গাঁইয়া
চন্দন মিত্র
সক্কালবেলাতেই
শুরু হয়ে গেল নারদ-নারদ পর্ব। পাশের ফ্ল্যাটের কানগুলি চাইলেন নিজেদের
জান লড়িয়ে দিয়ে ভেসে আসা শব্দতরঙ্গগুলিকে অক্ষুণ্ণভাবে অন্তরে স্থান দিতে
; চোখগুলি চাইলেন দেয়ালভেদী দৃষ্টি অর্জনের মাধ্যমে দেয়ালের ওপারে ঘটে
চলা ঘটনা সমূহ জলজ্যান্ত চাক্ষুষ করতে। যাকে কেন্দ্র করে এই রোববারের
নির্ঝঞ্ঝাট সকালটা নারদ-নারদে মাটি হতে বসল, সেই শ্রীমান সহজ (বাবার দেওয়া
জন্ম সার্টিফিকেটে থাকা নাম) ওরফে নিউটন (মায়ের দেওয়া ডাকনাম) মায়ের
কিনে দেওয়া নার্সারি রাইমের জ্যাক অ্যান্ড জিল ইত্যাদি ছিঁড়ে কুটিকুটি
করছিল। রত্নামাসি কেক-কফি
পরিবেশনের পর মোমো বানানোয় হাত লাগিয়েছিলেন। তিনি বুঝলেন আজ বেশি
রান্নাবাড়া করা মানে পণ্ডশ্রম, সবই ঢুকবে দৈত্যাকার ফ্রিজের পেটে। তিনি এও
জানেন নারদ-নারদ পর্বে তাঁকে আড়ালে থাকতে হবে, কোনোভাবে মঞ্চে উপস্থিত
হওয়া যাবে না। তিনি আর কী করবেন,
সদ্য তৈরি একপিস চিকেন মোমোতে কামড় মেরে গাল পুড়িয়ে, সদ্য তৈরি স্যুপ
বাটিতে ঢেলে চুমুক দিয়ে দ্বিতীয়বার গাল পুড়িয়ে শীতল পানীয়ে কুলকুচি করে জ্বালা জুড়োনোর জন্য ফ্রিজ খুললেন।
ইংরেজি
সাহিত্যের তরুণ অধ্যাপক ডক্টর স্বপন সামন্ত, কম্পিউটারে বসে লেখালেখি
করছিলেন ; ছুটির দিনগুলোতে তাঁর দিন যেমন কাটে তিনি তেমন ছন্দেই চলছিলেন।
আসন্ন বইমেলায় প্রকাশিতব্য লোকগানের বিশ্বরূপ বইটির
পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতিতে তিনি সবেমাত্র মনোনিবেশ করেছেন, ঠিক তখনই
নারদ-নারদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি অমূল্য সময় নষ্ট করতে বাধ্য হলেন।
তাঁর স্ত্রী কমলা হালদার সামন্ত আনন্দময়ী গার্লস হাইস্কুলের বাংলার
শিক্ষিকা, সোফায় প্রায়-শুয়ে মোবাইলে গাঁদাফুলের মালা বা ওই ধরণের কোনো একটা অশেষ ধারাবাহিকের মৌতাত নিতে নিতে ফোড়ন কেটে বসেন, তা নিউটনকে কোথায় ভর্তি করবে ঠিক করলে ?
স্বপন জানেন সক্কালবেলা কমলার কথার জিলিপিতে ঢুকে পড়া মানে তাঁর
পাণ্ডুলিপির গুষ্ঠির ষষ্ঠী পূজা হয়ে যাবে। তিনি যথারীতি কম্পিউটারে
চালিয়ে দেন, অরূপ রাহীর উদাত্ত কণ্ঠে গাওয়া লালনশিষ্য দুদ্দু শাহের বিখ্যাত পদ। বস্তুতে যে ঈশ্বর আছে করে তারি উল / যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল। গান চালালে সচরাচর স্বপন যা করেন আজও তার ব্যত্যয় ঘটল না। তিনি অরূপ রাহীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে দিলেন। স্বপন ও কমলা উভয়েই আক্ষরিক অর্থে বাঘের দেশের মানুষ এবং ভিতরে বাঘ পোষেন।
স্বপন তাঁর পড়াশোনা, ক্ষেত্রসমীক্ষা, সভা-সমাবেশ, মেলা-মোচ্ছবে বিস্তর
বিচিত্র মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, বাউল-ফকির সঙ্গ ইত্যাদি দিয়ে সেই বাঘটাকে
প্রায়-নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছেন।
কিন্তু কমলা ভিতরের বাঘটাকে নিষ্ক্রিয় করা তো দূরের কথা, তাকে আরও
আবোলতাবোল খাইয়ে ক্রমশ বর্বর করে তুলেছেন। তিনি মোবাইলটা সোফার উপর
একপ্রকার আছাড় মেরে তেড়ে আসেন স্বপনের দিকে; সুইচবোর্ড থেকে এক হ্যাঁচকায়
খুলে ফেলেন কম্পিউটারের জ্যাক। স্বপন বাধ্য ছেলের মতো অরূপ রাহীকে বিদায়
জানিয়ে কম্পিউটার বন্ধ করে দেন। স্বপনের একটি সিগারেট ধরাতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু তিনি জানেন এইসময় সেই চেষ্টাটা কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
কমলা ঝড়ের গতিতে ফিরে গেছেন তাঁর পূর্ব অবস্থানে। তিনি যথেষ্ট উঁচু গলায় বললেন, নিউটনের ভর্তি নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নিলে ?
—কী বোকার মতো চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে। ওর এখনও দুবছরও হয়নি। এর মধ্যে অত ভাবাভাবির কী আছে !
স্বপন যথেষ্ট সংযত। তাঁর কণ্ঠস্বর বড় জোর কমলার কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছানোর মতো
সীমিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত। ওঁত পেতে থাকা রসালো শব্দভুক কানগুলি ক্ষুণ্ণ হন।
তাঁদের রসনাতৃপ্তির ব্যবস্থা করেন কমলা হালদার সামন্ত।
—ন্যাকা
চৈতন্যের মতো কথা বলবে না বলে দিচ্ছি। আমি কী বলতে চাইছি তা তুমি ভালোই
জানো। ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাচ্ছ। বলছি নিউটনকে হোলি চাইল্ডে দেবে নাকি, ইউরো
কিডসে ?
—তোমার মাথায় ওই স্কুলগুলোর নাম কে ঢোকাল বলো তো ? শোনো আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি
সহজকে আমি ইংলিশ মিডিয়ামে দেব না। আমি চাই না আমার ছেলে তার মাতৃভাষা ও
সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত হোক। আর শোনো বাংলা মিডিয়ামে পড়লে আমার ছেলে হয়তো
বিড়ি-সিগারেট খাওয়া শিখবে আমার মতো। খুব বেশি হলে হয়ত গাঁজায় দু-চার টান
দেবে কখনও। আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে কোকেন খাবে, হেরোইন খাবে। তাছাড়া আমার
ছেলে যদি তার বাবার লেখা বই পড়তে না-পারে, সে দুঃখ সে রাখবে কোথায় !
—বাঃ
বাঃ বাঃ। ভালোই বুদ্ধি ধরেছ ছেলেকে তোমার মতো গোল্লায় পাঠাতে চাও। একজন
ইংরেজির প্রফেসর হয়ে মূর্খের মতো কথা বলছ। আর বলবে না বা কেন ! এখন যে-সে
কথায় কথায় ইংরেজি বলে। আর
বাবু পণ করে বসে আছেন, প্রয়োজন না-হলে ইংরেজি বলবেন না ! কেন একটু
আপ-টু-ডেট হওয়া যায় না ! এই যে তোমার কলিগরা তো কত পার্টিতে যায়। তোমার
ইচ্ছা হয় না ?
—না
হয় না। ওটা আমার সংস্কৃতি নয়। আমি সুন্দরবনের ছেলে। আমার গায়ে এখনও
মৃদঙ্গভাঙ্গার গন্ধ লেগে আছে। আমি তা অস্বীকার করতে পারব না। আর তুমিও তো
তাই, ভুলে গেছ জীবন বাজি রেখে তোমার বাবা মাছ-কাঁকড়া ধরে তোমাদের
ভাইবোনেদের মানুষ করেছেন। আজকে চাকরি পেয়ে ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হয়ে ইতিহাস
ভুলে যাচ্ছ, তাই না।
—ওটা কোনো যুক্তি নয় বুঝলে। একদিন হামাগুড়ি দিয়েছি মানে কোনোদিন হাঁটব
না, তা হয় নাকি ! এত যদি তোমার মাতৃভাষার প্রতি পিরিত তাহলে তুমি ইংরেজি
নিয়ে পড়তে গেলে কেন ? আর তুমি তো নিজেই বলো তোমাদের কে মন্দোদরী না
মন্দাকিনী ম্যাম নাকি কথায় কথায় বলেন বাংলাটা তাঁর আসে না। তিনি তো বাংলা
পড়তেই পারেন না তাতে তাঁর কী ক্ষতি হয়েছে ? যত সব আদিখ্যেতা !
—শোনো কমলা, ভুলে যেয়ো না তুমি একজন বাংলার শিক্ষিকা। তোমার মুখে এই ধরনের শব্দ বেমানান। আমি বাংলা সাহিত্য খুঁটিয়ে পড়েছি, এখনও পড়ি তা তুমি ভালোই জানো। ইংরেজি নিয়েছি সাহিত্যকে ভালোবেসে। ইংরেজি
নিয়ে পড়ার সুবাদে বিশ্ব সাহিত্যেরও স্বাদ নিতে পারি। একটা কথা বোঝার
চেষ্টা করো আমি ইংরেজি শেখার বিপক্ষে নই। কিন্তু মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে
ইংরেজি শেখার বিপক্ষে। একটা শিশু মাতৃভাষার মাধ্যমে জগৎ ও জীবনের সঙ্গে
তার সম্পর্ক বুঝে নেয়। মাতৃভাষা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখে। কাউকে মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত করা অপরাধ।
—আমি অতশত বুঝি না। শোনো তোমার বাপের মতো জমিদারি থাকলে আমিও ইংরেজি নিয়ে পড়তাম। টিউশ্যান
লাগবে না বলেই বাংলা নিয়েছিলাম। এমন একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়েছি যে কাউকে
বলতে গেলে মাথা হেঁট হয়ে যায় লজ্জায়। লোকে ভাবে বাংলার শিক্ষক মানে কিচ্ছু
জানে না। ইলেভেন-টুয়েলভে
গেলে সায়েন্সের স্টুডেন্টরা পাত্তা দিতে চায় না। আর দেবেই বা কেন একটা
ইংরেজিতে দরখাস্ত লিখতে বললে আমি কলম ভেঙে ফেলব। আমি চাই না আমার ছেলেও
এমন অপমানের জীবন পাক।
—ও
এবার বুঝেছি ইংরেজির জন্যই তুমি আমার প্রেমে পড়েছিলে, ঠিক যেমন আমি
পড়েছিলাম তুমি বাংলা নিয়ে পড়ছ বলে। অথচ দ্যাখো আমি ইংরেজি নিয়ে পড়ে
মাতৃভাষাকে আরও গভীরভাবে আবিষ্কার করছি, আঁকড়ে ধরছি ; আর তুমি বাংলা নিয়ে
পড়াশোনা করে হীনম্মন্যতায় ভুগছ। একেই বলে ট্র্যাজেডি !
—সে তুমি ভাবতেই পারো। তবে তোমার এই ব্যাকডেটেড চিন্তাকে কেউ গুরুত্ব দেবে না।
—আরে
বুঝছ না কেন এটা তোমার ভাবনার ত্রুটি। শুধু তোমার নয় ইংরেজদের ছেড়ে
যাওয়া দেশগুলির অধিকাংশ মানুষই এই বিভ্রান্তির শিকার। একে বলে
সাইকোলজিকাল কলোনিয়ালিজম। এককথায় বললে বলতে হয় শাসকের ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি
সবই উৎকৃষ্ট, রাজকীয় ; আর শাসিতের সবকিছু নিকৃষ্ট, ঘৃণ্য। একটা কথা
ভালো করে শুনে রাখো, কেউ ইংরেজি বলতে পারে মানে সে প্রকৃত শিক্ষিত এটা ঠিক
নয়, ভুললে চলবে না ব্রিটেনের কাউবয়েরাও ইংরেজিতে কথা বলে। শিক্ষিত
তাকেই বলা যায়, যে অন্তত একটি ভাষা শুদ্ধভাবে পড়তে, লিখতে বলতে পারে এবং সেই ভাষায় কোনো বিষয়ে সাবলীল আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। সেদিক
থেকে তুমি যথেষ্ট শিক্ষিত। তুমি যেমন ইংরেজি লিখতে পার না, তেমন অনেক
শিক্ষক সঠিক বানানে ও পদ্ধতিতে বাংলা দরখাস্ত লিখতে পারেন না, বাংলা
কবিতা বা প্রবন্ধ পড়ে বুঝতে পারেন না। লজ্জা তাঁদের পাওয়া উচিত কারণ তাঁরা
নিজের মাতৃভাষাটাই ঠিকমতো জানেন না। আসলে তাঁরা কোনোভাষাই ঠিক মতো
জানেন না, বাংলাও না, আর ইংরেজিও না। সেই ইয়েস, নো, ভেরি গুড গল্পের মতো।
আর আমাদের ম্যাডামের কথা বলছ, এখন তিনি আর ওই ডায়লগ দেওয়ার সাহস পান না।
আমি একবার তাঁকে ধরেছিলাম। বলেছিলাম আপনি মাতৃভাষা বলতে, পড়তে বা লিখতে
জানেন না এটা আপনার গর্বের নয়, লজ্জার বিষয় হওয়া উচিত। আমাকে দেখুন আমি
ইংরেজি তো জানিই বাংলাটাও
জানি, আবার স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও জানি কিছুটা। আর আপনার জানা
ভাষা বলতে সাকুল্যে একটা, সেটাও কতটা জানেন তাতে সন্দেহ থেকে যায়।
অধ্যাপকদের সামনে এমন জবাব পাওয়ার পর তিনি ডায়লগটা দেওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।
কমলা
কিছুটা শান্ত হন। সম্ভবত স্বপনের যুক্তি তাঁর মনে ধরেছে। মোবাইলটা হাতে
তুলে নেন। জুড়িয়ে যাওয়া কফির মগে চুমুক দিয়ে কী একটা শপিং সাইটে ঢুকে
পড়েন। রত্নামাসি দেখলেন চিৎকার চেঁচামেচি শেষ ; দুজনেই দুজনার কাজে ঢুকে
পড়েছেন পুনরায়। তিনি রান্নায় মনযোগী হওয়ার আগে প্লেটে মোমো ও বাটিতে
স্যুপ নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হন। স্বপনের দিকে প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলেন, দাদাবাবু, ধরুন।
—ও রত্নামাসি, আগে বউদিমনিকে দাও। আর তুমি খেয়েছ তো ?
মাথা
নেড়ে সম্মতি জানিয়ে রত্নামাসি কমলার সোফায় প্লেট ও বাটি নামিয়ে রাখেন।
তারপর আবার কিচেন থেকে মোমো ও স্যুপ নিয়ে আসেন দাদাবাবুর জন্য। মুচকি হেসে
মনে মনে ছড়া কাটেন, ভাব আছে ষোলো আনা/তবু কত তানা নানা।
নারদ-নারদ পর্ব পরিসমাপ্তির পথে পৌঁছে গেছে বুঝে প্রতিবেশী চক্ষু-কর্ণের
দল বেশ মর্মাহতই হন। ঘরের ভিতর থেকে আচমকা সহজের কান্নার শব্দে দুজনের
সম্বিৎ ফেরে। রত্নামাসিও ছুটে আসেন পাকশালা থেকে। বিছানায় খেলতে খেলতে সে
আচমকা মেঝের কার্পেটের উপর আছাড় খেয়ে পড়েছে। বেশি উঁচু নয়। তবে এই প্রথম
পতনের ধাক্কা তাকে বেশ নাড়িয়ে দিয়েছে বোঝা যায়। তার কান্না আর থামতে চায়
না। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে তার মা তাকে পই পই করে এতদিন মাম্মি, ড্যাডি
শিখিয়ে এলেন আর এখন সে কাঁদতে কাঁদতে বলছে মা, বাপি ...।
কমলা হালদার সামন্ত আনন্দময়ী গার্লস হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষিকা, আবার ফোড়ন কেটে বসলেন, একেবারে বাপের মতন গাঁইয়া।
======০০০======
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন