বিরহ
নন্দিতা আর প্রকাশের আজ তেরো বছরের বিবাহিত জীবনের মানসিক অবসান ঘটে গেল। ডিভোর্সটা এখনো না হলেও দুজনেই এখন থেকে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নন্দিতা আর প্রকাশের বিয়েটা হয়েছিল পাঁচ বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর। নন্দিতা এক বছরের বড় প্রকাশের থেকে। প্রকাশের পরিবার ব্রাহ্মণ আর নন্দিতার বাপের বাড়ি কায়স্থ। কিন্তু এই জাতপাত বা বয়স ওদের ভালোবাসায় বাঁধ সাধতে পারেনি।
নন্দিতা যে সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করতো, সেই কোম্পানিতেই সদ্য কলেজ পাশ করে প্রকাশ ঢুকেছিল। সেখান থেকেই ওদের বন্ধুত্ব শুরু। আর সেই বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি।
নন্দিতা আর প্রকাশ দুজনেরই অতীতে প্রেম ভাঙার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু দুজনের সেই অভিজ্ঞতাকে ওরা দুজনই কোনোদিন তেমন আমল দেয়নি।
একেবারে যেটাকে বলে একদম 'মেইড ফর ইচ আদার', সেটা ছিল দুজনেই প্রথম থেকে। যেমন দুজনেই দেখতে, তেমন মাথায় বুদ্ধি, তেমনি ওদের বন্ধুত্বপূর্ণ আর পরিপক্ক সম্পর্ক।
কিন্তু, নন্দিতা আর প্রকাশ, কারোও বাড়িতেই ওদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি। বাধ্য হয়ে দুই বাড়িতে জানিয়েই তাদের অমতে বিয়ে করেছিল দুজনে।
অনেকেই তখন ওদের বলেছিল যে বাবা-মায়ের আশির্বাদ ছাড়া বিয়েতে ওরা সুখী হবেনা। সেসবকে উড়িয়ে দিয়ে ভালোবাসার জোরে ওদের সম্পর্ক দিনে দিনে পক্ত হয়ে উঠছিল।
কিন্তু ওদের দুজনেরই একটা চাহিদা ছিল, সন্তান। কিন্তু নন্দিতার শরীর সন্তান ধারণে অক্ষম ছিল। প্রকাশ সেটার জন্য নন্দিতাকে কখনো দোষ দেয়নি।
কিন্তু ওদের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি হয় তখন, যখন বিয়ের প্রায় এগারো বছর পর প্রকাশ চেয়েছিল সারোগেসি মাদারের দ্বারা সন্তান নিতে। নন্দিতা সেটায় রাজী হয়নি। নন্দিতা চায়নি প্রকাশের স্পার্ম দিয়ে অন্যের পেটে ওদের সন্তান হোক। নন্দিতা বলেছিল সন্তান দত্তক নেওয়ার জন্য। কিন্তু সেটায় আবার রাজী হয়নি প্রকাশ। ও অন্যের সন্তানকে নিজের বলে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবেনা জানিয়ে দিয়েছিল।
সেই থেকে শুরু নন্দিতা আর প্রকাশের সুন্দর সম্পর্কে ছেদের। প্রথম প্রথম খুব ঝগড়া হতো দুজনের মধ্যে। তারপর আসতে আসতে সেটা বন্ধ হয়ে গেল। দুজনের মধ্যে কথাবার্তা কমে যেতে লাগলো। একসময় দুজন দুজনের কোনো খবরই রাখা ছেড়ে দিল।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে চা করে প্রকাশ বারান্দায় বসে নন্দিতাকে নিয়ে।
প্রকাশ জিজ্ঞেস করে নন্দিতাকে, "আমাকে আর ভালোবাসো না, তাই না?"
নন্দিতা তিক্ততার সাথে জবাব দেয়, "জানিনা।"
"দেখো, আজ আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।"
"কিসের সিদ্ধান্ত?"
"আমাদের সম্পর্কের।"
"কেমন সিদ্ধান্তের কথা বলছো?"
"আমার মনে হয় আমাদের সম্পর্কটা খুব বেশী তিক্ত হয়ে গেছে। এভাবে কোনো সম্পর্ক টিকে থাকতে পারেনা। এতে না তুমি ভালো থাকতে পারবে, না আমি। তার থেকে ভালো আমরা আলাদা হয়ে যাই।"
"তুমি পারবে আলাদা থাকতে?"
"কষ্ট হবে তোমাকে ছাড়া থাকতে। কিন্তু তোমার সাথে থেকেই বা সুখী কোথায় বলো?"
"সেটাই" বলে নন্দিতা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো।
"তাহলে তুমিও আমার সাথে সহমত?" প্রকাশ জিজ্ঞেস করলো।
"হ্যাঁ সহমত।" নন্দিতা জবাব দিল।
"তাহলে তুমি এই বাড়িতেই থেকো, আমি আমাদের নতুন ফ্ল্যাটটায় চলে যাবো।"
"ঠিক আছে।"
নন্দিতা আর প্রকাশ আলাদা হয়ে গেছে প্রায় তিন মাস হলো। এই তিন মাসে কেউ কারোও সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। দুজনের দুজনকে মনে পড়েনি, তা নয়। কিন্তু ওই যে অহং। নন্দিতা ভাবছে প্রকাশ না করলে ও কেনো করবে। আবার প্রকাশ ভাবছে নন্দিতা বা করলে ও কেনো করবে। এই চলছে দুজনের মধ্যে।
প্রতিবার দুর্গাপূজায় নন্দিতা আর প্রকাশ তিনদিন ধরে ঘুরে শহরের সব প্যান্ডেলের ঠাকুর দেখে। কিন্তু এবার দুর্গাপূজা কোথা দিয়ে কেটে গেল তা দুজনের একজনও বুঝে উঠতে পারলো না।
দুর্গাপূজা শেষে দশমী আজ, মায়ের বিদায় বেলা। এই দিনে প্রতি বছর নন্দিতাকে প্রকাশ নিজে হাতে সিঁদুর পড়িয়ে দশমী পালন করে। কিন্তু এবার দুজন দুজনের থেকে অনেক দূরে।
বুকে একহ্রাস কষ্ট চাপা নিয়ে নন্দিতা ফোন করলো প্রকাশকে-
-হ্যালো।
-কেমন আছো?
-এই চলছে। তুমি?
-আমারও তাই। শুভ বিজয়া দশমী।
-ওহ হ্যাঁ, আজ তো দশমী। শুভ বিজয়া দশমী তোমাকেও।
-আজ খুব কষ্ট হচ্ছে জানো?
-কেনো? কি হয়েছে?
-প্রতি বছর তুমি আজকের দিনে আমার সিথিতে সিঁদুর পড়িয়ে দাও। এত বছরে এই প্রথম যখন সেটা হবেনা।
-হুম! আমিও সেটা ভাবছিলাম। কিন্তু আজ শুধু সেই স্মৃতির জন্যই আমার কথা মনে পড়লো?
-যদি বলি প্রতি মুহুর্তে তোমার কথা মনে পড়ে। বিশ্বাস করবে আমার কথা?
-করতে পারি। কিন্তু এত মাসে আমার একবারও খোঁজ নাওনি কেনো?
-তুমি নিয়েছিলে?
-অহং?
-তাই বলতে পারো। তোমার আর আমার অহংটাই বোধহয় আমাদের সবটা কেড়ে নিল।
-আমারোও তাই মনে হয়।
এরপর নন্দিতা কিছু বলার আগেই ওর বাড়িতে পাশের বাড়ির বান্ধবী ডাক দিল দুর্গামাকে সিঁদুর ছোঁয়াতে যাওয়ার জন্য।
-আচ্ছা রাখছি এখন। গার্গী ডাকছে, মাকে সিঁদুর ছোঁয়াতে যাবো।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
নন্দিতা ফোন রেখে গার্গীর সাথে বেড়িয়ে পড়লো পাড়ার ক্লাবে দুর্গামাকে দশমীর সিঁদুর ছোঁয়াতে।
নন্দিতা ভিড় ঠেলে দুর্গামাকে সিঁদুর ছুঁইয়ে মন্ডপ থেকে নিচে নামতেই চোখের সামনে প্রকাশকে দেখে এক্কেবারে অবাক, "তুমি?"
প্রকাশ মুখে কিছু না বলে নন্দিতার হাতের পূজোর থালা থেকে সিঁদুর নিয়ে পড়িয়ে দিল নন্দিতার সিথিতে। নন্দিতা পুরো ব্যাপারটাতে একদম 'থ' হয়ে গেল।
নন্দিতা পুরো ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই প্রকাশ বললো, "আমিই তোমাকে কয়েকদিন আগে আমাদের সম্পর্কের অবস্থানটা বলে আলাদা হয়েছিলাম। আজ আবার আমিই বলছি, আমাদের সম্পর্কটা এতটাও ঠুনকো হয়ে যায়নি যে আজকের দিনে তোমার সিথিতে সিঁদুরটা আমি পড়াতে পারবো না। আজ যে শুধু তুমি একা কষ্ট পাচ্ছিলে তা নয়, কষ্ট আমিও পাচ্ছিলাম। তোমার সাথে কথা হওয়ার পর বুঝলাম, আমাদের দুজনের মাঝের মূল অসুবিধে হলো অহং আর সমাযোজনের অভাব। আর সেটা দূর করতে পারলেই আমাদের মাঝের বিশাল দূরত্বটা অনেক বেশী ক্ষীণ হয়ে আসবে।"
প্রকাশের কথা শুনে নন্দিতা আর নিজেকে সামলাতে না পেরে চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রকাশকে। কিছুক্ষণ পরে অনেক আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আমরা কি আবার আমাদের সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে পারিনা?"
"অবশ্যই পারি" বলে প্রকাশ আরোও শক্ত করে নিজের বাহুতে নন্দিতাকে জড়িয়ে ধরলো।
নন্দিতা আর প্রকাশের মাঝের দূরত্বই ওদের কাছে আসার মাধ্যম হয়ে উঠবে তা ওরা কখনো ভাবেনি। তাই হয়তো বলে, মাঝে মাঝে দূরত্বটা দরকার সম্পর্ককে নতুন সুযোগ দেওয়ার জন্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন