মহান ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কিছু কথা
অঞ্জনা দেব রায়
কোনও-কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু লিখতে বেশ ভয় করে , কারণ মনের মধ্যে সাহস হারিয়ে ফেলি, ভাবি সত্যজিৎ রায় এমন একজন মহান ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে লেখা খুবই কঠিন ব্যাপার । কেননা আমার জন্মের আগেই অনেক মহান ছবি যেমন পথের পাঁচালী (১৯৫৫) , অভিযান( ১৯৬২), মহানগর(১৯৬৩) এছাড়া আর অনেক ছবি প্রকাশিত হয়েছে । তাঁকে সরাসরি দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি । তবে বড় হয়ে তাঁর কিছু ছবি যেমন পথের পাঁচালী , চারুলতা, শাখা প্রশাখা ইত্যাদি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এছাড়া সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বিভিন্ন গুণী লেখকের লেখা পড়ে ও তাঁর তৈরি ছবি দেখে যেটুকু মনে হচ্ছে তাই লিখছি ।
সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী আমাদের মনে করিয়ে দেয় চলচ্চিত্র প্রাথমিকভাবে দৃশ্যমাধ্যম, তারপর আসে শোনা , এবং সেই দৃশ্যকে কতখানি সৌন্দর্যবোধে উপস্থাপিত করা সম্ভব, সেই ব্যাপারটা সত্যজিৎবাবু তাঁর প্রথম ছবি থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন । তাঁর প্রতিটি ছবিতেই নিজের দেশের আবহ , সংস্কৃতি স্পষ্টভাবে বোঝা যায় । সত্যজিৎ রায়ের ছবির সৌন্দর্য শালীনতা সভ্যতা আসলে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরই প্রকাশ ।
বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র মাধ্যমকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের ইতিহাসে । শুধু সিনেমা নয় , একটি সংস্কৃতির যা – যা নির্ণায়ক থাকতে পারে যেমন সংগীত , সাহিত্য, চিত্রশিল্প সেই সব ক্ষেত্রই কী আশ্চর্য স্বাভাবিকতায় আত্মস্থ করেছিলেন তিনি । সত্যজিৎ রায়ের প্রসঙ্গে অবধারিত চলচিত্রের কথা এসে পড়লেও সৃজনশীলতার প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর স্বকীয় উদ্ভাস আমাদের বিস্মিত করে । লেখার জগতে সত্যজিৎ রায়ের কলমের জাদু যে কতদুর বিস্তৃত তার প্রমান তাঁর শিশু ও কিশোরদের জন্য লেখাগুলি । এছাড়া বড়দের জন্য তাঁর ভাবনা জাগানো লেখাগুলি তো এক একটি মাইলফলক ।
আমরা জানি সত্যজিৎ রায়ের ছোটবেলা শিল্প সাহিত্যের উজ্জ্বল আবহে কেটেছে । ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছবি আকায় দক্ষ , আর সেটা পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে । পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর এবং পিতা সুকুমার রায় উভয়েই সাহিত্যের পাশাপাশি ছবি আঁকিয়ে তথা ইলাস্ট্রেটর হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ।
শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত ছবির মধ্যে নন্দলাল ছাড়া অন্য কোনও শিল্পীর কাজ তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি । নন্দলালের শিক্ষা , বিনোদবিহারীর সাহচর্য আর শান্তিনিকেতনের ঊষর প্রকৃতি সত্যজিৎ রায়ের শিল্প ভাবনাকে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে । পথের পাঁচালীর মতো ছবি যে গুরু নন্দলালের শিল্প সাহচর্য ছাড়া সম্ভব ছিল না , সে কথা বলেছেন সত্যজিৎ রায় নিজেই । লিখনশিল্পেও শান্তিনিকেতনের কাছে তাঁর ঋণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে স্বীকৃত । তিনি বলেছেন 'আমাকে ক্যালিগ্রাফি শিখিয়ে ছিলেন বিনোদদা । তিনি জাপানে ভ্রমণকালে এই শিল্পটি আয়ত্ত করেছিলেন । এই ক্যালিগ্রাফি শেখার ফলে পরবর্তী জীবনে বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় এসে আমি হাতে কলমে তা প্রয়োগ করি ।' আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছেন , 'আমি মনে করি শান্তিনিকেতনে এই ক্যালিগ্রাফি না শিখলে আমি নতুন রীতির নকশা ও হরফশিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারতাম না ।' অভিনেতা শিশির ভাদুড়ীর ভাই মুরারীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এক চিঠি থেকে জানা যায় কবি লিখেছেন , ' ছায়াচিত্র এখনো পর্যন্ত সাহিত্যের চাটুকারবৃত্তি করে চলেছে তার কারণ কোনও রূপকার আপন প্রতিভার বলে তাকে এই দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে পারে নি ।' আরও বলেছেন , 'ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতিপ্রবাহ।' অবাক লাগে , রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনার কিছুকাল পরে তাঁরই আশ্রমের এক ছাত্রের হাতে তৈরি হল এমন 'ছায়াচিত্র' – যা কিনা প্রথমবার আমাদের দেশে সাহিত্যের 'চাটুকারবৃত্তি '-কে পরোয়া না-করে এগিয়ে গিয়েছে 'দৃশ্যের গতিপ্রবাহ' – কে ভর করে । মূর্ত করেছে 'চলমান রুপের' সেই 'সৌন্দর্য ' যা 'বাক্যের সাহায্য ব্যতীত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক ' - ভাবে প্রকাশিত হতে পারে । সত্যজিৎই তো সেই 'রূপকার ' যিনি আপন প্রতিভায় ভারতীয় চলচ্চিত্রকে সাহিত্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়েছেন ।
এ কথা বলা যায় যে , শান্তিনিকেতন হল সত্যজিৎ রায়ের সোনালী ফসলের উৎস , যেখানে অঙ্কুরিত হয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতির এক বিস্মিত ইতিহাস ।
আজ এখানেই শেষ করলাম, কেননা সত্যজিৎ রায় হলেন বহুমুখী প্রতিভাধর । তাঁকে নিয়ে জানার ,বলার বা লেখার শেষ নেই । তাই আমি অস্কার জয়ী বিশ্ববরেণ্য মহান চলচ্চিত্র পরিচালক , সাহিত্যক, চিত্রশিল্পী , পরম শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ রায় মহাশয় এর জন্ম শত বার্ষিকীতে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও শত সহস্র কোটি প্রণাম জানাই ।
--------------------------------------------------------------
লেখিকা – অঞ্জনা দেব রায়
তারিখ – ৭/৫/২১
ঠিকানা – ৫৫৩ পি মজুমদার রোড
কলকাতা ৭৮
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন