Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গ্রন্থ-আলোচনা ।। সুন্দরবন ও পোর্ট ক‍্যানিংয়ের উপর উজ্জ্বল এক গ্রন্থ ।। অরবিন্দ পুরকাইত


সুন্দরবন ও পোর্ট ক‍্যানিংয়ের উপর উজ্জ্বল এক গ্রন্থ

অরবিন্দ পুরকাইত


একাধারে ভয়ঙ্কর ও সুন্দরের সহবাস সে দেশে। নদী-নালা-খাড়ির বিবিধ জলাধারে মৃদু লহর থেকে বিপুল তরঙ্গাভিঘাত। নোনা জলমাটিজোড়া 'নানান বরুনে' গাছগাছালির বিচিত্র সম্ভার। আর সেই জলেই কুমীর, সেই ডাঙাতেই বাঘ! জল-জঙ্গলজোড়া অবাধ বিচরণের তাদের সে রাজ‍্যে কোন সুদূর কাল থেকে উভয় সঙ্কট সাব‍্যস্ত করেই প্রায়-উভচর যাপন করে আসছে প্রকৃতির প্রভূতমান‍্য সম্ভ্রান্ত সন্তান। সুদূর সুউচ্চ গিরিরাজ থেকে উপলব‍্যথিত বিচিত্রছন্দ পথচলায় স্বাদু জলসম্পদের সঙ্গে মাটি-পাথর-কাঠ-ঘাস-পাতা, পাপ-পুণ্য, কৃষ্টি কতকিছুই না ঢেলেছে জাহ্নবী তার সাগর-মিলনের মোহনায়! ভারবহ দীর্ঘ যাত্রাশেষে মিলনের অন্তিম ক্লান্তিতে কতদূর বিস্তারে মেলে দিয়ে নিজেকে নিরস্ত করেছে সে! সে মিলনের সম্পন্ন ফসল ছড়িয়ে রয়ে গেছে আজও কতদূর! সুবিস্তৃত জল-ডাঙার সে এক বিচিত্র বিস্ময়কর রহস‍্যঘন চিত্রশালা! সে বিষয়-বিস্ময়ের টানে এসেছে কত না মানুষ, রচিত হয়েছে কত না কাব‍্য-কাহিনি, এসেছে সারা পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বমূলক শ্রেষ্ঠ সংস্থা থেকে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত স্বীকৃতি। কত নামে বিরাজিত সে সুন্দরবন! এক-এক নামের এক-এক উৎস-বাখ‍্যা-টীকা-ভাষ‍্য। আমরা তার চৌহদ্দিকে আমাদের স্বার্থে সীমিত করে এনেছি, আনছি। নির্মাণ-ধ্বংসের দীর্ঘ বিচিত্র লীলার মধ্যেও সে কিন্তু আজও কম সচেষ্ট নয় ঝড়-ঝঞ্ঝায় তার অধিষ্ঠানক্ষেত্রকে আগলে রাখতে, এমনকি কালে গর্বিত মহানগর-নামধারী অংশটিকেও।
       সুন্দরবন নিয়ে লেখাজোখা নিতান্ত কম নয়। কাব‍্য-কাহিনি তো আছেই, নিতান্ত সুন্দরবনকেন্দ্রিক আলোচনার বৃত্তটিও কম সমৃদ্ধ নয়। খুচরো থেকে বৃহৎ সেসব আলোচনার মধ্যে নেহাত কম নয় চর্বিতচর্বনও। সমৃদ্ধ বৃহৎ পূর্ণাঙ্গ আলোচনার পরিসরে পূর্ণেন্দু ঘোষের 'ইতিহাসের আলোকে সুন্দরবন ও পোর্ট ক‍্যানিং' বইটি এক অন‍্যতম ব‍্যতিক্রমী সংযোজন।

       সুন্দরবন নিয়ে লেখাজোখার জগতে উজ্জ্বল এই সংযোজনাটি সুন্দরবনের উপর নিছক কোনো অ্যাকাডেমিক বই নয়। বইটির সমৃদ্ধি তার দ্বিবিধ চরিত্রে – খানিক অ্যাকাডেমিক তো অবশ্যই, আর অনেকখানি প্রত‍্যক্ষ সংশ্রব-সংযোগসম্ভূত। পাথুরে প্রমাণ থেকে পুরাণকাহিনি, দলিল-দস্তাবেজ, বইপত্র থেকে কাহিনি-কিংবদন্তি, লোকশ্রুতি-লোকবিশ্বাস, আজন্মের আপন নিবিড় অভিজ্ঞতা থেকে সহযোগীদের স্মৃতি ইত্যাদি অজস্র উপাদান ভূমিকা গ্রহণ করেছে বইটির গড়ে-ওঠার পিছনে। বলতে গেলে, সুন্দরবনের 'সুসমৃদ্ধ ঐতিহ‍্যময় ইতিহাস' থেকে 'সঠিক ভূগোল'-এর অনুসন্ধান-প্রচেষ্টা যেমন এ বইয়ে, তেমনই বৃহত্তর সেই সুন্দরবনকে পটভূমে রেখে তার অন‍্যতম প্রধান কেন্দ্রটিকে নিয়ে অষ্টাদশ-অধ‍্যায় মহাক‍্যানিং রচনা করেছেন শ্রী ঘোষ ছয় শতাধিক পৃষ্ঠাজুড়ে।

       পায়ের তলায় সর্ষে নিশপিশ করে এ-বইয়ের লেখকের। ঘটনাবহুল উদ্দাম কৈশোর-যৌবনের মানুষটি সুন্দরবনের গহন এলাকায় চলে যান মনের খোরাক পেতে, চলে যান অচেনা জনপদ, পল্লির প্রান্ত‍র, বাউলের আখড়ায়। কম বিচিত্র নয় তাঁর জীবন ও পেশা। মাতলা নদীতে কাঁকড়া ধ‍রেছেন। তালা সারানো থেকে ক‍রেছেন স্টেশনে হকারির কাজ। সাইনবোর্ড লেখা, মাটির ঠাকুর গড়া, কিশোর পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে চাক‍রি, পু্রোনো বইয়ের ব‍্যাবসা। মাঝে রাজনীতি ক‍রেছেন, করেছেন শরীরচর্চা। তিনি গল্পকার। প্রবন্ধ লেখেন ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি নিয়ে। রানার, আবাদের দিন ও কথানক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনায়।

       সুন্দরবনের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, নদনদী, নদী-নালাসম্ভূত শব্দভাণ্ডার, পোর্ট ক‍্যানিংয়ের প্রয়োজন উপলব্ধি থেকে তার গড়ে ওঠা, তার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা, তার গুরুত্ব হ্রাস বিস্তৃতভাবে এসেছে আলোচ‍্য গ্রন্থে। ক‍্যানিংয়ের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, ধর্মমত, বরণীয় ব‍্যক্তিদের পরিচয়, গণ-আন্দোলন, সাহিত্য ও সাহিত‍্যিক, বাংলা সাহিত্যে মাতলা থেকে ক‍্যানিংয়ের উল্লেখ, সেখান থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা ও পত্রপত্রিকার সংগ্রহশালা, সাংবাদিকতার জগৎ, সেখানকার উৎসব-অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা ও নাট‍্যচর্চা এবং তৎসংশ্লিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রীর পরিচয়, শিক্ষা, বিদ‌্যালয়, পাঠাগার, রবীন্দ্রস্মৃতি, খেলাধুলা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, উদ্বাস্তু কলোনি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সালতামামি,  ইত্যাদি বহু কিছু তুলে ধরেছেন লেখক পরম যত্নে।
       বইটিতে তিনি সুন্দরবনকে প্রেক্ষিতে রেখে এক আধুনিক শহরের অভিধা অর্জনকারী ক‍্যানিংয়ের অতীতকে যেমন তুলে ধরেছেন (সঙ্গত প্রশ্ন তুলতে দ্বিধা করেন না লেখক যে গোড়াপত্তনের সত্তর-আশি বছরের মধ্যে সেখানে কোনো 'স্থায়ী বিদ‍্যালয় প্রতিষ্ঠান' গড়ে ওঠেনি, 'ফলে শিক্ষাশূন‍্য একটা শহরকে আধুনিক বলা যাবে কিনা এটাই বিবেচ‍্য বিষয়।' সে দীর্ঘ শিক্ষাশূন‍্যতার কারণও তুলে ধরেছেন), তেমনই বর্তমানের আছে এক অনুপুঙ্খ চিত্র। সে চিত্র কেন এবং তা কেমন রূপ লাভ করতে পারে, দৃষ্টান্ত হিসাবে তার খানিক আন্দাজ দেওয়া যেতে পারে মোট প্রায় শত পৃষ্ঠাজোড়া সপ্তম, অষ্টম ও নবম – এই তিনটি অধ‍্যায়ের শিরোনাম তুলে ধরে, যা যথাক্রমে এইরকম – ঘরবাড়ি, রাস্তা, সড়ক-পরিবহন, বাগান-দীঘি-জলপ্রকল্প ও চিকিৎসা ব‍্যবস্থা; বাজার, মৎস‍্য-বন্দর, জল-পরিবহন, নৌশিল্প ও পর্যটন; পৌর-সমীক্ষা ও বিবিধ। স্বাভাবিক কারণেই সেখানকার অফিস-আদালত, বাজার-দোকান, হাসপাতাল-নার্সিংহোম-ডাক্তার, কোচিং সেন্টার, কমিউনিটি হল, শরীরচর্চা কেন্দ্র থেকে সঙ্গীতশিক্ষা কেন্দ্র, সংঘ থেকে জেরক্স সেন্টার ইত‍্যাদির বিস্তৃত তালিকা-সমন্বিত সে চিত্র এতটাই অনুপুঙ্খ যে স্থানীয় মানুষজনের বাইরের পাঠকের কাছে ক্লান্তিকর ঠেকা অস্বাভাবিক নয়। পঠনকালে, তালিকার সব নাম পড়ার দরকার নেই এমন মাঝে মাঝে মনে হলেও, আলোচক হিসাবে সৎ থাকতে কোনো কিছু এড়িয়ে যায়নি বর্তমান আলোচক। বস্তুত যে তালিকা পরিশিষ্টে যাওয়ার কথা, উভয়েই সে-মাটির সন্তান হিসাবে বইটির লেখক এবং প্রকাশকের তাকে পরিশিষ্টে ঠেলে দিয়ে গৌণ গণ‍্য করতে সায় দেয়নি মন। লেখক নিজেই বলেছেন যে বইটি, 'নন্-অ্যাকাডেমিক ইতিহাস। একটু আলুথালু, একটু অগোছাল। হয়তো সুখপাঠ্য নয়।' বলা যেতে পারে যে সমকালীন সামগ্রিক চিত্র তুলে রাখাটাও যেখানে কাঙ্ক্ষিত, সেখানে সংশ্লিষ্ট অধ‍্যায়গুলোতে আলোচনা অংশটি দৃষ্টান্ত-সহ খানিক বর্ধিত আকারে রেখে, তালিকাকে পরিশিষ্টে পাঠানোই ভাল। বস্তুত পরিশিষ্ট কোনো হেলাফেলার জায়গা তো নয়, ঠিকমতো ব‍্যবহার করতে পারলে তা বইয়ের বক্তব্য, বিন‍্যাস, বিশ্বস্ততা ইত‍্যাদির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অনুসন্ধানী পাঠক বরাবরই সমাদর করবে তাকে। এ পুস্তকের অষ্টাদশ অধ‍্যায়ে ধৃত চারটি পরিশিষ্টেও (সচরাচর পরিশিষ্ট কোনো অধ‍্যায়ের অধীন হয় না অবশ্য) তার নজির বর্তমান, যেখানে জমির পুরোনো দলিল-অর্পণনামা, দেলকাব‍্য, যাত্রাপালার একাঙ্কী গান, সেবক সঙ্গীত, মন্ত্রতন্ত্র, গ্রামীণ সঙ্গীত রচয়িতা ও তাঁদের গান, কর্তাভজা গীত; ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত লেখকের 'লোকায়ত ঝাড়খণ্ডীয় সংস্কৃতি ও সুন্দরবন' শীর্ষক এক লেখা; বরুণদেব পাত্রের 'তেভাগা আন্দোলন (সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট)' এবং শেষেরটিতে – ইংরেজিতে – ১৯৫১-র জনগণনার ডিস্ট্রিক্ট হ‍্যান্ডবুক থেকে ক‍্যানিংয়ের অংশ এবং ১৮৮৯ সালের 'দি ক‍্যালকাটা রিভিউ' থেকে নেওয়া 'দি সুন্দরবনস্, ১৮৮৯', যার মধ্যে প্রথম পরিশিষ্টের তিনটি দলিল ও একটি অর্পণনামা বাদে বাকি অংশটি পুস্তকের মূল অংশে অনায়াসে স্থান করে নেওয়ার যোগ্য। বস্তুত পরিশিষ্ট অংশ ঠিকমতো ব‍্যবহার করতে পারলে এ পুস্তকের পৃষ্ঠা এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে মূল‍্যও হ্রাস পেতে পারত। 'নন্-অ্যাকাডেমিক' কি না সে প্রসঙ্গে বলা যায় যে কোনও গ্রন্থের নামের মধ্যেই যেখানে 'ইতিহাস' শব্দটি স্থান পায় এবং বিশেষত সে ইতিহাস যদি এমন স্থানীয় হয়েও বৃহত্তর ইতিহাসের সঙ্গে প্রত‍্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে তো তার পক্ষে পুরোপুরি নন-অ্যাকাডেমিক হওয়া বোধহয় কখনোই সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ গ্রন্থও পুরোপুরি অ্যাকাডেমিক লক্ষণবিমুক্ত নয়। কিন্তু অ্যাকাডেমিক লক্ষণকে ছাপিয়ে রয়েছে সে মাটির সন্তানরূপে এ গ্রন্থের গ্রন্থকারের সামগ্রিকভাবে একরকম সম্পৃক্ততার ঘ্রাণ, আত্মিক টান। আর তা ছিল বলেই অন‍্যান‍্য অনেক অংশের সঙ্গে সঙ্গে আমরা পাই 'গঞ্জের ফেরিওয়ালা ও ফেরিওয়ালার ডাক'-এর মতো মন-কেমনিয়া কলম! কথাটা তো শেষ অবধি এই যে, পাঠক কী পেলেন বইটি থেকে, পুস্তকের আটপৌরে চরিত্র সেখানে সবসময় খুব একটা বড় বাধা কিছু নয়। এই বই শেষ পর্যন্ত অতীতখননের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান অবলোকনের হাত ধরে ভবিষ‍্যতের কোনো রূপরেখা রচনায় সহায়কের ভূমিকা গ্রহণ করতে সক্ষম।

       এরই একান্ত পরিপূরক হিসাবেই যেন আসে লেখকের গ্রাম-পরিক্রমা – এ গ্রন্থের অন‍্যতম সম্পদ। বর্ধিষ্ণু আটাশটি গ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন লেখক। সে চিত্রে ধরা রয়েছে গ্রামবিশেষে তাদের নামের উৎস, চতুঃসীমা, প্রাচীনত্ব, ঐতিহাসিকতা, চকদার ও ভূস্বামী, জনসমাজ, রাস্তাঘাট, পানীয় জলের ব‍্যবস্থা, বিদ্যুৎ, জীবিকা, শিক্ষাব‍্যবস্থা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব‍্যবস্থা, দেবস্থান বা ধর্মীয় স্থান, লৌকিক দেবদেবী, পূজা-পার্বণ, মেলা, সংস্কৃতি, প্রবাদ-ছড়া, বিনোদন, হাটবাজার, সংঘ-সমিতি, খেলাধুলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার, ডাকঘর, ব‍্যাঙ্ক, যোগাযোগ ব‍্যবস্থা,  ব‍্যক্তিত্ব, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, কুটিরশিল্প, মন্দির-মসজিদ-গির্জা, কবরস্থান ইত্যাদি। এই ষোড়শ অধ‍্যায়টির শুরুতে বর্তমান আলোচকের এক অনুভবের কথা – পুরোপুরি পালন করা সম্ভব হোক আর না হোক – উচ্চারণের মাধ্যমে আলাদা করে ধন‍্যবাদার্হ হয়ে রইলেন লেখক। আগ্রহী পাঠকদের উদ্দেশে অনুরোধ রেখেছেন তিনি, 'এখন থেকে প্রত‍্যেকে যে যাঁর স্বগ্রামের ইতিহাস লিখে রাখুন।' সত্যি এমনটি হতে পারলে ইতিহাসের উপাদানের জন্যে অনেক সময় উদ্্ভ্রান্তের মতো অবস্থা হয় না অথবা ভিন্ন অর্থে 'চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে' দশা ঘটে না স্থানীয় ইতিহাস-ভূগোল, লোকজীবন-লোকসংস্কৃতি ইত্যাদির গবেষকদের। আর স্থানীয় বলা হচ্ছে যা কিছু, আদতে তো তা বৃহৎ ভূখণ্ডের সঙ্গেই অন্বিত, আর সেই হিসাবে দেশ বা রাষ্ট্র সেই স্থানিক বৃত্তান্ত-বৈশিষ্ট্যকে বাদ দিয়ে নয়। বরং তথাকথিত উক্ত স্থানীয় মাটি-মানুষের মাহাত্ম‍্যকে উপেক্ষা করে সমাজের আলোকিত বা বিত্তশালী অংশ কিংবা দেশ-নগর-শহরতলির শাসনসংক্রান্ত ঘটনাক্রমের উপর্যুপরি বিবরণ লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে কত হে অসম্পূর্ণ ইতিহাসের জন্ম দিয়ে চলেছি আমরা! কোনও কোনও খুব বয়স্ক/বয়স্কা কেউ প্রয়াত হলে বর্তমান আলোচকের অনেকসময় মনে হয় যে আসলে তা সমৃদ্ধ এক ইতিহাসেরই চিরপ্রস্থান।
       বইটির অসাধারণ একটি মুখবন্ধ রচনা করেছেন অসিতরঞ্জন চক্রবর্তী 'ভূমিকা নয়, কিছু কথা' শিরোনামে। আকছার ব‍্যবহৃত 'অসাধারণ' শব্দে হয়তো ঠিকঠাক বার্তাটি না-ও পৌঁছাতে পারে – এমন মুখবন্ধ বিরল। বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক-তাঁর বিদ‍্যার ব‍্যাপ্তি ও গভীরতায় বিস্মিত হতে হয়। বইটি প্রসঙ্গে শ্রী চক্রবর্তীর এ বক্তব্য অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য, 'এ বই ইতিহাসের, বাংলার ইতিহাসের, ভারতের ইতিহাসের একটি বেসিক বুক। এ বই পদ্ধতিগতভাবে ঐতিহাসিকদের সমস্ত গবেষণাগত উদ্ভাবিত পথে চলেও আবার নতুন দিগদর্শন দিয়েছে – এবং ভবিষ‍্যৎ গবেষকদেরও পথ দেখাবে। প্রথমে তাই বলব, এ বই প্রাচ‍্য পাশ্চাত্যের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি-ফিল পাওয়ার যোগ্য।' লেখকের 'প্রাক্্কথন' এবং প্রকাশক মৃত‍্যুঞ্জয় সেনের 'প্রকাশকের নিবেদন' অবশ্যই অনুধাবনযোগ‍্য। বেশ কিছু চিত্র, মানচিত্র বইটিকে আরও বেশি মূল্যবান ও প্রামাণিক করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক খ‍্যাতির অধিকারী হিরণ  মিত্রের প্রচ্ছদ বইটির মর্যাদা বাড়িয়েছে। গ্রন্থশেষে রয়েছে অধ‍্যায় ধরে ধরে স্বীকৃতিমূলক 'গ্রন্থপঞ্জি ও অন‍্যান‍্য'।
       বলা বাহুল্য, পুস্তকধৃত বিষয়বস্তুর নিরিখে এ আলোচনা নিতান্তই সংক্ষিপ্ত। এ পুস্তকে পাঠক আরও পাবেন পোর্ট ক‍্যানিংয়ের কলোনিয়াল চরিত্র, সেখানে আগত অনেক মানুষের শিকড়ের কথা, বহু বিশিষ্ট মানুষজনের ক‍্যানিংয়ে পদার্পণ ইত্যাদি অনেক কিছুই।
       ভাল লাগল দেখে যে, বিষয়বস্তুর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, 'ইতিহাসের সৌরভ দিয়ে সুন্দরবনকে যাঁরা আরও সুন্দরতর করে গেছেন' উল্লেখ করে গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তিনি জেলার তিন বিশিষ্ট ব‍্যক্তিত্ব প্রভাত ভট্টাচার্য, অমরকৃষ্ণ চক্রবর্তী ও এম এ জব্বারকে। বইয়ের কাগজ, ছাপা ও বাঁধাই ভাল।

       নগণ্য দু-একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করি। বৃষভানু কৃষ্ণভানু হয়ে গেছে (পৃষ্ঠা ১৮২)। ১৮৯ পৃষ্ঠার প্রথম তিন পঙ্্ক্তির পর অসম্পূর্ণতা রয়ে গেল কি? ২৪০ পাতায় উত্তীর্ণকারী-স্থলে উত্তীর্ণ হবে। ২৪২ পাতায় 'চলতি শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে...', হবে গত শতাব্দীর। অকুতভয়ী অকুতভয় হবে (২৬১)। একাধিক স্থানে সখ‍্যতা হয়ে গেছে, সখ্য হবে, পৈত্রিক হবে পৈতৃক। সৌজ‍ন‍্যতা (৩১৯) হবে সৌজন্য, সম্মানীয় (৩৭৬) হবে সম্মাননীয়। 'আগ্রহী পাঠকদের উদ্দেশ্যে করে অনুরোধ করব' (৩৯১), 'উদ্দেশে অনুরোধ'-ই যথেষ্ট ছিল। 'এর জন্য পূজার পূর্বদিন রাতের পান্তা ভাত করে রাখতে হয়।' (৩৯৭) – এ পঙ্্ক্তি সংশোধনযোগ্য। 'পুড়ে গরু চোপরায় দড়।/চাল কিনে খায় পালি বড়।।' (৪১৬) আমাদের এখানে 'কুড়ে গরু চোপায় দড়/মেয়ে খায় তার পালি বড়।' এখানে কুড়ে আসলে কুঁড়ে এবং মেয়ে মেঙে-রই উচ্চারণ। 'হাজারে ব‍্যাজার নি/শ'য়ে ভয় নি।।' 'সামিস‍্যে'টির বন্ধনীতে ব‍্যঞ্জনা দিয়েছেন লেখক, 'নির্ভীকতা বোঝাতে প্রবাদটি ব‍্যবহার করা হয়'। বিরক্তিহীনভাবে এমনকি ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটের মধ‍্যেও নির্বিকার, নির্বিবাদ থাকা বা কাজ করে যাওয়াকেও বোঝায় এটি। হাজার কথা শোনালেও যিনি ব‍্যাজার হন না। ৪২১ পাতার শেষে দুটি হাটের কোনটির কথা বলা হয়েছে তা উল্লেখ করে দিলে ভাল হত। পাঠকের ধরে নেওয়ার কথা শেষেরটি অর্থাৎ সাতমুখীর হাট। প্রথম উল্লেখযোগ্য মাধ‍্যমিক ছাত্রটির প্রাপ্ত নম্বরের ক্ষেত্রে (৪২২ পৃষ্ঠা) শিক্ষাবর্ষের উল্লেখ থাকলে ভাল হত। 'স্প্রিংয়ের বঁটির বাঁট/ও গোলাপি গোবর ঘাঁট।।' (৪৪৬) ছড়াটির প্রথম চরণ আমাদের এখানে 'এসক‍্যালান্টি বঁটির বাঁট'। এই চরণে ছড়ার ছন্দটিও সুচারু লাগে। ৪৭৮ পাতার খেলার ছড়ায় পাঁচ নম্বরে উল্লিখিত ছড়াটি যতদূর জানি তিনটি ছড়ার সমাহার – 'কুড়ি'য় বে' পর্যন্ত প্রথমটি, তার পর থেকে 'আই অ্যাম এ ডিস্কো ড‍্যান্সার' পর্যন্ত দ্বিতীয়টি এবং বাকি অংশ তৃতীয়টি। ৫২৬ পাতায় উল্লিখিত দেলনাচের শোভাযাত্রায় ধ্বনিত আওয়াজের একটিতে আছে 'শিব ঘরে দিয়ে বাতি / ফুল ফুটেচে নানা রতি/...।' আমাদের এখানে দ্বিতীয় চরণটি 'ফুল ফুটেচে নানা জাতি' – এতে অন্ত‍্যমিলটিও ভাল আরও।

       দীর্ঘ পরিশ্রম ও অধ‍্যবসায়ে পাঠকসমাজকে এমন একটি গ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্য হার্দিক অভিবাদন শ্রী ঘোষকে।
       এ জাতীয় বইয়ে একটি নির্ঘণ্ট অত্যন্ত কার্যকর, যার অভাববোধ করবে পাঠক।

 

               *           *           *

 


গ্রন্থের নাম – ইতিহাসের আলোকে সুন্দরবন ও পোর্ট ক‍্যানিং
গ্রন্থকারের নাম – পূর্ণেন্দু ঘোষ
প্রকাশকের নাম –  লোকসখা প্রকাশন
প্রকাশকাল – ২৫ জানুয়ারি ২০১৭ (১১ মাঘ ১৪২৩)
মূল্য – ৫০০ টাকা।

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩