কয়েক বছর হল দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তির স্বাদ পেয়েছে দেশবাসী। লাল মুখোদের রক্ত চক্ষু আর দেখতে হয় না। সহ্য করতে হয় না বিদেশী চাবুকের আঘাত। গোরাদের ভারি বুটের আওয়াজ আর শুনতে পাওয়া যায় না। সরকার জোর দিয়েছে শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে স্কুল, কলেজ। দেশকে স্বাধীন করার, পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার যে স্বপ্ন ছিল যুব সমাজের চোখে, সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে। সেই আকাঙ্খা চরিতার্থ হয়েছে। এখন যুব সমাজের চোখে দেশকে গড়ে তোলার স্বপ্ন। কৃষিকাজ, পড়াশোনা সব দিক দিয়েই সাফল্য আসতে শুরু করেছে। কেবল কৃষিকাজ বা পড়াশোনা নয় খেলাধুলাও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে যুব মানসে। উত্তর, পশ্চিম ভারতে ক্রমশ জনপ্রিয়তা বাড়ছে কুস্তির। অন্যদিকে পুর্ব, দক্ষিণ ভারতের ছেলেরা মেতে উঠেছে ফুটবল নিয়ে।
উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানার গ্রামে গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠেছে কুস্তির আখড়া। বজরং বালীর নাম নিয়ে সেই সব আখড়ায় ভিড় জমাচ্ছে তরুণ, যুবকরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও চলত এই সব আখড়া। তখন সংখ্যায় অনেক কম ছিল। প্রশিক্ষণ দেওয়া হত কুস্তির। লাঠি, ছুরি চালানোও শেখানো হত। আর গোপনে শেখানো হত বন্দুক চালানো, সেই সঙ্গে শেখানো হত বোমা তৈরি এবং নিক্ষেপ। সে সবের প্রয়োজন আর নেই। এখন ছেলে ছোকরারা কুস্তি লড়ে খেলার আনন্দে, মনের আনন্দে।
রাম সিং তার ব্যতিক্রম নয়। কিছুটা লেখা পড়া সে করেছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ ক্ষেতিবাড়ি নিয়ে। সকাল হলেই সে হাল মহিষ নিয়ে বাবা কাকাদের সঙ্গে ক্ষেতে যায়। ক্ষেত চষে, রোয়া বোনে। তারপর সবুজ গম, যবের চারাগুলোকে হাওয়ায় মাথা দোলাতে দেখলে অনাবিল আনন্দে ভেসে যায়। যখন ফসল পাকে, সেই পাকা ফসল কেটে গোলায় তোলা, খড় পোড়ানো হাজারো কাজ সারতে হয় রামকে। তাছাড়া বাড়িতে পালিত গাই মহিষের দেখাশোনা, তাদের খেতে দেওয়া, স্নান করানো, দুধ দোওয়া প্রভৃতি কাজ রাম নিজের হাতেই করে।
সারাদিন ঘরের কাজ করার পর সন্ধ্যার সময়ে সে যায় মহল্লাওয়ালে দাদাজীর বাড়িতে। মহল্লার বাচ্চাদের কাছে দাদাজীর দারুণ জনপ্রিয়তা। প্রতি সন্ধ্যায় দাদাজী মহল্লার বাচ্চাদের কিসসা শোনান। কখনও পুরাণের কাহিনী, কখনও ইতিহাসের কাহিনী, কখনও ক্রান্তিকালের কাহিনী। দাদাজীর কিসসাতে কখনও উঠে আসে বজরং বালীর পরাক্রম। কখনও উঠে আসে দাক্ষিনাত্যের শিবাজি মহারাজের বীরত্ব। কখনও উঠে আসে ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুকদেবের দেশভক্তির আখ্যান। কিসসা শুনতে শুনতে কখনও রাম উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। কখনও নীরব হয়ে যায়। কখনও আবার তার দুচোখ বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা। রাম ভাবে সেও একদিন ভগৎ সিংয়ের মত দেশের হয়ে লড়াই করবে। দেশ রক্ষার জন্য সে তার সর্বস্ব ত্যাগ করবে। আবার কখনও ভাবে সে বজরং বালীর মত পরাক্রম দেখাবে।
সকালে বাড়ির কাজ, বিকালে দাদাজীর কাছে কিসসা শোনার পরেও রামের হাতে থাকে অনেক সময়। সেই সময়ে সে আখড়ায় যায় কুস্তি লড়তে। কৃষিকাজ, পশু পালন করতে তার ভাল লাগলেও, রামের সব থেকে ভাল লাগে কুস্তি। আখড়ার অনান্য ছেলেরা রামের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না। একেতো তার শরীরে অসুরের শক্তি, তার উপর অল্প দিনেই সে শিখে নিয়েছে কুস্তির যাবতীয় দাঁও প্যাঁচ। কুস্তির আখড়ায় রামের আস্ফালন দেখে বেজায় খুশি তার গুরু। তিনি রামকে বলেন, "শক্তি চাই, আরও শক্তি। আউর তাকৎ বেটা, আউর তাকৎ।" শক্তি বাড়ানোর জন্য রাম কখনও কুড়ুল চালিয়ে কাঠ কাটে। কখনও ঘোড়ায় চড়ে। দেখতে দেখতে রাম এক অপরাজেয় কুস্তিগীর হয়ে উঠেছে। তার আখড়ারতো বটেই, এমন কি আসে পাশের আট দশটা গ্রামের কুস্তিগীররাও তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না। রাম নিমেষের মধ্যেই তাদের ধরাশায়ী করে দেয়। তার আর ভাল লাগে না এদের সঙ্গে কুস্তি করতে। সে তার গুরুর কাছে জানতে চায় কোথায় গেলে আরও ভাল, আরও শক্তিশালী পালোয়ানদের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে পারবে।
একদিন রাম সিংয়ের গুরু তাকে পরামর্শ দেন, "বেটা রাম, পল্টনে লোক নিচ্ছে তুই ভর্তি হয়ে যা। সেখানে গেলে আরও তাকৎদার, আরও বেহতর পালোয়ানদের সঙ্গে তুই পাঙ্গা নিতে পারবি।" উচ্ছসিত রাম ভর্তি হয় কুমায়ুণ রেজিমেন্টে। তারপর শুরু হয় তার নতুন এক জীবন। সৈনিকের জীবন।
দুই
বরফ বরফ বরফ। যে দিকে চোখ যায় কেবল বরফ আর বরফ। চারিদিকে কেবল পুরু বরফের আস্তরণ। হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে যেন এক তুষার শুভ্র প্রাঙ্গন। আর হবে নাই বা কেন, নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে তাপ মাত্রা নেমে যায় মাইনাস পনেরো ডিগ্রিতে। কোথাও কোনও চাষাবাদ বা পশু পালনের চিহ্ন মাত্র নেই। কোথাও কোনও জন বসতি চোখে পড়ে না। এমন দুর্গম অঞ্চলে অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। পুরো অঞ্চলটা যেন এক শীতল মরুভূমি। যুগ যুগ ধরে কারও কোনও আগ্রহ নেই, কারও কোনও মাথা ব্যথা নেই এই অঞ্চলটাকে নিয়ে।
আকসাই চীন। টিবেটিয়ান প্ল্যাটুর একটা অংশ আকসাই চীন। যে অঞ্চলটাকে বহু বছর ধরে ভারত তার অংশ বলে দাবী করে আসছে। আবার চীনও আকসাই চীনকে তার সিনজিয়ান প্রদেশের অংশ বলে দাবী করতে শুরু করে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের ব্রিটিশ সরকার এবং চীনের কিং সরকার কেউই এই অঞ্চলটাকে গুরুত্ব দেয়নি। তখন কারাকোরাম পাশ এবং প্যাংগং লেককে আনুমানিক সীমা হিসেবে ধরে নেওয়া হত।
আঠারোশো পঁয়ষট্টি সালে ব্রিটিশ সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এই অঞ্চলটিতে জনসন লাইন এঁকে সীমা ঘোষণা করে। কিন্তু চীন সরকার জনসন লাইন মানতে চায়নি। কারণ জনসন লাইন আঁকার সময়ে ব্রিটিশ সরকার চীনের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি। ব্রিটিশ সরকারের যুক্তি ছিল জনসন লাইন আঁকার সময়ে সিনজিয়ান চীনের অংশ ছিল না। আঠারোশো আটাত্তর সালে চীন সিনজিয়ান দখল করে সেখানে সেনা পাঠাতে শুরু করে, এবং কারাকোরাম পাশকে বর্ডার লাইন বলে দাবি করতে থাকে। এরপর ব্রিটিশ সরকার সিনজিয়ান প্রদেশ লাগোয়া ম্যাকডোনাল্ড লাইন প্রস্তুত করে, তখন আকসাই চীনের অনেকটা অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন হয়। চীনের কিং সাম্রাজ্যের পতন হয়। গৃহযুদ্ধ শুরু হয় চীনে। অন্যদিকে গ্রেট ব্রিটেন বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
এই সময় ভারতের ব্রিটিশ সরকার তিব্বতের সঙ্গে সিমলা চুক্তি করে। সিমলা চুক্তির সময়ে তিব্বত চীনের অধীনে ছিল না, তাই সিমলা চুক্তির সময়ে চীনকে ডাকা হয়নি। সিমলা চুক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ম্যাকমোহন লাইন। হেনরি ম্যাকমোহন তিব্বতের সঙ্গে ভারতের যে বর্ডার লাইন প্রস্তুত করেন সেটাই ম্যাকমোহন লাইন নামে পরিচিত।
কিন্তু চীন তিব্বতের স্বাধীনতা অস্বীকার করে ম্যাকমোহন লাইন রিজেক্ট করে দেয়। চীনের দাবি তিব্বত কোনও স্বাধীন দেশ নয়, তাই বর্ডার লাইন প্রস্তুতের কোনও অধিকার তার নেই। অথচ তিব্বত তখন চীনের অধীনে ছিল না। উনিশশো পঞ্চাশ সালে চীন তিব্বত আক্রমণ করে তিব্বত দখল করে নেয়।
অন্যদিকে বিশ্ব রাজনীতিতে এক অন্য দোলাচল শুরু হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে কমিউনিস্ট দেশগুলোর এক ঠান্ডা লড়াই চলছে। রাশিয়া রয়েছে কমিউনিস্ট দেশগুলোর পক্ষে। ফলে কমিউনিস্ট দেশগুলো ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। ভারত বরাবরই কমিউনিস্ট চীনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনের স্বাধীনতাকে ভারত উষ্ণভাবে মান্যতা দিয়েছে। কিন্তু শান্তিকামী দেশ ভারত তিব্বতের উপর চীনের আগ্রাসনের ভাল চোখে দেখেনি। ভারত চীনকে তিব্বত থেকে সরে আসতে বলে। তখনই ছন্দ পতন শুরু হয়। শুরু হয় সন্দেহের বাতাবরন। চীনতো ভারতের কথায় কান দিলই না, বরং আকসাই চীনের সেনা পাঠাতে শুরু করে দেয়। শান্তি, মৈত্রীর দেশ ভারত চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট রাখতে তিব্বতে চীনের আধিপত্য মেনে নেয়। সেইসঙ্গে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াতে জন্ম হয় 'হিন্দি চিনি ভাই ভাই' স্লোগানের। অথচ যখন ভারতের আকাশ বাতাস 'হিন্দি চিনি ভাই ভাই' স্লোগানে মুখরিত হচ্ছে তখন চীন গোপনে আকসাই চীনের রাস্তা তৈরি করছে! আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে প্রথমে ভারত এই রাস্তার কথা জানতে পারেনি। কিন্তু জানতে পারার পরেও, চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট রাখার জন্য নীরব থেকে যায়।
এরপর আরও এক ঘটনা বাড়িয়ে তোলে সন্দেহের বাতাবরণ। তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দলাই লামা চীনের ভয়ে ভারতে পালিয়ে আসেন। অতিথি বৎসল দেশ ভারত দলাই লামাকে আশ্রয় দেয়। বিষয়টা চীন একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি, ভাবে ভারত বোধ হয় আবার তিব্বতকে চীনের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছে।
তিন
অবশেষে ভুল ভাঙল ভারতের। মর্টার হানা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করে চীন। সীমানা এবং আরও অন্যান্য কিছু কারন নিয়ে শুরু হয়েছিল বিরোধ। ভারত ভেবেছিল আলোচনার টেবিলেই মিটে যাবে এই বিরোধিতা। কিন্তু অবশেষে এই বিরোধিতা এসে দাঁড়ায় রণাঙ্গনে। পশ্চিমের আকসাই চীন থেকে পূর্বের নর্থইষ্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি অর্থাৎ অধুনা অরুণাচল থেকে সিকিমের পার্শ্ববর্তি বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে লড়াই। আশি হাজার চীনা সেনা হাজির হয় এই লড়াইতে। সেখানে ভারতের সেনা সংখ্যা মাত্র কুড়ি হাজার। তার উপর ভারতের শক্তিশালী নৌ সেনা এবং বায়ু সেনা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বিরত থাকে এই লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ করা থেকে।
লাদাখ দখলের জন্য পাঁচ হাজার চীনা সেনার এগিয়ে আসার খবর পেয়েছেন কুমায়ুণ রেজিমেন্টের মেজর শয়তান সিং ভাট্টি। লাদাখের চুশুল উপত্যকা এবং দৌলত বেগ ওল্ডি বিমান ঘাঁটি রক্ষার দায়িত্ব তার উপরে। সমুদ্র থেকে প্রায় সাড়ে ষোলো হাজার ফিট উপরে রেজাংলার বিভিন্ন পোষ্ট রক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন মেজরের চার্লি কোম্পানির একশো কুড়িজন সেনা। তিন কিলোমিটার লম্বা রেজাংলা গিরিপথের বিভিন্ন পোষ্টে পজিশন নিয়েছে চার্লি কোম্পানির সাত, আট এবং নয় নম্বর প্লাটুন। বরফাচ্ছন্ন রেজাংলার হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় সারা রাত জেগে সমর সজ্জার তদারকি করছেন মেজর। তার সঙ্গে জেগে আছেন রেডিও ম্যান রাম চন্দ্র যাদব এবং মেজরের দেহরক্ষী নিহাল সিং।
রাত সাড়ে তিনটের সময় আঘাত হানে চীনারা। কমান্ড পোষ্টের কিছু দুরে নায়েক গুলাব সিংয়ের পজিশনে প্রথম হানা দেয় চীনারা। তারপর আঘাত করে সাত এবং আট নম্বর প্লাটুনের পজিশনে। কিন্তু ভারতীয় সেনাদের আগের রাত থেকেই প্রস্তুত রেখেছেন মেজর। মুহুর্মুহু গর্জে উঠছে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র। হুকুম চাঁদের মেশিন গান শুরু করেছে চীনা নিধন যজ্ঞ। রেজাংলাতে শুরু হয়ে গেছে ঐতিহাসিক লড়াই। গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ছে চীনা সেনারা, তারপরেও গিরিপথ ধরে উঠে আসছে অগুন্তি চীনা সেনা। শত্রু নিধন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন ভারতীয় জওয়ানরা। হাবিলদার সুর্য রাম কমান্ড পোষ্টকে জানাচ্ছেন সাত নম্বর প্লাটুনকে আক্রমণ করেছে চীনা সেনারা। প্রায় চারশো চীনা সেনা উপরে উঠে আসার চেষ্টা করছে। যদিও উপরে থাকার সুবিধা নিয়ে মরিয়া লড়াই চালাচ্ছেন ভারতীয় জওয়ানরা। সারারাত লড়াইয়ের পর একটু একটু করে আকাশ ফর্সা হচ্ছে। ভোরের আলোতে দেখা যাচ্ছে গিরিনালাগুলো চীনা সেনাদের মৃত দেহে ভরে উঠছে।
মেজর শয়তান সিং রেডিও মারফত বিভিন্ন পোষ্টে খবর দিচ্ছেন। সেইসঙ্গে নিজের কমান্ড পোষ্টে বসে না থেকে জওয়ানদের সঙ্গে রণাঙ্গনে এসে গুলি চালাচ্ছেন। রেজাংলা গিরিপথ দখলের জন্য চীন পাঁচ হাজার সেনার সঙ্গে প্রভুত পরিমাণে বিভিন্ন আকৃতির মেশিন গান এবং মর্টার পাঠিয়েছে। তার পেছনে আছে শক্তিশালী কামান বাহিনী। যাদের সঙ্গে আছে বিভিন্ন আকার এবং আকৃতির কামান। সাধারণত স্থল যুদ্ধে কামান বাহিনী শত্রুকে ব্যস্ত রাখে। সেই সুযোগে পদাতিক বাহিনী এগিয়ে যায়। কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে কামান নেই। কারণ পার্বত্য দুর্গমতার কারনে কামান ওঠানো সম্ভব নয়। প্রতিটা ভারতীয় পোষ্টের পেছনে রয়েছে সুউচ্চ পর্বত। ফল স্বরূপ রেজাংলা গিরিপথের পাহারায় থাকা একশো কুড়িজন ভারতীয় জওয়ানকে নামতে হয়েছে এক অসম যুদ্ধে। যাদের সঙ্গে আছে রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড, বেয়নেট আর শক্তিশালী দুটো করে হাত। সেই সঙ্গে আছে আত্মবিশ্বাস এবং দেশ ভক্তিতে পরিপূর্ণ সিংহ হৃদয়।
মেজর শয়তান সিং ভালোভাবেই জানেন মাত্র একশো কুড়িজন জওয়ান নিয়ে পাঁচ হাজার চীনা সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় কোনও মতেই সম্ভব নয়। বারে বারে বার্তা পাঠাচ্ছেন হেড কোয়ার্টারে, আরও সেনা, আরও অস্ত্র, আরও রসদ, আরও খাদ্য পাঠানোর জন্য। হেড কোয়ার্টার থেকে বার্তা আসে আর কিছুই পাঠানো সম্ভব নয়। মেজর যদি একান্তই যুদ্ধ করতে না পারেন, তাহলে যেন রেজাংলা ছেড়ে চলে আসেন। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পালানো সম্ভব নয়। তাহলে আরও বড় অঘটন ঘটে যাবে। রেজাংলা থেকে পিছু হটলে লাদাখ বেরিয়ে যাবে ভারতের হাত থেকে। তার বদলে আরও কিছুক্ষণ চীনা সেনাদের আটকে রাখতে পারলে হয়তো আরও ভারতীয় সেনা এসে যেতে পারে হেড কোয়ার্টার থেকে। হয়ত চার্লি কোম্পানিকে সাহায্য করতে এসে যেতে পারে কুমায়ুণ রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি। তবে চরম লড়াই শুরু হওয়ার আগে মেজর রেডিও মারফত সব পোষ্টে খবর পাঠাচ্ছেন যে এক অসম লড়াইতে নামতে চলেছে চার্লি কোম্পানি। কেউ যদি লড়াই ছেড়ে চলে যেতে চায়, যেতে পারে।
কিন্তু ওরা যে ভারতীয় সেনা। যারা দেশ মাতৃকার জন্য হাসি মুখে মৃত্যুকে বরণ করতে পারে। ওদের কাছে আগে দেশের মান, তারপর নিজের প্রাণ। দেশ রক্ষার মহান দায়িত্ব যাদের উপর, তারা কি করে দেশ মাতৃকাকে শত্রুর হাতে তুলে দিয়ে ফিরে আসবেন? একজন জওয়ানও নিজের জায়গা ছাড়তে রাজি নন। তারা একবাক্যে মেজর কে জানালেন শেষ রক্ত বিন্দু মাটিতে না পড়া পর্যন্ত তারা লড়াই চালিয়ে যাবেন। রণক্ষেত্র ত্যাগ করার বদলে তারা হাতে তুলে নিলেন আগ্নেয়াস্ত্র। চুশুল উপত্যকার পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হতে থাকে ভারতীয় জওয়ানদের রণহুঙ্কার।
ভোর থেকেই গর্জে উঠতে থাকে চীনাদের কামান। সেই সুযোগে চীনা সেনারা রাইফেল, মর্টার নিয়ে চালায় দ্বিতীয় হামলা। মেজর শয়তান সিং তাদের পরিকল্পনা আগেই ধরে ফেলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়ে রেখেছেন মেশিনগান। চীনা সেনাদের নিচে থেকে উপরে ওঠার পথ প্রায় বন্ধ। রেজাংলা গিরিপথ তাদের মৃত্যু ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মেজরের ফাঁদে পা দিয়ে চীনা সেনারা উপরে উঠে আসছে। চীনা সেনারা যখনই বন্দুকের পাল্লায় মধ্যে চলে আসে তখনই গর্জে ওঠে ভারতীয়দের মেশিনগান। নয় নম্বর প্লাটুনের কাছে বিদ্ধস্ত হয় চীনা সেনারা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আশপাশের অঞ্চল ভর্তি হয়ে যায় চীনা সেনাদের মৃতদেহে। অন্য দিকে আট নম্বর প্লাটুনের জওয়ানরা প্রতিহত করেন তৃতীয় এবং চতুর্থ দফার হানা।
আট নম্বর পোষ্টের হরিরাম কমান্ড পোষ্টে খবর পাঠান চীনা সেনারা বিভিন্ন দিক দিয়ে উঠে আসার চেষ্টা করছে। অসংখ্য চীনা সেনা উঠে এসেছে আট নম্বর প্লাটুন এবং কমান্ড পোষ্টের মাঝামাঝি অঞ্চলে। প্রথমে ভারতীয় জওয়ানরা ভেবেছিলেন কুমায়ুণ রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি এসে গেছে চার্লি কোম্পানিকে সাহায্য করতে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা বুঝতে পেরে হাবিলদার হরপাল সিং চিৎকার করে সকলকে সতর্ক করেন। আট নম্বর প্লাটুনকে আক্রমণ করতে আসা চীনা সেনাদের প্রতিহত করেন কমান্ড পোষ্টের জওয়ানরা। আবার গিরিনালাগুলো ভরে ওঠে চীনা সেনাদের মৃত দেহে।
অন্যদিকে সাত নম্বর প্লাটুনকে ঘিরে ফেলেছে চীনা সেনারা। খুব কাছাকাছি এসে গেছে দুই পক্ষ। ফলে গুলি চালানোর উপায় নেই। দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় বেয়নেট নিয়ে হাতাহাতি লড়াই। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে সেই লড়াইও পরিনত হচ্ছে অসম লড়াইতে। চীনা সেনাদের পরনে আছে মোটা শীত বস্ত্র। বেয়নেট যে বস্ত্র ভেদ করতে পারছে না। সাধারণ পোষাক পরা ভারতীয়রা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছেন চীনাদের বেয়নেটের আঘাতে। এমন সময়ে যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসেন কুস্তিগীর রাম সিং। 'জয় বজরং বালী' হুঙ্কারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে মত্ত মাতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়েন চীনাদের উপর। বেয়নেটে কাজ হচ্ছে না তো কি হয়েছে, দুটো শক্তিশালী পেশিবহুল হাত আছে। হাতের বেয়নেট ফেলে দিয়ে তিনি শুরু করেন মল্লযুদ্ধ। রাম সিংয়ের প্রবল প্রতাপে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে শত্রু শিবিরে। রুদ্রমুর্তি ধরা রাম সিং চীনা সেনাদের ধরে পাথরে আছড়ে মারছেন। কখনও আবার দুই চীনা সেনার চুলের মুঠি ধরে মাথা ঠুকে ভবলীলা সাঙ্গ করছেন। শত্রু নিধন করতে করতে এগিয়ে চলেছেন রাম সিং। তার সামনে এসে পড়ে জং নামের এক চীনা সেনা। হাত বাড়ান রাম সিং। কিন্তু পাঁকাল মাছের মত পিছলে সরে যায় জং। দৌড়ে পালায় সে। অবশ্য বেশি দুরে না গিয়ে অপেক্ষায় থাকে। জং জানে মুখোমুখি লড়াইতে সে পেরে উঠবে না এই ভারতীয়র সঙ্গে। তাই সে পেছন থেকে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে রাম সিংকে। বেয়নেটের আঘাতে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় রাম সিংয়ের পিঠ, বুক। মাটিতে পড়ে যান রাম। তারপর চারিদিক থেকে আসা বেয়নেটের আঘাতে বীরগতি প্রাপ্ত হন। দেশ মাতৃকার জন্য শহীদ হলেন ভারত মাতার বীর সন্তান রাম সিং।
আবার এগিয়ে আসে জং। শত্রু সেনার হাতে লাঞ্ছিত হতে দেয় না রাম সিংয়ের মৃতদেহকে। তারপর সে রাম সিংকে দেয় এক অভূতপূর্ব সম্মান। সে মাটি থেকে তুলে নেয় রাম সিংয়ের বন্দুক। বন্দুকের বেয়নেটটা মাটিতে পুঁতে দিয়ে তার উপর রাখে রাম সিংয়ের হেলমেট।
- "কি করছ জং? ও আমাদের শত্রু!" প্রশ্ন করে অন্যান্য চীনা সেনারা।
- "হ্যাঁ শত্রু। তবে ও একজন অসীম সাহসী বীর যোদ্ধা। যে খালি হাতে আমাদের বেয়নেটের সামনে বুক চিতিয়ে মরণ পণ লড়াই করে গেল। আমরা এই অপরাজেয় যোদ্ধাকে সম্মুখ সমরে হারাতে পারিনি। আমরা কাপুরুষের মত ওকে পেছন থেকে আঘাত করেছি। আমরা ভীরু, আমরা কাপুরুষ। আমরা যোদ্ধা নামের কলঙ্ক। আর ও রণাঙ্গনে বীরগতি প্রাপ্ত এক সর্বোচ্চ সম্মানীয় পুজোনীয় যোদ্ধা।" অন্যান্য চীনা সেনাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জং রাম সিংয়ের মৃত দেহের সামনে নতজানু হয়ে বলে, "হে মহান শত্রু তোমাকে প্রনাম।"
কয়েক দিনের মধ্যেই জারি হল সিজ ফায়ার। থামল যুদ্ধ। শহীদ রাম সিংদের দেহ রয়ে গেল বরফের নিচে। মাত্র একশো কুড়িজন ভারতীয় বীর জওয়ান কেড়ে নিয়েছিলেন তেরশো চীনা সেনার প্রাণ। নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে তারা লাদাখকে রক্ষা করেছিলেন চীনের হাত থেকে। আজও তাঁরা পুজিত হন আহির ধামে।
।। সমাপ্ত ।।
দেবাংশু সরকার।
ঠিকানা - 34/10/A, M.G.ROAD
BUDGE BUDGE
KOLKATA - 700137.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন