আজের এ ভারত
আজ একই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি করা এক বন্ধুর স্মরণ সভা l এসেছে ধীমান l এসেছে সূত্রধর l সঙ্গে সুকন্যা। ইন্দ্র পতন ঘটে চলেছে। রোজই এক একটা নক্ষত্র খসে পড়ছে আকাশ থেকে আর তার স্মৃতিচারণে সভা। বেঁচে থাকা নেতাদের সবারই বয়স সত্তরের বেশি। তাই এক এক করে ডাক আসে। নেতা নেত্রীদের প্রয়াণে এক একটা বর্ণাঢ্য স্মৃতি সভা। বক্তৃতার ফোয়ারা। ধীমানদের ডাক আসে সভায় অংশ গ্রহণ করার জন্য। শুধু স্মরণসভা নয় সংবর্ধনা সভারও শেষ নেই। কেউ কবি কেউ অধ্যাপক কেউ পন্ডিত। তবে সবাই নক্ষত্র জগতের লোক। নক্ষত্রের মেলা। এই সভাগুলোতে অংশগ্রহণ করা আজ যেন অভ্যেস হয়ে গেছে । এরই মধ্যে থেকে ইচ্ছের পাহাড়ের শিখরটা মাথা তুলে দাঁড়ায় । বার বার উঁকি মারে। হয়তো একদিন ধীমান সূত্রধরের স্মরণ সভা হবে । তাদের অতীত গৌরবান্বিত হয়ে উঠবে বক্তৃতার জৌলুসে। ধীমান ভাবে। তার অস্বস্তিটা বেড়ে ওঠে । বুকের ভেতরটা ধড়পড় করতে থাকে। মঞ্চে মাইক অনুরোধ জানায় ধীমান যেন মঞ্চে যায় । ধীমান ওঠার চেষ্টা করে । পারে না । পা জরিয়ে যায়। সে খবর পাঠায় তার শরীর খারাপ সে যেতে পারবে না । পাশে সূত্রধরের কাঁধে ভর করে বসে সে এলিয়ে পরে। মঞ্চে বক্তৃতা শুরু হয়। সুকন্যা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পারে না । অনুষ্ঠান শেষের জন্য অপেক্ষা করে । ধীমান নেতিয়ে অর্ধশোয়া অবস্থায়। ধীমানের মনে পড়ে যায় চেনা অচেনা অসংখ্য এলোমেলো মুখ । তারা সবাই ক্ষুদে। না ছিল চাল না ছিল চুলো । জীবনের এক চতুর্থাংশও তারা দেখে যেতে পারে নি। সে দিনগুলোয় বুক চিতিয়ে লড়ে গেছে। রাষ্ট্র তাদের জেলে রাখতেও ভরসা পায় নি। ধীমান জানে সে বেঁচে আছে। কিন্তু আসগর মহিম দীপ্তেন বেণুরা বেঁচে নেই। ভাবতে ভাবতে ধীমান স্মৃতির অন্তর্মহলে চলে যায়। স্মৃতি এসে তার সঙ্গে বসে।
সেই দিদির বাড়ি। অনেকদিন পর সবাই মিলেছে। ধীমান, সূত্রধর, নিতাইদা, সুকন্যা, হরবরা, তারকাসুন্দরী। এছাড়া আজ আছে কাজল, কাজলের স্ত্রী মিতা। এই বাড়িতে এক কালে নেতা থেকে সাধারণ আশ্রয় প্রার্থী কর্মীদের সমাবেশ ঘটত। বিভিন্ন বয়সের নানা জন। স্কুল ছাত্র থেকে কলেজ শিক্ষক শ্রমিক কৃষক সরকারি কর্মচারী সবার অবাধ গমনাগমন। দিদি যেন মহিম আসগর বেনু দীপেনের মা। বয়স্ক নেতাদের বোন বা দিদি। একই সঙ্গে অভিবাবক। জামাই বাবু স্বল্পভাষী সজ্জন মানুষ। দিদির ভাই কৌশিক ধীমানের স্কুলের বন্ধু। তার হাত ধরেই ধীমানদের এখানে প্রথম পরিচয়। সবাই এসেছে। নিরাবরণ নিরাভরণ সভা। সভার শুরুতেই সবাই কাজলকে সেই নাম না জানা অপরিচিতদের আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে বলে। কয়েক ছত্রে কাজল তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। নাম গোত্রহীন বিবরণ মাত্র ওরা।কোন মহাত্মা নয়। অত্যন্ত সাধারনের দল। ছেঁড়া ছেঁড়া ছিন্ন ভিন্ন মুখ ভেসে ওঠে :
ছেঁড়া ছেঁড়া কত মুখ
ছিন্ন ভিন্ন ছবি,
জোড়া লাগাবার
আজও চেষ্টা করি।
. ( সজল ব্যানার্জী )
ওরা কঠিন এক অনিশ্চিতের মধ্যে দিয়ে চলছে। মৃত্যুর শমন জারি । ওদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে রাষ্ট্রের সরকারি বাহিনী। তাদের অপরাধ তারা স্বপ্ন দেখে। নতুন শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন। সংবিধানের দেওয়া মিথ্যা প্রতিশ্রুতিকে ওরা ভাঁওতা বলে অগ্রাহ্য করে, নিজেদের জোরে তারা আনতে চায় তাদের স্বপ্নের সে দিন। এর জন্য ফুটিয়ে তুলবে নিজেদের রক্ত দিয়ে রক্ত করবি :
কোনো এক রক্ত ভেজা শহুরে দুপুরে
সামরিক তল্লাসির মুখে ,
সানকিতে ভাত বেড়ে ছেলেকে সাজিয়ে
বসিয়ে দিয়েছিল খেতে, আসগরের মা।
( ঐ )
আজ ওদের অনেকে নেই। স্বপ্ন পূরণের তাগিদে সব উপেক্ষা করে তারা লড়াই করে গেছে । প্রাণ দিয়েছে. মায়েরা সেই ভোরের অপেক্ষায় । কিন্তু আজও সেই ভোর আসে নি। মিতা বলে
তিলজলা , তপসিয়া , মতিঝিলের
বস্তিতে বস্তিতে ,
কত শত আসগরের মা'র
রাত শেষে আজও হলো না যে ভোর।
( ঐ )
মনে পড়ে সেই মনার বুড়ি পিসি আর সেই সব বাউন্ডেলে ছেলেগুলোর কথা যারা মনার পিসির সাবধান বাণী অগ্রাহ্য করত। তাদের দৌরাত্বে পিসি পাগল হয়ে যেত। পিসির ঘরের দাওয়ায় শুয়ে বসে তাদের স্বপ্ন দেখা। ওটা যেন ওদের মুক্তাঞ্চল । মনার পিসি ওদের কথা লুকিয়ে কান পেতে শুনত। ভয়ে শিউরে উঠত । পুলিশ ওদের তাড়া করত। ওরা আগাম খবর পেয়ে হাওয়া। পুলিশের জেরায় জেরবার পিসি । সে বিরক্ত হয়। ওদের ওপর খড়গহস্ত হয়ে ওঠে:
মনার বুড়ি পিসি
বাউন্ডুলে ছোঁড়াগুলোকে ,
গলা ফাটিয়ে গাল দিত
তাড়িয়ে বেড়াত দেখা হলেই রোজ।
(ঐ )
বুড়ি পিসি ওদের কে? ওদের কর্মকান্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক কি ? সম্পর্কটা আমরা খুঁজে পাই যখন
জানি:
চিরুনি অভিযানের রাতে
নাম না জানা বাউন্ডুলে এক ছোঁড়াকে ,
জলপটি দিয়ে কাঁথা মুড়িয়ে শুইয়ে,
পিসি বসে থেকেছে সারা রাত চাল ভাঙ্গা উঠোনে।
^^^^^^
নিষ্ফল পুলিশ রাত শেষে
ফিরে গেছে খালি হাতে।
(ঐ )
বুড়ি পিসি আজ একা। বাউন্ডেলে ছেলেগুলো কোথায় কে হারিয়ে গেছে। কিন্তু বুড়ি পিসির স্মৃতির
জগতে ওরা এখনো বেঁচে। সে সেই জল চুইয়ে পড়া চালের তলায়
দিন কাটায়। স্মৃতিতে সেই বাউন্ডেলেরা :
সে পিসির ঘর
চাল দিয়ে জল পড়ে
আজও ভেসে যায় ,
বুড়ি বসে থাকে উঠোনে একাই।
^^^^^^^
বসে বসে ভাবে,
ঘর ছাড়া, তাড়া খাওয়া
ছেলেদের দল, হারিয়ে গেছে কী সব
সময়ের ভীড়ে !
( ঐ )
ওরা কোথায় গেছে ? প্রশ্ন জাগে। কাজল নিজেদের দিয়েই বোঝে:
কেউ কেউ ফিরে গেছে
বর্ণহীন , প্রাণহীন, নিস্ফলা জীবনে।
কেউ কেউ চলে গেছে বনে ,
আশার প্রদীপ হাতে।
( ঐ )
মধ্যে মধ্যে হতাশ চোখে কুয়াশা। কাজলদের মনে হয় :
চারিদিক ঘিরে আছে গভীর তমিস্রা ,
আনন্দে মাতাল যতো হিংস্র শ্বাপদেরা। .
মনার পিসিরা তবু আজও প্রতিক্ষায়
সেই সব ছেলেদের তরে।
( ঐ )
এই তমসা অন্ধকারেও আলোর ছোঁয়া :
আঁধারের বৃন্ত থেকে প্রভাতের ফুল
ছিঁড়ে এনে দেবে বলে আসগরের মাকে,
সূর্য স্বপ্ন দেখা আজও আছে ,
হয় নি তো শেষ।
( ঐ )
সূত্রধর সূত্র ধরে দেয়। কোন সংগ্রাম কোন আত্মত্যাগ বৃথা যায় না। দীর্ঘ মেয়াদী এ লড়াই।একবার ব্যর্থ হয় লড়াই, আবার লড়াই আবার ব্যর্থতা, যতক্ষন না সেই ভোরের উদয়। এখনও মহিম আজগরের মায়েরা অপেক্ষায়:
রাত হয়েছে অনেক, মা অপেক্ষায়। ছেলে কখন আসে, এসে খাবে। মহিম আসগরের মায়েরা ভাবনায়। আজও ভাত পেতে বসে থাকে। বাস্তারের জঙ্গলে বা সিরিয়ার বস্তিতে । দুর্গম পাহাড়ের আঁকেবাকে জল্লাদেরা হানা দেয় আদিবাসী ঘরে। আদিবাসী মেয়েটা বন্দুক হাতে।
নিশানা স্থির, প্রতিশোধের আগুন চোখে। মহিম আসগর মুখর শ্লোগানে শ্লোগানে।স্মৃতির আকাশে ঘন কালো মেঘ। যেন বৃষ্টি হয়ে রক্ত ঝরে অঝোরে। মহিম আসগরেরা বেঁচে থাকে। আজও চেতনার জ্যোৎস্নায় নক্ষত্র হয়ে জ্বলে ।
একদিকে অতীতচারণ অন্যদিকে ভবিষ্যতের ছবি আঁকা । অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের বহমানতা । এই বহমানতার মধ্যে ভবিষ্যৎকে দেখা। ব্যর্থতার গ্লানি মুছে নতুনকে দেখা:
অতীত সে ফিরে আসে বার বার
টোকা মারে মনের দরজায়,
কত সে ঘটনা তরী বেয়ে ভাসে
টুকরো টুকরো ছিন্ন ভিন্ন,
স্মৃতির আকাশে খুঁজে ফেরে কাকে?
মিলিয়ে নিয়ে সবাইকে
চিনে নিতে চাই আজের এ আলো আঁধারে
সময়ের প্রবাহে পৌঁছে যেতে চাই সে ভোরে,
যাত্রা আমাদের উদয়ের পথে,
মহিম আসগরেরা অপেক্ষায় সে দিগন্তে
আদিবাসী মেয়েটা আজও পাহারায় বন্দুক হাতে।
অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের মধ্যে জাবর কাটা নয়। পৌঁছে দিতে হয় নতুন প্রজন্মের কাছে । সেই তাগিদ অনুভূত হয়, সঞ্চারিত হয় সবার মধ্যে :
কবি কলম বন্ধ কর না। লিখে চল অবিরাম। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। তোমার কবিতা আজ বাতাসে তুফান হয়ে আসে। বেঁচে থাক কবিতা তোমার। তুমি আমি থাকব না আর। কিন্তু থাকবে এ সব ইতিকথা যা বলে সত্য যথা। এখনো উঁকি মারে চেতনার আকাশে। রক্ত ঝরে আজও এই বিদায় বেলায়। নতুন প্রজন্ম জানে না সব কথা। তাদের জন্য রাখা সঠিক এ বার্তা । মহিম আসগরের মা আজও অপেক্ষায়। কবে ফুল ফুটবে তার ভাঙা চালের গালিচায় ।
মনার মা পিসিরা আজও ওদের ফিরে আসার অপেক্ষায়। ওরা হারায় না, ফিরে আসে বার বার। নতুন সাজে নতুন উদ্যমে :
ওরা কি হারায়? কেউ ওরা হারায় না। ওরা ওই বাউন্ডেলে দল। জেগে থাকে আমাদের ভাবনায়। ওরা সবাই রক্তবীজের সন্তান। আজও খুঁজে ফেরে নতুন সকাল । ফলবে একদিন ফল। রাইফেল হাতে ভাড়াটে বাহিনী ওদের খুঁজে ফেরে বেলেঘাটা থেকে বাস্তার
জঙ্গলে সমুদ্র তটে বস্তিতে বস্তিতে। রক্ত জমা কত সে কাহিনী নীরবে গুমরে মরে আকাশে বাতাসে। মনার মা আজও অপেক্ষায় শাঁখ হাতে দাওয়ায় । ওরা কবে ফেরে যুদ্ধ শেষে মুক্তির নিশান হাতে। এ অন্ধকারের বিদায় বেলায় ।
ধীমান ঘুমিয়ে পড়েছিল । সুকন্যা তাকে ডাকে। ধীমান ধড়পড় করে উঠে বসে । এ কি অনুষ্ঠান শেষ ! এতক্ষন সে কি দেখছিলো ! সব যেন এলোমেলো আবার । স্মৃতির পাহাড়টার আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ছে। ধীমানের বুকে একটা যন্ত্রনা কেঁদে ওঠে। সূত্রধর বোঝে. সবটা হালকা করে দেওয়ার জন্য বলে,
তোর দেখছি মরণ দশা । কেলিয়ে পড়েছিস। এবার তোর জন্য একটা স্মরণ সভার আয়োজন করতে হবে । সুকন্যা বোঝে না হাসবে না কাঁদবে ।
ধীমান সুকন্যা বাড়ি ফেরে। ধীমানের অস্বস্তিটা যায় না। পরের দিন ১৫ ই অগাস্ট। ভারতের স্বাধীনতা দিবস। ধীমানও ফেলে এসেছে তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সত্তরটা স্বাধীনতা সকাল। সে যখন তার শৈশবে বাল্যে তখনও সেই প্রতিটি সকালই তাকে আবিষ্ট করে রাখতো একটা আবেগে। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে পাড়ার দাদা দিদি বাড়িতে বাবা কাকা সবার সঙ্গে সে মিলত সে আবেগে। ভারত আজ স্বাধীন, প্রতিটি নাগরিক পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত এবার। স্বাধীন সরকার ভারতের প্রতিটি মানুষের জন্য নতুন এক ভারত গড়ে তুলবে যেখানে ক্ষিধের জ্বালা থাকবে না, থাকবে না বেকারির যন্ত্রনা, শিক্ষা স্বাস্থ্যের অভাব হবে না। এই বিশ্বাসের ওপর ভর করে প্রতিটি স্বাধীনতা দিবস তাকে তার ছোটবেলায় মোহগ্রস্ত রাখতো। প্রভাত ফেরি গান কবিতা বক্তৃতায় মুখর হয়ে থাকত প্রতিবছরের ওই নিদৃষ্ট ভোরগুলো। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবের অভিজ্ঞতা তার মননকে অন্য খাতে ঠেলে নিয়ে যেতে শুরু করে। একটা বিকল্প সমাজ ভাবনা তার চেতনার জগতে তাকে অন্যরকম ভাবনায় আবিষ্ট করে তোলে। সাম্যবাদের প্রতি এক নিঃশর্ত আনুগত্য দানা বাধে। যুক্তি দিয়ে সে ভারতের স্বাধীনতা ও তার পরের অবস্থাকে বোঝার চেষ্টা করে, এই ব্যবস্থার বৈরী হয়ে ওঠে তার মনন, সুকান্তের অবাক পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে ভারত। প্রশ্ন ওঠে এ ভারত কি সত্যি স্বাধীন ভারত, এ ভারত কি আত্মসম্মান নিয়ে নিজে টিকে থাকতে পারবে, নাগরিকরা কি তাদের অধিকার ফিরে পাবে, দুবেলা দুটো ভাত কি সবার জুটবে? এ সবই তাকে ভাবিয়ে তোলে। এরই মধ্যে আকাশ বাতাস মুখরিত হয় সত্যিকারের স্বাধীন ভারতের দাবিতে। সমাজতান্ত্রিক ভারত গড়ে তোলার দাবিতে মানুষ সোচ্চার হতে থাকে। শ্লোগান ওঠে, এ আজাদী ঝুটা হ্যায়। ধীমানের মানসপটে যে চলতি ভারত ভেসে ওঠে তার স্বরূপটা ধীমান কয়েক ছত্রে তুলে ধরে তার লেখনীতে :
সত্তর বছর আগে সেদিন । ১৫ ই আগস্ট ১৯৪৭ । নাচে গানে কবিতায় তাক ধিনা ধিন ধিন। দিনটা ঐতিহাসিক ভারত হল স্বাধীন। আনন্দ সংবাদ। আমরা নই আর পরাধীন। চারিদিকে হর্ষধ্বনি । ঘোষণা হৃদয় বিদারক। স্বর্গলোক যাত্রিণী মা হলেন মুক্ত। মুক্তির ফরমান শুনি।
তাঁর ইহকাল সমাপ্ত। তিনি পরলোকগত। ফাঁস তার গলায়। ফাঁসিতে তিনি হত। দেহে প্রাণ নেই আর। ধর থেকে মুন্ডু বিচ্ছিন্ন। ভারত দ্বিখন্ডিত । দুই জাত, দুই পাত । সেই থেকে স্বাধীনতা দিবস মায়ের প্রয়াণ দিবস। সন্তানেরা আশ্রয় হারা। ভিক্ষাপাত্র হাতে ভিক মাগে সবহারা। ঘুরে ফেরে আজও, আশ্রয়ের খোঁজে তারা ।অনুগ্রহের ডালি হাতে নয়া শাসক । তাক ধিনা ধিন ধিন। বন্দুক হাতে নয়া অভিভাবক। এসেছে আজাদ, আমরা স্বাধীন।
ধীমান বিশ্বাস করা শুরু করে যে সেদিন স্বাধীনতা নয় ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল এই মাত্র । দেশি শাসকের মুখোশে বিদেশী শাসক। ভারতের অর্থনীতির লাগাম তাদের হাতে। নামে মাত্র প্রজাতন্ত্র সমাজতন্ত্র। কার্যত স্বৈরতন্ত্র হয়ে ওঠে ধনিদের অবাধ গণতন্ত্র আর গরিবদের জন্য লাঠি গুলি। দরিদ্র পীড়িত ভারতে বেকারত্ব লাগাম ছাড়া। দুর্নীতির প্রসবখানা ভারত। খন্ডিত এ ভারতে সাম্প্রদায়িক হানাহানি। কর্পোরেট জগতের অবাধ লুন্ঠনাগার ভারত। এ ভারতে বিদ্রোহ দিকে দিকে। নৌবিদ্রোহের পর তেলেঙ্গনা, তেলেঙ্গনা থেকে তেভাগা নকশালবাড়ি ছত্তিশগড়। সময়টাকে ধীমান ধরে রাখার চেষ্টা করে তার লেখনীতে :
দশকটা উনিশ শতকের সত্তর। পঞ্চাশ বছর আগে পশ্চিম বঙ্গ তখন লাশকাটা ঘর, সারবাঁধা লাশ পরে আছে একটা আরেকটার ওপর। পুলিশ লকআপ থেকে জেল, জেল থেকে হাসপাতাল হাসপাতাল ঘুরে শ্মশান, রাজপথ ধরে অন্ধ গলির আনাচে কানাচে ওরা গায় মুক্তির গান; কারা হানা দেয়? ক্ষুধার্ত শ্বাপদ, কারাগারের অন্ধকার ঘিরে রাখে মুক্ত ময়দান, নবজাতকের ঠিকানা তখন লাশকাটা ঘর। এরই মধ্যে মুক্তিসূর্য উঁকি মারে আবার। ঘুমন্ত শবের চেতনায়; নতুন সাজে বিনয় বাদল দীনেশ, দেখা দেয় সূর্য সেন বার বার। বন্দুকের মুখে কিশোর যুবক, গুলির শব্দ ছাপিয়ে স্লোগান শোনা যায়----- 'বিপ্লব জিন্দাবাদ'' এ আজাদী ঝুটা হ্যায়'। সন্দেহের মেঘ জমে আবার, বাতাসে দূষণ ছড়ায়। এ বঙ্গে আজ সমাজকে গ্রাস করে ভোগবাদ। ১৫ ই আগষ্টের কালা কারবার। 'স্বাধীন' এ ভারতে বিভেদ বিদ্বেষের রাজনীতি। ফিরে আসে মন্বন্তর আবার।
ধীমানের চেতনা তাকে যেন কালের বার্তা পৌঁছে দেয়। এক রক্তক্ষয়ী শ্রেণিযুদ্ধ যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এই চিন্তার জন্ম মানুষের বাস্তব অবস্থা থেকে উদ্ভূত চেতনার প্রসবখানায়। সেখানে আগামীর বার্তা:
ছোট্ট ছোট্ট কথা
মৃদু মন্দ ব্যাথা
স্পর্শ করে হৃদয়
মন করে জয়
বাতাসের মর্মর ধ্বনিতে
ঝর্ণার কল কল রবে
কালের বার্তা ভেসে আসে
শুকনো পাতায় আগুন জ্বলে
সে জানিয়ে যায়
বর্ষা এই এলো বলে
পোয়াতি মাটি কেঁদে ওঠে
জীবনের বাগানে ফল ফলে l
ঘুম আসে না
কালের বার্তা শুনি,
আমি জেগে থাকি
প্রহর গুনি
ঢং ঢং ঢং ———
রাতের প্রহরী আমি
পাহারায় বসে আছি
হিসেবের খাতা হাতে,
কে আসে কে যায়
জীবন তরী বেয়ে
লেনদেনের বোঝা বায়,
আমি থাকি অপেক্ষায়
কখন সূর্য ওঠে
সব লেনদেন মিটিয়ে,
তমসাঘন এই রাতের শেষে
মুখোমুখি সুকন্যা আমার
ইশারায় ডেকে যায়
দূর হয় এ আঁধার।
ধীমান তার আজের এই বার্ধক্য আর একাকিত্ব পেড়িয়ে অতীত অবগাহন করে । বহুজনের মধ্যে তাদের সংগ্রামের মধ্যে নিজেকে ফিরে পেতে চায়। আধুনিক সভ্যতার বিচ্ছিন্নতা তাকে পীড়া দেয়। যে সমাজের আবির্ভাবকে সে অবলোকন করে সেই সমাজের প্রতি সে দায়বদ্ধ। সে সমাজ গঠনের লড়াইয়ের সাথী সে। তার বার্ধক্য তার পথে বাধা হতে পারে না। তাই সে লেখনী ধরে । তার মনন জানান দেয় :
বার্ধক্যের এই বারবেলায় দিবা নিশি এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে তার নিজের একাত্ম বহুত্ব খুঁজে বেড়ায়। জীবনের ক্ষেতে চাষের আল বেয়ে মুক্তির গান গায়। একাকিত্বের সীমা পেড়িয়ে সুদূর অসীমে জনতার বীণার তানে বহুত্বের ঝংকার সে শোনে। বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে বহুর সন্ধানে জীবনের খেয়া বেয়ে মানুষের ঘাটে তরী ভেড়ে অভিজ্ঞতার ডালি হাতে। বর্ণাঢ্য এ জীবনে নানা বর্ণের মিলন প্রচ্ছদে বার্ধক্য ডানা মেলে তার জীবন প্রাঙ্গনে।
তার দাবি শোষণ ভিত্তিক এই সমাজের ধ্বংস ঘটিয়ে নতুন শোষণমুক্ত সাম্যবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠা। তাই সে নেখনি ধরে :
সময়ের প্রবাহে
সাম্যের দাবিতে
বাল্যের বেলা শেষে
কৈশরের আগমন।
কলি ফোটে জীবনের কাননে,
কৈশোরের নাও বেয়ে
পৌঁছে যাই যৌবনের খেয়া ঘাটে,
সাম্যের তনয়া ইশারায় ডাকে
তার চোখের নজরে
বার্তা ভেসে আসে,
স্নায়ুর জগৎ হয়ে
বেঁধে এসে আমার পিঞ্জরে,
আমি বার্তাবাহী তার
বলে যায় সংগোপনে,
বসন্তের সন্ধ্যায়
কোনো এক পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়
নীরব আলিঙ্গনে
মিলতে চায় আমার আঙিনায়।
সে অতীতকে আহবান করে নেহাত অতীত বিলাসী বলে নয়। অতীত তার কাছে শিক্ষার ভান্ডার। অতীতের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের চলার পথ দেখায়। ভুলগুলোকে ঠিক করে নতুন করে চলার পথে চলার দিশা মেলে। সে বলে:
কথা কও কথা কও
হে বন্ধু অতীত আমার,
কেন তুমি নীরবে চেয়ে রও
বল তুমি কথা
বুঝি যেন যথা
হোক না কর্কশ সে বার্তা;
নীরব থেকো না তুমি
তুমি কও কথা।
চলার পথে পথিক আমি
আমি পথ খুঁজে ফিরি
সে পথ দেখাও তুমি,
তোমার কথা আমার নিশানা
তোমার নীরবতা আমায় কাঁদায়,
কেন তুমি আনমনে চেয়ে রও?
আমি থাকি অপেক্ষায়
হে অনাদি অতীত
কথা কও কথা কও।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন