স্মৃতিপটে মাস্টারমশাই
জীবন পাইক
আজ থেকে বছর চৌত্রিশ আগের কথা ৷ আমি তখন সবে মাত্র মাধ্যমিক পাশ করেছি ৷ গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা জীবন শহুরে পরিবেশে কেমন যেন বেসামাল হয়ে পড়ছিলাম৷
গ্রাম্য বিদ্যালয় থেকে একেবারে ভর্তি হলাম শহরের নামকরা কলেজে ৷দক্ষিণ কোলকাতার সিটি ক একাদশ শ্রেণির ছাত্র তখন আমি ৷ প্রথম পিরিয়ডে এলেন এক মাঝ বয়সী অধ্যা -পক ৷তাঁর কালো প্যান্টের উপরে ইন না করা সাদা জামা,কাঁধে ঝোলা ব্যাগ,মুখে পরিপাটি করে রাখা সাদা কালো দাড়ি এবং অসীম মমতায় কথা আমার অন্তরে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা বোধ গড়ে ওঠে ৷ আমি সে দিন তাঁর পাঠদানে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম ৷ আমি সেই থেকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ওনার কোন বাংলা পিরিয়ড করিনি এমন কখনো হয় নি ৷
উনি আর কেউ নন ৷আমার জীবন পথের দিশারী ,আমার স্বপ্নের শিক্ষক অধ্যাপক অরিজিৎ মিত্র ৷আজ উনি নেই ৷১২ইজানুয়ারি ওনার জন্ম দিবস ৷গভীর শ্রদ্ধায় ওনার ছবির সামনে আজ মাথা নত হয়ে আসে ৷
মন না চাইলে ও দুটো বছর পরে ওই কলেজ ছেড়ে চলে আসি আর্মহাস্ট স্ট্রীট সিটি কলেজে ৷অরিজিৎ মিত্র আমার মধ্যে যে মাতৃভাষার আগুন জ্বেলে দিয়েছেন তা আমি ত্যাগ করি কি করে ৷
তখন সিটি কলেজে আমাদের নাট্য সাহিত্য পড়াচ্ছেন অধ্যাপক ব্রাত্য ব্রত বসু (পঃবঃশিক্ষা মন্ত্রী)অর্থাৎ আমাদের বি.বি স্যার৷ কবিতায় এস .জি (শর্বরী ঘোষ)৷মাতৃভাষাকে ভালোবাসা যায় কিন্তু তার অতলান্তিক গভীরতা -য় আমি ক্রমশঃ দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম ৷
সে দিনে আমার মতো গরীব বস্তির অন্ধকার ঘরে স্বপ্নের সন্ধানে হাতড়ে হাতড়ে বাঁচা ছেলেটার টিউশন পড়ার খরচ জোগাড় করাটা বড়োই দুরুহ ব্যাপার ৷
আমি আশাবাদী প্রফেসর এ.মিত্র নিশ্চয়ই আমাকে বুঝবেন ৷
তাই সে দিন কোন দ্বিধা না করে স্যারের কাছে সরাসরি তাঁর স্টাফ রুমে হাজির হলাম ৷স্যারকে
প্রনাম করলাম ৷
স্যার এ.মিত্র আমাকে চিনতে পেরে বলেন,
বলো কেমন আছ?কি পড়ছো ?
সে দিন ওনাকে পড়াশোনা সংক্রান্ত সব কথা খুলে বললাম ৷
রসিক মানুষ তিনি ৷আমাকে উনি বললেন--
আমি তোমাকে খুব ভালো এক শিক্ষকের কাছে
পাঠাচ্ছি ৷ভালো হবে ৷ভালো রেজাল্ট করতে পারবে ৷
আমি তো নাছোড়বান্দা ৷বললাম,
----স্যার,যদি আপনার অসুবিধা না হয় তো আপনার কাছেই পড়ব ৷কলেজের পঠনপাঠন স্যারের সেদিন শেষ হয়েছিল ৷
উনি বললেন তোমার খুব তাড়া নেই তো?
আমি বললাম না স্যার ৷
এরপর সেদিন এ.মিত্র কে অনুসরণ করে এগিয়ে চললুম ৷স্যার বলতে বলতে যাচ্ছিলেন বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করছো ,অনেক অনেক বেশি তোমাকে পড়তে খেয়াল রেখো ৷
কথা বলতে বলতে উনি সেদিন আমাকে ওনার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন ৷
যেখানে আমার সহপাঠীরা অন্যান্য অধ্যাপক -দের কাছে পড়তো ৪০০টাকা ফিজ দিয়ে ৷জানি না কেন স্যার সেদিন আমাকে বললেন তোমাকে দিতে হবে না ৷টানা তিন বছর আমাকে অতি স্নেহে উনি পড়িয়েছেন ৷ শুধু আমাকে নয় ৷ আমার আগের ব্যাচের একটি ছেলে গরীব কিন্তু মেধাবী ৷পরিতোষ মন্ডল এ.মিত্র ওকে ও বিনা বেতনে পড়িয়েছেন ৷আজ ছেলেটা এক কলেজের অধ্যাপক ৷ওনার বাড়িতে আসার সময় এক ছাত্রী হঠাৎ রাস্তায় পড়ে গিয়ে পা কেটে যাওয়ায় ফোন করে বাড়িতেই ডাক্তার ডেকে আনেন ৷যতবার ওনার বাড়িতে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রী প্রয়োজনে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত ৷
স্যার বলতেন,ফেরার সময় সবাই মিলে ভালো করে খাওয়া দাওয়া করেই ফিরবে ৷ পকেট থেকে উনি বের করে দিতেন অনেক টাকা ৷
উনি সেদিন আমাদের পাশে ছিলেন বলেই
আজ আমরা কেউ স্কুলের শিক্ষক কিংবা কেউ কলেজের অধ্যাপক ৷প্রফেসর অরিজিৎ মিত্র আজ ও প্রতি পদে পদে আমাকে উজ্জীবিত করে থাকেন ৷তিনি আমার ধ্রুবতারা ৷আমার জীবন পথের দিশারী ৷
----------------------------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন