Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

ছোটোগল্প ।। মানবেতর জীবন আখ্যান ।। সৌমেন দেবনাথ

মানবেতর জীবন আখ্যান

সৌমেন দেবনাথ


এই না হলে বস্তী! ভোরের কিঞ্চিৎ আলো উঁকি মারার পূর্বেই বড়রা কাজ সেরে মোটামুটি নিশ্চিন্ত। ছোটরা এবার ব্যস্ত। সারি দিয়ে ট্রেন রাস্তার পাশে বসে পায়খানা করছে। পিছনে দুই চারটা কুকুর অপেক্ষায়। এই ট্রেন রাস্তার দুই পাশ দিয়ে ছিন্নমূল কিছু মানুষের বসবাস। 
লুঙ্গি, জামা কোনো রকমে পরে বদরুল বললো, আইজ্জা ফিররা যদি হুনছি তুই কাইজ্জা করছত, তয় তোর মাথার চুলডি ছিররা শাক রাইন্দা খামু।
ওর বৌ নীরব থাকার মানুষ না। জবাব দেয় বলেই মার খায়৷ সারাদিন কান্না করে, যাকে পায় তাকেই স্বামীর নিষ্ঠুরতার কথা শোনায়। আজ অবশ্য কিছু বললো না। শুধু বললো, দেইখা শুইনা রিসকা চালায়েন।
বদরুল রিক্সা নিয়ে বাজারে গেলো। আরো দশ পনেরটা রিক্সা চলে এসেছে। সেই তুলনায় যাত্রী নেই। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিক্সা নিয়ে ওরা। রিক্সাগুলো দেখতে সুন্দর ও রঙিন হলেও রিক্সাওয়ালাদের জীবন সুন্দর ও রঙিন নয়। ভরদিন হাড়ভাঙা খাটুনি। এই একটা পেশা যেখানে ফাঁকি চলে না। গন্তব্যে যাত্রী না পৌঁছে দেয়া অবধি কোনো বিশ্রাম চলে না। শহর আলীর পঞ্চাশটার বেশী রিক্সা আছে। তাঁরই কাছ থেকে বদরুল রিক্সা ভাড়া নিয়েছে। দৈনিক দুইশত টাকা ভাড়া দিতে হয়। এক যাত্রী বদরুলকে হাত ইশারা করে ডাকলেন, যাবি?
বদরুল বললো, যামু। তয় আপনি আমারে তুই কইয়া ডাক পাড়লেন? আপনার থেইক্কা কি আমি ছোডো?
যাত্রী রেগে বললেন, খাস তো রিক্সা টেনে। আবার সম্মান চাস? 
বদরুল কথা না বাড়িয়ে বললো, কই যাইবেন?
যাত্রী বললেন, নৈচাপুর।
বদরুল বললো, তিরিশ ট্যাকা লাগবো। তেল, চাইলের দাম বাড়ছে। 
যাত্রী বদরুলকে ঠাস করে এক চড় মেরে বললেন, আমার বেতন বেড়েছে?
বদরুলের মুখটা অন্ধকারে ভরে গেলো। রিক্সা চালায় বলে ও যেন মানুষই না। অন্যের হাতে মারও খায়। মুখ নিচু করে যাত্রীর দুটি ব্যাগ রিক্সায় তুললো আর বললো, কুলির কামও কইরা দেওয়ন লাগে, দুইডা ট্যাকা ধইরা দ্যান কি?
যাত্রী বললেন, অভাবে তোর স্বভাব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মুখ বন্ধ করে রিক্সা চালা।
নৈচাপুর এসে গামছা দিয়ে মুখ মুছলো বদরুল। নাক ঝাঁড়লো। হাফ ধরে গিয়েছে। ঘৃণায় যাত্রী ওর মুখের দিকে তাকালেনই না। কুড়ি টাকার একটা নোট বের করে দিলেন। টাকাটা ছেঁড়া। বদরুল বললো, বাই, ট্যাকাটা বদলাইয়া দ্যান।
যাত্রী রেগে গেলেন। বললেন, ভাই বললি ক্যান? আমাকে কি তোর ভাইয়ের মত মনে হচ্ছে? প্যান্ট, টাই, কোট দেখছিস না?
বদরুল মুখ নিচু করে থাকলো। লোকটি চলে গেলেন। সেখানে পরিচিত দুই তিনজন রিক্সাওয়ালা ছিলো। তারা কথা বলছে। বদরুল শুনছে। টিপু বললো, কত হইলো নায়ক বাই?
রাজ্জাক বললো, পাইচিলাম এক বেক্কল পাচেনজার, বিশ ট্যাকার জায়গায় আশি ট্যাকা লইচি।
আব্বাস বললো, মারছত। গলা কাটছত তার। তোগো লইগা বেবাক রিকসাওয়ালাগোর বদনাম রটে। হারাম খাইসনারে। আক্কাস, তোর খবর কী?
আক্কাস বললো, শৈলডা ভালা না। বল নাই রিসকা টাননের। গাছতলাত গুমাইচি। 
চুপ করে বদরুল সব শুনলো। সন্ধ্যা বেলা ঘরে ফিরে এলো। পাখিদের মত কিচিরমিচির করছে বস্তীর বাচ্চাগুলো। জরিমন বললো, আপনের বড় পোলারে আইজ্জা নইজা বুড়া মারছে। খেত থেইক্যা বলে কী কী চুরি করতাছিলো।
বদরুল রেগে বললো, মাইরা ফালাই না ক্যান? চিন্তা কমতো।
ছোট ছেলেটা গুড়গুড় করে মায়ের কোলে ঠেলে উঠে নিজের উদরপূর্তির সন্ধান করে। ছোটর বড়টাও কাছে এসে বায়না ধরে। মা বলে, বড় হইছত, খেলগা।
এমন সময় ওদের মাঝে নছিমন বিবি এলো। মনের জমিন বর্গা দিতে দিতে চেহারায় আর সেই আগের জৌলুস ভাব নেই। তাতে কি! সূর্য যতই আলো বিলাক তার কি আলোর ঘাটতি পড়ে! শারীরিক ছলাকলা দেখিয়ে দেখিয়ে প্রচুর কামাই রোজগার করছে৷ বদরুল একবার তাকিয়ে নজর ফিরিয়ে আবার তাকালো। অগ্নি দাহ্য বস্তুর অভাবে প্রজ্জ্বলিত হতে পারে না, নছিমন বিবি যেন বদরুলের সামনে সেই দাহ্য বস্তুই। তার বিকশিত সৌন্দর্য বদরুলের চোখ, নাক, কান, গালে দুলে দুলে যেন ছোবল মারলো। পান খাওয়া লাল ঠোঁট, জিহ্বা থেকে কথা বের হচ্ছে না, যেন অমৃত ঝরছে। বুকের বসন ঠিক নেই, ঠিক রাখেও না সে। এত কামগন্ধময় আর কামনাময় হয়ে নিজেকে প্রকাশ করছে, যে কারোরই রক্ত তার সংস্পর্শে টগবগ করবে।
নিজেকে সংবরণ করে বদরুল বললো, কিত্তে আইছত, বাইর হ্।
সে কথাতে কর্ণপাত না করে নছিমন বিবি বললো, শুকনা বৌয়ের দেহে কি সুখ পাস? যে গাছ দিনের পর দিন ফুল, ফল দিতাছে, তার মাঝে কি সৌন্দর্য আছে?
জরিমন ক্ষেপে গিয়ে বললো, তুই গেলি সামনে থেইক্কা?
নছিমন বিবি বললো, রাগোস ক্যান? কত পোলাপান পেটে ধরবি আর?
জরিমন বললো, যে আমার পেটের ভাত জোগায় তার সন্তান পেটে ধরি, তোর কী তাতে?
নছিমন বিবি হেসে বললো, মাইয়া দুইডা তো ডাগর হইয়া উঠছে, নজরে পড়ে। শাড়ি পরা শিখাবি না? দিয়া দে, লগে নিয়া যাই।
বদরুল দম করে দাঁড়িয়ে উঠে নছিমনকে বললো, বাইর হ্ বেশ্যা বেডি। বাইর হ্।
নছিমন বিবি উঠতে উঠতে বললো, শুকনা বৌয়ের হাড্ডির গুতায় মরবি, যাইস আমার কাছে, রসের কথা কমু।
জরিমন বললো, ঝাটা হাতে নিয়া বেহায়াডারে পিডায়ে দ্যান।
বদরুলকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে নছিমন চলে গেলো, দর কষাকষি লাগবো না, উপযুক্ত কড়িও দেওন লাগবো না। যাইস, বুকের জমিন দিমু, জল খাবার দিমু। কাঁথার তলে গরম চা খাওয়ামু।
বলেই একগাল হাসি দিতে দিতে চলে গেলো। ওষ্ঠপ্রান্তের ও হাসিতে কোনো মায়াবী ভাব নেই, চাতুরীতে ভরা।
পরদিন বদরুল রিক্সা নিয়ে বাজারে গেলো। কত শৌখিন মানুষ তার রিক্সায় উঠে, অথচ তার জীবন কত অবহেলার। একজন যাত্রী এলো। তিনজন রিক্সাওয়ালা তাকে ডাকছে। যাত্রী পড়ে গেছে বিপদে। শেষে বদরুলের রিক্সায় এসে উঠলো। বদরুল কেতুনগরের উদ্দেশ্য রিক্সার প্যাডেল মারতে শুরু করলো। যাত্রী বললো, আপনার জামাটা তো ছিঁড়ে গিয়েছে।
বদরুল বললো, শরীলডা হুদা ঘামে। কোনো জামা টিকে না। ট্যাকা নাই গাইটে। ছয় ছয়ডা পোলাপান। বাইত চাইল লইয়া গেলে তারা খাইবো।
যাত্রী বললো, এত বাচ্চা নিয়েছেন কেনো?
বদরুল চুপ থাকে। যাত্রী নামলেন। পঞ্চাশ টাকার নোট বের করেছেন। বদরুল বোকার মত চেয়ে বললো, ভাংতি নাই, বাই।
যাত্রী ভাঙিয়ে দেবে বলে ভীড়ের মধ্যে এক দোকানে গেলো, কিন্তু আর ফিরে এলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বদরুল বললো, আমার পেটে লাত্থি মারলেন এমনে?
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো বদরুলের। গাছতলায় বেশ কিছুক্ষণ মনমরা হয়ে ও বসে থাকলো।
সন্ধ্যায় এক যাত্রী জুটলো। বস্তীতে আসবে। ঘরে ফেরার সময় হয়ে গেছে, তাই এই যাত্রীকে পেয়ে খুব খুশী হলো বদরুল। বদরুল বললো, বস্তীতে আমার ঘর। আপনারে তো চিনলাম না!
যাত্রী ইতস্তত করলো কিছুক্ষণ। বুঝে গেছে বদরুল। বললো, নছিমনের কাছে যাইতাছেন? মাইনসে জানলে কলঙ্ক লাগবো না?
যাত্রী বললো, কাঁঠাল খাইলে আঠা লাগবো। আঠার ভয়ে কাঁঠাল খাওয়ন বন্ধ করে কেউ?
বদরুল আপন মনে রিক্সা টেনে চলে এলো। যাত্রী দুটো টাকা ধরে দিলো। বদরুল বললো, বেশী দ্যান ক্যান?
যাত্রী বললো, কাউরে কইয়ো না, বাইত গিয়া বৌয়ের লগেও কওনের দরকার নাই।
বদরুল মাথা নিচু করে ঘরে ফিরলো, পরিবেশটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারলো। ছেলে, মেয়ে নিয়ে বসবাস করা কঠিন হয়ে উঠবে ভেবে চিন্তিত হলো।
জরিমন খেতে দিলো। আর বললো, বস্তীতে নতুন নতুন বেডা মানুষ কোত্থেকে আয়ে?
বদরুল উত্তর না করে খাওয়া শেষ করতে ব্যস্ত হলো।
ঐ মুহূর্তে মশিউরের বৌ মরিচ নিতে এলো। কিন্তু মরিচ থাকলেও জরিমন দিলো না। বললো, নাই।
মশিউরের বৌ বললো, তোর ঘরে থাহে কি? রিকসা চালাইলে কি সংসার চলে?
বদরুল হিংস্র প্রাণীর মত চেয়ে বললো, তোর ভাতার মশিউরে কী করে? চারকি?
মশিউরের বৌর উত্তর করার আগেই জরিমন বললো, আমার ভাতারে রিকসা চালায়। রোজগার করে। তোর ভাতার তো তাস খেলে, গানজা খায়।
মশিউরের বৌ বললো, আমার সোয়ামী রাজনীতি করে। তাই বন্ধুগো লগে তাস খেলে, গানজা খায়। আমার ঘরে চাইল আছে, ট্যাকা আছে। আছে তোর?
জরিমন বললো, গরীব মাইনসের হক তোর ভাতার মাইরা কাইট্টা আনে। গোণ্ডাগিরি করে, মেম্বর সাবের চামচা।
মশিউরের বৌ বললো, বরো মাইনসোগো লগে মিশশা থাকলে হেইডা চামচা হয়রে হিংসুইটা?
বদরুল জরিমনকে থামতে বললো, জরিমন থামলো না। জরিমন ক্ষিপ্ত হয়ে মশিউরের বৌকে বললো, এত সুকের সংসার, মরিচ নিতে আইচত ক্যান?
মশিউরের বৌ বললো, বদু বাই, দেখচেন আপনের বৌ কেমনে আমার লগে কাইজ্জা করে?
বদরুল জরিমনকে চুপ থাকতে বললো, জরিমন সে কথায় কান না পেতে বললো, আমার সোয়ামীর কাছো আবার নালিশ দ্যাস? এই মুখপোড়া বেডা, আপনের সামনে আপনার বৌরে যাচ্ছেতাই কইতাছে, হুনতাছেন না?
বদরুল ভাত খাওয়া বন্ধ করে বৌর চুলের গোছা ধরে বললো, কাইজ্জা করস ক্যান? খাইয়া কি তর হুদা কাইজ্জা করনের কাম?
মশিউরের বৌ বললো, বদু বাই, বেডির থোতাত মারেন। বেবাক মাইনসের লগে হেইতে লাগে। পোলাপানডির খোঁজ রাহে না।
যতক্ষণ পারলো মরণপ্রায় বৌটাকে মারলো বদরুল। তখন নছিমন বিবি এলো। এসেই বললো, বুঝিরে বদু, তোর মনের জ্বালা। তোর যৌবন থাকতে তোর বৌ হইয়া গেলো বুইরি। জানি তো কোন্ জ্বালাত মরস।
বদরুল বললো, আমার ঘরে ক্যান আইছত? চইলা যা।
নছিমন বিবি মশিউরের বৌ আর বদরুলের বৌর দিকে তাকিয়ে বদরুলকে বললো, নিজ ঘরে তো অনেক খাইছত, একদিন আমার ঘরে খা। বাত্তি হইয়া গেছি? ডেগা লাগবো? আছে। 
তারপর কৌণিক চোখে চেয়ে বললো, বাত্তি ফলে মাছি উড়ে বেশী কিন্তু! তুই দেকি বড্ড বোকা!
বলেই একগাল হাসলো নছিমন বিবি। মশিউরের বৌ বললো, বদু বাই, এই বেডি শেষ কইরা দিলো বস্তীটারে।
বদরুল কিছু বলতে যাচ্ছিলো। নছিমন বিবি থামিয়ে দিয়ে বললো, রোজগার তো কম করলি না। সঞ্চয় কিছু করছত? আমার ঘরে যাইস। পুষ্পশয্যায় শুয়াইয়া সুক ঢাইলা দিমু। এত লজ্জা করস ক্যান? কত বড় বড় ব্যবসায়ী আহে, তুই তো কিয়ের রিকসাচালক। তোরে যে ডাহি, এই তোর কপাল।
বদরুলের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলো। এমন আহ্বানে যেকোন পুরুষই কাবু হয়ে যাবে। জরিমন আর মশিউরের বৌ মিলে নছিমন বিবিকে তাড়িয়ে দিলো, ঠিক যেভাবে কুকুর তাড়ায়।
মশিউরের বৌ বললো, জরি, মিলমিশ করে না থাকলে আমাগো বেডাগো সামলাইতে পারমু না কিন্তু। বস্তী থেইকা এই বেশ্যারে তাড়াইতে হইবো।
বদরুল ঘরে যেয়ে ঘুমালো। যে আগুন নছিমন বিবি জ্বেলে দিয়ে গিয়েছে তাকে তা অস্থির করে রেখেছে। বৌ ঘরে ঢুকতেই বাজপাখি হলো সে।
এভাবে চলতে থাকলো জীবন। দুটো স্কুল ছাত্রীকে নিয়ে বদরুল রিক্সা ছেড়েছে। সে নিজের থেকেই বললো, আমারও দুইডা মাইয়া আছে। ইশকুলে দেবার পারি নাই। পেটের বাত দিতে পারি না, ইশকুলে কেমনে দিমু?
এক ছাত্রী বললো, আপনাদের মত রিক্সাওয়ালাদের দুঃখে আর ব্যথিত হবো না। এমন কথা বলে বলে দুটো টাকা বেশী নিতে চান।
বদরুল বললো, মাগো, ইশকুলে যারা পরে তাগো কাছ থেইকা আমি দুই এক ট্যাকা কমই লই। কিন্তু যারা চারকি করেন তাঁরা তো আমাগো দুই এক ট্যাকা বেশী দ্যান না! মাগো, দুক্কের কপাল নিয়া জন্মাইছি। আমাগো ঘৃণায় করো।
ছাত্রী দুটি আর কোনো কথা বললো না। ওরা যা ভাড়া তা দিয়ে নেমে চলে গেলো। দুটি কবুতরের বাচ্চার দিকে বদরুল চেয়ে থাকলো। আর নিজের অভাগী দুই মেয়ের কথা ভাবতে লাগলো। 
রিক্সা টানলে শরীরে আর শক্তি থাকে না। খালি রিক্সা তাও টেনে নিয়ে যাওয়া ওর জন্য অনেক কষ্টের। তখন এক যাত্রী বললেন, এই যাবি?
বদরুল না-সূচক মাথা ঝাঁকালো। তখন গলা বাজিয়ে যাত্রী সাহেব বললেন, যাবি না কেন্? তেল জমে গিয়েছে? কাঁচা টাকা ইনকাম তো! যা বের হ্।
এমন কথা শুনে শুনে সব সয়ে গেছে। বদরুল কান্না করতে চায়, কান্না করতে পারে না। বড় হলে এই সমস্যা।
উঁকুন বাছা বিকেল বেলায় মশিউরের বৌ বদরুলের বৌর মাথার উঁকুন বেছে দিচ্ছে। ট্রেনের নিচে সেজ ছেলেটা পড়তে যেয়েও পড়েনি। দৌঁড়ে এসে মায়ের কোলে লুকায়। বুকটা তার ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। বদরুল বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ সেই যাত্রীর সাথে দেখা। আজও সে নছিমনের কাছে আসবে। বদরুলের রিক্সায় উঠলো। বদরুল বললো, বিয়া করেন না ক্যান?
যাত্রী বললো, অল্প ট্যাকাত অনেক মজা। 
বদরুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, পাপের বোঝা ভারী করতাছেন ক্যান?
যাত্রী বললো, নিষ্পাপ কেডা?
বদরুল চুপ করে রিক্সা টানতে লাগলো। আজও ভেবেছিলো বাড়তি টাকা সে পাবে। পেলো না। বরং হুমকি পেলো। যাত্রী বললো, কাউরে জানাইবেন না। কেউ যদি জাইন্না যায় তবে বস্তীতে রটাইয়া দিমু আপনে আমারে ঠিকানা দিছেন। আপনে দালাল।
বদরুল দাঁতে জিহ্বা কেটে চুপ হয়ে গেলো। ঘরে এলো। সেজ ছেলের বিপদের কথা শুনামাত্রই বৌকে বকলো, করছ কি বাইত? পোলাপানডি দেখস না কেন্? গতর দেখস? গতরে তোর মরিচ গুঁড়া দিমু। 
মুখ বুঝে থাকে জরিমন। মরার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ছেলেকে বুকে করে বসে থাকে বদরুল। বাচ্চাদের প্রতি এত দরদ জরিমন আজ তা প্রথম দেখলো। ভাত দিয়ে জরিমন বললো, লন, বাতডি খান।
একটি কুকুর এসে দাঁড়িয়ে আছে। জরিমনকে গরম দিয়ে বদরুল বললো, কুত্তাডারে খেদাস না ক্যান?
ছেলেমেয়েদের মুখেও তুলে তুলে খাওয়ায়ে দিলো। বড় মেয়েটা বললো, বাজান, রূপকথার গল্প হুনাইবা? নছিমন কাকী আমারে কোলে বসাইয়া রূপকথার গল্প শোনাইছে। নতুন জামা কিননা দিবো কইছে।
ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিলো বদরুল। বললো, তুই নছিমনের ঘরে গেছিলি?
আব্বার রাগ দেখে বড় মেয়ে চুপ হয়ে গেলো। জরিমনকে ডেকে বললো, তোর বড় মেয়ে নছিমনের ঘরে যায় কেমনে? দেইখা রাখস না ক্যান?
জরিমন বললো, কইডারে আমি দেইখা রাখমু? সারাদিন পাগল হইয়া যাই পোলাপানের জ্বালায়।
ছেলেমেয়েগুলোকে বোঝাতে লাগলো বদরুল। কারোর বাড়ি যেতে মানা করলো। মাকে সারাদিন কাজে সাহায্য করতে বললো। 
মেজ মেয়ে বললো, তয় আমাগো দুই বইনের দুইডা লাল জামা কিননা দিবা?
মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বদরুল বললো, দিমু। ঈদ আয়ুক।
ঈদ আসতে কত দেরী, তা শুনেই মেয়েদের মুখে হাসি ফুঁটলো। মনে মনে গুমড়ে কাদতে লাগলো বদরুল।
পরের দিন নছিমন বিবি পান খেতে খেতে মশিউরের বৌর কাছে এলো। মশিউরের বৌ নছিমন বিবিকে তিরস্কার করে বললো, দূর হইয়া যা বদমাশ বেডি। তোর লইগা মেম্বর সাব আমাগো উচ্ছেদ কইরা ছাড়বো।
নছিমন বিবি বললো, দূর দূর করতাছস ক্যান? তোর মর্দা তো আমার কুঁইড়াঘরে হান্দায় না। তরুণ তরুণ যুবকরা আহে। এইডা একটা সমাঝ সেবা বুঝলি বেডি। সমাঝে ইভটিজিং, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ এডি হইবো না। মশিউরের বৌ বললো, দূরে কোথাও যাইয়া ব্যবসা খুল। আমাগো ভিটা ছাড়া করিস না।
নছিমন বিবি বললো, মেম্বর ঘর ছাড়া করবো ক্যান? মেম্বর বকবোই বা ক্যান? তাঁর পোলাপান তো দিনে তাঁর পিছে, রাইতে আমার সামনে।
তখন বদরুলের বৌ এলো, বললো, তোরে না কইছি এদিকে আইবি না?
নছিমন বিবি সব কথার উত্তর না করে বললো, ও বেডি, তুই তো দেহি আবার পোয়াতি হইছস! এত বাচ্চা ন্যাস ক্যান? ছয়ডা বাচ্চারে তাই খাইতে দিতে পারস না। তোর ভাতারে তো আচ্ছা পুরুষ! তোর দেহ থেইকা এত সুক লয়?
বদরুলের বৌ রেগে বললো, তুই দূর হবি সামনে থেইকা? ঝাঁটা দিয়া মুখ খুঁচায়া দিমু?
নছিমন বিবি বললো, বেডি, এত রাগস ক্যান? তেজ কমে না ক্যান? আমি তো প্রতি রাইতে পুরুষের সময় দিই, আমার তো বাচ্চা বাঁধে না পেটে! বাচ্চা নিতে নিতে বস্তীডারে যে ভরাইয়া ফালালি। শরীর গরম হইলে তোর মর্দাডারে আমার কুঁইড়াঘর দেহায়া দিতে পারস না? মনের রস মিটাইতে গিয়া দেহডারে তো শেষ করলি। পোলাপানডিরে পালবি কেমনে? 
মশিউরের বৌ বললো, যাবি, না ঝাঁটা নিমু?
নছিমন বিবি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে হাসতে চলে গেলো। পথে মশিউরের সাথে দেখা। বললো, তোর বন্ধুরা তো আমার কুঁইড়াঘরে আয়ে যায়। যাস না ক্যান? ঘরে বৌ দেইক্কা?
মশিউর বললো, নিজে দাওয়াত না দিয়া দুইডা দালাল লইয়া ল, বেশর্মা।
নছিমন বললো, এক ডাল দিয়া কত দিন ভাত ভালো লাগে ক? তোরা এলাকার বেডা। তোরা গেলে বিক্রি হমু নামমাত্র মূল্যে। আইস, ভোগ যতই করস দেখবি উপভোগ শেষ হইব না।
মশিউর রেগে প্রস্থান করলো, নছিমন থেমে থাকলো না। শুনিয়ে বললো, আইস কিন্তু যে কোনো দিন। কোনো নির্দিষ্ট বার নাইগা আমার কাছে। প্রতিদিনই বেডা ছেলের স্পর্শ লই আমি। মাছের দামে পুকুর পাবি।
নছিমন তারপর নিজ মনে বলতে বলতে চলে গেলো, যাওনের লইগা মন দৌঁড়ায়, বিবেকরে দোহায় দিয়া সাধু সাজে!
ওরা কয়েকজন রিক্সাওয়ালা গল্প করছে। বদরুল নিশ্চুপ। আক্কাস বললো, চুপ ক্যান? 
বদরুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, বৌয়ের পেটে আবার বাচ্চা আইছে। 
আব্বাস হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো, বৌ পোয়াতি হইছে? মিষ্টি খাওয়াবি না?
বদরুল নির্লিপ্ত নয়নে বললো, ছয় ছয়ডা পোলাপান। সংসার চলে না। থাকনের জায়গা নাই। আবার নতুন মুখ আসতাছে। গলায় দড়ি দিমু? মিষ্টি খাইতে কেমনে চাস? সুকের সন্তান? 
রাজ্জাক বললো, মাগার, সন্তান নিস ক্যান? সারাদিন রিক্সা চালাস। রাইতে না ঘুমায়া বৌর পিছে লাগছ ক্যান?
বদরুল দ্বিতীয় বার দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, কেমনে কি ঘইট্টা যায়, বুঝি না।
আব্বাস বললো, তোর বৌর জমিটা উর্বর। ফসল ফলতেই আছে। শুধু চাষ দেওয়ন দরকার।
বদরুল বললো, টিটকিরি কাটিস না। বুকটা ফাইট্টা যাইতাছে।
টিপু বললো, তোগো বস্তীতে বলে কী কাহিনি হইতাছে রাইতে?
বদরুল অস্বীকার করার চেষ্টা করলো, কি কস! কই পাস এ সব কথা? 
টিপু বললো, দুইডা যাত্রী বেশী টানলেই তো রাইতের খরচা বারাইয়া যাইবো! 
বদরুল বললো, যার মনে যা চায় করগা। চাঁদ মুখো চুমা দিবি, না সাপের মুখের বিষ নিবি যার যার ব্যাপার।
টিপু হেসে বললো, দেখায়া পরিচয় করাইয়া দিবি? দিমুনে কিছু ট্যাকা।
বদরুল রেগে গেলো, বললো, আমারে কি দালাল পাইছত? কমিশন দিতে চাস? যা যা ঠিকানা লইতে লইতে যা, বেশর্মা কাম করবি, শরম করে ক্যান? 
বিড়ি বের করে বদরুল টানতে লাগলো। মাথা গরম হয়ে গিয়েছে। ঐ সময় একটি ছেলে ও একটি মেয়ে এলো। ওরা পার্কে যাবে। ছেলেটি গরম দিয়ে বললো, মুক্ত খোলা বাতাসে বিড়ি টানছেন কেনো?
বদরুল বললো, বিড়ি টানলে একটু বল পাই বাজান। 
বদরুল বিড়ি ফেলে দিয়ে যাত্রীদ্বয়কে নিয়ে পার্কের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো, বললো, পার্কে যাইবেন ক্যান? শুনছি হেনো খারাপ কাম হয়।
যাত্রীদ্বয় পরস্পর পরস্পরের সাথে কথা বলছে। বদরুলের কথার উত্তর করার সময় নেই। বদরুল বুঝতে পারলো রিক্সাতে বসে তারা ভাল কাজ করছে না। রিক্সা থামিয়ে বললো, নামেন। যান। বেদ্দাব সব।
মেয়েটির চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। বদরুল বললো, মা, লেকাপড়া শিখখা মানুষ হও। ইজ্জত বিলায়া দিও না। মানুষ যেইডা ভালা বলবো হেইডা কইরো। 
ছেলেটি রেগে বললো, পেটে দুকানি বিদ্যে আছে? জ্ঞান দেন যে! 
বদরুল বললো, ব-কলম আমি। তয় ইজ্জত রাইখা কাম করি। আল্লা তোমাগো মাফ করুক।
ভাড়া না দিয়েই ওরা হাটতে হাটতে পার্কে চলে গেলো। বদরুল ভাবলো, লেকাপড়া শিখখা তো মানুষ বড় হয়। এ তো দেখি সব অমানুষ। আমার মাইয়া দুইডা লেকাপড়া শিখে নাই, তাই কি নষ্ট তো হয় নাই! যাও বাজান যাও পার্কে, কাঁধে সংসারের জোয়াল পড়লে সব মজা ছুটবো।
বাসি রুটি আর পঁচা কলা এই যোগে দুপুর পার। পেটে রোগ লেগেই থাকে।  যাত্রী নেই, সবাই বসে আছে যার যার রিক্সা ধরে। টিপু এক মহিলার দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে আছে। দেখে বদরুল বললো, মাইনসের বৌ-ঝির দিকে এমনে চাইয়া থাকোস ক্যান? 
টিপু বললো, তুই না হয় বুইড়া হইছত, আমাগো বুইড়া হইতে দেরী আছে। ভালা কিছু দেখলে নজর পইড়া যায়।
বদরুল বললো, ঘরে তোর মায়া-বৌ আছে। এত নিচে নামোস কেমনে?
টিপু বললো, বৌয়ের বিষ নাই। আমি বেসামাল হইলে থামায় না কেউ। যে গতর নজর পোড়ায়তে জানে না, হেই নজর অন্য দিকে যাইবোই।
বদরুল তীর্যক চোখে চেয়ে ওখান থেকে সরে পড়লো। 
মেম্বারের কানে নিয়মিত ট্রেন রাস্তার বস্তীর খবর যায়। আজ নিজেই চলে এসেছেন নছিমন বিবির কাছে। মেম্বার সাহেব বললেন, কি সব শুনছি? সত্য?
নছিমন বিবি বললো, সইত্য। আপনেও আমার ঘরে আইসেন। সুক দিমু। নিম ফুলের মধু দিমু বিন্দু বিন্দু।
প্রচণ্ড রেগে গেলেন মেম্বার। দাঁত কিটমিট করে বললেন, বেয়াদব মহিলা।
নছিমন বিবি বললো, রাইতে আইসেন। আপনের ঐ কোদাল দাঁতের কোপ বুকের মৃত্তিকায় নিঃসংকোচে নিমু।
মেম্বার আরো রেগে গেলেন। মশিউর, রবিউল মেম্বার সাহেবের পিছন থেকে নছিমন বিবিকে দুই হাত নেড়ে ইশারায় বোঝালো। যার অর্থ মেম্বারকে আমরা বোঝাবো। নছিমন বিবি নিজেকে অনেকটা নির্ভার মনে করে মেম্বারের চোখে মুখে চেয়ে বললো, কি মেম্বর সাব, আমারে দেইখা কি আপনের চোখ টাটায় না? আইয়েন, যৌবনের দাবি পূরণ করমু। নিদ্রালু, তন্দ্রালু আলুথালু অঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেইলেন। গ্রাস হইয়া থাকমু, চোখ বুইজা থাকমু, যা পারেন কইরেন।
মেম্বার সাহেব আর থাকতে পারলেন না। ফিরে চলে গেলেন। তজিমুদ্দিনের কুঁড়েঘরে গাঁজা খাওয়ার আসর বসে। তজিমুদ্দিনের চার সন্তান। একটিও বাবা মায়ের রং পায়নি। বস্তীর সবাই তাকেও ঘৃণা করে। 
রবিউলের বৌটা এসে জরিমনকে বললো, ছাগলডা সারাদিন ডাকছে, ছুটছে, আর পাইতাছি না। 
জরিমন বললো, দেহি নাই।
মশিউরের বৌ এসে বললো, রন্টুর মা, আমাগো মর্দা হাসটারে দেখছোত?
জরিমন বললো, না। দেখ্ তজিমুদ্দিনের গানজার আসরে, না হয় নছিমনের কুঁইড়াঘরে।
মশিউরের বৌ জরিমনের উপর রাগ দেখিয়ে চলে গেলো। রবিউলের বৌ বললো, পোলার বাপ ওহন আমারে দাম দেয় না। রাইত কইরা ঘরে আহে।  ছাগলডার মত হেইও কি আমার থেইক্কা ছুইট্টা গেলো?
জরিমন বললো, বেডা মানুষ পিঁপড়ার লাহান। মিষ্টি যেই দিকে পাইবো, হেই দিকেই ছুটবো।
খুঁজতে খুঁজতে মশিউরকে নছিমন বিবির কুঁড়েঘরে আবিষ্কার করলো তার বৌ। বৌ বললো, শেষ পর্যন্ত আপনেও এই বেইজ্জতি বেডির ঘরে ঢুকছেন? লন, সুক লন। আমার ধারে আইলে আণ্ডা ছাইটা দিমু।
মশিউর বললো, ক্ষেপছত ক্যান? খইয়ের লাহান ফুঁটতাছত ক্যান? তোরে তালাক দিমু।
বৌ বললো, দে তালাক দে। ভালা ভাতার ধরুম।
সন্ধ্যায় বদরুল ঘরে ফিরছে। টিপু নাছোড়বান্দা হয়ে দেখা দিলো। তাকে সাথে নিতেই হবে। বদরুল রাগ দেখিয়ে বললো, রিক্সা চালাস, কোনো এলাকা তোর চিনতে বাকি? আমি লইয়া যাই কেমনে? আমার বদনাম রটবো।
টিপু বললো, সব মাইনসের কাছে সব কথা জিগান যায়? ট্যাকা দিমু। মায়াগো লইগা জামা কিনতে পারবি।
বদরুল বললো, আমার মায়াডি ছেঁড়া জামা পইরা থাকবো, তবুও হারামের ট্যাকা দিয়ে তাগো কিছু কিননা দিমু না।
টিপু বদরুলের উপর ক্ষিপ্ত হলেও নিজেকে সামলে নিলো। বদরুলের সাথে না এলেও পিছু পিছু এসে নছিমন বিবির কুঁড়েঘরে গিয়ে উঠলো।
পরের দিন মশিউরের বৌ কান্না করতে করতে চলে যাচ্ছে। জরিমনকে সামনে পেয়ে বললো, নছিমন আমার ঘর ভাঙলো। তার উপর গজব পড়বো।
জরিমন বললো, দেখছোত পুরুষ মানুষ কিসে পাগল? 
নছিমনকে গাল দিতে দিতে বৌটা চলে গেলো। আয়তনের স্বামী মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। অনেক কষ্টে দুই সন্তানকে মানুষ করছে। নছিমন বিবি তাকে একা পেয়ে বললো, বিয়া করবি না আর?
আয়তন বললো, না। পুলা মায়া দুইডারে মানুষ করতে পারলে জীবন সার্থক হয়।
নছিমন বিবি বললো, স্বামীর সোহাগ লইবি না?
আয়তন দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, কপাল ভাঙছে আমার। সোহাগ পাওনের আশা আর করি না।
নছিমন বিবি বললো, ভবিষ্যতে যদি বিয়া করনের লইগা মন চায় কী করবি? জানস তো, দীর্ঘদিন ক্ষেত পইরা থাকলে জঙ্গল বাঁধে। হেয় ক্ষেতে ফসল হয় না। রাতে রাতে আমার ঘরে আইবি? মেলা পুরুষ আহে। জমিডারে একটু চাষ দিয়া রাখলি এই আর কি!
আয়তন ক্ষেপে গেলো, কি কইলি! তোর মত বেশ্যারে আমি ঝাঁটা মারি! সমাঝ লইয়া থাহি। তুই হইলি হেয় সমাঝের কীট, উচ্ছিষ্ট। 
নছিমন বিবি বললো, প্রতি রাতে নতুন নতুন পুরুষের ছোঁয়া লাগে শরীলে। এর যে কি মজা বুঝবি কেমনে! স্বাদের কথা ভুইলা গেছত?
আয়তন বললো, তোর লজ্জা করে না?
নছিমন বিবি বললো, পানিতে নামলে শাড়ি ভিজবোই, শাড়ি ভেজার ভয়ে কি রোজগারের লগে সুকও হারামু?
নছিমন বিবি আয়তনকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেলো। সামনে বদরুলকে পেয়ে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত হলো। বদরুল বললো, হাসোস ক্যান? মন রাঙাইতে চাস?
নছিমন বিবি বললো, তুই আমার আদর খাইলি না, ভালা। কিন্তু প্রত্যেক দিন নতুন নতুন খদ্দের আইনা দেস, আমি কিন্তু দেহি। কত কইরা লস? 
বদরুল আকাশ থেকে পড়লো। চোখ মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। নছিমন বিবি থেমে থাকলো না, বললো, তুই আমার হইয়া কাজ করতে পারোস। ট্যাকা আমিও দিমু।
বদরুল হাত দিয়ে নিজের কান ঢেকে বললো, শেষ কইরা দিলি আমারে। আর কত ক্ষতি করবি, কত ইজ্জত লইয়া খেলবি? 
নছিমন বিবি বললো, ব্যবসা করি আমি, বদনাম রটাস আমার। তলে তলে লাভ খাস তুই! বস্তীর সবারে জানায়া দিমু।
বদরুল হাত জোড় করে বললো, মান-সম্মান শেষ করিস না, তোর পায়ে পড়ি।
নছিমন বললো, মাফ পাবি না। ক আমার হইয়া কাজ করবি? 
বদরুল নিরুপায় হয়ে বললো, করুম।
বদরুল বাড়ি এলো। নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে লাগলো। সিদ্ধান্ত নিলো যেকোন দিন এ বস্তী ছেড়ে দেবে। ওদিকে আয়তন মেম্বারকে সব কথা বলে দিয়েছে। মেম্বার পড়লেন চিন্তায়। নগ্নতার চর্চা? তিনি বড় সড় সিদ্ধান্ত নিলেন। বিকাল দুইটার দিকে এক ব্যক্তি এসে জানিয়ে দিয়ে গেলেন, কাল দশটার মধ্যে সকলকে চলে যেতে হবে। নতুবা উচ্ছেদ করা হবে। তা শুনে তজিমুদ্দিনের ঘরের গাঁজাখোরগুলো, রবিউল, মশিউর সবাই মেম্বারের কাছে গেলো। রবিউল বললো, মেম্বর সাব, থাকুম কই? যামু কই? 
মেম্বার সাহেব বললেন, তা আমি জানি? তোদের নোংরামি সীমা লঙ্ঘন করেছে, আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
মশিউর বললো, আপনের কাম-কাজ কইরা দেই, অহন থাকনের জায়গা কাইড়া লইবেন?
মেম্বার সাহেব বললেন, তোরা কাজ মাগনা করে দিস না। কাজের বিনিময়ে টাকা দেই। তোরা এখন যা।
মেম্বারের প্রতি সবার রাগ হয়ে গেলো। সবাই মন খারাপ করে ঘরে ফিরে এলো। একথা এখনো বদরুল জানতে পারেনি। বাড়িতে জরিমন চিন্তিত। রাত হয়ে গিয়েছে। বদরুল ঘরে ফিরছিলো। তখন দুই যুবক বললো, পরমপুর যাবেন?
বদরুল দেখলো অনেক ভাড়া। ও রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু পরমপুর অনেক দূর। অন্ধকার রাত ফিরবে কেমন করে? মাঝে মাঝে নির্জন পথ। লোকজনের চলাচল কম। বেশ ভূতুড়ে স্থানে যেতেই দুই যুবক ছুরি, পিস্তল বের করলো, আর বললো, চিল্লাবি না। চিল্লাইলে মুণ্ডু নিমু। 
বদরুল চিৎকার করলো না। ওরা রিক্সাটা নিয়ে চলে গেলো। চেয়ে চেয়ে দেখলো বদরুল। এবার ও করবেটা কী? সোজা শহর আলীর কাছে গেলো, মামা, রিসকাটা খোয়া গেছে। 
শহর আলী বললো, ভালা করছত। কিননা দিবি। নইলে জেলে হান্দায়া দিমু। 
বদরুল দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, কেমনে কিনমু? কই পামু এত্ত ট্যাকা?
শহর আলী চোখ গরম দিয়ে বললো, কেমনে কিনবি হেইডাও কইয়া দিমু? ব্যাংকো থেইক্কা লোন নিগগা। অল্প অল্প কইরা শোধ দিবি। অহন রাইত হইছে, বাইত যা।
বাড়ি ফেরার পথে আব্বাসের  সাথে দেখা। বদরুল বললো, আব্বাইসা, রিসকা ডাকাত নিছেগা। 
আব্বাস হেসে বললো, ডাকাত তোরে পাইছিলো? তাও তো ভালা, ডাকাত দেখছোস। তাগো কি গোঁফ লম্বা লম্বা?
রসিকতা করে আব্বাস চলে গেলো। নানা কিছু ভাবতে ভাবতে বদরুল বাড়ি ফিরলো না। বাচ্চাগুলো না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। জরিমন পথ চেয়ে আছে।
সকাল বেলা কেউ কেউ মেম্বার সাহেবের বাড়ি যাচ্ছে কারণ মেম্বার সাহেবকে কারা নাকি গুলি করে মেরেছে। নছিমন বিবি বললো, বড়ো ভালা মানুষ আছিলো!
আর কেউ কেউ রইচদের বাড়ি যাচ্ছে চোর দেখতে। গত রাতে ঐ বাড়ি এক চোর ধরা পড়েছে।
 
======০০০======


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক