স্মৃতির পাতায়
সমর আচার্য্য
এখন একটু নিরালায় বসলেই অতীতের দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে কান্তিবাবুর। দেখতে দেখতে পঁচাত্তর বছর হয়ে গেল জীবনটার।
মনে পড়ে বাবার কথা। সেই পূর্ববঙ্গ থেকে আসার দিনের কথা।
একমাত্র কাকা বেশ কয়েক বছর আগে বিনা পাসপোর্টে ভারতে চলে এসেছিলেন। কলকাতায় (তখনকার কলিকাতা )এক তুতো দাদার সংসারে ঠাঁই নিয়েছিলেন । এবং ভারতীয় নাগরিকত্বের শংসাপত্র জোগাড় করে ফেলেন ।
তারপর অনেক চেষ্টা করে একটি সরকারি দপ্তরে চাকরি পেয়ে দাদা বীরেন আচার্য্য কে ভারতে চলে আসার জন্য উৎসাহ দিতে থাকেন । শেষের দিকে পিড়াপীড়ি পর্যায়ে চলে যায় সেই আবদার।
দাদা বীরেনবাবুও ভাইয়ের কথা মতো ভারতে আসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন।
কোন এক কারণে তার নিজেকে বাদ দিয়ে পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে স্ত্রীর পাসপোর্ট ভিসার ব্যবস্থা হয়।
ভাই হারান চিঠি লিখে জানায়, দাদা, তুমি চিন্তা করো না, আমি কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বৌদিদের নিয়ে আসব। তার পাসপোর্ট করা ছিল।
সেইমতো দিন ঠিক হয়। এবং বীরেনবাবু বিনা পাসপোর্টে দালাল ধরে এপারে আসবেন ।
যথারীতি ভাই হারান নির্ধারিত দিনে হাজির হয় ।
গ্রাম থেকে গরুর গাড়িতে করে কুষ্টিয়া এসে সেই রাতটা এক আত্মীয়র বাড়ি থেকে পরের দিন কুষ্টিয়া থেকে শিয়ালদহ গামী ঢাকা মেলে চড়ে বসেন ।
দর্শনা স্টেশনে কথামতো বীরেনবাবু নেমে যান। স্টেশনের বাইরে অদূরে একটি চায়ের দোকানে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন।
তারপর যথারীতি চেকিং শেষ করে প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে ট্রেন ছাড়ে।
স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, ভাইকে বাই বাই জানিয়ে নিজে চলে যান দালালের বাড়ি। ঐ রাত্রি থাকতে হবে। পরেরদিন ভোর ভোরে বর্ডার পার করে দেবে ওরা।
ট্রেন ছাড়ল। বোধহয় বিকালের দিকে শিয়ালদহ পৌঁছায় কান্তিদের ট্রেন।
বীরেনবাবু পরের দিন বেলা এগারো /বারোটার আগেই ঠিকানা খুঁজে টালিগঞ্জে ভাইয়ের বাসায় চলে আসেন।
তারপর শুরু হয় তার নতুন জীবন সংগ্রাম। ভাইয়ের তেমন উঁচু পদে চাকরি নয়। তাছাড়া তখনতো বেতন খুবই কম।
সংসারে অভাব অনটন শুরু হলো। বীরেনবাবুর গণৎকারী করা অনিশ্চিত আয় এবং কাকার সামান্য বেতনে বাড়ি ভাড়া দিয়ে সংসার আর চলতে চায় না। তার উপর কান্তিকে তখনকার এক নামকরা স্কুলে ভর্তি করলেন।
মাস ছয়েকের মধ্যেই বাধ্য হয়ে কলকাতা ছেড়ে নদীয়া জেলার হাঁসখালিতে এসে জ্যাঠতুতো বৌদির আনুকূল্যে একটুকরো জমি পেয়ে বসবাস শুরু করেন। কান্তি থেকে যায় কাকার কাছে।
মা বাবাকে ছেড়ে থাকার অভ্যাস নেই, তাই কিছুদিন পর থেকেই খুব মন পুড়তে থাকে। কাকার কাছে বায়না ধরে হাঁসখালি যাবে বলে। এর আগে একবার হাঁসখালি এসেছিল সবার সাথে। মাস দুই তিন আগে। ওর বায়নার চোটে কাকা বললেন, আমার তো ছুটি নেই। তুই কি একা যেতে পারবি?
কান্তি বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, পারবো কাকা, তুমি যদি শিয়ালদহ স্টেশনে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসো, তাহলে খুব পারব।
একদিন হারান কাকা তাকে শিয়ালদহ এসে বানপুর লোকাল ট্রেনে তুলে সিটে বসিয়ে দিয়ে গেলেন। একটা হাঁফ টিকিট কেটে পকেটে দিয়ে বললেন, সাবধানে রাখিস। সাথে চারটে সিকি । আর বললেন, রানাঘাটের পরে আড়ংঘাটা, তারপরেই বগুলা। রাস্তায় টি টি ই বয়স জিজ্ঞাসা করলে বলবি এগারো বছর। কান্তি বলে, কিন্তু কাকা, আমার বয়স তো তেরো। সে হোক,তোকে যা বললাম, তাই বলিস। ট্রেন ছেড়ে দিল। তখনও ডিজেল বা ইলেকট্রিক ট্রেন হয়নি। সব স্টিম ইঞ্জিনে চলা। শিয়ালদহ ছেড়ে ইঞ্জিনের চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ট্রেন এগিয়ে চলল। একাকি কান্তির প্রথম ট্রেন সফর। তবে কেন যেন খুব একটা ভয় টয় করেনি।
পরণে ছিল একটা সাদা হাঁফ প্যান্ট, গায়ে একটা হাঁফহাতা জামা। যাইহোক সারা রাস্তায় টি টি ই ওঠেনি। তিন ঘন্টার অধিক সময়ের পথ। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে আসছিল। একজন বয়স্ক যাত্রী কান্তিকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, খোকা, ঐভাবে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখো না। চোখে কয়লার কুচি ঢুকতে পারে। পরে উনি বুঝিয়ে বললেন, ইঞ্জিন তো কয়লায় চলে। চিমনির ধোঁয়ার সাথে কয়লার কুচি উড়ে আসে। আর তা ট্রেনের গতির বিপরীত দিকেই আসে। একভাবে তাকিয়ে থাকলে চোখে এসে পড়তে পারে।
ট্রেন বগুলা স্টেশনে ঢুকল। কান্তি ট্রেন থেকে নেমে গেট পার হতে গিয়ে গেটে দাঁড়ানো টি ই র কাছে বাধাপ্রাপ্ত হলো। টি ই টিকিট দেখে ছেড়ে দিতে গিয়েও আবার আটকে দিয়ে বললেন, পাশে দাঁড়াও। তারপর সব যাত্রী ছাড়া হয়ে গেলে বললেন,চলো। বলে তার সঙ্গে অফিস ঘরে নিয়ে গেলেন। আরো দুয়েকজন ছিল সেখানে। তখনতো এখানকার মতো বেশি যাত্রী হতো না। টি, ই বললেন, কি নাম তোমার? নাম বলাতে আবার বললেন, শিয়ালদহ থেকে উঠেছ? তা তোমার বয়স কত? তারপর হেসে বললেন, হাঁফ প্যান্ট পরেছো বলে তুমি কি আর শিশু আছো?
কান্তি আমতা আমতা করে বলে, আমার বয়স এগারো স্যার। তাই বুঝি? কোন ক্লাসে পড়ো?
কান্তি বলে, ক্লাস সিক্স এ স্যার।
যাইহোক, টি ই অফিসের অন্য লোকের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করে বললেন, তোমার আর হাঁফ প্যান্ট পরা বা হাঁফ টিকিটের বয়স নেই। আজ ছেড়ে দিলাম। এরপর থেকে পুরো টিকিট কেটে যাতায়াত করবে। বলে বললেন, যাও। একটু এগিয়ে গেলেই হাঁসখালির বাস পাবে। এর আগে শুনে নিয়েছিলেন কোথায় যাবে ।
পরে কাকার কাছে জিজ্ঞাসা করেছিল কান্তি, কাকা, তুমি মিথ্যা কথা বলতে বললে কেন, কাকা বলেছিলেন, তোর আসল বয়স তেরো হলেও স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে, এগারো বলে। তোর বয়স কাগজে কলমে এগারো ই। আর তাই এবং পয়সার জন্যও বটে হাঁফ টিকিট কেটে দিয়েছিলাম। কান্তি বুঝতে পারে ব্যাপারটা, তাই এই নিয়ে আর কোন কথা বলে না।
আজ বাবা নেই কাকাও নেই। তারা সবাই আকাশের তারা হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেই দিনগুলোর কথা প্রতিনিয়ত বড় মনে পড়ে।
মনে পড়ে টি ই বাবুর বলা, খোকা, তোমার আর হাঁফ প্যান্ট পরার বয়স নেই।
এখন বুড়ো বুড়ো লোকগুলোর হাঁফ প্যান্ট পরা দেখলেই সেই কথা মনে পড়ে। কালের আবর্তনে কত পরিবর্তন হলো ---আরও কত হবে, তা একমাত্র সময় ই বলবে।
নাতনির ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়ে, ও দাদু, কি ভাবো সারাদিন অত? চলো চলো, মা ভাত বেড়েছে -----।
--------
নাম :--সমর আচার্য্য
ঠিকানা --রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর
চলভাষ --৯৭৭৫৭৭২২৫৫
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন