অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া
বেলা ছোট হয়ে এল,এখনই কড়া রোদ্দুর তো পরক্ষণেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এবং আবার কড়া রোদ এবং নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা।আকাশে বাতাসে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন।শিউলির ডালে কুড়ি ভরে এল টগর ফুটিল মেলা।চারিদিকে কাশ ফুলের সমারোহ-এসবই জানিয়ে দেয় শরৎ এসেছে।আর হিমের পরশ তো উপরি পাওনা বিশেষ করে সকাল সন্ধ্যায়।তার অরুণ আলোর অঞ্জলি দেখে হৃদয় মন ভরে যায়।এই সময় থেকেই ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু জমতে দেখা যায়।নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা,চারিদিকে কাশফুলের সমারোহ বড় বেশি স্মৃতিমেদুর করে তোলে আমাদের।প্রবীনদের,নবীনদেরও।প্রবীনদের মনে পড়ে অনেক পুরনো কথা,মধুরস্মৃতি,দুঃখের স্মৃতিও।পাওয়া না পাওয়ার বেদনা থাকলেও এই সময় মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরির খেলা দেখে মন কি আর বিষণ্ণ থাকতে পারে।স্মৃতিমেদুর মন বারবার অতীতেই ফিরে যেতে চায়। ভাবে আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।হ্যাঁ, আমি বিশেষ করে এখানে স্কুলজীবনের কথা বলতে চাইছি।ওই সময় শরতের দিনগুলি যেভাবে কাটিয়েছি তার কথা বড় বেশি মনে পড়ে।আমরা কখনও মাঠের আল ধরে কিংবা ফাঁকা রাস্তায় কয়েকজন মিলে ' মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি/আহা,হা হা হা' –এই গান গাইতে গাইতে দৌড়ে দৌড়ে নেচে বেড়াতাম।প্রকৃতির অপরূপ রূপ দেখে যেমন আনন্দ হত তেমনি কয়েকদিন পরেই পুজো আসছে বলে স্কুলের ছুটি হয়ে যাবে এই আনন্দও কোনও অংশে কম ছিল না বরং বেশিই বলা যায় কারণ বেশ কয়েকদিন বই ছুঁতে হবে না।এসব খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এখনকার কথা অবশ্য আলাদা। কাশফুল ছোটরা এখন অনেকেই চেনে না।ধানের ক্ষেতই তো অনেকেই দেখেনি তাই কী করে বুঝবে এই বাণীর সারমর্ম-'আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরির খেলা রে ভাই, লুকোচুরির খেলা।'নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা অবশ্য অনেকেই বোঝে যদি সেখানে আকাশ বলে কিছু থাকে।শহরের উন্নয়নে আজ ঢাকা পড়েছে আকাশ।
শরৎ এলে কত কথায় মনে পড়ে যায়।স্মৃতির সরণি বেয়ে চলতে চলতে আমরা বিভোর হয়ে পড়ি।মনে পড়ে কুমোরদের দুর্গামূর্তি গড়া দেখার কথা। তারা বনেদি বাড়ির পুজোগুলোতে বংশপরম্পরায় মূর্তি গড়তে আসত আর আমরা তা বসে বসে দেখতাম এবং তাদের নানা কৌতূহলী প্রশ্নে জেরবার করতাম।মনে পড়ে আগমনি গানের কথা।পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকে খঞ্জনি/মন্দিরা বাজিয়ে কিছু মানুষ দ্বারে দ্বারে গান গেয়ে ভিক্ষে করতে আসত।সেই সব গানের কথা হয়তো আজও অনেকেই ভুলতে পারেনি।সেই আগমনি গান এখন আমরা সিডি এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে গায়ক-গায়িকার কন্ঠে শুনতে পাই ঠিকই তবু মনে হয় সেই ফ্লেভারটার কোথাও যেন একটু অভাব আছে।নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘ দেখে আমাদের অনেক কথা মনে পড়ে যায়।রবীন্দ্রনাথের গানের কথা দিয়েই বলি-'হৃদয়ে ছিলে জেগে,দেখি আজ শরত মেঘে।অর্থাৎ কিছুই হারিয়ে যায়নি,ওই মেঘ দেখেই আমাদের কত কথা মনে পড়ে যায়।এমনই সেই মেঘের জাদু।এই সাদা মেঘের সাথে আমরা মনকে উড়িয়ে দিয়ে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করি।শরতের একটা মোহময়ী রূপ আছে আর এই রূপের কাছে আমরা সকলেই কম বেশি নিজেদের সমর্পণ করে বসি অজান্তেই। এমনিই তার জাদু।'কে রয় ভুলে তোমার মোহনরূপে।'
নয়ন ভোলানো যে শরৎ আসে তাকে প্রকৃতি ও মানুষ এইভাবে অভিবাদন জানায়-'আমার নয়ন ভুলানো এলে/আমি কি হেরিলাম হৃদয় মেলে/শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে/শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণরাঙা চরণ ফেলে/নয়ন-ভুলানো এলে।'চারিদিকে স্বচ্ছ ঝকঝকে একটা পরিবেশ।আকাশের গায়ে যেন পুজো পুজো গন্ধ।এই শরৎকালের বড় উৎসব তো দুর্গোৎসব বা শারদোৎসব।স্বচ্ছ পরিবেশের কথা বললাম এই কারণে যে এই সময় রাস্তাঘাট এবং চারপাশ খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। আগে গ্রামবাংলায় দুর্গাপুজোর প্রায় এক/দেড় মাস আগে থেকেই ঘরদোর পরিস্কার করার একটা ধুম লেগে যেত।সমস্ত বাড়ি চুনকাম করা হত।এখন সেই ছবি অনেকটাই বদলে গেছে।এইসব ভাবতে ভাবতেই অন্তরে বেজে ওঠে সেই গভীর সুর- বাজলো তোমার আলোর বেণু।এই সুর অন্তরে ধ্বনিত হলেই মনে পড়ে যায় মহালয়ার কথা।মনে পড়ে যায় সেই ছোটবেলায় আধো ঘুম-জাগরণে রেডিয়োয় 'মহিষাসুরমর্দিনী' শোনার কথা।সেই জলদগম্ভীর কন্ঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র পাঠ-'আশ্বিনের শারদপ্রাতে- আজও কেমন যেন বিহ্বল করে তোলে।তবে একটা কথা না বললেই নয় তাহল আমাদের ছোটবেলায় মহালয়া শোনার যে আকুল আগ্রহ ছিল এখনকার ছোটদের মধ্যে সেই আগ্রহ নেই বললেই চলে।
শুরু হয় দিন গোনা। সেই দিন এসেও যায়।এই উৎসবকে আমরা এতটাই ভালোবাসি যে চারদিনের জায়গায় বাড়িয়ে এখন আট/দশ দিন করে নিয়েছি কোথাও কোথাও।এখন থিম পুজোর বড় আকর্ষণ।পুরো উৎসবের সিংহভাগটাই এখন কর্পোরেট দুনিয়ার কবলে তাই নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন। মানুষ যেমন ক্রমশ আসবাবে পরিণত হচ্ছে তেমনই এই উৎসবের যত জৌলুসই থাক না কেন তার কৌলিন্য এবং আন্তরিকতা হারাচ্ছে।মহামিলনের এই উৎসবের প্রকৃত আনন্দও তাই ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।আগে এই শারদোৎসবের বেশ কিছুদিন আগে থেকে খই ভাজা হত,সেই খই থেকে মুড়কি,খই কূটে গুড় অথবা চিনি দিয়ে নাড়ু,নারকেল নাড়ু,টানার নাড়ু-এইসব মা-ঠাকুমারা বানাতেন।এছাড়াও অনেক কিছু বানাতেন,আমি শুধু কয়েকটির কথা এখানে উল্লেখ করলাম।এই চিত্রটা অবশ্য অনেকটাই গ্রামবাংলার।এখন কি সে সব আছে? এখন সব দোকানেই পাওয়া যায়।এই সময় যারা বাইরে অর্থাৎ শহরে বা চাকুরিস্থলে থাকত তাদের অনেকেই দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে গ্রামের বাড়িতে এসে উৎসবে শামিল হয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিলিত হত।সে ছবিও পাল্টে গেছে।এখন এই সময়টায় অনেকেই বাইরে ঘুরতে চলে যায়।
এবার আসছি পুজোর গান এবং শারদ সাহিত্য প্রসঙ্গে ।আগে পুজোর প্রায় মাস খানেক আগে বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানি থেকে বিখ্যাত শিল্পীদের গাওয়া গানের রেকর্ড প্রকাশিত হত এবং তা শোনার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।সে সব গান আজও অনেকের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে।এখন প্রায় সারা বছর ধরেই গানের সিডি, অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। কাজেই এখন পুজোর গান বলে আর কিছু নেই বললেই চলে।এইসময় যেন সাহিত্যেরও পরব শুরু হয়ে যায় এবং প্রচুর পত্রপত্রিকার শারদীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়।স্বাধীনতা দিবসের পর থেকেই বিগহাউসের শারদীয় সংখ্যার প্রকাশ শুরু হয় এবং মহালয়ার আগেই সে কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যায় বলা যেতেইপারে।এইসময় প্রচুর লিটিলম্যাগাজিনেরও শারদীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয় এবং যতদিন যাচ্ছে তা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
নীল আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা,চারিদিকে কাশফুলের সমারোহ,শিউলি ফুলের হাসি ভোরের শিশির,কমলা রঙের রোদ-এসব দেখে অনেক কথাই মনে পড়ে গেল,যার কয়েকটির কথা বললাম মাত্র।আপনাদেরও নিশ্চয় এই লেখা পড়তে পড়তে অনেক কথাই মনে পড়বে যা আমি বলতে পারলাম না।
B-4/3,ROAD NO-5,RIVERSIDE TOWNSHIP, BURNPUR,WEST BARDHAMAN.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন