Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮৪তম সংখ্যা ।। ফাল্গুন ১৪৩১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ছবি
  এই সংখ্যায় একটি গ্রন্থ আলোচনা ও একটি ধারাবাহিক রচনা ছাড়া সব লেখাই ভাষা দিবস, মাতৃভাষা, ভাষাচেতনা ও ভাষা সমস্যা বিষয়ক রচনা। লেখাগুলি এই সংখ্যাকে অনেকটাই সমৃদ্ধ করেছে। পড়ুন। শেয়ার করুন। মতামত জানান। লেখকগণ নিজের নিজের লেখার লিঙ্ক শেয়ার করুন যতখুশি, যে মাধ্যমে খুশি। কিন্তু স্ক্রিনশট শেয়ার নৈব নৈব চ!  অন্য বিষয়ের লেখাগুলি আগামী সংখ্যার জন্য রইল।  সকলকে ধন্যবাদ, অভিনন্দন। ভালো থাকুন।   --সম্পাদক, নবপ্রভাত। ==  সূ  চি  প  ত্র  == প্রবন্ধ-নিবন্ধ অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙ্গালীর বাংলা ভাষা দুর্জয় দিবস।। বটু কৃষ্ণ হালদার ভাষা শহীদদের পঁচাত্তর বছর।। অনিন্দ্য পাল একুশে ফেব্রুয়ারি : বাঙালির শ্রেষ্ঠ অশ্রুবিন্দু।। জীবনকুমার সরকার কবিগানের সাহিত্যিক ও সমাজতাত্ত্বিক মূল্য।। বারিদ বরন গুপ্ত বিপন্ন মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি।। শ্যামল হুদাতী মায়ের দুধ আর মাতৃভাষা।। প্রদীপ কুমার দে একুশে ফেব্রুয়ারি : কিছু কথা।। বনশ্রী গোপ বাংলায় কথা বাংলায় কাজ।। চন্দন দাশগুপ্ত বিপন্ন মাতৃভাষা ও তার মুক্তির পথ।। মিঠুন মুখার্জী. হে অমর একুশে, তোমায় ভুলিনি, ভুলব না।। মহম্মদ মফিজুল ইসলা...

কবিতায় সেতুবন্ধন (তৃতীয় অংশ) শিল্পবিপ্লবোত্তর কাল ।। রণেশ রায়

কবিতায় সেতুবন্ধন (তৃতীয় অংশ) 

 শিল্পবিপ্লবোত্তর কাল 

 রণেশ রায়


এবার আসা যাক রোমান্টিক কাল আর ভিক্টরিয়া কাল। এই সময়কালকে বেষ্টন করে আছে শিল্প বিপ্লব  ও রেনেসাঁ কালের উষা লগ্ন ও তার পরের মধ্যগগন। রোমান্টিক কালকে (1785-1830) অনুসরণ করেছে ভিক্টরিয়া কাল (1830-1901) । মধ্যযুগের রাজতন্ত্র, পোপতন্ত্র আর সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রথমে বেনিয়ারাজ তারপর আধুনিক শিল্প যুগের আবির্ভাব ঘটেছে এই সময় কালে যা ধর্মের শাসনের জায়গায় আইনের শাসন বলবৎ করতে সাহায্য করে। এই দুটো  সময়কালকে পুঁজিবাদের বিকাশ ও তার ক্ষয়ের কাল বলা হয় যে সময়কাল ধরে প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদ বিকাশলাভ করে, তা সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয় আর পৃথিবী জুড়ে তার রাজত্ব বিস্তার করে। আর্থ সামাজিক রূপান্তরের সঙ্গে শিল্প সাহিত্যে এক বিপ্লবী পরিবর্তন আসে। কিন্তু শোষণ ব্যবস্থা ভিন্ন আঙ্গিকে টিকে থাকে। তার ক্ষয়ের দিকটা প্রকট হতে থাকে। সভ্যতার এক সংকট দেখা যায়।  


মানুষের চিন্তার জগতেও এই যুগের প্রথম পর্যায়ে  এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। নতুন এই সমাজের  উষালগ্নে মানুষ এক নতুন জীবনের কল্পনা করে। তার মননে জীবনের  উপাসনার কেন্দ্রবিন্দু হয় প্রকৃতি,প্রেম ও মানবতা। মানুষের জীবনধারণ বদলাতে থাকে। প্রথম যুগে  অর্থাৎ শিল্প সমাজের আবির্ভাব লগ্নে মানুষ তার ব্যক্তিসত্তাকে বুঝতে শেখে। ব্যক্তিস্বাধীনতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখে। মানুষ হয়ে ওঠে আশাবাদী আবেগ প্রবন। সে নিজের আবেগ দিয়ে নিজের মননে এই মহাবিশ্বকে দেখতে চায়। নিজের সত্তা অক্ষুন্ন রেখে সমাজে জায়গা করে নিতে চায় প্রেম ভালোবাসা দিয়ে। মধ্যযুগের বর্বরতাকে সে অস্বীকার করে। কিন্তু সেটা চায় তার ভাববাদের ডানা মেলে। প্রকৃতি ও প্রেমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শিল্প সাহিত্য। কবিতার আয়নায় সেটাই মুর্ত হয়ে ওঠে বায়রন সেলি ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর কাব্য প্রতিভায় যা পরবর্তীকালে আমাদের দেশে মাইকেল রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রতিভাত হয় তাদের রোমান্টিকতায়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য যে শিল্প বিপ্লবের পরের পর্যায়ে মানুষের রোমান্টিসিজম ভেঙে যায়, শিল্প সমাজের অবক্ষয় ধরা পড়ে। এই রোমান্টিকতার মননের সঙ্গে বাস্তবের সংঘাত বাধে। সমাজে একটা সম্প্ৰদায়ের আরেকটা সম্প্ৰদায়কে শোষণ করা অব্যাহত থাকে। মুষ্টিমেয়ের প্রাচুর্য ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ভোগবাদকে মদত করে যা সবসম্প্ৰদায়ের মানুষকে কলুষিত করে। মানুষ ভোগবাদের শিকার হয়। শিল্প সাহিত্যে এই অবক্ষয় ধরা পড়ে। নগর সভ্যতাকে আর আদর্শ সভ্যতা বলে মনে করা হয় না।পুঁজিবাদের মধ্যগগনে  ভিক্টরিয়া যুগ থেকে  শিল্প সাহিত্যে এর প্রভাব দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য যে রোমান্টিক ও ভিক্টরিয়া যুগকে সময় ধরে ভাগ করা যায় না। এ হল একই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটা যুগ থেকে আরেকটা যুগে প্রবেশ। অনেক কবির মননে এই দুই যুগের প্রভাবই দেখা যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে  এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা মনন গড়ে ওঠে। কবিতার আয়নায় তা ধরা পড়ে। মার্ক্সবাদ নতুন দর্শন নিয়ে মানবসমাজকে নতুন ভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ  করে। ভাববাদী দর্শনের জায়গায় বস্তুবাদী দর্শন দেখা যায়। বস্তুবাদী দর্শন দুটো খাতে প্রবাহিত হয়। চলতি ব্যবস্থার  এই সমর্থকরা আধুনিক সভ্যতার ত্রুটি দূর করে মানবতাবাদের ভিত্তিতে সমাজকে পুনর্গঠিত করার কথা বলেন। তাঁরা একধরনের বস্তুবাদের কথা বলেন যাকে মার্কসবাদীরা যান্ত্রিক বস্তুবাদ বলেন।কিন্তু মার্ক্সবাদ দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের দর্শন প্রচার করে যা শিল্প সভ্যতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের উচ্ছেদের কথা বলে। হেগেলের দ্বন্দ্ব তত্ত্ব মার্কসের ভাবনায় প্রস্ফুটিত হয়। সমাজ বিকাশের ধারায় দ্বন্দ্ব তত্ত্বের গুরুত্ব অনুভূত হয়। শোষক ও শোষিতের মধ্যে বৈরিতার প্রেক্ষাপটে সমাজে মানুষের অধিকারের প্রশ্নটা সামনের সারিতে উঠে আসে। শ্রেণী সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। সমাজতন্ত্র বিশেষ জনপ্রিয় হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শিল্প সমাজের গর্ভে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক দেশগুলোর স্বাধীনতার লড়াই। এই পরিবর্তন শিল্প সাহিত্যের উপর প্রভাব ফেলে। একদিকে ভোগবাদকে কেন্দ্র করে যেমন একধরনের আধুনিক সাহিত্য জন্ম নেয় তেমনি অধিকারের লড়াইকে কেন্দ্র করে আরেকধরণের বিদ্রোহের শিল্প সাহিত্য গড়ে ওঠে যা ভিক্টোরিয়া পরবর্তী আধুনিককালে আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এই পরিবর্তন  মূর্ত হয়ে ওঠে কবিতায়। আমরা নিচে কয়েকটা কবিতায় রোমান্টিক ও ভিক্টরিয়া আমলের অনুবাদ কবিতা তুলে ধরব যার আয়নায় এই যুগে দুটোর মধ্যেকার ঐক্য ও দ্বন্দ্বের দিকটা প্রতিফলিত হয়। তারপর বর্তমানকালের কথায় আসব। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আর মানুষের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে কবি মানসে গড়ে উঠেছে এক কল্পনার জগৎ যা কবির ভাবপ্রবনতা বা রোমান্টিকতাকে মুর্ত করে তোলে। কবিতাগুলো ধ্রুপদী কবিতার মর্যাদা পেয়েছে।


নিচের কবিতাটা  পারসী কবি শেলীর বিখ্যাত কবিতা Ode to the  West Wind কবিতার বাংলা ভাবানুবাদ। প্রকৃতির ঋতু চক্রের মধ্যে কবিতাতে কবি তার ধ্বংস আর সৃষ্টর রূপ বর্ণনা করেন। বাতাস এক অশরীরী শক্তি যে একদিকে ধ্বংসের প্রতীক আবার সে সৃষ্টিকে আহবান জানায়। পশ্চিমের উন্মাদ  বাতাস  সৃষ্টির প্রতীক। সেই আবার  শীতের ঠান্ডায় এসে গাছের জীর্ন  পাতা ঝরায়  যা আবার শীত শেষে বসন্তের নতুন পাতার জন্ম দেয়।  বসন্তের আগমনের বার্তা বহন করে। তিনি বলেন যদি শীত আসে তবে বসন্তের আগমনে  আর দেরি থাকে না।  মানুষের জীবনের জীবন চক্রটাও একই রকম। সুখ দুঃখ জন্ম মৃত্যু নিয়ে জীবন। জন্মের পর ক্ষয় লয় ।  কিন্তু তা আবার নতুন জন্মের বার্তা বাহক।


Ode to the West Wind
BY PERCY BYSSHE SHELLEY

1792-1822




পশ্চিমা বাতাস উৎসর্গ তোমায় 



হে উন্মাদ পশ্চিমা বাতাস !

তুমি শরতের নিঃশ্বাস,

দেখা দেও না, 

বয়ে চল অবিরাম,

তবু তোমার অশরীরি উপস্থিতি

শিহরণ জাগায় স্নায়ু জগতে আমার।

শীতের প্রাদুর্ভাব, তোমার প্রবাহে

তরু হতে ঝরে পড়ে 

বিবর্ণ নিষ্প্রাণ পত্ররাশি

মরণোন্মুখ পাতা বাহার,

পক্ষাঘাতে জীর্ণ 

পীত কালচে ফেকাসে লাল,

কোন জাদুকরের জাদুবলে

পলায়ন তার !

বন প্রাঙ্গনে যেন মহামারী,

আকাল আজ জঙ্গল অঙ্গনে।

বায়ুরাজ পশ্চিমা বাতাস, 

তুমি তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাও

হিম প্রবাহে

কোন এক  অন্ধকার শৈত্য শয্যায়।

খোসা বীজ আশ্রয় নেয়

কুণ্ডুলি পাকিয়ে কোন এক

অন্ধকার কবরে হিমেল গহ্বরে।


তোমার সোহাগিনী বসন্ত ভগিনী, 

তার বাঁশির সুর বেজে ওঠে

 অদূরে স্বপ্নপুরী এ পৃথ্বীতে,

সে বেণুর সুরে প্রাণসঞ্চার,

রাখাল বালকের মত

তাড়িয়ে নিয়ে চলে ভ্রুনেরে,

বাতাসে  নিঃশ্বাস তাদের

জেগে ওঠে সবে কলকল রবে।


হে উন্মাদ পশ্চিমা বাতাস,

তুমি অশরীরি, শোন তুমি,

তুমি ধ্বংস তুমি সৃষ্টি

 রক্ষাকর্তা তুমি।


হে পশ্চিমা বাতাস, তোমার আঘাতে

টুকরো টুকরো মেঘ আকাশে ভাসে,

জীর্ণ পাতার মত ঝরতে থাকে,

বাতাস তুফান হয়ে ওঠে

সংঘর্ষ তুফানে মেঘে,

জোট বাঁধে মেঘেরা

কেঁপে ওঠে আকাশ বাতাস,

বাতাসে তুফান আকাশে বজ্রপাত,

বিদ্যুৎ চমকায়, 

বর্ষের বিদায় লগ্নে রাতের শেষ বেলায়

তুমি ভয়ঙ্করী, ভেঙে কর সব চুরমার,

তুমি আগমনী গান গাও

নতুনের বার্তা বও,

জানান দাও তুমি,

মেঘ স্বর্গদূত  হয়ে নামবে

বর্ষা হয়ে ঝরবে 

আকাশ নেমে আসবে দিগন্তে,

সে মিলবে এসে পৃথ্বীর আলিঙ্গনে,

সমুদ্র উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে,

জল সিঞ্চন বৃষ্টি প্রপাতে,

পোহাতি মাটি উর্বর হয়ে উঠবে,

প্রাণ সঞ্চার সবুজে সবুজে

অঙ্কুর মাথা তুলবে আকাশে।



  

হে উন্মাদ পশ্চিমা বাতাস !

তুমি জাগাও তাকে,

নিটোল স্বচ্ছ ভূমধ্যসাগর 

গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে

নিদ্রামগ্ন সমুদ্র বক্ষে,

স্বপ্নে বিভোর সে এক স্বপ্নপুরি মাঝে,

শান্ত উদাসীন সে ঘুমায়

জাগিয়ে তোল তুমি তাকে;

তারই পাশে বাওয়াস উপসাগরে 

নির্বাসিত সেই প্রস্তর দ্বীপ,

নিদর্শন ফেলে আসা সে অতীত,

স্বপ্নে দেখে সে

ভগ্নদশা অট্টালিকা গম্বুজ যত

নির্বাসিত তারা সমুদ্র গভীরে

কেঁপে ওঠে ঢেউয়ের তীব্র কম্পনে।


সমুদ্র তলে নীলাভ শৈবাল 

মিষ্টি সুবাস ছড়ায় যত পুষ্পরাজ,

বয়সে ভারাক্রান্ত তারা,

তাদের বিদায় বেলা আজ।

হে শক্তিমান পশ্চিমা বাতাস

আটলান্টিকের পথ ধরে তুমি নেচে চল,

তোমায় পথ করে দিতে

আটলান্টিক দ্বিখণ্ডিত হয় 

সমুদ্র গহ্বরে ফাটল ধরে,

সে পথে তুমি বাধাহীন দুর্নিবার,

তোমার দুর্বার গতিতে নতজানু সবে।


শেওলায় আচ্ছাদিত

সমুদ্রগর্ভে যত বৃক্ষরাজি

বিবর্ণ জরাজীর্ণ পত্ররাশি তার,

তোমার পরিচিত কন্ঠস্বর

ভয়ঙ্কর বার্তা বয়ে বেড়ায়

ভয়ে কুঁকড়ে মরে তারা,

ধূসর বিবর্ণ তাদের মুখ

আশ্রয় খোঁজে তারা।

হে বন্ধনহীন পশ্চিমী বাতাস

তোমার তান্ডববার্তা শোনা যায়

ধ্বংসের মাঝে তোমার সৃষ্টি

তুমি শোন আগামীর পদধ্বনি।



যদি আমি বিবর্ণ পাতা---

ও: সর্বশক্তিমান পশ্চিমা বাতাস ! 

বয়ে নিয়ে চল আমায় আমার অন্তে।

হলে আমি ত্বরিতগতি মেঘ

ভেসে চলি তোমার ডানায় ডানায়,

যদি আমি সমুদ্রের ঢেউ 

দেখ আমার প্রলয় নাচন,

তোমার অঙ্গে অঙ্গে

তোমার হাত ধরে 

ভাসি আমি  তরঙ্গে তরঙ্গে।

হে বন্ধনহারা মুক্ত বাতাস

তোমার শক্তি শিহরণ জাগায়,

দাও আমায় ক্ষমতা তোমার।


আমি যদি শৈশব ফিরে পাই

তোমার বন্ধু আমি, 

তোমার ক্ষমতার ভাগিদার,

তোমার সাথে বিচরণ আকাশে বাতাসে,

পাল্লা দিয়ে চলি গতিকে তোমার।

কিন্তু হায় ! জীবনের এই দিনান্তে

অক্ষম আমি, তাই নিবেদন আমার,
হে উন্মাদ বাতাস ! তুমি বন্ধু আমার,

সাহস জোগাও, আমাকে জাগাও,

সাঁতার কাটি ঢেউয়ে ঢেউয়ে;

এ নব বসন্তে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়

নতুন পাতায় নব জন্ম আমার

ভেসে চলি মেঘের ডানায় ডানায়।


জীবনের কণ্টক শয্যায় শুয়ে রই,

আঘাতে আঘাতে আমি বিদীর্ণ

আমি রক্তাক্ত, রক্ত ঝরে আমার,

 তাও ডরি না আমি ভয়ে।

কিন্তু হায় !

এ জীবন সায়াহ্নে

সময় বয়ে নিয়ে যায় আমাকে

সময়ের ভারে আমি ভারাক্রান্ত,

শৃংখলিত  আমি,  আমি ন্যুব্জ আজ,

আমি বিবর্ণ ঝরা পাতা;

তবু জেনো আজও অদম্য আমি

আমি তোমায় ভালোবাসি,

হে উন্মাদ বাতাস,

অশরীরী শক্তি তুমি, 

তোমার গতি তোমার উদ্যম

অহং আমার, তুমি বন্ধু আমার।





 ৫


বিদায় ঘণ্টা বাজে শোন ওই,

বাজে ওই শরতের বিদায়ের গান,

শীতের আগমনে আমি ঝরা পাতা 

তাই বধ আমায় আজ,

আমি তোমার নিবেদিত প্রাণ

ঝরা পাতার মত আমিও  ঝরে যাই।

বিষণ্ণ মধুর বিদায়ের সুর শোনা যায়,

ও আমার অশরীরী নির্মম শক্তি ! 

আমাকে নিয়ে যাও

বিদায় দাও আমায় আজ।


তোমার অদম্য শক্তি বলে

এই মহাবিশ্বের ওপ্রান্তে 

আমার জীর্ণ মৃত ভাবনা,

ঝরা পাতা, উড়িয়ে নাও, 

ভাসিয়ে নিয়ে যাও তাকে

তোমার গতির শক্তিতে,

বিদায় দাও আমাকে

ত্বরান্বিত হোক নতুনের আগমন-----

নতুন তোমায় স্বাগতম।


অগ্নিকুন্ড থেকে ভেসে আসা

ছিন্নভিন্ন অনির্বাপিত ভষ্মরাশি 

আমার কথামালা হয়ে

ছড়িয়ে যায় মানুষের মাঝে

বিচ্ছুরিত হয় আমার ওষ্ঠ থেকে

নিদ্রা মগ্ন এ পৃথ্বীতে।



হে বন্ধু, উন্মাদ পশ্চিমা বাতাস!

আমার এ বিদীর্ণ বক্ষে

ভাবনা জাগাও নব জাগরণের

জেগে উঠুক ঘুমন্ত এ ধরা,

ভবিষৎ দ্রষ্টার বার্তা শোনা যায়,

'শীত আসলে বসন্ত জাগ্রত দ্বারে,

তার আর আসতে বিলম্ব কোথায়'?










WILLIAM WORDSWORTH এর  Three years  She Grew in Sun and Shower কবিতার  ভাবানুবাদ (1770-1850)



কবির কন্যা রোগযন্ত্রনায় ভুগে তিন বছর বয়সে মারা যায়। তাকে হারিয়ে কবি শোকস্তব্ধ। তার  অনুপস্থিতি কবির কাছে অসহনীয়। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি ভাবেন প্রকৃতি তাকে মুক্তি দিয়েছে। নিয়ে গেছে নিজের তদারকিতে সাহচর্যে তাকে গড়ে তুলবে বলে। আর মানুষতো প্রকৃতির সন্তান। তার ইচ্ছেতেই তার আবির্ভাব তিরোভাব। সময় হলে যেমন সবাইকে যেতে হয় তাকেও যেতে হয়েছে। কিন্তু সে বেঁচে তাঁর হৃদয়ে। প্রকৃতির কোলে পরিণত হয়ে সুস্থ সবল শরীরে সে বেঁচে থাকবে তারই সাথে। দুজনে এক স্বর্গীয় সুখ ভোগ করবে। এখানে কবি রোমান্টিক, প্রকৃতি উপাসক।তাই অনুশোচনা নয় যদিও মেয়ের শারীরিক অনুপস্থিতি তাঁর কাছে পীড়াদায়ক। কবির মনের এই দ্বৈত মনন ভাষা পেয়েছে তাঁর এই কবিতায়।




রোদ বৃষ্টিতে সে বেড়ে ওঠে 


সময় বয়ে যায় 

তিন বছর হয়ে গেল, 

রোদে জলে বেড়ে ওঠে সে,

কিন্তু প্রকৃতি জানিয়ে যায়,

" এমন সুন্দর অঙ্কুর 

অঙ্কুরিত হয় নি আগে কোনদিনই

কখনও ফোটে নি এমন ফুল এ ধরায়

সে যে একান্ত আমারই,

তাকে গড়ে তুলব আমার মত করে

আমারই দুহিতা সে যে,

তার এ কি যন্ত্রনা এই বিশ্ব কারায়

এ ধরা উপযুক্ত নয় তার জন্যে।


তাকে আমি নিয়ে যাই আমার কাছে

সে বেড়ে উঠবে আমার কোলে,

আমার যত্নে আদরে সোহাগে।

আমারই দুহিতা সে যে,

পাহাড়ে সমভূমিতে ধরিত্রীর বুকে

স্বর্গে মর্তে  নিকুঞ্জ বনে 

সর্বত্র সে আছে, তার দেখা পাবে, 

এক অদৃশ্য ক্ষমতা বলে 

সে প্রজ্বলিত হবে 

 ধীর শান্ত পূর্ণ রমণী রূপে''।


মৃগশিশু সে খেলে বেড়ায়, 

নেচে বেড়ায় আনন্দ কোলাহলে 

প্রকৃতির নীরব নিশ্চিত কোলে 

পাহাড়ের ঝর্ণায় বা তৃণ প্রান্তরে 

শান্তির নিঃশ্বাস আকাশে বাতাসে।


নিশ্চুপ পিতা  যন্ত্রনায় কাতর, 

সে ভেবে চলে, 

কবিতার প্রচ্ছদে তার ছবি আঁকে;

কন্যা তার ভেসে বেড়ায় মেঘের  ডানা  বেয়ে, 

বৃক্ষরাজি স্বাগত জানায় তাকে, 

আকাশ থেকে সে নিচে উঁকি মারে, 

শোকস্তব্ধ পৃথ্বী নিঃশব্দ শোকে 

সে তার সহমর্মী আকাশ পারে। 


আকাশের নক্ষত্র সমাজ 

কত আপন তার  সাথে

মহাবিশ্বের সর্বত্র তার বাস অনন্ত সুখে 

উর্বশী নেচে চলে তার ভ্রমন পথে 

 মর্মরিত সে ধ্বনি বাতাসে 

আনন্দ মুখরিত কন্যা 

মেঘ হয়ে ভাসে আকাশে।


প্রকৃতির সাহচর্যে কন্যা বেড়ে ওঠে 

যেন সরোবরে কলি ফুল হয়ে ফোটে , 

শিশু পরিণত হয় কুমারী কিশোরি হয়ে 

প্রকৃতির সোহাগে আদরে

সে জীবনের স্পন্দন শোনে,

যেখানেই থাকুক না সে 

অন্তের  ওপ্রান্তে ওই সুদূর অনন্তে,

পিতা তাকে খুঁজে পায় তার অন্তরে। 


কন্যার বিচ্ছেদে মর্মাহত শোকস্তব্ধ সে 

তার বিচ্ছেদ  প্রতিমুহূর্ত ব্যথা দেয় তাকে, 

কিন্তু সে জানে প্রকৃতি সর্বশক্তিমান 

তার ইচ্ছেতে যেতে হয় সবাইকে

অনুশোচনা করে না সে আর 

সময় হওয়ায়  আদরের কন্যা চলে গেছে তার, 

সে এখন বেঁচে আছে প্রকৃতির সাহচর্যে

শোক কষ্টের উর্ধে সে প্রকৃতির কোলে, 

অনন্ত সুখের স্বর্গে তার বাস 

মরজগতের যন্ত্রনা বেঁধে না তাকে আর

যখনই তাকে খোঁজে তার দেখা পায়

সুখে দুখে আদরে সোহাগে

তারই অন্তরে যে কন্যার নিবাস।





নিচের কবিতাটা  উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের  (1770-1850) লেখা বিখ্যাত কবিতা Westminster Bridge এর অনুবাদ কবিতা যেখানে কবি লন্ডনকে শিল্প সমাজে গড়ে ওঠা নগর সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করেন।তিনি তাঁর এই কবিতায় লন্ডন শহরের সৌন্দর্য তুলে ধরেন যা ভিক্টরিয়া যুগের সাহিত্যকে প্রতিনিধিত্ব করে। 


সুন্দরী সে নগরী




সুন্দরী বসুন্ধরা, তোমার এই গর্ভগৃহে 

সুন্দরতম কি হতে পারে আর !

আর কে থাকতে পারে তোমার হৃদয় জুড়ে 

সুন্দরতর এই অনিন্দ সুন্দর নগরীর চেয়ে !

যে উপেক্ষা করে, পাশ দিয়ে চলে যায়,

 দেখে না যে এই অনুপম দৃশ্য,

তার চেয়ে অর্বাচীন কে এই দুনিয়ায়?

সুবেশা সে নগরী, পরনে মোহিনী বেশ 

একাকিনী নিশ্চুপ সকালের সৌন্দর্যরাশি,

মনোরমা সে মহীয়সী, হৃদয় স্পর্শ করে।

দিগন্ত শেষে আকাশ, বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে 

গড়ে ওঠে জাহাজ গম্বুজ নাট্যশালা মন্দির

কি বিপুল ঐশ্বর্য গরিমায় !

কখনও কি দেখেছ সূর্যের উলম্ব কিরণ চ্ছটায়

ঝল মল করে উপত্যকার শিলা, 

পাহাড়ের তুষার কি উজ্জ্বল জৌলুসে !

কখনও আমি দেখিনি, ছিল না  অনুভবে,

নদীর কলকল বয়ে চলে আপন মনে ;

হে ঈশ্বর ! নিদ্রামগ্ন যেন সব গৃহ রাতের স্তব্ধতায়,

সে উদার শক্তিমান হৃদয় শুয়ে আছে এখনও।






নিচের কয়েকটি  কবিতায় বিভিন্ন  কবির প্রকৃতি পূজা ও মানব  প্রেম নিয়ে কবির আবেগ ধরা পড়ে যা রোমান্টিক যুগের সাহিত্যের একটা বৈশিষ্ট্য। জন কিটস To Autumn কবিতায় প্রকৃতির উপাসক। লর্ড বায়রণের কবিতাটা নারীর রূপ বর্ণনা যা কবির আবেগ প্রবণতা তাকে এক কল্পস্বর্গে নিয়ে গেছে। পরবর্তীকালে ভারতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উর্বশী কবিতায় আমরা এর ছোঁয়া পাই।









To Autumn BY JOHN KEATS কবিতার ভাবানুসারে (1795-1821)


হে শরত তোমার গান তুমি গাও




হে শরত তোমার গান তুমি গাও,

ও বন্ধু শরত, তুমি মায়াবী সুন্দরী

প্রকৃতির  মরশুমী বৈচিত্রে

অঙ্গে অঙ্গে ভরা যুবতী রমণী,

ফুল ফলে শোভিত তুমি,

উদয় কালে তুমি সূর্যের সঙ্গিনী,

নিরালায় একান্ত গোপনে দুজনে আলাপে,

এ সাঁঝ বেলায় ভাবনা তোমাদের

কেমনে সাজাবে দুহিতাকে ফলে ফুলে,

লতানো বৃক্ষরাশি লতায় পাতায় 

তোমার বাতায়নের আলিঙ্গনে

সেজে উঠবে তোমার সাজঘরে, 

সহাস্য নত মুখ তার 

যেন বিনম্র কিশোরী নব বধূ সাজে

কানায় কানায় ভরা মধু রসে,

মধুকর এসে বসবে মধু সিঞ্চনে

মধুর ভান্ডার পূর্ণ হবে মধু সঞ্চয়ে।


তোমাদের আশীষে গর্ভবতী মৃত্তিকা,

শস্য ভান্ডার উপচে পরে ফসলে ফসলে,

 তুমি সুন্দরী মহিয়সী সেখানে,

কখনও তোমাকে দেখা যায় বাহির দ্বারে

বসে থাকো নির্বিকার,

সোনালী শাড়িতে সেজে শস্য শয্যা পরে,

এলোকেশী তুমি সুন্দরী

কেশ তোমার ঝোড়ো বাতাসে ওড়ে

অথবা তুমি গভীর ঘুমে আধ চষা ক্ষেতে,

হতেও পারে তুমি আচ্ছন্ন আফিমের ঘোরে।

                                                  

তোমারে দেখি না বসন্ত সঙ্গীতে

ভুলে থাক সে সংগীত আজ, 

বসন্ত সঙ্গীত আসে না  তোমার সুরে

চেনে না তোমায় এ দুখের অঙ্গনে।

তোমার নিজের সংগীত  তুমি গাও

তোমার আহবান ভেসে আসে সংগীতে, 

গোধূলি বেলায় অবসন্ন মেঘ জ্বলে ওঠে

রক্তিম আকাশ অস্তমিত সূর্যের সোহাগে

দিগন্তে ডানা মেলে এসে এ ধরণীতে,

এ বিদায় বেলায় বিষাদের গান গাও

বেজে উঠুক তোমার জীবন সঙ্গীতে।





নিচের কবিতায় কবি প্রকৃতির সৌন্দর্য রাশির মধ্যে তাঁর কল্প মানসে এক সুন্দরী নারীকে দেখেন। তাঁর কল্পচিত্র রচনা করেন কবিতাতে। ফুটে ওঠে এক মহীয়সির অসাধারণ কল্প রূপ।একই সঙ্গে প্রকৃতি আর মানব প্রেমের এ এক অসাধারণ ছবি।কবির রোমান্টিক মানস প্রকাশ পে কবিতাটার প্রতিটি ছত্রে।






She Walks in Beauty

BY LORD BYRON (GEORGE GORDON)

 1788-1824)

 কবিতার ভাবানুসারে 



সুন্দরী রূপসী সে হাঁটে


সুন্দরী রূপসী, 

সে হেঁটে বেড়ায় নিজ সাজে,

সে হাঁটে

তার সুন্দরতম রূপে 

মেঘহীন আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র মাঝে, 

আলো আঁধারের সৌন্দর্যরাশি জড়ায় তাকে,

মুখে তার পূর্ণিমার জ্যোছনা

আঁখিতে জ্বলে রাতের তারা  

আলোর বিচ্ছুরণ তার তনুর আঁকে বাঁকে।


যদি সে আঁধারের ছায়া বিস্তৃততর

বা সে আলোর কিরণ ম্রিয়মান 

সৌন্দর্য তার হয়ে পড়ে ক্ষীণতর। 

 সৌন্দর্যের ঢেউ খেলে যায় তার তনু পরে,

অথবা  স্নিগ্ধতা আলোকিত মুখ বলয়ে,

বিশুদ্ধতার ছোঁয়া তার সৌন্দর্যলোকে,

প্রিয়তমা সে সবার হৃদয় আলয়ে। 


নম্র শান্ত প্রত্যয়ী সে তার চোখে মুখে,

সন্ধ্যার দীপ জ্বলে  ভুরুতে 

আলোর আভা ভেসে ওঠে বিশ্বজয়ী হাসিতে,

জানিয়ে যায় কেটেছে দিন কি আনন্দে

শান্তি বিরাজে তার জীবনে 

নিখাত সে প্রেম তার হৃদয়ে

ডানা মেলে সূর্যের কিরণে।




Walter De-Mare

The Listeners


 নিশি রাতে 




আঁধার ঘনায় আকাশে,

নিঝুম সন্ধ্যা, চাঁদের কিরণে

আলো আঁধারের খেলা,

সবুজ গালিচা প্রাঙ্গণে

সওয়ারি নামে এসে,

ঘোড়া ঘাস চিবিয়ে চলে

মৃদু গুঞ্জন বাতাসে,

এ নিশুতিতে দেখা যায় না কিছু।

পথিক দরজায়  কড়া নাড়ে, 

টক্ টক্ টক্,

'কেউ কি আছেন ভেতরে?'

নিস্তব্ধ, উত্তর নেই কোনো।

পেঁচা ডেকে ওঠে

তার কান ঘেষে উড়ে যায়,

শ্রবণ যন্ত্র জাগে;

আবার  দরজায় টোকা 

'কেউ কি আছেন ভেতরে'?

সাড়া নেই কোন

নিঃশব্দ নিশ্চুপ

কেউ নামে না,

সে ধূসর চোখে দাঁড়িয়ে বিমূঢ়,

ভেতরে অশরীরি কারা শ্রোতা !

ঘুরে ফেরে ঘরে

তাদের আস্তানা সেখানে,

মায়াবী চাঁদের আলোয়

মানব কন্ঠের শ্রোতা,

তাদের নীরব উপস্হিতি তার কানে;

ঘোড়া নড়া চড়া করে

ঘাস চিবোতে থাকে,

নিস্তব্ধতা ভেঙে শব্দ ভাসে

জেগে ওঠে বাতাস

চাঁদের কিরণে রাতের আঁধারে।


হঠাৎ দরজায় টোকা মারে

গলা তুলে বলে

 'ওদের বোলো এসেছি,

আমি আমার কথা রেখেছি'।

নিঃশব্দ মায়াবী আধাঁর ভেঙে

ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়।

ঘোড়ার খুরের  শব্দ,

টগ্ বগ্ টগ্ বগ্,

আস্তে আস্তে মেলায়।

সওয়ারী গেল কই?

উত্তর মেলে না।

 

ওপরের কবিতায় সাহিত্যে রহস্যবাদের এক অসাধারণ উপস্থাপনা কবির কবি মানসে। তাঁর মননে এক অতীন্দ্রিয় অশরীরী আত্মার উপস্থিতি যে ইহজগতের উপস্থিতিকে তেমন স্বীকৃতি দেয় না, তার ডাকে সাড়া দেয় না। কবিতায় তিনি এক অদ্ভুত metaphor সৃষ্টি করেছেন যা পাঠকের শরীরে কাঁটা হয়ে বেঁধে।


নিচের  কবিতাটায় কবি অচিন পথের যাত্রী। ব্যতিক্রমী একজন যে সকলে যে পথে চলে সে পথে চলে না। জানে না তার চলার পথ তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। জীবনের দেওয়া নেওয়ার হিসেব করে সে চলে না। সেই অর্থে সে রোমান্টিক। আমি অবশ্য কবিতাটাতে আমার ভাবনা যোগ করেছি। দুটো পথ থাকলে একটা পথ ধরতেই হয়। সে পথ ভুল হলে সঠিক পথ খুঁজে নিতে হয়। সেই অর্থে আমি নিশান ধরে চলার কথা বলেছি। কিন্তু কবির চলা চলার আনন্দে চলা। এক রোমান্টিকতা।




The Road Not Taken BY ROBERT

FROST(1874-1963)

কবিতার ভাবানুবাদ এর সঙ্গে আমার ভাবনা যুক্ত হয়েছে।




যে পথে হয় নি চলা


শীত পড়েছে কুয়াশা ঘন আকাশ,

সামনে পাতাঝরা পীত বর্ণের জঙ্গল 

অনিশ্চয়তার গন্ধে ভরা বাতাস,

মাঝে দুটি রাস্তা চলে গেছে দুদিক ধরে

দুঃখিত আমি, পারি না দুটো ধরেই চলতে

বেছে  নিতে হয় দুটোর একটা,

যে পথ বৈঠা বায়

আমার প্রত্যয়ে আমার চেতনায়।

আমি চলি একটা রাস্তা অনুসরণ করে,

 দূরে কোথাও বাঁক নিয়েছে

হয়তো চলে গেছে অজানা কোন দিশায়।

পথিক আমি, পথ ধরে চলি

জানি না সে পথ পৌঁছবে কোথায় !

অন্য একটি পথ রয়ে গেল অধরা

হলো না অন্য পথ ধরা,

ভাবি ও পথে চললেই ভালো ছিল

 খুঁজে পেতাম নিশানা

দূর হতো অনিশ্চয়তা আমার;

কিন্তু পথ যে দুটোই অজানা

ধরতে হয় একটা কোন ।

যদি আমার পথের সঠিক নিশানা,

সমস্যা থাকে না তবে

হোক না শরীর ক্ষত

কণ্টকিত আমার সে পথ 

সে পথেই পৌঁছব নিশান হাতে;

বিভ্রান্ত আমি, ভাবি

ওপথে গেলেই হয়তো ছিল ভালো।


 জানা নেই আমার কোনদিকে

কোথায় আমাকে নিয়ে যাবে এ পথ,

যদি দুটো পথ দুদিকে 

মিলব না আমি কারো সাথে

সবাই যে চলছে অন্যপথে,

সেটাই হয়তো পার্থক্য গড়ে দেবে।

আমি চলি ভিন পথে

যে পথ বেঁচে আছে আমার চেতনায়

আশা রাখি পৌঁছব নিশান ধরে।

যদি ভুল পথে যাই তাও যেন নিরাশ না হই,

বিকল্প পথ যদি সঠিক দিশা দেখায়

আপত্তি করব না আমি,

ক্লান্তিহীন আবার শুরু, আমার যাত্রা,

আমি বয়ে চলি আমার বার্তা

চলব আমি যে পথে হয়নি চলা

পথিক আমি দিগন্ত ধরে

 আমার অন্তহীন যাত্রা ।




জন্ম মৃত্যু নিয়ে লেখা জিবরানের Grave-Digger   কবিতায় অলঙ্ঘনীয় প্রকৃতির নিয়মকে তুলে ধরা হয়েছে।মানুষ তখনি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠতে পারে যখন হাসিমুখে সে মৃত্যু বরণ করতে পারে। সে তখন

সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর তথা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার  আশীর্বাদ পায়। ধরা হয় সেখানে প্রকৃতি মানুষের সৃষ্টি কর্তা। মৃত্যুও তাঁর হাতেই।  কবিতাটি মাত্র চার লাইনের কিন্তু গভীর অর্থবাহক। বাংলা অনুবাদে আমি কবিতাটাকে সম্রসারণ করেছি। আমার ভাবনাটা যোগ করেছি। বাংলায় কবিতাটার নাম দিয়েছি 'মৃত্যুঞ্জয়ী'।



মৃত্যুঞ্জয়ী


কোন একদিন এক বিষণ্ণ রাতে

আমি এসেছিলাম এ অন্ধকারে-----

এসেছিলাম এ সমাধি পাশে,

নিজের কোন এক অহংকে

যাব আমি নিজেই সমাধিস্থ করে।


কবর খানায়  দেখি সমাধি দাঁড়িয়ে,

কার কন্ঠস্বর যেন কানে, 

বসে এসে আমার ভাবনায়

আর কেউ নয় সে যে কবর স্বয়ং,

সে আমাকে হাসিমুখে স্বাগত জানায়,

কোলে তুলে নেয় আদরে সোহাগে

নির্জন নিস্তব্ধ এ সমাধিস্থলে 

কেউ নেই কাছে অমাবস্যার এ রাতে।

আমরা মুখোমুখি দুজনে এ নির্জনে,

সে আমাকে বলে যায় 

চুপি চুপি  কানে কানে এ নিরালায়,

"আজ আমি নিজেকে পেয়েছি তোমার মাঝে

পেয়েছি তোমাকে আজ  আপন ভাবনায়।

যারা আসে এ সমাধিতে

আর কাউকে নয়,

আমি শুধু ভালোবাসি তোমাকে"   .       .


আমার প্রত্যয় গভীর হয়,

জানতে চাই, "আমার ওপরে কেন তুমি প্রসন্ন,

কি দিয়ে তোমাকে করেছি জয়

আমি তো পূজি নি তোমাকে

কেন তোমার আজের এ সৌজন্য

কিসে আমার এ গৌরব

আমি সামান্য এক, 

কিছুই যে নেই দেবার তোমায়"

সে বলে, "তুমি জানো না কি দিলে আমাকে

দিয়ে গেলে একমুঠো ভালোবাসা আমায়,

সবাইকে দেখি কাঁদতে কাঁদতে আসে এখানে

বিরোহিনী কাঁদে বিরহ ব্যথায়

সবার অসন্তোষ আমার উপরে

কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যায় ,

 আমার ওপরে কত যুগের সঞ্চিত অভিযোগ।

শুধু তোমাকেই দেখি প্রসন্ন মনে

তুমি  পেরেছ আমাকে চিনতে

কোন অভিযোগ নেই আমার উপরে

এলে হাসতে হাসতে 

ফিরে যাচ্ছ, হাসি দেখি তোমার মুখে

ধন্য আমি আমার মধ্যে পেয়েছি তোমাকে"

জীবন মৃত্যুর লুকোচুরি খেলাঘরে

বুঝি আমি আজ 

আমি মৃত্যুঞ্জয়ী তার সমাধি বুকে।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

প্রচ্ছদ।। ৮৩তম সংখ্যা ।। মাঘ ১৪৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ।। প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮১তম সংখ্যা ।। অগ্রহায়ণ ১৪৩১ নভেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮২তম সংখ্যা ।। পৌষ ১৪৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮৪তম সংখ্যা ।। ফাল্গুন ১৪৩১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত