাস টেনে পড়ে অর্থাৎ সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। তবে তা নিয়ে খুব একটা দুর্ভাবনা আছে তা মনে হয় না। বন্ধু বান্ধব ইতস্তত থাকলেও তারা খুব একটা বাড়ি আসে না। পাড়ার ক্লাবে মধ্যে মধ্যে টেবিল টেনিস খেলতে যায়। বন্ধুবান্ধব যারা আছে তারাও ছেলেটির বাবা বা তাদের আত্মীয় স্বজন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না। ছেলেটি এ ব্যাপারে যেন উদাসীন। মায়ের সঙ্গেই তার জীবন। তবে ওর এক মেয়ে বন্ধুকে মাঝে মাঝে বাড়ি আসতে দেখা যায়। মেয়েটি অতি সাধারণ দেখতে। বোঝা যায় দুজন দুজনের খুব বন্ধু। ঊষা দেবী অর্থাৎ ছেলেটির মা ওকে খুব ভালোবাসে।ওদের বন্ধুত্বকে যেন একটু বেশি মদত করে যেটা আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে খুব স্বাভাবিক নয়। এ নিয়েও পাড়ায় কৌতূহলিদের মধ্যে কানাকানি শ্লেষা শ্লেষি।

ঘটনাচক্রে আমার সঙ্গে পরবর্তী কালে পরিবারটির ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে । আমি আঞ্চলিক একটা বিদ্যালয়ে মাস্টারি করতাম বলে এলাকায় বুড়ো বাচ্চা সবারই পরিচিত। আর প্রায় চল্লিশ বছর ধরে পাড়ার চায়ের দোকানে আমাদের একটা আড্ডা আছে। একদিন দেখি ছেলেটি পাড়ার কিছু আড্ডাবাজ ছেলের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েছে। ওকে ছেলেগুলো টিটকিরি মারছে উত্তেজিত করছে। ওকে সাধারণত মাথা তুলে জোরে কথা বলতে দেখা যায় না। আজ সে ব্যতিক্রমটা দেখি। ব্যাপারটা এতদূর এগোয় যে ওকে এবার মারধর খেতে না হয়! আমি এগিয়ে যাই। ছেলেগুলোকে নিরস্ত করি। আর ব্যাপারটা বাড়ে না। জানতে পারি ছেলেটি ও তার মায়ের ব্যাপারে  ছেলেগুলো  কিছু প্রশ্ন করে যেগুলো ওদের অধিকার বহির্ভূত বলে ছেলেটি মনে করে আর সেটা ওদের মুখের ওপর বলে। তাই নিয়ে বিবাদ। ছেলেটির সাথে কথা বলে মনে হলো ওর আত্মসম্মান বোধ তীব্র। সেখানে আঘাত লাগলে ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, ভয় পায় না। এটা আমার ভালো লাগে। ওকে নিয়ে আমি ওর বাড়ির দিকে এগোই। বাড়ির সামনে এসে ও আমাকে প্রায় জোর করে বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। আমিও নিজের মধ্যে চাপা ঔৎসুক্যটার বশবর্তী হয়ে আলাপে একটু বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। আলাপের মাধ্যমে যদি পরিবারের রহস্য  কিছু থেকে থাকে সেটা যদি ভেদ করতে পারি। আর আমাদের সবার জীবনের অন্দরে রহস্য ভেদের জন্য একজন ফেলুদা আছে সেটা তো অস্বীকার করতে পারি না। ওর মায়ের সাথে কথায় কথায় জানি ছেলেটিকে পড়াবার জন্য ওরা একজন ইংরেজি শিক্ষক খুঁজছে। ঘটনা চক্রে ওটা আমার বিষয়। তাই স্বেচ্ছায় সেই দায়িত্ব নিই। তবে আমার তাগিদটা শিক্ষক হিসেবে যতটা তার থেকে গোয়েন্দা হিসেবে বেশি।

আমি খুব অল্পদিনের মধ্যে নিজের অজান্তেই যেন রন্টুদের পরিবারের একজন হয়ে পড়ি। বলা হয়নি ছেলেটির নাম রন্টু। আমাকে এখন মামা বলে ডাকে। আমার যেমন এ বাড়িতে অবাধ প্রবেশ ওরাও আমার বাড়ি যায়। ঊষা দেবী আমার স্ত্রীর বান্ধবী হয়ে উঠেছেন। আগে যেমন ওনাকে কোন এক ধোঁয়ার আড়ালে দেখতাম এখন সেটা অনেকটা দূর হয়ে গেছে। সূর্যের আলোক রশ্মি ওনার চোখে মুখে দেখি। ওনারা যেখানে যান আমাকে নিয়ে যান। এমন কি বিকেলের সেই রহস্যের অন্তরালে। আমার কাছেও যেন ফুলের প্রস্ফুটন। একটা একটা করে পাপড়ি খোলে। তবে ঊষাদেবীর স্বামীর অন্তরীণ হওয়ার রহস্য এখনও আমার অজানা। অবশ্য নিশ্চিত হয়েছি যে উনি বেঁচে আছেন। তবে কোথায় কেন জানি না। ঊষাদেবী একটা কঠিন রোগে আক্রান্ত। বোধ হয় সেইজন্য নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখেন। আর নিজেকে দূরে রেখে স্বামীকেও যেন অন্তরীণ রাখতে সাহায্য করেন।

কোন কোন দিন যেমন ওদের সঙ্গে যাই তেমনি সেদিনও গেছি। একটা গানের আসর। আসর বসিয়েছেন কিছু গণ্য মান্য ব্যক্তি। বলা চলে এক মজলিস। বোঝা যায় যে এ ধরণের মজলিসে ঊষাদেবীকে আসতে হয় তার জীবিকার জন্য। যারা পাড়ায় এ ধরণের একটা সন্দেহ প্রকাশ করেন সেই ফেলুদারা আমার আগেই রহস্য ভেদ করেছেন সন্দেহ নেই। সেখানে ঊষাদেবী গায়িকা। আজ তাঁর সঙ্গে তবলা সঙ্গত করবে তার ছেলে। যে নিয়মিত তবলায় সঙ্গত করে সে আজ আসতে পারবে না। ছেলের বান্ধবীও আজ সঙ্গে এসেছে।

মজলিস শুরু হয়েছে। আজ ঊষাদেবীর শরীর ভালো নেই। তাও পেটের তাগিদে আসতে হয়। গান ধরেছেন ঊষাদেবী। উপস্থিত অতিথিরা গুছিয়ে মেজাজে বসেছেন। ঊষাদেবীর গলা তাদের আমেজটা ফিরিয়ে আনে। একটা মাদকতার পরিবেশ তৈরি হয়। ছেলে সুন্দর সঙ্গত করছেন। সঙ্গে একটা বাদ্য যন্ত্র। মধ্যে মধ্যে মায়ের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। সে এই সংগীতের পরিবেশে অভ্যস্ত বোঝা যাচ্ছে। শ্রোতাদের মধ্যে কয়েকজন মদ মাতাল আছে যারা উচ্ছসিত প্রশংসায় আসর জমিয়ে তুলছে। দু তিনটে গান হয়েছে। আসর এখনও সে উচ্চতায় উঠতে বাকি। শ্রোতাদের পয়সা ছোড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন উচ্চে আসর উঠবে। হঠাৎ ঊষাদেবীর কাশি ওঠে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারেন না। পুরোণ রোগটার আক্রমণ। গলা স্তব্ধ হয়ে আসে। ছেলেও বোঝে। বাজনা ছেড়ে মাকে এসে ধরে তোলে। ঊষা দেবী উঠতে থাকেন। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন। সংগঠক বিড়ম্বনায় পড়েন। তিনি এসে ঊষাদেবীকে মনের জোর দেন, আবার গানে বসতে বলেন। ছেলে আমাকে মঞ্চ থেকে ইশারা করায় আমি আর বান্ধবী মেয়েটি এগিয়ে যাই। ঊষাদেবীকে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে মাইক্রোফোন নিয়ে গান শুরু করে মা যেখানে শেষ করেন সেখান থেকে। প্রথমে বিরক্ত হলেও এই অল্প বয়স্ক ছেলের গান আর তার সঙ্গে নাচ মাদকতার পরিবেশটা ফিরিয়ে আনে। ঊষাদেবী আমাদের সঙ্গে এসে বসেন। উনার পাশে এক ভদ্রলোক শ্রোতা। ঊষাদেবীকে জল খাইয়ে একটু সুস্থ হতে সাহায্য করেন। ছেলের গান জমে ওঠে । মায়ের জায়গা পূরণ হয়। আবার মেতে ওঠেন শ্রোতারা। বৃষ্টির মত পয়সা পড়তে থাকে। সংগঠক ভদ্রলোক সেগুলো কুড়িয়ে তোলে। তাই দেখে ছেলে বিরক্ত হয়। গানের মাঝে সেও পয়সা কিছু কুড়িয়ে নেয়। এভাবে চলতে চলতে অনুষ্ঠান শেষ হয়। উঠে জায়গায় ফিরতেই সংগঠক ভদ্রলোক এসে রন্টুর কুড়িয়ে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে বলেন। তার মজুরি যেটা প্রাপ্য সেটা সে পাবে বলে আশ্বস্ত করেন। রন্টু মানে না। সে বলে ওই টাকা মায়ের আর তার শ্রমের পয়সা সেটা তাদের প্রাপ্য। সংগঠক হিসেবে ওনার যা প্রাপ্য সেটা ওরা ওনাকে দেবে। ঊষাদেবী ছেলেকে টাকা দিয়ে দিতে বলেন। ছেলে সেটা না দিয়ে দৌড়ে ওখান থেকে পালায়। ঊষাদেবী সংগঠককে বলেন উনি টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন। সংগঠক সেই প্রতিশ্রুতিতে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। আমি এতক্ষন খেয়াল করি নি। যে ভদ্রলোক ঊষাদেবীর শুশ্রূষা করছিলেন উনি তখনও দাঁড়িয়ে। ঊষাদেবী আমার সঙ্গে উনার পরিচয় করিয়ে দেন স্বামী বলে। এতক্ষন আমি উনার দিকে তাকাই নি। এবার তাকালাম। দেখি আরে এ তো আমার সেই কলেজের বন্ধু। শুনেছি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দেয়। পুলিশ ওকে খুঁজে পায় নি। ও আমাকে চিনতে পারে। দুজনেই আবেগ তাড়িত হলেও সংযত থাকি। বুঝি এটা আবেগ প্রকাশের জায়গা নয়। এটা ঊষাদেবীর যেমন জীবিকার জায়গা তেমনি গোপনে স্বামীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ। একটু এদিক ওদিক হলে বিপত্তি। উনি বেরিয়ে যান। আমরাও বাড়ির দিকে এগোই। আমি বুঝি এ লড়াইটা ওদের তিনজনের, গোটা পরিবারের। পরিবারে কেউ হারিয়ে যায় নি। একই সূত্রে বাঁধা।

বেরিয়ে এসে দেখি রন্টু দাঁড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি ওর অধিকারের লড়াইটা যে সমর্থন করি তা ও বোঝে। ও এসে মায়ের দায়িত্ব নেয়। সবাই মিলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা ফিরে আসি। ওদের বাড়িতে নামিয়ে আমি নিজের বাড়িতে। আমার অতীতও যেন আমার সঙ্গে ফিরে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ার সময় সুহাস বিপ্লবী দলে ঢুকে যায়। আমিও ওদের সমর্থক ফেউ হয়ে ওদের সাথে ঘুরতাম। ওরা তখন ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনের কথা বলত। বিশ্বাস করত যে ভারত প্রকৃত স্বাধীনতা পায় নি। আর দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধের সঙ্গে সমাজতন্ত্র গঠনের লড়াই এর সংহতি সাধন করা দরকার বলে মনে করত। তাই ওরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিল। সুহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হওয়ার আগেই সব ছেড়ে চলে যায়। আমি মধ্যে মধ্যে ইতস্তত খবর পেলেও সব খবর পেতাম না। শুনেছিলাম বিয়ে করেছে।

স্ত্রী খাওয়ার তাগিদ দেয়। কিন্তু আমি যেন আমার অতীতের সঙ্গে মোকাবিলা করছি। নানা ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছি। যেন কোন অঙ্ক মেলাতে আমি মশগুল। খাবার ইচ্ছে নেই। স্ত্রীকে পাশে বসাই। ওকে সব বলি। ও সুহাসকে না চিনলেও আমার কাছে ওর কথা শুনেছে। আর তখনকার বিপ্লবী রাজনীতির কথা ও জানে। দূর থেকে সুহাসের ওপর একটা শ্রদ্ধা ওর মনে। বোধ হয় আমাদের সমাজে সব মেয়েদের ক্ষত্রেই এটা সত্যি। ওদের মুক্তির ইচ্ছের মধ্যে ওরা বোধ হয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বিপ্লবীদের খুঁজে পায়। ওকে সব বলে আমিও কিছুটা হালকা হই। তারপর খেতে যাই। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ি। 

শুয়ে শুয়ে ভাবি ঊষাদেবীর ছেলেকে নিয়ে বর্তমান এই কঠিন জীবন। পর্দার আড়ালে থেকে এক আত্মবলিদান। আর্থিক অনটন তার ওপর এই অসুস্থতা। ছেলেকে এক হাতে বড় করা। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। স্রোতে গা ভাসানো নেই। আছে খালি অধীর প্রতীক্ষা। আর প্রত্যয়। অথচ এই মহিলাকে নিয়ে কত অকথা কুকথা। যারা সুহাসকে চেনে না তারা এই মহিলাকে নিচে নামাবার জন্য সুহাসকে বেচারি বানায়।প্রচুর রোজগেরে বলে প্রচার করে। অথচ সুহাস ছিল ডান পিটে। শিক্ষকদের সঙ্গেও তর্ক করত। রোজগার কোনদিন করেছে বলে জানি না। সব ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপ্লবের কাজে। একেবারেই বেচারি নয়। আসলে আমাদের মধ্যে জন্মের পর থেকে যে নারী বিদ্বেষ গড়ে ওঠে এই সমাজে তাই কালক্রমে বিষবৃক্ষ হয়ে এই ফলই ফলায়। সেটাই পুরুষ প্রধান সমাজের নিয়ম। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি।

পরের দিন ঘুম থেকে উঠে আবার দৈনন্দিন জীবন। আমি অনেক দিন হল অবসরজীবী। সকাল বিকেল আড্ডা আর পড়ানো যখন যেমন থাকে। যতটা বাড়ির কাজ না করলে চলে না ততটুকু করা। বাকিটা স্ত্রী করে। এর সঙ্গে রন্টুকে পড়াতে যাওয়া। অন্য ছাত্ররা আমার বাড়িতে এসে পড়লেও রন্টুকে আমি পড়াতে যাই। কেন সেটা আগেই বলেছি। গোয়েন্দা গিরির জন্য। সেটা আর সেদিনের পর থেকে দরকার নেই তাও আমি যাই। বলতে দ্বিধা নেই এখন যাই ঊষার আকর্ষণে। ওরা যেন আত্মীয় সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। এখন রন্টুকে পড়ানোর আগে পরে ঊষার সঙ্গেও কথা হয়। 

ঊষাদেবী বাড়ি এসে বিছানা নেয়।  পুরনো রোগটা ভালোই মাথা চাড়া দেয়। এরই মধ্যে গেলে পরে ওনার সঙ্গে দেখা হয়। আমি যতটা সম্ভব উনার খবরাখবর নিই। একদিন আমি পড়াতে গেছি। রন্টু বাড়ি নেই। ঊষার সঙ্গে কথা শুরু হয়। এটা ওটা কথার পর সুহাসের কথা ওঠে। ওরা নিজেরা বিয়ে করেছে জানায় ঊষা। তাও যেন অনেক কিছু অবলা রয়ে যায়। আমি বলি ঊষাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। তবে  কার  সঙ্গে ওর মিল পাই। ঊষা হেসে ওঠে। ওকে আমি এই প্রথম মন খুলে হাসতে দেখলাম। মনে হল ও যেন নিজেকে মেলে দিতে চায়। এ যেন খাঁচায় বন্দি এক পাখি খাঁচার বাইরে ডানা মেলেছে। ও আমাকে বলে, " আমি আগেই আপনাকে চিনেছি। কিন্তু তাও অচেনাই রয়ে গেছি। জানান দিই নি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে দিন কতক দেখা হয়েছে। প্রায় চল্লিশ বছর আগে। আপনি একই রকম আছেন বদলান নি। বয়স হলেও চিনতে অসুবিধে হয় না"।

"তবে তুমিই কাজল!" আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে।

আমার শুধু সুহাসের কথা মনে পড়ে। আর ওকে জড়িয়ে সেই মেয়েটির কথা যাকে আমি দুচারবার দেখেছি। আবছা যে চেহারাটা প্রায় চল্লিশ বছর আগের ওই মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দেয় তার সঙ্গে ঊষাদেবীর চেহারার যে খুব মিল পাচ্ছি তা না। ও পরিচয় দেবার পর আজকে সব মিলিয়ে একটা মিল পাই। আমার স্মৃতিতে আবছা হলেও ফিরে আসে কাজল।

তখন  মেয়েটি সুহাসদের বিপ্লবী কাজকর্মে যোগাযোগের বাহন ছিল। তবে আমার চেনার সুযোগ খুব হয় নি। আপাত শান্ত ওই মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী ছিল। খুব ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করত। সুহাস ওর খুব গুণগ্রাহী ছিল। আমি অবশ্য এর বেশি কিছু জানতাম না। কৌতূহলী হওয়াটাও আমাদের কারও নিষেধ না থাকা সত্ত্বেও বারণ ছিল। আত্মনির্ধারিত বারণ।আজ জানলাম ওই মেয়েটিই আজকের ঊষাদেবী।


 ৩

ঊষাদেবী বেশ কিছুদিন ভোগেন। রন্টুর বান্ধবী উনার সেবা যত্ন করে। দরকারে এ বাড়িতে থেকে যায়। ওর বাবা মা প্রায়ই আসেন। মেয়েটির বাবা সুহাস বাবুর বন্ধু ওই পরিবারের হিতাকাঙ্খী। ঊষাদেবীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন । বাড়িতে থেকেই এই রোগের চিকিৎসা। যক্ষায় আক্রান্তদের চিকিৎসা হল খাওয়া দাওয়া আর নিয়মিত ওষুধ। মেয়েটি খুবই দক্ষতার সঙ্গে ঊষাদেবীর  দেখাশোনা করে। এই ব্যাপারটাও পাড়ার কৌতূহলী জনতার চোখ  এড়ায় না। তারা রন্টুর সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ককে কেন্দ্র করে নির্ভুল সহজ যোগের অঙ্ক কষেন। মুখে মুখেই একে একে দুইয়ের অংকের ফল ছড়িয়ে পড়ে। পরিবারের মধ্যে ভবিষ্যৎ পরিবারের অঙ্কুর এনারা দেখতে পান। সেটা দুই অর্বাচীন পরিবারের আদিখ্যেতা বলে মনে করেন। এত অল্প বয়সে এই সম্পর্ক নিয়ে বাবামায়ের প্রশ্রয়কে আর যাই হোক অভিভাবক সুলভ নয় বলে মত দেয়। অবশ্য এতে ঊষাদেবীর কিছু আসে যায় না। আর মেয়ের বাবামাকেও আমি নির্বিকার দেখি। এরই মধ্যে মেয়ের বাবামায়ের সঙ্গে আমারও ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে সুহাসের সংগে আমার আর বিপিন মানে মেয়ের বাবার একআক্ষিক সম্পর্কের দৌলতে। দুজনেই সুহাস সম্পর্কে উদগ্রীব তাই দুজনের মধ্যে আলোচনার দরজা খোলাই থাকে। বিপিনবাবুর মেয়ের নাম রীতা। বিপিন বাবু একটা জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করেন। আর্থিক অবস্থা ভালো। কলকাতায় বালিগঞ্জে একটা এপার্টমেন্টে থাকেন। ওনারা আমার বাড়ি আসেন আমরাও ওনার বাড়ি যাই। আমাদের সম্পর্কের সূত্র ধরে আমার মেয়ের সাথে রন্টু ও রীতারও ভাব হয়। তবে ওদের দুজনের সম্পর্ককে আমার মেয়ে ও তার মা সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। এ ব্যাপারে আমারও যে রক্ষণশীলতা কাজ করে না তা নয়। তবে আমি মানিয়ে চলি। সম্পর্কটাকে স্বাভাবিকভাবে দেখার চেষ্টা করি।

মাস ছয় ভোগার পর ঊষাদেবী ভালো হয়ে উঠেছেন। আগের জীবনের ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন। এদিকে ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেছে। সেই নিয়ে উনি ব্যস্ত। জীবিকার প্রয়োজনে গানটা ধরে রাখতে হয়েছে। আমি রন্টুর পড়াশুনার দেখভাল করি। ছেলেটি পড়াশুনায় খারাপ নয়। তবে খুব ভালো নম্বর পাবার জন্য যথেষ্ট নয়। নম্বর পাবার কৌশলটা সেরকম রপ্ত করে নি।সেই অর্থে ভালো ছাত্রের দলে পড়ে না। তবে পাঠ্য বইয়ের বাইরে অনেক বই পড়ে। বিশেষ করে গল্পের বই। এটা বোধ হয় বাবা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। আমার কাজ এই ক'মাসে ভালো নম্বর পাবার কায়দাটা যতটা পারা যায় শিখিয়ে দেওয়া। আজকাল প্রশ্নের যা ধরণ বিশ্লেষণ পদ্ধতি নয় ওপর ওপর জানার প্রয়োজনটা বেশি। এক আধ কথায় বা টিক মেরে যা চাওয়া হয় তার জানান দেওয়া। নিজের জ্ঞান উজাড় করে দেওয়ার দরকার নেই।

আমার বিপিন বাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় ঊষাদেবী সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা হয়ে যায় যার কিছুই জানতাম না। বিপিনবাবু সুহাসের পাড়ার বন্ধু ছোটবেলা থেকে। বিপিনবাবু সুহাসবাবুর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে গভীরে কিছু না জানলেও ওঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন যেটা আবার আমি জানি না। সুহাসের বাড়ির সঙ্গে পাড়ার সূত্রে ওদের বাড়িরও যোগাযোগ। সুহাসের এক ভাইয়ের সাথে বিপিনের এখনও যোগাযোগ আছে। বোঝা যায় সুহাসের প্রতি ওর একটা শ্রদ্ধা আছে আর তাকে কেন্দ্র করে আকর্ষণ। আর ঊষাদেবী নিজের গুনেই ওদের খুব কাছের মানুষ। সুহাস ঊষাদেবীর বিয়ে থেকে পরবর্তীকালের অনেক খবরই বিপিনবাবু আর বিপিনবাবুর স্ত্রী মিনাদেবী রাখেন। উনাদের কাছ থেকেই জানতে পারি ওদের বিয়ের খবর। বিয়ের পর ঊষাদেবীর গ্রামের স্কুলে পড়াবার খবর। ওখানে স্কুলে চাকরিটা চলে যাওয়ার পর ঊষাদেবী এখনকার বর্তমান বাসস্থানে ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন। 

বিপিনবাবুর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ছোট সংসার। মা ও মেয়ের জীবন খুবই সাধারণ ছিম ছাম। সেই তুলনায় বিপিনবাবু একটু সৌখিন মনে হয়। তবে সংস্কার মুক্ত খোলা মনের মানুষ। চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল স্ত্রীকে উনি অত্যন্ত সন্মান করেন। মেয়ে বাবা পাগল। পড়াশুনায় মোটামুটি। একটু আবেগপ্রবণ। ভালো কবিতা গল্প লেখে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়লেও বাংলায় আসক্তি। বাংলায় সাহিত্য চর্চ্চা। রন্টুর প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ। যেন এক অধিকার বোধ। রন্টু যেন একান্তই ওর এমন একটা ভাব। অথচ দুজনে সব সময় যে গায়ে গায়ে তা নয়। এক এক সময় দুজনের মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে তর্ক এমন কি হাতাহাতিও হয়। রীতা যেন রন্টুর অভিভাবক বিপিনবাবু আর তাঁর স্ত্রী সেটা যেন উপভোগ করেন। আর দুজনেরই ঊষাদেবীর ওপর অগাধ আস্থা।

আমার এখন জীবন ঊষাদেবী আর বিপিনবাবুর সন্নিধ্যেই কাটে। স্ত্রীও সঙ্গে থাকে। তিনটে পরিবারকে নিয়ে যেন একটা ত্রিভুজ। আর এই ত্রিভুজের অতিভূজ যেন সুহাস-ঊষাদেবীর পরিবার। সুহাসের অনুপস্থিতিই অতিভুজের বাহুর বাড়তিটুকু যোগ করেছে। সুহাসের প্রতি আমাদের আকর্ষণই তৃতীয় বাহুর বাড়তি অংশটুকু। এখন আর আমার পড়ানোর জীবন নেই। রন্টুর পরীক্ষা হয়ে গেছে বছর দুই হয়ে গেল। এখন ও বারো ক্লাসে পড়ে আমার মেয়ের সাথেই। বিপিনের মেয়েও বিএ ক্লাসে পড়ছে। ও রন্টুর থেকে বড় বলে জানলাম। ও নিয়ে আর আজকাল  আমি ভাবি না। আমার স্ত্রী আর মেয়ে যদিও ওদের সম্পর্কটা মানতে চান না। ঊষাদেবীও আজ আমাদের মধ্যে একজন। আজকাল ওনার গানের প্রোগ্রাম তেমন থাকে না। আর্থিক টানাটানি চলছে।

দেখতে দেখতে আরও বছর তিনেক কেটে গেল। রন্টু বারো ক্লাস পাশ করে একটা ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়েছে। রীতা বাংলা নিয়ে এমএ পড়ে। লেখালেখিতে একটু পরিচিতি হয়েছে। ও এখন যেন রন্টুর অভিভাবক। রন্টু এর পর কি করবে না করবে সব ব্যাপারেই ওর কর্তৃত্ব। রন্টুর সঙ্গে সম্পর্কে যেন নতুন মোড় নিচ্ছে। কর্তৃত্বটা বাড়ছে কিন্তু বাহ্যিক আবেগটা কমছে। আজকাল রীতার এক সহপাঠীর সঙ্গে রীতাকে প্রায়ই দেখা যায়। রন্টুর সাথে ওর খুব ভাব। রন্টুরও ভয় ওর কাছ থেকে সাধন যদি রন্টুকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু রন্টু যে সাধনকে হিংসে করে তা নয়। বরং সাধনের সঙ্গে ইয়ার্কি মারে। রীতাকে নিয়ে খেপায়। আমি ঠিক বুঝি না। আমার বোঝার কথা নয়। আর বুঝেই বা কি করব। বিপিনবাবুরাই তো আছেন। এ ব্যাপারে উনাদের তেমন মাথা ব্যথা নেই। ঊষা দেবীও নির্লিপ্ত। আমার এখানে মাথা ঘামানোর দরকার কি। তাও আমার স্ত্রী মেয়ে মাথা ঘামায়। আমাকে প্রশ্নে জর্জরিত করে যার উত্তর আমার জানা নেই। এ আমার এক বিড়ম্বনা। তাই আমি আজকাল যথাসম্ভব ওদের এড়িয়ে বিপিনবাবুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখি।

আজকাল আমার বিপিনের ওখানে বেশি যাওয়া হয় না। শরীরটা খারাপ। আর একটু অলস হয়ে পড়েছি। বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করে না। তবে ঊষার বাড়ি যাই। সুহাসের খবর নিই। রন্টু মধ্যে মধ্যে আসে। ফোনে বিপিনের সঙ্গে কথা হয়। একদিন বিপিনের সঙ্গে কথা হলো ও আসবে। আমি সময় ঠিক করলাম। ওরা বিকেলে আসবে। রাতে খেয়ে যাবে। 

বিপিন দিনক্ষণ ঠিক রেখে এল। আমিও অপেক্ষায় ছিলাম । আজ অনেকদিন পর চুটিয়ে আড্ডা হবে। ঊষা আর রন্টুকেও রাতে খেতে বলেছি। আমি আর বিপিন বসার ঘরে বসেছি। ওরা শোবার ঘরে। বিপিনের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলার পর ও পকেট থেকে একটা নেমন্তন্ন পত্র বার করল। রীতার বিয়ে। জানতে পেরে আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। পাত্র কে? তবে কি রন্টুর সঙ্গে ছাড়া ছাড়ি হয়ে গেল। রন্টু হলে তো আমি এ বাড়ির থেকে জানতে পারতাম যদিও এ ব্যাপারে ঊষা কোনোদিন মুখ খোলে নি আমিও প্রশ্ন করি নি। আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারি নি। বিপিনকে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম। বিপিন জানাল সাধন পাত্র। তখন ওকে আমি বলেই বসি যে আমরা তো সবাই জানি রন্টু পাত্র। পাড়ার সবাই তাই জানে। বিপিন হো হো করে হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলে:

"সে কি তুমি জানো না! বাইরের কারো জানার কথা নয় অবশ্য। তবে আমি ভেবেছি যে ঊষা তোমাকে বলেছে। তুমি জান। তাই আমি বলি নি।"

আমি জানাই যে না এ ব্যাপারে আমিও কিছু জানতে চাই নি ঊষাও বলে নি। তবে ওদের মেলা মেশা দেখে সবাই আন্দাজ করেছি এই মাত্র। বিপিন তখন বলে,

" শোন তোমার সব জানা দরকার। পেছনের অনেক কিছু জানার আছে। ঊষা যখন স্কুলে পড়ায় তখন অন্তঃসত্তাকালীন সুহাসের সঙ্গে ধরা পড়ে। জেলে থাকাকালীন ওর মেয়ে হয়। রীতাই সে মেয়ে। ওই অবস্থায় খুব অসুবিধেতে পড়ে। সে মেয়েকে আমরা বড় করার দায়িত্ব নিই। বছর খানেক পরে ওরা ছাড়া পায়। ঊষার আর স্কুলের চাকরিটা থাকে না। কিছুদিন পরে ওদের ছেলে হয়।ওই রন্টু। আমরা আমাদের কাছে রেখেই রীতাকে বড় করি আর ঊষা ছেলেকে নিয়ে তোমাদের পাড়ায় ও বাড়িতে আশ্রয় নেয়। গানকে পুঁজি করে জীবন চালাতে থাকে। আর সুহাস তো যথারীতি অন্তরীণ। ও ওর কাজ করে যায়। রীতা একটু বড় হলে ব্যাপারটা জানতে পারে । আমিই ওকে জানাই। তখন থেকে ও ভাইকে আগলে রাখে। ঊষার ওখানে ওর দ্বিতীয় বাসস্থান। বাইরের লোকেদের কাছে অন্যরমম লাগে। এই নিয়ে আমি বা ঊষা কেউ মাথা ঘামাই না।" আমি স্তম্ভিত। ঊষাকে আরও ভালোভাবে চিনলাম। আর চিনলাম এই বিপিনকে।


রীতার বিয়ের পর অনেকদিন কেটে গেছে। রীতা এখন সাংবাদিকতার কাজ করে। সঙ্গে সাহিত্যচর্চা আছে। সাংবাদিকতার জগতে স্পষ্ট বক্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। তার সঙ্গে সে স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষ ও কিছু স্বার্থগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছে। আজের বাজারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেতে সরকারবিরোধী কথা বলতে স্পর্ধার দরকার হয়। সেটা নিজের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে। আর রাষ্ট্রের চোখে বাবা  যখন এক রাষ্ট্রবিরোধী তখন সেটা জানাজানি হলে ও ক্ষমতাগোষ্ঠীর সুনজরে থাকতে পারে না সেটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত জীবনে ওর একটা অঘটন ঘটে। সাধনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ। ওর শিশুসন্তানকে নিয়ে ও বাবা মানে বিপিনের সঙ্গে থাকে। ইতিমধ্যে ওর মা মারা যায় একটা কঠিন অসুখে। বিপিন এখন অনেকটাই মেয়ে নির্ভর। সর্বক্ষণের সঙ্গী নাতনী। এদিকে রন্টু এখন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। বিয়ে করেছে। গান নিয়েই আছে। গানই ওর জীবিকা। আজ এখানে কাল সেখানে গানের জন্য ডাক আসে। তাতে যা রোজগার চলে যায়। বাড়িতে একটা গানের স্কুলও চালায়। ঊষা আজকাল তার মা মারা যাওয়ার পর নাকি ভাইয়ের ওখানে গিয়ে নিয়মিত থাকে। পাড়ায় বেশি দেখা যায় না। আমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় নি। যা খবর পাই রন্টুর কাছ থেকে । রন্টু মাঝে মাঝে আসে। আমার মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে আমরা দুজন। বাইরে জগতের সঙ্গে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তবে বিপিনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ফোনেই বেশি কথা হয়। কখনও ও আসে। আমিও যাই। আমার আর বিপিনের মধ্যে এখনও অনুপস্থিত অন্তরিনে থাকা সুহাস। জেনেছি ও দীর্ঘদিন জেলবাসের পর এখন বাইরে। তবে মূল স্রোতে নয়। কানাঘুষোয় ওর সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়। বিপিন কিভাবে জেনেছে যে ও বাইরে কোন এক প্রদেশে জঙ্গল অঞ্চলে এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে। ও নাকি এক আদিবাসী মহিলাকে নিয়ে থাকে। বিয়ে করেছে কি না ঠিক জানা নেই। তবে কোনোটাই অসম্ভব নয়। আমাদের মত ছা পোষা মানুষের কাছে বিষয়টা অকাম্য হলেও এটা অসম্ভব কিছু না। জীবনের নিয়মে এটা ঘটে থাকে বিশেষ করে ব্যতিক্রমী মানুষের ক্ষেত্রে। তবে ঊষাদেবীর জন্য খারাপ লাগে। ও নিশ্চয় এটা ভালোভাবে নেয় নি। ওর সঙ্গে দেখা হয় না বিশেষ তাই এ ব্যাপারে ওর প্রতিক্রিয়া আন্দাজই শুধু করতে হয়। আর সেজন্যই বোধ হয় নিজের সংসার থেকে দূরে ভাইয়ের ওখানে থাকে। আর ভাই নাকি বিয়ে করেনি। দুজনের পক্ষেই তাই সেটাই বেশি সুবিধেজনক। যাই হোক জীবনে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয় তাই ঊষাও বোধ হয় মানিয়ে নিয়েছে।  আমাদের দিন চলে যাচ্ছে।  বিপিনেরও আমার মত অবস্থা। আমরা না ঘরকা না ঘাটকা। এর মধ্যে পৃথিবীতে নতুন এক দুর্যোগ। করোনা দুর্যোগ। সব কিছু থমকে গেছে। চিন্তা ভাবনা বাজার হাট একের সঙ্গে ওপরের যোগাযোগ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নতুন ধরনের জীবনের বিধান। সব কিছুই ওলট পালট। এর মধ্যে সচল কেবল এক ভীতি। হার হীম হওয়া ভয়। কি জানি কখন করোনা ধরে। আর এ নিয়ে নানা গবেষণা। আমাদের মত বয়স্ক লোকেরা আসতে আসতে একা সব কিছু থেকে দূরত্বে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। সময় সবই কেড়ে নেয়। নিচ্ছিলও। কিন্তু অল্প বয়স্কদের এ কি জীবন। বাচ্চাদের  মোবাইল কম্পিউটার হাতে শিক্ষা বন্ধুত্ব খেলাধুলো সব। ছেলেমেয়েদের অফিস বাজার সবেতেই অন লাইন। কতদিন চলবে জানা নেই। অনেকে বলেন এটাই নতুন সভ্যতা। ডিজিটাল সভ্যতা। মেনে নিতে হয়। কেউ একে বিজ্ঞান দিয়ে আবার কেউ ধর্ম দিয়ে বোঝে । আমাদের কাছে কোন ব্যাখ্যা নেই। ওই যে বললাম আমরা না ঘরকা না ঘাটকা। না পারি বিশ্বাস করতে না পারি অবিশ্বাস করে ছুড়ে ফেলে দিতে। অনিশ্চয়তার ভয়টা আমাদেরও গ্রাস করে। ঊষার অনেকদিন খবর নেই। মধ্যে মধ্যে ফোন করত।  সুহাসের শেষ খবর পাওয়ার পর ওর ওপর দুর্বলতা যেন বেড়ে গেছে। ওর কথা মনে হলেই কাজলের মুখটা ভেসে ওঠে। একটা সহানুভূতির ছোঁয়া যেন নিজের অজান্তেই ছুঁয়ে যায়। আজ সেটার তীব্রতা কেন যেন বেড়েছে। একটু বেলা হতে বেরিয়ে রন্টুর কাছে যাই। এটা ওটা কথার পর ঊষার কথা জিজ্ঞাসা করি। ও জানায় মায়ের শরীরটা ভালো না। তাই আসতে পারে না। ওই নাকি প্রায়ই যায়। মাকে আসতে বললেও আসতে চায় না। মামার ওখানেই থাকে। তবে চিন্তার নেই। তাও রন্টুকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখলাম। বোধ হয় মায়ের শরীর নিয়ে চিন্তা। আর ঊষার সাবেকি অসুখটা তো ভালো নয়। ওটা নিয়ে চিন্তা তো হবেই। তা ছাড়া ওর জীবনে যে ঝড় বয়ে গেল। শেষ জীবনে একটা ধাক্কা খেল। আর ধাক্কাটা আর কারও কাছ থেকে নয়, সুহাসের কাছ থেকে যার জন্য ও জীবনটাকে বলতে গেলে উৎসর্গ করেছে। জীবনে কিছু পায় নি। আশাও  করে নি। আমি মনে মনে ভাবি। 

দিনকতক পরে রীতার ফোন পাই। রীতা এবার ওর বাবার জন্মদিন পালন করবে। এখনকার ছেলেমেয়ের মধ্যে এই উৎসাহটা খুব দেখা যায়। আমরা কোনদিন ঘটা  করে জন্মদিন পালন হতে দেখি নি। আজ ছেলেমেয়েরা শুধু নিজের ছেলেমেয়ে নয় বাবা মায়ের জন্মদিন পালনেও উৎসাহী। ব্যাপারটা মন্দ লাগে না।  ছেলেমেয়েরা আজ বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য নিষ্ঠ নয় বলে  যে অভিযোগটা করা হয় তা সর্বতোভাবে সত্যি নয়।  আসলে কর্মজীবনের তাগিদে ওদের জীবনধারণে বদল এসেছে। কাজের স্বার্থে অন্য কোথাও থাকতে হয়। তাছাড়া আমাদের সঙ্গে ওদের আচার আচরণে পার্থক্য আছে।  আর আমাদের যে রক্ষণশীল জীবন তা সবটা ঠিক তা নয়।  তাই নানা কারণে একটা দূরত্ব এসেছে। এর জন্য আমরাও কিছুটা দায়ী।  যাই হোক রীতার নেমন্তন্নে মন ভরে ওঠে। আজ এই করনার বাজারে হোটেল রেষ্টুরেন্ট করা  যাবে না। বেশি লোকের সমাবেশ বারণ। তাই আমরা দুচারজন ওদের বাড়িতেই মিলব সেই শুভ জন্মদিনে, সেটাই ঠিক হয়। আমি আর স্ত্রী নিমন্ত্রিত। 

আমরা বিপিনবাবুর জন্মদিনে ওদের বাড়ি যাই। রাস্তাঘাটের যানবাহনের অবস্থা খারাপ ভেবে বিপিন তার ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সাধারণত  বিপিন গাড়ি বিশেষ ব্যবহার করে না। । গাড়ি থাকলেও খুব দরকার ছাড়া গাড়ি চড়ে  না। আর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ওর গাড়ির ব্যবহারটা কমে গেছে। এখন ওটা রীতাই বেশি ব্যবহার করে। মনে হয় রীতা  আমাদের অসুবিধের কথা ভেবে গাড়ির ব্যবস্থা করে। বিপিনের ঘরে ঢুকে দেখি বিপিন আর এক ভদ্রলোক বসে।  এই গোঁফওয়ালা ভদ্রলোককে আমি চিনি না।  অবাঙালি বলে মনে হল। বিপিন ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। বিপিনের মামাতো ভাই।  দিল্লিতে থাকে। ব্যবসা করে।  কথায় হিন্দি টান ।  বাঙালি হলেও বাঙালি বলে মনে হয় না। নানা বিষয়ে আলোচনা হতে থাকে। আর আজ আলোচনায় করনাই প্রাধান্য পায়। রোগটা কি কতটা সংক্রমক কতটা প্রাণঘাতি এসব মিশিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। দিল্লিতে সংক্রমণ বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে শুরু হলেও এখনও মারাত্মক রূপ ধারণ করে নি। তবে আতংকিত সবাই। এরই মধ্যে এ নিয়ে আতংক সৃষ্টি করা প্রচারের বাহুল্যতা এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। আলোচনার মধ্যে রীতা চা নিয়ে আসে।  চায়ের পর্ব শেষ হলে কেক কাটার আয়োজন। সবাই বেশ কৌতুক বোধ করি।  আমাদের জীবনে এটা তো কৌতুক বটেই। ছোটবেলায় জন্মদিনে মায়ের হাতে পায়েস খাওয়ার মধ্যেই মজাটা থাকত। বাকিটা আদিখ্যেতা বলে ভাবা হত। এর মধ্যে রীতা এসে বসে। ওর সাংবাদিকতা নিয়ে নানা কথা ওঠে।  ওর সংবাদে যে সংবাদ পরিবেশিত হয় তা নিয়ে ও যে অসুবিধের মধ্যে পরে তাও ও বলে।  বেশ কিছুদিন আগে একটা আদিবাসী অঞ্চলে পুলিশের সাথে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ব্যাপারটা ও তুলে ধরে। ওখানকার এক নেতার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়।  সেই নিয়ে রীতাকে কম ভুগতে হয় নি।  ওকে গ্রেপ্তার করার কথাও ওঠে।  এ নিয়ে বিপিন যথেষ্ট উদ্বেগে। এই আলোচনায় সুমিতবাবু অর্থাৎ নতুন পরিচিত ভদ্রলোকও যথেষ্ট উৎসাহের সঙ্গে অংশ গ্রহণ করে।  এরপর কেক কাটার পালা। উৎসাহের সঙ্গে সেটা পালন হয়। রীতার ছোট্ট মেয়ে কেক কেটে গান গেয়ে অনুষ্ঠানকে উৎসব মুখর করে তোলে।

কেক পর্ব শেষ হলে আবার আমরা গপ্পো করতে বসি। জানতাম না যে আমার জন্য এরকম একটা রহস্যের উপাদান সংগ্রহ করে রেখেছে বিপিন। আলোচনার মধ্যে হঠাৎ আগুন্তুক ভদ্রলোক গোফ খুলে ফেলে।  মাথা থেকে একটা কৃত্রিম চুলের গোছা খুলে একধারে রাখে।আমি অবাক হয়ে দেখি সুহাস সামনে বসে যাকে আমি বেশ কিছুদিন আগে ঊষার গানের মজলিসে দেখি। আমি আবেগ প্রবণ  হয়ে উঠে আসি ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য।  ও বলে থাক সামাজিক দূরত্বটা বজায় থাক। আবেগ চেপে নিজের জায়গায় বসি। রীতা জানায় কিছুদিন আগে উনার সঙ্গে বসেই ও ইন্টারভিউ নেয়। সেদিন ওনাকে চিনতে পারে নি। ও জানত না বাবার সংগে উনার ভাব আছে।  আর উনি অন্য কেউ নন সুহাসবাবু, রীতার বাবা, যার সম্পর্কে সে বিপিনবাবুর কাছেই জানতে পারে।

তারপর আমাদের মধ্যে নানা  কথাবার্তা শুরু হয়। সেই কলেজের কথা। ইউনয়ন গঠন সুহাসের রাজনীতি এসব।  কাজলের কথাও। কাজলের কথার সঙ্গে ঊষাদেবী উঠে আসেন। আমি বা বিপিন যে কথার জন্য উদগ্রীব সেটা তোলার সুযোগ পাই।  জানতে চাই এখন  সুহাস  কেমন আছে এখন কি করছে। ওর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কি। সুহাস  কিছুই গোপন করে না। ওর জেল জীবন তারপরের জীবনের কথা বলে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলে না। আমি সেটা উস্কে দেবার জন্য ঊষার কথা রন্টুর কথা বার বার তুলি।  কিন্তু আমরা ওর বর্তমান জীবনের কথা যা শুনেছি তা জানতে পারি না । আমাদের জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আমি তখন ঊষার ওর ভাইয়ের সঙ্গে থাকার কথা ওর অসুস্থতার কথা বলি। সুহাস কোথায় কার সঙ্গে থাকে তা জানতে চাই। এবার সুহাস  মুখ খোলে। ও জানায় রাজনীতিগত ভাবে  দলের সঙ্গে ওর মত বিরোধ হয়েছে। ও মনে করে পূরণ ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটছে দলের কাজে। তবে এখন অনেকেই সেটা মানছে না।এই নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধ করলে দলে ভাঙ্গন ধরতে পারে। তাই সুহাস চুপ করে সরে আছে। ওর আশা দল যখন ভুল বুঝবে তখন আপনা থেকে দূরত্ব কমবে। এ বিষয় গুলো নিয়ে আমাদের উৎসাহ থাকলেও ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমরা বেশি উৎসাহী। আমি আবার জানতে চাই ঊষাদেবীর খবর কি? উনার চিকিৎসার কি হচ্ছে? সুহাস বলে:

" কেন তোমরা জান না? ও মারা গেছে"

আমরা আকাশ থেকে পড়ি। আমি বলি:

" রন্টু বলল যে ওর মা মামার ওখানে থাকে। ও অসুস্থ"। সুহাস বলে:

" ওটা রন্টু বলে কারণ ওকে সেটাই বলতে বলা হয়েছিল। ঊষা বেশ কিছুদিন হল আমার ওখানে গিয়েই থাকত। সবাই জানত ও একজন আদিবাসী মহিলা আমার সঙ্গে থাকে । দলের নির্দ্দেশে ও ওখানে মেয়েদের শিক্ষার দায়িত্বে ছিল। সেই সূত্রে ওদের মধ্যে রাজনীতির কাজও করত। বছর তিনেক আগে ও যে গ্রামে কাজ করত সেখানে ম্যালেরিয়া হানা দেয়।  ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ওখানে মারাত্মক। তাতে মৃত্যুর হার আজ কবিড থেকে কম নয়। আর সেটা প্রধানত গরিব মানুষের ঘরেই হানা দেয়। তাতে কাজল মানে তোমাদের উষা মারা যায়।  এটা খবরের কাগজে বের হয়। তবে ঊষা অন্য নামে ছিল। ওখানকার বাইরের জগৎ ঊষা নামে কেউ মারা গেছে বলে জানে না। পুলিশ সাংবাদিক কেউ না। এটা বোধ হয় আমার ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। পার্টির স্বার্থে বিপ্লবের স্বার্থে আমাকে মেনে নিতেই হয়। ওর আত্মত্যাগ অমর হয়ে থাকবে "

আমি আর বিপিন পরস্পর মুখের দিকে তাকাই। এটাই তবে সুহাসের আদিবাসী মহিলাকে নিয়ে বসবাসের গল্প।       

উনাকে কেউ সরেসদা আবার কেউ সরেসবাবু বলে ডাকেন। সুরেশ বসু নাম হলেও ওনাকে কেউ সুরেশ বাবু বা সুরেশদা বলেন না। ওই নামটা যে উনার সেটাই আমরা কয়েকজন কাছের লোক ছাড়া অন্যেরা জানেন না। অনেকে সত্যিকারের নামটা ভুলেই গেছেন।শহরের ক্লান্তিকর পরিবেশ থেকে দূরে কল্যানীর একপ্রান্তে সরেসবাবুর ছোট্ট বাড়ি। সরকারি অফিস থেকে অবসরের পর এই বাড়ি করে তিনি এখানের নিজ বাড়ির পাকা বাসিন্দা হয়েছেন। তবে কলকাতার পরিচিত মহল ওনাকে এখনও টানে। প্রতিসপ্তাহেই সেখানে কফি হাউসে আড্ডায় এখনো যান। কখনো কখনো দাদার বাড়ি বা বন্ধুর বাড়িতে কলকাতায় থাকেন। এখানে স্ত্রী আর উনি একা। স্ত্রী আছেন। একা বলি কি করে! যদিও বাঙালি হিন্দু পরিবারে একে একে এক। আজ আমরা মনে করি দুজনে দুটো সত্তা। তাই একা নন দোকা। আজকাল আমিও ওখানে থাকি।কার্যত এটাই আমার পৈতৃক ভিটে।

সরেসবাবুদের  ছেলে মেয়ে দুজনেই ভিন প্রদেশে। ছেলে ও ছেলের বউ দুজনেই চাকরিরত আর সেই  সূত্রে ভিনপ্রদেশ বেঙ্গালোরে । আর মেয়ে জামাইয়ের চাকরির দৌলতে তার সঙ্গে বোম্বেতে।  সেই সূত্রে বছরে কিছু সময় ধরে সরেসবাবু ঘর ছাড়া। ছেলে মেয়ের সঙ্গে কাটে। বয়স হয়েছে। শারীরিক কারণে পরনির্ভরশীলতা বেড়েছে। তাই ছেলে মেয়ে এখানকার বাস উঠিয়ে ওখানে ওদের কারও একজনের সঙ্গে বা পালা করে দুজনের ওখানে থাকার কথা বললে সেটা সরেসবাবু অস্বীকার করতে পারেন না । হয়তো ভবিষ্যতে সেটা মেনে নিতে হবে। কিন্তু এখনই সরেসবাবু সেটা চান না নিজের জীবন সবটা বর্জন করে। যদিও স্ত্রীর এতে আপত্তি নেই। ওনার মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে মেয়ের বাড়িতে বেশ কাটে। কিন্তু সরেসবাবু সেটায় এখনই রাজি নন বলে স্ত্রী এ ব্যাপারে চুপ। আর তাঁর চুপ থাকাটাই সরেসবাবুর পক্ষে বিড়ম্বনা। মনে হয় উনি ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে চুপ থাকেন। বরং নিজের মত প্রকাশ করলে ইচ্ছেকে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানালে একটু অশান্তি হয় তো হতো কিন্তু এই বিড়ম্বনাটা থাকত না। যে সব মেয়েরা  আমাদের সমাজে নিজের ইচ্ছেকে দমন করে থাকে তাদের নিয়ে এই সমস্যাটা দেখা যায়। এছাড়া একটা ব্যাপার আছে। ছেলে মেয়েদের জীবন ধারণ আর আগের যুগের পুরনো ধাঁচের মানুষের জীবনধারণ ভাবনা চিন্তার মধ্যে একটা সংঘাত আছে। সেটাকে এড়িয়ে চলতে গেলে যতদিন সম্ভব আলাদা থাকাই ভালো। সরেস বাবুর এই যুক্তিটাকে স্ত্রী সুব্রতা অস্বীকার করতে পারেন না। এটা অল্প বিস্তর হলেও ওনার পক্ষেও সত্যি। আর কলকাতায় ভাই বোন পরিচিত সবাই যাদের সঙ্গে একই ভাষায় গল্প গুজব করা যায়। তাই একটা পেছন টান ওনারও আছে। 

সরেস বাবু মিশুকে প্রাণবন্ত সরেস মানুষ। তিনি তাঁর জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে অন্তত এই সরেস ডাকটার প্রতি সুবিচার করে গেছেন। জনপ্রিয় ওই নামটা ছাড়া  ওনার নামডাক খুব একটা নেই। পরিচিতির ছোট গন্ডির মধ্যে সরেসবাবু যথেষ্ট জনপ্রিয়। আলাপে প্রলাপে দক্ষ। নিজের বয়স হলেও অল্প বয়স্কদের মধ্যে উনি এখনও যুবক। হাসি ঠাট্টা টিকা টিপ্পনীতে উনি সত্যি এক রসিক পুরুষ। কিন্তু আপাত এই হালকা চালের মানুষটার গভীরে এক  সত্যনিষ্ঠ গম্ভীর মানুষ যেন লুকিয়ে থাকে। যেটা উনি বিশ্বাস করেন সেটা বললে কেউ ক্ষুন্ন হবে ভেবে তিন পিছিয়ে থাকেন না। এই নিয়ে ঘরে বাইরে তার বিবাদ। সক্রিয় ভাবে এখন আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও কোন আন্দোলন মিটিং মিছিলে এখনও পা মেলাতে চেষ্টা করেন। সে সূত্র ধরে সমাজের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। 

এখন বয়স হয়েছে। আগে থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সরেস বাবু।লেখালেখি নিয়ে থাকেন। সাবেকি সমাজ আন্দোলনের ভাবনার সঙ্গে এখন বৃদ্ধদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাঁর সমাজ ভাবনা। তাঁদের সুস্থ থাকা, অসুস্থ হলে যথারীতি চিকিৎসার ব্যবস্থা এসব নিয়ে তাঁর ভাবনা। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকা। এর সঙ্গে একটা বিষয় তাঁকে বিশেষ ভাবে ভাবায়। এ নিয়ে পরিচিত অপরিচিত মহলে বিভিন্নজনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাধে। অবশ্য কাউকে কাউকে তিনি সহমতে পেয়ে যান। বিষয়টা হল বার্ধক্যে অসুস্থ থাকাকালীন যখন শরীর আর নিতে পারে না তখন পরিণতির  অনিবার্যতা। অথচ তাকে পরিবারের সবার মুখের হাসি কেড়ে নিয়ে পরিবারকে সর্বশান্ত করে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার প্রথাগত  চেষ্টার তিনি বিরোধী। এই অবস্থায় তিনি ইচ্ছামৃত্যুকে অধিকার বলে সরকারের মেনে নেওয়া উচিত বলে মনে করেন। উনি উদাহরণ তুলে বলেন কি দুরবস্থা ও মানসিক কষ্টের মধ্যে মা বিছানায় অসুস্থ ছেলের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আদালতে ছেলের স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার দাবি করতে বাধ্য হয়।  আদালত তা মেনে না নেওয়াকে অমানবিক বলে মনে করেন সরেসবাবু। এই নিয়ে যুক্তি তর্কে বসলে অনেকে বলেন সম্পত্তির লোভে এই সুযোগ নিয়ে ছেলে মেয়েরা বাবা বা মায়ের হত্যা মৃত্যুকে  স্বেচ্ছামৃত্যু বলে চালাবে তাই এটা মেনে নেওয়া যায় না। এই মতের সঙ্গে সরেসবাবুর একমত নন। তাঁর মতে এমন কোন নিয়ম দেশে আছে কি যার অপব্যবহার হয় না? এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হিসেবে একটা দুটো অঘটন ঘটলেও পরপ্রজন্মের প্রতি এ ধরণের অবিশ্বাস উনার মতে ঠিক নয়। তাহলে কোন নিয়মই চালু করা চলে না। আবার অনেকের মতে জন্ম মৃত্যুতে মানুষের হাত নেই। দুটোই ওপরওয়ালার হাতে। সেখানে উনার মতে তাহলেতো জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালু করা চলে না। জন্মনিরোধক ওষুধ ব্যবহার করা অপরাধ। আমরা জানি অনাকাঙ্খিত সন্তান সম্ভাবনা দেখা দিলে ভ্রূণ হত্যা করা হয়। এসব ক্ষেত্রে আমরা নিয়মিত ওপরওয়ালার বিধান ভাঙ্গি। অথচ একজন কষ্টরত বৃদ্ধ যার প্রয়ান আজ বা কাল অনিবার্য তাকে বিছানায় কষ্ট দিয়ে পরিবারকে সর্বশান্ত করে সবার নিরানন্দের কারণ হয়ে বাঁচিয়ে রেখে কোন উপরওয়ালার বিধান মানা হয় সেটা সরেসবাবুর তা বোধগম্য হয় না। তিনি ইচ্ছামৃত্যুকে একটা অধিকার বলেই মনে করেন। আরও ভাবেন যে এই নিয়ম চালু হলে মানুষও এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে প্রাথমিক পর্যায়ে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হলেও। এ নিয়ে সরেসবাবু আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে। কারো কারোকে সঙ্গে পেলেও এ নিয়ে তিনি তেমন সাড়া পান না। আন্দোলন গড়ে ওঠে না। একে উনি মানুষের পিছিয়ে থাকা চিন্তার ফল বলে মনে করেন। ভাবেন আজকের সমাজজীবনে বৃদ্ধদের অবস্থা যেদিকে এগোচ্ছে করোনার মতো ভাইরাস একে যেমন সংকটাকীর্ন করে তুলছে তাতে আগামীদিন এই দাবিটা উঠতে বাধ্য। 

এখন সরেসবাবুর ছেলে বদলি হয়ে কলকাতায়। সঙ্গে বৌমাও। সরেসবাবুর সঙ্গে থাকে। নাতি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ছেলে ছেলের বউ নাতি স্ত্রীকে নিয়ে আনন্দে আছেন। স্ত্রী নাতির পড়াশুনা দেখেন। একসঙ্গে টিভি দেখা কেরাম খেলা নিয়ে নাতির সঙ্গে ভালই কাটে। এই আনন্দের সংসারে যেন যতদিন পারা যায় কাটিয়ে যাওয়া। বার্ধক্যে সবাইকে নিয়ে এই চলার আনন্দ ভোগ করার জন্যই সরেসবাবুর  বেঁচে থাকা। শরীরটা ভেঙে পড়লেও এখনো সম্পূর্ণ অচল হয়  নি। এরই মধ্যে বেরন।তবে বুঝতে পারছেন যখন তখন বসে যেতে পারেন। এরই মধ্যে করোনা ভাইরাস। আর বয়সজনিত সমস্যাতো আছেই। তবে সরেসবাবু দমতে রাজি না। এর মধ্যেই নিজের লেখাপড়া। তবে ছেলে মেয়ের এখনকার জীবন যাপন তাদের ব্যক্তি ভবিষ্যত নিয়ে ধারণা এসব নিয়ে ছেলের সঙ্গে বিরোধ দেখা যায়। স্ত্রী চুপ করতে বলে। মেয়ে ফোনে  ছেলের পক্ষ নে। এ নিয়ে বিরোধ যেন বেড়ে চলেছে। আজকাল স্ত্রীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা।আর এসব বিরোধ ঘরে বন্দি থাকে না। বাইরে সাতকানে পৌঁছায় যে না তা নয়। তবে তাতে সরেস বাবুর কিছু আসে যায় না। সরেস বাবু জানে সব সংসারে এসব থাকে। তবে তিনি এটাও জানেন যে অন্যান্য অনেকের থেকে উনি ভালো আছেন। আর ছেলে বা মেযে  সব সময় তার সঙ্গে আপদে বিপদে। আর বউ মাকে নিয়ে কোন সমস্যাই নেই। স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনদিন অভিযোগ ছিল না আজও নেই। তবে মতবিরোধ যখন হয় তখন তা তুঙ্গে। এছাড়া ভাই বোনদের সঙ্গে সরেস বাবুর মোটামুটি সুসম্পর্ক। এখনো পূরণ যৌথ পরিবারের রেশটা এ বাড়িতে আনাচে কানাচে উঁকি মারে।

আজকাল পাড়ায় আড্ডায় বিশেষ কেউ আসে না। বাজার যাতায়াতের পথ অনুসরণ করে যে কজন বের হন তাদের সস্নিদ্ধ চোখ খুঁজে ফেরে । যদি কাউকে পাওয়া যায় জমে থাকা মনের কথা বলার জন্য। সরেসাবুর তেমন খবর নেই। মিশুকে সবার প্রিয় আড্ডার মধ্যমণি মানুষটা যেন হারিয়ে গেছে। করোনা র দৌলতে কেউ কারো বাড়ি তেমন যায় না তাই খবর পাওয়া যায় না। আমরা জানি কোমরে একটা চোট লাগায় সরেসবাবু আজকাল একেবারেই বেরোতে পারেন না। আজ বাজারে শোনা গেল উনার কভিড হোয়েছে। খবরটা শুনে সকলের মন খারাপ। খবরটা কতটা সত্যি জানা দরকার। হঠাৎ বিশু বাবুর সঙ্গে আমার দেখা । উনাকে জিজ্ঞাসা করেও বিশেষ কিছু জানা গেল না। দুজনে ঠিক করলাম সরেস বাবুর বাড়ি গিয়ে খবর নেব। পরের দিন রবিবার সরেস বাবুর বাড়িতে আমি আর বিশুবাবু। বাড়িতে সবাই আছে। সরেস বাবু বিছানায়। আমাদের দেখে স্বভাবসুলভ হাসি উনার মুখে উপচে পড়ল। কেমন আছেন জানতে চাইলে কোমরের ব্যাথার কথা বললেন। আমরা করোনার কথা জানতে ইচ্ছুক থাকলেও সেটা জানতে চাইতে পারছি না। সংকোচে একটু বেশি দুরত্ব রেখে চলছি। এমনিতেই ভাবনার জগতে একটা অস্পৃশ্যতার রোগের ছোঁয়া। অস্বীকার করা যায় না। এই রোগটা আজ সবাইকে আক্রমণ করেছে। সরেস বাবু বুদ্ধিমান লোক। আমাদের অস্বস্তির দিকটা বোঝেন। নিজে থেকেই বলেন:

''ছেলে বলল বাজারে রটেছে আমার নাকি করোনা হয়েছে। আজ এটা খুব স্বাভাবিক। যদি সত্যি সত্যি করোনা হয় তবে অবাক হবার কিছু নয়। শরীরে ব্যাথা ঠান্ডা লাগা সব নিয়ে আমিও ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আর আমার ভয়টা শুধু করোনা নিয়ে নয়। করোনা চিকিৎসা নিয়ে। তাছাড়া আমার বয়স হয়েছে। কিছু হলে যন্ত্রণা সবার। বাড়িতে এতগুলো লোক। আমার জন্য ওদের সারাজীবন বিপন্ন। শুধু রোগ নয়। বেসামাল অর্থ খরচ। কে সামলাবে বলুন? সেজন্যই আমার বরাবরের স্বেচ্ছা মৃত্যুর দাবি।"

আমরা তখনও বুঝি নি উনার করোনা হয়ছে কি না। ছেলে পাশে দাঁড়িয়ে। উনার স্ত্রী চা করতে গেছেন। ছেলের কথায় আমরা আশ্বস্ত হলাম। ছেলে জানাল:

''দেখুন না কাকু, বাবার সেই চিন্তাটা মাথাচাড়া দিয়েছে। স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকার। করোনার  ভয় সেটাকে জিগিয়ে তুলেছে। যাই হোক করোনা টেষ্ট করা হয়েছে। কিছু পাওয়া যায় নি। কোমরের চোট টাও তেমন কিছু নয় বলে ডাক্তার জানিয়েছেন। উনার ভয় যদি করোনা হয় যদি বিছানায় পড়েন তবে আমাদের কি হবে। বোঝাতে পারছি না বয়স হলে এগুলো সঙ্গী।" সরেসবাবুর লেখা একটা চিরকুট ছেলে তুলে ধরে তাতে লেখা :

" যদি আমার কভিড হয় আর আমাকে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ গ্রহণ করতে হয় তবে  আমার  মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। এটা আমার স্বেচ্ছা মৃত্যু। যদি কাউকে দায়ী করতে হয় তবে তা হল রাষ্ট্রের স্বেচ্ছামৃত্যুর দাবিকে অস্বীকার।যদি এই দাবি মান্যতা পেত তবে আমার ইচ্ছা অনুযায়ী আমি আরও কিছুদিন এই পৃথিবীতে থাকতে পারতাম। প্রিয়জনদের ছেড়ে আমি চলে যেতে চাই না। তাও এটা যে অনিবার্যতা আজ হোক কাল। আমি এও চাই না যে অসুস্থ হয়ে পড়ে থেকে প্রিয়জনের স্বাভাবিক সুন্দর জীবন বিপন্ন করে তুলি, চিকিৎসা ব্যবসার খপ্পরে পড়ে তারা নিঃস্ব হোক। তাই কিছুটা আগেই আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। পরে অসুস্থ অবস্থায় হয়তো সেটা সম্ভব হবে না। পড়ে  থাকতে হবে মৃত্যু শয্যায়। সেটা এড়াতে আমার এই স্বেচ্ছামৃত্যু। স্বেচ্ছামৃত্যুর সোচ্চার দাবি।"

আমরা পড়ে হাসি।তবে কি উনি করোনা ধরে নিয়ে ভয়ে এরকম একটা পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু উনিত এত দুর্বল মনের লোকতো  নন। আমরা জানতে চাই। উনি বলেন:

'' হ্যাঁ ভয়ে । তবে করোনার ভয়ে নয়। চিকিৎসার ভয়ে, বিছানায় অক্ষম হতে পড়ে  থাকার ভয়ে, অন্যদের কি হবে সেই ভয়ে আর সর্বোপরি আমার অধিকারের দাবিতে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে।''

ছেলে চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলে।

যাই হোক আমরা বিরম্বনা মুক্ত। করোনার ভয়টা কাটে। এরপর সরেস বাবু তার স্বমূর্তিতে। চুটিয়ে অনেকদিন পর আড্ডা। নানা কথা। আজ মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে। করোনার আবহে ছাঁটাই হয়ে  চলেছে, ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ। এরই মধ্যে নিরবে নতুন  শ্রম আইন কৃষি আইন । একটার পর একটা সংস্কার। চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসা। সরকার লেজে গোবরে। পৃথিবীজুড়ে করোনা আর আর্থিক সংকটের দ্বৈত আক্রমণ আলোচনায় উঠে আসে। আলোচনা শেষে সবাই তৃপ্ত। অন্তত এই দুঘন্টা আমাদের মুক্ত মন। করোনা আতংক পালায়। আমরা বুঝি সরেস বাবু সুস্থ হয়ে উঠবে। আমরা আবার ছন্দে ফিরব। বেলা হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে।

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। করোনা আপদ থাকলেও সে অনেকটা মানুষের শরীরের নিরাপদ আশ্রয়ে। যদিও কখনও কখনো কারো কারো শরীরে মারাত্মক বিবাদী হয়ে  ওঠে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে আবার সেরে উঠছে। আমরা বুঝে গেছি এ নিয়েই বাঁচতে হবে। সবাই বের হচ্ছে। কাজ কর্ম শুরু হয়েছে। তবে দেশে ব্যাপক কর্মহীনতা। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার দূর অস্ত। পরিবেশ দূষণ যুদ্ধের আবহ মানুষের জীবন জীবিকার সমস্যা আরও জটিল করে  তুলেছে। নতুন কৃষি নীতির দৌলতে জমি অকৃষি  সম্প্রদায়ের হাতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। কৃষি কাজের সুযোগ কমছে।এর ফলে মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়ছে। মানুষের প্রতিবাদের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ ভেঙে চুরমার। বিচারবিভাগ তার নিজস্ব স্বত্বা হারাতে বসেছে। এদিকে  লক ডাউন উঠে গেছে। রাষ্ট্র আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। মানুষ আর ঘরে বসে থাকছে না যদিও করোনার ভয়ে যে সামাজিক বন্ধনটা আলগা হোয়ছে তার রেশটা থেকে গেছে। আমাদের আড্ডার বহর ছোট আকারে হলেও আবার জমে উঠেছে। আর সরেস বাবু এলে তো কথাই নেই। তবে উনি মধ্যে মধ্যে উধাও হয়ে যান। পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন করেন এমন উনার কিছু বন্ধু আছে তাদের কাছে চলে যান। তাদের সঙ্গে পাহাড়ে জঙ্গলে সমুদ্রে বেড়াতে যাওয়ার নেশাটা আবার পেয়ে বসেছে। এক একটা এলাকা  ঘুরে এসে সেখানকার মানুষ সেখানকার পরিবেশ নিয়ে উনার রসালো আলাপ আড্ডাকে নতুন মাত্রা দেয়। আমাদের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে।

আজ মানুষের মধ্যেকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্ষোভ যেন একটা মোহনায় মিলতে চলেছে। পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনের ডাকে সামিল হয়ে শ্রমজীবি মানুষ তাদের অধিকারের কথাও বলছে। আবার শ্রমিকদের আন্দোলনে পরিবেশবিদরাও যুক্ত হচ্ছে। করোনাই বোধ হয় একে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করছে। মানুষের শ্রম সময় বাড়িয়ে তাকে কম্পিউটারমুখী করে মানুষের স্বাস্থ্যের যে বারোটা বাঝছে সেটা দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। একটা মনোরোগ সমাজকে গ্রাস করছে। আর জমি অকৃষি সম্প্রদায়ের হাতে গিয়ে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসার বাধ্যমে যে পরিবেশ দূষণ বাড়াবে সেটা মানুষ বুঝতে পারছে। খনির অধিকার কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়ার জন্য যে আজকের কৃষি সংস্কার কাজ করবে সেটা পরিষ্কার হচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য বেনিয়া মাফিয়াদের হতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে অগ্নিগর্ভ অবস্থা যা রাষ্ট্র বলের প্রয়োগ করে ছাই চাপা দিয়ে রাখছে। আপাতভাবে অবস্থা শান্ত। রাষ্ট্র নিশ্চিন্ত। কিন্তু মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের দাবি দানা বাঁধছে। দেখা যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ জানান না দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে বড় বড় জমায়েত হচ্ছে।

হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে একটা খবর পড়ে  পাড়ায় সবাই স্তম্ভিত উদ্বিগ্ন। ঝাড়খন্ড ছত্তিশগড় বিহারের বিভিন্ন অঞ্চল ধরে মানুষ অধিকারের দাবিতে সোচ্চার। বিরাট জমায়েত। রাষ্ট্র জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু মানুষ উত্তাল। পরিবেশবিদরা পরিবেশ রক্ষার  দাবিতে, মানুষ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠনের অধিকারের দাবিতে রুটি রোজগারের দাবিতে কৃষি জমি অকৃষিবিভাগে স্থানান্তরিত হতে না দেওয়ার দাবিতে বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশ। তা সামলাতে পুলিশ গুলি চালায়, ব্যাপক গ্রেপ্তার করে। জনা  কুড়ি মানুষ  গুলিতে মারা যায়। মারা যাওয়ার তালিকায় সুরেশ বোসের নাম দেখা যায় যার বাড়ি পশ্চিম বঙ্গে। আমাদের সরেস বাবুর নাম। আমরা জানি উনি উনার পরিবেশবিদ বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়েছেন। নামটা দেখে আমাদের সংশয় হয়। আর আমি আরেকটা নাম পাই যিনি ধরা পড়েন। একজন মহিলা সাংবাদিক যাঁর নাম রীতা । আমার মনে খটকা লাগে । ভেসে ওঠে সুহাস কাজলের নাম যাদের আমি চিনতাম। আর পরের প্রজন্মকে যেন দেখি ঝর্ণার কলতানে,  পাহাড় শিখর থেকে তুষার গলে ঝর্ণা হয়ে নেমে এসে মেলে নদী মোহনায়। কাজল বেঁচে নেই সুহাসের খবর পাই না। তবে ওদের ছেলে রন্টুর  সঙ্গে আমার এখনও যোগ আছে। ওদের পরিচয় এই কলমেই পাঠকরা আগে পেয়েছেন। আমি একে একে দুই করার চেষ্টা করি। মেলাবার চেষ্টা করি। কোথায় যেন একটা ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই। সময় নষ্ট না করে সরেসবাবুর বাড়ি যাই। জানতে পারি ওর ছেলে বাবার খবর পেয়েছে। বাবার মৃতদেহ আনতে চলে গেছে ভিন প্রদেশে।


বেশ কিছু সময় কেটেছে। এখন রিঙ্কু শহর থেকে দূরে মফস্বলে কোন এক আধা শহরে এক কামরা একটা ঘরে ভাড়া থাকে। এখন বয়স পঞ্চাশ উর্ধে। সঙ্গে স্ত্রী। অঞ্চলের ছেলে মেয়েদের দুজনে মিলে পড়িয়ে যে সামান্য রোজগার তা দিয়ে চলে যায়। ওদের সন্তান নেই। রিঙ্কু পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে জড়িয়ে পড়েছে। ওকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার দরকার নেই। আমাদের পূর্ব পরিচিত সেই স্কুলে পড়া ছেলেটি। ভালো গান বাজনায়। বাবা আমাদের সুহাস আর মা কাজল দুজনেই গত হয়েছেন আমরা জানি। দিদি রীতা সাংবাদিকতার কাজেই যুক্ত। সে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার। কলকাতায় থাকে।  ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে মধ্যে মধ্যে আসে। রিঙ্কুও দিদির ওখানে যায়। রীতার দুই মেয়ে। তারাও এখন বড় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত। বাবা মায়ের উত্তরাধিকার বহন করে দুজনেই চলে। সমাজের সমস্যা দেখে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না। তা নিয়ে ভাবে। এ নিয়ে কি করা দরকার তা নিয়ে দাবিতে সোচ্চার হয়। রাষ্ট্রের ভুল নীতির বিরোধিতায় আন্দোলনে যুক্ত হয়। বাবা মায়ের উত্তরাধিকার বহন করলেই তাদের চিন্তাভাবনা যার যার চেতনার খাতে প্রবাহিত। সব কিছুতে মিল পাওয়া যায় না আবার মৌলিক কিছু বিষয়ে মিল আছে।আপাতদৃষ্টিতে অমিলটা প্রকট হলেও এর অন্তঃস্থলে যে মৌলিক মিল আছে তা হয়তো আগামী দিনে তাদের একই খাতে বইতে দেখা যাবে।

আজের সমাজে উগ্র শিল্পায়নের মুখে বিশেষ করে ভারতসহ সব আফ্রিকা এশিয়ার পিছিয়ে পড়া দেশগুলো যে পরিবেশ বৈচিত্র হারিয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের কবলে ধ্বংসের মুখে সেটা রিঙ্কুদের ভাবায়। একদিকে রুটি রোজগারের অভাব অপরদিকে পরিবেশ ধ্বংস। ভোগবাদের দরুন ভোগের লালসা এক কৃত্রিম ভোগ বিলাসী জীবন যেমন পরিবেশ দূষণের কারণ তেমনি কম জমিতে বেশি উৎপাদন রাসায়নিক শিল্পে লাভ ঘরে তোলার তাড়নায় কৃষি উৎপাদনে নয়া কৃষি প্রযুক্তি পরিবেশ দূষণ মানুষের স্বাস্থ্য দূষণ জমির অবক্ষয় ঘটিয়ে চলেছে। উন্নত আগ্রাসী দেশগুলো এর সুযোগ নিয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে শোষণ করে চলেছে। আর রাষ্ট্র এর তাবেদারী করছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করে রিন্টুরা। তারা ভাবে তাদের পূর্বসূরীরা এই দিকটা অবহেলা করে কেবল রুটি রোজগারের তাগিদকে কেন্দ্র করে শ্রেণী সংগ্রামকে  দেখেছেন আর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা না বলে  পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তোলাকে একধরনের সৌখিন রাজনীতি বলে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। কার্ল মার্কসের যুগে পরিবেশ দূষণের বিষয়টা এত ভয়ঙ্কর আকার নেয় নি বলে তা ধ্রুপদী মার্ক্সবাদে তেমন গুরুত্ব পায় নি। কিন্তু আজ অবস্থা বদলেছে। পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে পশ্চাদপদ একটা দেশকে যে ধ্বংসের কিনারে ঠেলে দিচ্ছে গরিব মানুষরাই যে প্রধানত এর ফল ভোগ করছে সেটা পরিবেশ বিরোধী আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। আক্রান্ত দেশগুলোর রুখে দাঁড়ানো দরকার। এই পরিবেশ দূষণ অবস্থাপন্ন মানুষদের জীবনও বিপর্যস্ত করে চলেছে। মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে ভোগবাদ তাদের জীবনের প্রকৃত আনন্দ কেড়ে নিচ্ছে। আর বিষয়টার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহার। প্রযুক্তির সুষ্ঠ ব্যবহার, সাধারণ মানুষের জীবনে তাকে নিয়ে যাওয়া আজ যে শ্রেণীর লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত সেটা বোঝা দরকার বলে রন্টুরা মনে করে। আজ প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি যেমন উৎপাদন প্রণালীতে একটা মৌলিক বদল এনেছে তেমনি মানুষের মনন প্রক্রিয়ায় জীবন ধারার পরিবর্তনে বদল আনতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আর সবটার অভিমুখ কর্পোরেট স্বার্থ তার প্রাধান্যবাদ। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শ্রমজীবী মানুষ দেশপ্রেমিক মানুষ পরিবেশবিদদের একজোট হতে হয়। গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। তিনটে খাতে বয়ে যাওয়া আন্দোলনকে একটা মোহনায় মিলতে হয়। ভারতের মাওবাদী দল অনুসৃত শুধু খতম অভিযানের মাধ্যমে শুধু সমরবাদ দিয়ে এ লড়াইয়ের সামগ্রীকতা ধরা যায় না বলে রিঙ্কুরা মনে করে। বিষয়টা নিয়ে তারা আজ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিভিন্ন মার্ক্সবাদী সংগঠনের সঙ্গে আলাপে উৎসাহী। তাদেরকেও আজ আন্দোলনের ভ্রাতৃপ্রতিম শক্তি হিসেবে পেতে চায়। তারা চরমপন্থীদের গণআন্দোলনকে পরিহার করার বিষয়টা মেনে নিতে পারে না।

রিঙ্কুর দিদি রীতার এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিরোধটা মিটে গেছে। তারা আবার একসঙ্গে জীবন যাপন করছে। তাদের দুই মেয়ে। রীতা সাংবাদিক হিসেবে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা নিয়ে বরাবরই সরব। সাংবাদিকতার সূত্রে সে ভারতে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘোরাফেরা করে। বিশেষ করে ছত্তিশগড়  ঝাড়খন্ড উড়িষ্যা উত্তর কর্নাটকের বিভিন্ন খনিজ অঞ্চল তার ঘোরা। সেখানে আদিবাসী দলিত মানুষের দুরবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আজ ভূমি সন্তানদের উৎখাত করে খনিজ সম্পদের ওপর অধিকার কায়েম করতে দেশি বিদেশি কর্পোরেট সংস্থা কেমন তৎপর সে সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল। সেখানকার মানুষের এই আক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই নিয়ে লেখালেখি করে বলে সে রাষ্ট্রের কুনজরে। দু একবার গ্রেপ্তার হয়।  ভারতের ধর্ম বর্ণ নিয়ে যে বিভাজন আর রাষ্ট্র তাকে কিভাবে ব্যবহার করে সেটা সে দেখেছে।  রুটি রোজগারের লড়াইয়ের সঙ্গে এই দলিত সমাজ আদিবাসী সমাজের সমস্যাকে একটা সূত্রে কিভাবে বাঁধা যায় সেটা নিয়ে সে ভাবে। এর সঙ্গে নয়াউদারনীতিবাদ কিভাবে কর্পোরেট দুনিয়ার এই লুঠের রাজকে আজ ভয়ঙ্কর করে তুলেছে তা সে প্রত্যক্ষ করে। সেখানে যে লড়াই চলছে সেখানে ধ্রুপদী মার্কসবাদের তাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারতের বিশেষ প্রেক্ষাপটে বিচার করার বিষয়টায় ঘাটতি রয়ে গেছে বলে রীতারা মনে করে। এর সঙ্গে সমাজের মননের পরিবর্তন দরকার। মানুষকে আত্মস্বার্থ ত্যাগ করে ভোগবাদ বর্জন করে গরিবমানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। সেটা বিপ্লবএর পর দেখা যাবে বলে এড়িয়ে গেলে এ লড়াই সামগ্রীকতায় দানা বাঁধতে  পারে না বলে রীতারা মনে করে। এর জন্য বস্তুভিত্তিক লড়াইয়ের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক লড়াইকে যুক্ত করতে হয় বলে তারা মনে করে। গড়ে তুলতে হয় বর্ণ ধর্মকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে লড়াই।

রীতার বড় মেয়ে আবার ভারতে মাওবাদী দলের সমর্থক। মধ্যে মধ্যে মাওবাদী অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে ওর যাতায়াত। ও রিঙ্কুর ভাবনাকে কটাক্ষ করে। ওর গণআন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে রাখাকে সংস্কারবাদী সুবিধাবাদী বলে হেয় করে। আবার রিঙ্কু ওকে সমরবাদী হটকারী রাজনীতির প্রবক্তা বলে। দুজনের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ তর্কবিতর্ক। আবার দুজনেই রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়ে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে লালগড় নন্দীগ্রামের আন্দোলনে দুজনে একসঙ্গে অংশগ্রহণ করে। দুজনের মধ্যে একত্রিত হওয়ার আগ্রহ থাকলেও একজনের পার্টি লাইন আর আরেকজনের পার্টিবিহীন গণআন্দোলনের ধারণা দুজনকে মিলতে দেয় না। কিন্তু আন্দোলন ও তার সাফল্য ব্যর্থতা দুজনকেই কি ভাবে একত্রিত হওয়া যায় সেই ভাবনায় ভাবিত করে। রীতার মেয়ে কঙ্কা মুখে যাই বলুক গণআন্দোলনকে অস্বীকার করতে পারে না। পরিবেশের প্রশ্নটাও আজ সামনে এসে পড়ে। এছাড়া আছে ভারতের অর্থনীতিতে সমাজজীবনে কর্পোরেট সংস্থার প্রধান্যবাদের প্রশ্নটা।

তার বড় মেয়ে কঙ্কাকে নিয়ে রীতার নানা চিন্তা। ও ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সুব্রতর প্রেমে পড়েছে। সুব্রত পড়াশুনা ছেড়ে বিপ্লবী কাজকেই নিজের জীবন বলে গ্রহণ করেছে। বাড়ী ঘর ছাড়া পলাতক জীবন। পুলিশ খুঁজে বেড়ায়। ওদের দুজনের গোপন যোগাযোগ আছে যার সবটা নাগাল পায় না রীতা। আদর্শের দিক থেকে সুব্রত শ্রদ্ধার পাত্র হলেও রীতার ভয়। ও দেখেছে বিপ্লবী আন্দোলনে যখন ভাঁটার টান তখন অনেক বিপ্লবী হতাশায় নিমজ্জিত হয় গোপন জীবন থেকে বেরিয়ে এসে হতাশায় ভোগে। পড়াশুনা শেষ হয় নি আবার বেরিয়ে চাকরি নেই এই অবস্থায় কেউ যেন নিজেকে দায় বলে মনে করে। কঠিন বাস্তবের মোকাবিলা করতে পারে না। তখন তার মনে হয় ভুল করেছে কারও সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে না। যেন না ঘরকা না ঘাটকা। আবার অনেকে গোপন জীবনযাপন করলেও নিজে এই ব্যবস্থার কুপ্রথাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে বেরিয়ে আসতে পারে না। এদের অনেকের মধ্যে অসংযত বেপরোয়া জীবন যাপনের ধরণ দেখা যায়। ছেলেদের মধ্যে পুরুষতন্ত্র কাজ করে। এটা রীতা আদিবাসী সমাজে গরিব মানুষের মধ্যেও দেখেছে যেখানে মেয়েরা জীবিকার জন্য মাঠে কলে কারখানায় কাজ করে। আর এটা মধ্যবিত্ত শহরে ছেলেদের মধ্যে দেখা যায়। পার্টি জীবনের সুস্থ জীবনযাপনের অনুশীলনের অভাবে এটা ব্যাপক। এর ফলে মুখে বিপ্লবী হলেও নারীপুরুষের সম্পর্কে ব্যাপারে তার ঘাটতি দেখা যায়। পরস্পর সহনশীলতা শ্রদ্ধার অভাবের জন্য সম্পর্কটা অনেকের ক্ষেত্রে ভঙ্গুর হয়। এর ফলে সম্পর্কটা বেশিদিন টেকে না। রীতার কাছে এটা চিন্তার। সুব্রতকে আদর্শ ছেলে মনে হলেও ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়ে রীতার দুশ্চিন্তা। সে মনে করে এই সমস্যা সমাধানের উপায় ব্যক্তিজীবনে নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া যেটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। যাই হোক নিশ্চয়তার পূর্বশর্ত দিয়ে কোন সম্পর্ক গড়া যায় না সেটা রীতা বোঝে। তাও তার ভেতর দ্বন্দ্ব। অবশ্য বাবা মায়ের মধ্যেকার আদর্শ সম্পর্কটা তাদের বিপ্লবী জীবনে ভাঁটা আর জোয়ারেও কিরকম অটুট ছিল সেটাও রীতা দেখেছে।

ভারতে এখন একটা চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী দল ক্ষমতায়। দেশের মধ্যে তারা ঘোর হিন্দুত্ববাদী। মুসলমান বিদ্বেষী। আবার মুসলমান সমাজের মৌলবাদীদের মুসলমান সমাজে কর্তৃত্ব। তাই ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভাজিত রাখার কাজকর্ম ভয়ঙ্কর মাত্রা পেয়েছে যা আবার ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের শর্ত তৈরি না করে! আবার বর্ণবাদ দেশকে ক্ষত বিক্ষত করে রেখেছে। গরিব নিম্ন বর্ণের মানুষ এর শিকার।  গরিব বড়লোকের মধ্যে শ্রেণীবিভাজন ছাড়াও ধর্ম বর্ণে মানুষে মানুষে বিভাজনটা ভারতে শ্রেনিযুদ্ধকে জটিল এক রূপ দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বায়নের কর্মসূচিকে কার্যকরী করতে তাকে ত্বরান্তিত করতে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক স্তরে বৃহৎ শক্তির কাছে দায় বদ্ধ। সেজন্যই সরকার আজ করোনা কালকে সামনে রেখে তার আড়ালে তথাকথিত সংস্কারের কাজকে ত্বরান্বিত করে চলেছে। বেসরকারিকরণ সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা শিল্প ব্যাংক ইন্সুরেন্স খনি শিক্ষা স্বাস্থ্য সবই বেসরকারি হাতে বিকিয়ে দিচ্ছে। বিদেশি সংস্থার অনুপ্রবেশ অবাধ হয়েছে। বিদেশি পুঁজি অবাধে ঢুকে চলেছে। এর সংগে ভোগবাদের অবাধ বিস্তৃতি। ইতিমধ্যে শ্রম আইন বদল হয়েছে নতুন কৃষিআইন ঘোষিত হয়েছে যা নিয়ে কৃষক আন্দোলন ছমাস ধরে অব্যাহত। সব মিলিয়ে অবস্থা জটিল। অথচ সত্যিকারের বাম আন্দোলন বহুদা বিভক্ত। একটা চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে আর্থ সামাজিক জীবনে।

এই সংকটের মধ্যে রিঙ্কুরা নেমেছে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে। রাষ্ট্রের কড়া নজর যেন এই আন্দোলন সমাজতন্ত্র লড়াইয়ের আন্দোলনের সঙ্গে কোনরকমে যুক্ত না হতে পারে। অথচ শেষ বিচারে এই আন্দোলনের সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়াটা যেন আজ পৃথিবীজুড়ে একটা অনিবার্যতা হয়ে দাঁড়াতে চলেছে যা সমাজতন্ত্রের আন্দোলনকে একটা ভিন্ন মাত্রা দেয়। পরিবেশের আন্দোলন দাবি জানায় প্রযুক্তির উন্নতিকে সঠিকখাতে বইয়ে নিয়ে যাওয়া যাতে পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়নের ফসল সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এটা আর কিছু সৌখিন মানুষের সখের আন্দোলন থাকতে পারে না। এই আন্দোলন নয়া উদারনীতিবাদকে অস্বীকার করে শেষ বিচারে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দেশপ্রেমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশের সম্পদ লুঠের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন। যেখানে বৃহত্তর বামআন্দোলন নতুন ভাবে বৃহত্তর জোটের মাধ্যমে গড়ে ওঠার শর্ত তৈরী হয়েছে। তাই পরিবেশ আন্দোলনকে কর্পোরেট দুনিয়া আজ কুনজরে দেখছে। তাদের ওপরও রাষ্ট্রের বল প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে।

হঠাৎ এক বিপত্তি আজ সারা বিশ্বজুড়ে। করোনার আক্রমণ। মানুষের আর্থসামাজিক জীবন তছনছ করে দিয়েছে এই রোগ। এই সংকটকালে কর্পোরেট দুনিয়া ফায়দা তুলে চলেছে। লকডাউন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিদান। সমাজ জীবনে এক বিচ্ছিন্নতার আবহ তৈরী হয়েছে, পারস্পরিক অস্পৃশ্যতা অথচ রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে হাতে গোনা ব্যবস্থা। অসংখ্য রুগী। বেসরকারি হাসপাতাল নার্সিং হোম হয়ে উঠেছে লুঠেরার রাজত্ব। আর রাষ্ট্র নিয়ে চলেছে একের পরে এক সংস্কার কর্মসূচী। সরকারি সংস্থা বিক্রি করে দিচ্ছে। খুচরো বাজার থেকে জল জমি জঙ্গল কৃষি সবক্ষেত্রে বেসরকারি বিশেষ করে বিদেশি সংস্থার অবাধ লুঠের অধিকার স্বীকৃত। কৃষি সংস্কারের নামে কৃষি জমি থেকে ফসল, ফসল নিয়ে ব্যবসা সবেতেই কর্পোরেট দুনিয়ার আধিপত্য স্থাপিত হয়ে চলেছে। প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে কর্পোরেট দুনিয়ার আধিপত্য। ছোট ছোট ব্যবসায়ী উৎপাদকদের কর্পোরেটদের দাস বানানো হচ্ছে। উঠে যাচ্ছে ছোট ব্যবসায়ীদের দিন মজুরদের ন্যূনতম জীবন যাপনের সুযোগ। এরই মধ্যে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী উত্থান। গ্রামীন স্বার্থ গোষ্ঠীর সাথে শিল্প কর্পোরেট স্বার্থ গোষ্ঠীর  বিরোধ। রাষ্ট্র কর্পোরেট স্বার্থ গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে গরিব মানুষের জীবিকা দেশের স্বার্থ যা আজের পুঁজিবাদের প্রবক্তা নয়াউদারনীতিবিদরা অস্বীকার করে।

রন্টুরা ভাবে এটাই সময়। সব আন্দোলনকে একটা ধারায় বইয়ে দেওয়ার সময়। সবার জন্যই এই সংঘর্ষের ময়দান আজ এক মহামিলন প্রাঙ্গণ। তবে রাষ্ট্রের আক্রমণ আর শুধু মাওবাদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ও ভাবে দিদির মেয়ে কঙ্কা কি ভাবছে। ওর তো পাত্তা নেই। সেই যে গেছে! আজকাল বাড়িতে ফেরে না। রিঙ্কু খুব চিন্তিত। এই সেদিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে এনকউন্টারে কয়েকজন মারা গেছে। সুব্রত ধরা পড়ে জেলে। কঙ্কার কথা ভেবে ও বিমর্ষ হয়ে পড়ে। ভাবে কি জানি কঙ্কার কি হয়? ও ভাবতে পারে না যে আজ নয় কাল নিজেও ও একই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে।

ভারতের কৃষক আন্দোলন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। সারা ভারতে তা ছড়িয়ে পড়েছে। শ্রেণীসংগ্রামে যুক্ত বামপন্থী দলগুলো পরিবেশবিদ দেশপ্রেমিক শক্তিগুলো একজোট হয়ে একে সমর্থন জানাচ্ছে। এটা এক ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ পেয়েছে। এটা সত্যি যে এর নেতৃত্বে দিচ্ছে বড় বড় জমির মালিক এমনকি গ্রামীন ফসল  ব্যবসায়ী মধ্যসত্ত্বাভোগীরা। কিন্তু এর অভিমুখ যেহেতু বিশ্বের বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা, কর্পোরেট মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যবসায়ী আর তাদের তাবেদার ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাই তা এত ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছে। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষজনের কাছে একে সমর্থন করা বলতে গেলে বাধ্যবাধকতা। আর বামপন্থীদের এই সুযোগে সংগঠন গড়ে তুলে নেতৃত্ব দিতে তৈরি থাকা দরকার। এই ভাবনা থেকে রিঙ্কুরা এই আন্দোলনের সমর্থক হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে একে কেন্দ্র করে যে মঞ্চ গড়ে ওঠে তার সঙ্গে থেকে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এদের উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে আজ রাষ্ট্র যে কি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সেটা উন্মোচিত হয় পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের ময়দানে গরিব মানুষদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালনার ঘটনায়। আর এর সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপটা ধরা পড়ে।

একদিকে নির্বাচন অন্যদিকে তারই মধ্যে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সমাবেশের ডাক। জমায়েতে খুব ভালো সারা। কেন্দ্রীয় বাহিনী রুট মার্চ করছে। তারা এই অবস্থায় জমায়েতের বিরোধিতা করে। বাধা দিতে থাকে। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। জমায়েতে রন্টুরা আছে। বাধাকে উপেক্ষা করে বক্তব্য রাখা শুরু হয়। আধাবাহিনী একটু একটু করে আগ্রাসন বাড়াতে থাকে। লাঠি চার্জ দিয়ে নিষ্ক্রিয় মৌখিক বাধাকে  সক্রিয় সরব করে তোলা হয়। জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলা শুরু হয়। বাহিনী কাঁদুনে গ্যাস ছোড়া শুরু করে। জনতা কিছুটা ছত্র ভঙ্গ হতে থাকে। কেউ কেউ সে গ্যাসের বুলেট ধরে তা পাল্টা জোয়ানদের দিকে নিক্ষেপ করে। নিরস্ত্র জনতার সঙ্গে সশস্ত্র রক্ষীবাহিনীর এক অসম পথযুদ্ধ। যে কোন আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই অসম যুদ্ধের সাক্ষী আমাদের প্রতিটি রাজপথ দেশের আনাচে কানাচে সেই সুদূর অতীত থেকে বিশেষ করে ব্রিটিশ আমল থেকে। গত শতাব্দীর ষাট সত্তর দশকে এটা নিয়মিত হত। অনেকদিন পর আবার। যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা জানে এরপর কি অপেক্ষা করছে। তাই ঘটনা পরম্পরায় ঘটল। বাহিনী এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। গুলিতে মারা যায় চারজন। আহত অনেকে। রিঙ্কুর মত কয়েকজন ধরা পড়ে। খুব দ্রুত খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। তার সঙ্গে কিছু যোগ হয়ে সরকারি প্রতিবেদনে যা দাঁড়ায় তা হলো:

৫ ই এপ্রিল ২০২১ সালে এক অবৈধ সশস্ত্র জমায়েতকে সৈন্যবাহিনী শান্তিপূর্ণভাবে নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করে। কিন্তু অবাধ্য জনতা মারমূখী হয়ে ওঠে। গুলি চালায়। আত্মরক্ষায় আধাসেনা পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয়। গুলিতে জনা চারেক মারা যায়। আধাসেনামাহিনীর সাত আটজন গুরুতর আহত।

এ হল সেই পরিচিত বয়ান। পুলিশ হেফাজত থেকে বের করে গুলি করে মারা হোক আর জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি করে মারা হোক। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির এদিক ওদিক হয় না। গতে বাঁধা পুলিশ মিলিটারি জনতার আচরণ আর সাংবাদ মাধ্যমে খবর।

রিঙ্কু থানার লক আপ হয়ে গেল জেল হাজতে। জেলে বসে ওর কঙ্কার কথা মনে পড়ে। ও একদিন তর্ক শেষে বলেছিল:

দেখ রিঙ্কু পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনে যতই নিশ্চিন্ত থাক সশস্ত্র লড়াইয়ের পথে না গিয়ে যতই গণতন্ত্র অহিংসার মহিমা কীর্তন করিস না কেন রাষ্ট্র কিছুদিন সেটা মেনে নিলেও যখন নিজের আঁতে ঘা লাগবে তখন কিন্তু সহ্য করবে না। রাষ্ট্রের সন্ত্রাস থেকে কেউ বাদ পড়বে না।

রিঙ্কু ভাগ্নি কঙ্কাকে আজ অস্বীকার করতে পারে না। তাই বলে গেরিলা লড়াই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একমাত্র পথ সেটা সে আজও মেনে নিতে পারে না। সে যে এমন হতে পারে ভাবে নি তা নয়। তবে গণআন্দোলন ছেড়ে গেলে জনগণকে সক্রিয় প্রতিরোধে সামিল করা যায় না। তাদের সঙ্গে না নিয়ে যুদ্ধে এগোন যায় না। আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করার সুযোগটা নেওয়া চলে। আজ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকেজো করে সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে রাষ্ট্রের কাজ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বাড়ছে। সেটা ফ্যাসিসম। ফ্যাসিবাদকে রুখতে ব্যাপক মানুষকে সক্রিয় করে এ যুদ্ধে সামিল করা বিপ্লবের অঙ্গ। এতে মানুষ বাস্তব থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। জনমত তৈরী হয়। মিথ্যে প্রচারের মোকাবিলা করা যায়। তাই লড়াইয়ের অন্যান্য রূপগুলোকে বুঝে নিতে হয় তার সুযোগ নিতে হয়। তবে শেষ বিচারে শ্রেণী লড়াইটা নির্ধারক যার সঙ্গে অন্য লড়াইগুলোকে মেলাতে হয়।

প্রতি রবিবারের মত রিঙ্কুর স্ত্রী আর রীতাও সাক্ষাৎ নিতে আসে ঠিক বিকেল চারটেতে। জালের এপার আর ওপার। দুপক্ষের মধ্যে কথোপকথন। আজও ওরা এসেছে। নানা কথার ফাঁকে রীতা একটা কাগজ রিঙ্কুর হাতে গুঁজে দেয়। কিছুক্ষণ কথা বলে আজকের মত সাক্ষাৎকার শেষ। রীতারা বিদায় নেয় আর রিঙ্কু ওয়ার্ডে ফেরে। ওর মন ছটপট করছে রীতার দেওয়া কাগজটায় কি আছে দেখার জন্য। কে কি লিখলো। কিন্তু তার জন্য  নিরালা চাই।

ওয়ার্ডে ফিরে সবার সঙ্গে চা খেয়ে রিঙ্কু প্রলয়কে নিয়ে একটু আলাদা হয়ে বসে। প্রলয় ওর লড়াইয়ের সাথী। একসঙ্গে ধরা পড়েছে। ওর সঙ্গে কোন গোপনীয়তা থাকে না। কাগজটা খুলে দেখে একটা চিঠি। কঙ্কার লেখা। রিঙ্কুর উৎসাহে উগ্রতা বাড়ে। সে চিঠিটা পড়তে থাকে একটু জোরে যেন প্রলয় শুনতে পায়। কঙ্কা লিখেছে:

প্রিয় মামা,

জানলাম তুমি ধরা পড়েছ। জল্লাদদের গুলিতে চারজন সাথীকে হারিয়েছ। এটা আমাদের এখানে আজ প্রায় রোজের ঘটনা। জানোনা হয়তো আমিও বেশ কিছুদিন হল তোমার থেকে অনেক দূরে রাইপুর জেলে বন্দী। মা মাত্র জেনেছে। দুদিন আগে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে। সেই সুযোগে আমি চিঠিটা পাঠাচ্ছি। তোমাকে অনেক কিছু বলার ছিল। এখানে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের এমন কিছু শিখতে সাহায্য করেছে যা নিয়ে আমাদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক হত। আমার ধারণা আমাদের এই অভিজ্ঞতা আর আজের লড়াইয়ে তোমার অভিজ্ঞতা  ভাবনার জগতে আমাদের কাছে টানতে সাহায্য করবে। আমাদের লড়াইয়ে একে অপরের সাথী হতে পারব। তাই এই চিঠি লেখার তাগিদ।

আমরা আজ গণআন্দোলনের গুরুত্বটা আরও বেশি করে বুঝছি। গণ আন্দোলন আমরা চাই বা না চাই মানুষ চালিয়ে যায় কারণ তাদের অভিজ্ঞতাই গণআন্দোলনের প্রয়োজন তাদের বুঝিয়েছে। তবে গণআন্দোলনকে সশস্ত্র লড়াইয়ের পরিপূরক হিসেবে দেখতে হয়। অস্ত্র সমর্পণ করে গণ আন্দোলন দিশা হারায়। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের চক্রজালে জড়িয়ে যায়। এর থেকে শিক্ষা এই যে গেরিলাযুদ্ধ সশস্ত্র লড়াইয়ের একমাত্র রূপ নয়। বিশেষ অবস্থায় তা সর্বোচ্চ রূপ হতে পারে। সে নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার। আর আজকের নয়াউদার্নীতিবাদের যুগে পুঁজিবাদের যে কদর্য রূপ তার বিরুদ্ধে তোমাদের মত পরিবেশবিদরা যেমন লড়ছে তেমনি দেশপ্রেমিক শক্তিও লড়ছে। সেটাকে সন্মান দেওয়া উচিত যেটা আমরা দিই নি। তারাও তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বুঝবে এ লড়াইকে কোন খাতে বইয়ে নিয়ে যেতে হয়। সমাজতন্ত্র গঠনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? এর সঙ্গে ভোগবাদের সমস্যা আছে যেটার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে নিজের ব্যক্তি স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়তে হয় যেটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অঙ্গ। এ ছাড়া আছে রুটি রোজগারের লড়াই যেটা কলে কারখানায় ক্ষেত খামারে আবহমানকাল ধরে মানুষের লড়াই। সেখানে গণআন্দোলনের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। আজ প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশের দরুন উৎপাদন প্রণালীতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শিল্প কাঠামো বদলেছে। দৈহিক শ্রমের ওপর এই প্রযুক্তির প্রভাবটা বিশেষ অনুধাবনের বিষয়।এটা লড়াইয়ের পথ নির্ধারণে কি ভূমিকা পালন করে সেটা ভেবে দেখতে হয়। এই প্রযুক্তির উন্নতি মানুষের মননে এক অবিশ্বাস্য প্রভাব ফেলছে। আর এর অপব্যবহার সমাজের সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তথাকথিত সভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। একই সঙ্গে ভোগবাদকে মদত করছে। সমাজের অসম বন্টন জীবন জীবিকামর সুযোগে কুঠারাঘাত করছে। ফলে বিত্তশালী অনেকেও এর বিরুদ্ধে লড়াইটা চাইছে। সেদিক থেকে লড়াইয়ের ফ্রন্ট ব্যাপকতা লাভ করছে। শ্রেণীর লড়াইয়ের সাথে একে কিভাবে যুক্ত করা যায় সেটা ভাবা দরকার। এই উদ্ভূত প্রশ্নগুলোর সঠিক সমাধানের ওপর আগামীদিনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের শর্ত নির্ভর করছে। লড়াই ত্যাগ করে নয় আরো তাকে আঁকড়ে ধরে সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব বলে মনে হয়। এছাড়া নেতৃত্বের প্রতি নিঃস্বর্ত আনুগত্য বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারি না। এর থেকে এক ধরণের স্বেচ্ছাচারিতাকে মদত দেওয়া হয়। নেতৃত্ব ভুল করলে সেটা তুলে ধরার সুযোগ পার্টির মধ্যে থাকে না। কেন্দ্রিকতার ঝোঁক বাড়ে। পার্টির ওপরের তলার সঙ্গে নিচের তলার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা অস্বীকৃত হয়।

সবশেষে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভিত্তিক একটা শিক্ষা তুলে ধরছি যার সমাধান খুব কঠিন অথচ একটা গোপন বেআইনি দলের পক্ষে খুব জরুরি। প্রথমেই বলি সুব্রতর সংগে আমার আর পুরোন সম্পর্কটা নেই। রাজনৈতিক জীবনে ওর ত্যাগ স্বীকারকে শ্রদ্ধা জানিয়েও বলছি ব্যক্তিজীবনে ওর ভাবনা আর কাজকে আমি ঠিক বলে মনে করি না বলে আজ আমাকে ওর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কটা অস্বীকার করতে হচ্ছে। ওর আচার ব্যবহারে  আমার মনে হয়েছে মননের দিক থেকে পুরুষতন্ত্রের ছায়া যা ওর মধ্যে আমি দেখি। দুজনের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর দায়বদ্ধতা দুজনের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধনটা বজায় রাখতে পারে। তাছাড়া পার্টিকে না জানিয়ে আমাকে না জানিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটা প্রবণতা ওর মধ্যে। এর থেকে আমার মনে হয়েছে বিপ্লবী কর্মীদের নিজের বিরুদ্ধে নিজের লড়াইটা একটা বিরামহীন সংগ্রাম।আত্মলালসা আত্মস্বার্থ ত্যাগ করতে না পারলে বিপ্লবী থাকা যায় না। যাক সেটা নিয়ে দেখা হলে কথা হবে। ভালো থাকিস। একদিন মুক্ত আকাশের নীচে দেখা হবে।

প্রণাম জেনো 

 কংকা

রিঙ্কুর মনে হল কয়েকদিনের মধ্যে এই সেদিনের কঙ্কা কত বড় হয়ে গেছে। ওর চিন্তা ভাবনা এখন অনেক পরিণত। ও যে শুধু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বললো তা নয় রিংকুকেও তার অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে সাহায্য করল। ওর দাদু সুহাসবাবু দিদা কাজল আর মা রীতার অভিজ্ঞতা যেন তৃতীয় প্রজন্মে মিলে এক নতুন দিশা হয়ে উঠেছে যা এ লড়াইয়ের বহমানতা। একই সূত্রে গাঁথা।


মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩