রাত্রি আটটা দুই মিনিট।
টির রিং… টির রিং …
মুঠোফোনে আওয়াজ হতেই মুঠোফোন হাতে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকাতে ভেসে উঠলো ইংরেজি ক্যাপিটাল অক্ষরে লেখা বড়ো ছেলে শশধরের নাম। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ইনকামিং কল রিসিভ করে ডান কানের কাছে নিয়ে আসতেই ওদিক থেকে পরিচিত অথচ কম্পিত হিউমার মিশ্রিত স্বরে আওয়াজ ভেসে এল —
'বা..বা.. আমি এইবারে টোকিও গ্রীষ্মকালীন যুব অলিম্পিকের আসরে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছি, আমি কোয়ালিফাই করেছি।'
এই কথা শোনার পরই বাবা লম্বোধর হিন্-দয়ার এর মুখ থেকে কিছু কথা বের হয় না‚ শুধু দু চোখ বেয়ে নাখের ডগা দিয়ে জল পড়ছে। প্রায় মিনিট খানেক মূক থাকার পরে তার গলার স্বর ফুটল, স্বর যন্ত্র তার স্বাভাবিকতা ফিরে পেল। তখন বলে উঠলো
'বাহ বেটা! আজ আমার জীবনটা সার্থক করে দিলি তুই!'
তারপর কিছুক্ষণ ফোনালাপ চলার পর শশধর ফোন রাখে। এদিকে ফোন টেবিলে রেখে দেওয়ার পর লম্বোধর হিন্-দয়ার, কুড়মী সম্প্রদায়ের মানুষ‚ ভাবে আজ তার জীবনের যে অপূর্ণতা ছিল, তাতে সম্পূর্ণতা পেল। তার বংশ তালিকায় উজ্জ্বল ও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে শশধরের নামের নিচে বাবার নামের জায়গায় লম্বোধর হিন্-দয়ার। তাই আজ তার হৃদয়ের আনন্দ সমস্ত সীমারেখাকে অতিক্রম করে এক অসীম সীমাহীন জগতে বিচরণশীল। এই আনন্দের জোয়ারে কখন যে রাত আটটা দুই মিনিট থেকে সাড়ে দশটা বেজে গেছে সে বুঝতেই পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে বিছানাতে শুতে যায়। শুয়ে শুয়ে তার মাথায় চলে এল সেই কালো‚ অন্ধকার সময়ের ছবি। তার অতীতের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল‚ সেই অপূর্ন‚ ব্যর্থতার ছবি। সে ফিরে যায় সেই অতীত স্মৃতির মণিকোটায়— —
…. করমাটাঁড় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। গায়ের রং কালো কিন্তু শরীরের উত্তেজনার কাছে গায়ের রং একেবারে নিষ্প্রভ। তার জন্মের পর তার শরীরের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে বাড়ির লোকেরা বোধ হয় বিধাতার মারফত অবগত হয়েছিল‚ তাই তারা নামকরণের সময় বৈপরীত্য সৃষ্টির জন্যে নাম দিল লম্বোধর। যেমনটা দেখা যায় গ্রামের কারো নাম – কোন জাতির পদবী বা লাস্ট নেম দেওয়া হয়। যেমন থাকে মণ্ডল কালিন্দী। তেমনই তার শরীরের দৈর্ঘ্য কম হবে অনুমান করেই বাড়ির লোক তার নাম দিয়েছিল লম্বোধর। লম্বোধর বেঁটে আকৃতির প্রায় চার ফুট পাঁচ ইঞ্চির মতো হলে কি হবে? সে যে অসম্ভব রকমের জোরে দৌড়াতে পারে। তার সমবয়সীদের মধ্যে কেউ থাকে হারাতে পারেনি। একমাত্র মানসিক প্রতিবন্ধকতা বাদে গায়ের রং বা শরীরের দৈর্ঘ্য এগুলো যে প্রতিভার কাছে অতি তুচ্ছ‚ তা আমরা ইতিহাসের পাতায় যদি চোখ মেলি‚ তাহলে তার প্রচুর প্রচুর উদাহরণ পাব। হেলেন কালার‚ দেবেন্দ্র ঝাজারিয়া‚ মার্টিন গাপটিল —এরা প্রত্যেকেই দেখিয়ে দিয়েছেন শরীরের প্রতিবন্ধকতা প্রতিভার কাছে সম্পূর্ন রূপে পরাস্ত‚ পরাভূত।
ইন্টারন্যাশনাল গেম খেলার ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রত্যেক বছর জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে হয়। তাই চাষবাস ও মনসা পূজার পরেই সে প্রতিদিন বিকালে দৌড়ায়। গ্রামের সঙ্গীদের সাথে সে প্রাকটিস করে কিন্তু সেখানে তার গ্রামের কম্পিটিটররা তাকে হারাতে পারে না । তাদের সঙ্গে তার জয়ের প্রায় ২৫ মিটারের আকাশ-জমিনের পার্থক্য হয়। বন্ধুরা হিংসায় বলাবলি করে —
' না রে..‚লম্বুকে‚ নাই পারবি হারাতে? এইবারেও সেই ফার্স্ট হবে!'
এইভাবে সেপ্টেম্বর - ডিসেম্বর পেরিয়ে সেই বহু প্রতীক্ষিত কাঙ্ক্ষিত মাস জানুয়ারি এল। এবারে ইন্টারন্যাশনাল গেম খেলার যোগ্যতা নির্ণায়ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে ২৩ থেকে ২৫ শে জানুয়ারী‚ গুজরাটের আমেদাবাদ শহরে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে। এদিকে লম্বু তার প্রাকটিস বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সে সকালে আর বিকালে দুবেলা নিয়মিত প্রাকটিস শুরু করেছে। এবারে তাকে তার বাবা টাকা ধার করে প্রাকটিসের সরঞ্জাম কিনে দিয়েছে। খুব ভালো স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানীর। প্রাকটিসের সরঞ্জাম গুলো দেওয়ার সময় বলেছে –
"দেখ বাবা‚ এইবারে একটু চেষ্টা কর ভালো করে…।"
সেও মনে মনে চাই বাবার এই ইচ্ছা পূরণ করতে। তাই সে মনে মনে পণ করেছে তাকে জাতীয় স্তরের এই দৌড় প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়ে দেশের হয়ে ইন্টারন্যাশনাল গেম খেলে বাবার ইচ্ছা নামক শূন্যস্থান পরিপূর্ন করতে। জোর কদমে চলছে প্রাকটিস।
– —-- —-- —--
দেখতে দেখতে সেই কাঙ্ক্ষিত ও বহুপ্রতীক্ষিত দিন খুব কাছে এল। আগামী মঙ্গলবার ২৩ তারিখ পড়েছে। তাই সে রবিবারেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। পুরুলিয়া জংশনে "পোরবন্দর কবি গুরু সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস" ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে। নির্ধারিত সময়ের আধ ঘণ্টা পরে ট্রেন এল। লম্বু ট্রেনে উঠে নির্ধারিত কামরার নির্দিষ্ট সিট নম্বরে বসে। সাথে রয়েছে তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক। যিনি বসেছেন লম্বুর সিটের পরের পরে। মিনিট পাঁচেক পরে ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেন দ্রুত গতিতে চলছে তার গন্তব্যস্তলে পৌঁছানোর জন্যে। বিলাসপুর জংশন পার হওয়ার পর লম্বু মনে মনে ভাবে
"এইবারে বাবার ইচ্ছা সে পূরণ করবেই করবে।"
পরের দিন সোমবার ট্রেন আমেদাবাদ জংশনে পৌঁছাল। ট্রেন থেকে নেমে অটোর সাহায্যে নির্দিষ্ট হোটেলে। রাত্রিতে ঠিক মতো খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে‚ পরের দিনই সে ট্র্যাকে দৌড়াবে। তাই ঘুমানোরও তার মাথায় আসে বাবার সেই কথার প্রতিধ্বনি
"দেখ বাবা এইবারে একটু চেষ্টা কর ভালো করে…।"
সকালে উঠে মুখ ধুয়ে‚ শরীর চর্চা করে‚ হালকা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে স্টেডিয়ামের উদ্দেশ্যে। সাথে রয়েছেন হেড স্যার। যথা সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর স্টেডিয়ামে ঢুকতেই তার হৃদয়ে এক পশলা সুনামির ঢেউ তার সমস্ত শরীরকে চাঙ্গা করে দিল। চারিদিকে ক্রীড়াবিদদের সমাগমের পাশাপাশি দর্শকের উল্লাস তার মনকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিল। লম্বুর ট্র্যাকে দৌড়ানোর সময় ঠিক হয়ে গেছে। তাদের ইভেন্ট শুরু হবে সকাল সাড়ে এগারো নাগাদ। আর মিনিট তিরিশের বাকি। ইতিমধ্যে সে ওয়ার্মআপ শুরু করে দিয়েছে। দেখতে দেখতে সময় চলে এলো। রেফারি হুইসেল বাজিয়ে জানিয়ে দিল—
"কৃপইয়া‚ ট্র্যাকিং লাইন পে খড়ি হো যাইয়ে…।"
যথারীতি প্রত্যেক রানার রেডি হয়ে যায় তাদের নিজ নিজ ট্র্যাকিং লাইনে। লম্বুও প্রস্তুত। অন্যান্য দৌড়বিদদের সাথে সাথে সেও গভীর আগ্রহে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে‚ রেফারি সাহেবের হুইসেলের আওয়াজ। এদিকে রেফারি সাহেবও রেডি‚ এক দুই তিন করে হুইসেল বাজিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে লম্বুও দৌড় শুরু করে দিয়েছে।….
শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হল। লম্বু কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে পাঁচ সেকেন্ড সে বেশি সময় নিয়েছে। লম্বুর মন খুব খারাপ। সে অনেক জোরে দৌড়েছিল। সে ভেবেছিল কোয়ালিফাই করতে পারবে। কিন্তু পারল না। তার বাবার আশা পূর্ণ করতে পারল না। একরাশ হতাশা তার সমস্ত মন ও শরীরকে অবশ করে দিল। হেড স্যার এসে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে‚ কিন্তু সেই সমস্ত সান্ত্বনা তার মনকে আর চাঙ্গা করতে পারছে না। সে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে। দর্শকদের চিৎকার চেঁচামেচি কিছু তার কর্ণকূহরে প্রবেশ করছে না। কর্ণকুহরে একটাই আওয়াজ বার বার ধ্বনিত হচ্ছে
"দেখ বাবা এইবারে একটু চেষ্টা কর ভালো করে…"।
কিন্তু সে কি করবে। সে তো প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছিল। প্রায় আধ ঘন্টার পর সে একটু চেতনা ফিরে পেল। হেড স্যার তাকে বলল
" চিন্তা করো না লম্বু, চল পরের বছর হবে। হার জিত খেলারই অঙ্গ। চাপ নিও না। পরের বছর আবার ট্রাই করো।"
অগত্যা কিছু করার উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে স্যারের সঙ্গে স্টেডিয়াম থেকে ভারাক্রান্ত ও বিষাদগ্রস্ত মনে বের হয়। অটো ধরে হোটেলে যাওয়ার জন্যে। স্যারের সাথে অটোতে বসে আছে‚ কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা আর বের হয় না । চুপচাপ বসে আছে। ভারাক্রান্ত মনে হোটেলে ঢুকে। হোটেলে বসেও তার মন ঠিক নেই। রাত্রে খাবার খেতে মন করে নাই। কিন্তু স্যারের বার বার ডাকার ফলে সে আসে এবং হালকা কিছু খেয়ে আবার বিছানায় শুয়ে যায়।
পরের দিন সকালে উঠে। কিছু করতে মন করছে না। কিন্তু কিছু করার নেই‚ স্যারের সান্ত্বনাও তার মাথা ব্যথা আর ঠিক হচ্ছে না। দুপুরে আবার ট্রেন‚ বাড়ি যেতে হবে। তাই কিছু খেয়ে স্যারের সাথে বেরিয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে। তারপর দেড় দিন ট্রেনে থাকার পর অবশেষে পুরুলিয়া জংশনে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে। সেখান থেকে টোটো ধরে‚ বাস স্ট্যান্ডে নেমে‚ আবার বাস ধরে শেষে পড়ন্ত বিকালে বাড়ি পৌঁছায়। বাবার প্রশ্নের জবাবে সে কিছু বলতে পারেনি — মাথা নিচু করে নিরুত্তর ও নিশ্চুপ…..।
হটাৎ ঘুম ভেঙে যায় লম্বুর। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সকাল হয়ে গেছে। সূর্যরশ্মি দরজার ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করেছে‚ অন্ধকার ঘরকে আলোকিত করে তুলেছে। বিছানা থেকে উঠে বসে। তার মন আজ খুব প্রসন্ন। তার চোখে মুখে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। তার মনের আশা আজ পূর্ণ। সমস্ত ব্যর্থতা আজ ঢাকা পড়েছে। সে তার বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু তার বড় ছেলে শশধর আজ তা করতে সফল হয়েছে। শশধর শুধু তার একা স্বপ্ন পূরণ করেনি‚ আজ তার বাবা লম্বোধর ও দাদু জলধর হিন্-দয়ার'এর স্বপ্নও সফল ও সম্পূর্ন করেছে।
=============
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন