সমীর কুমার দত্ত
জমিদার রায়বাহাদুর কন্দর্পনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে শরিকি সংঘর্ষের ফলে তাঁর সম্পত্তি ভগ্নদশাগ্রস্ত ভূতুড়ে সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে মামলার রায়ের দিন গুনছিলো।
সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মামলাটির নিস্পত্তি হলে পাঁচ শরিকের মধ্যে নিজ নিজ অংশে রিমডেলিং,মেরামতি ইত্যাদির কাজ শুরু হলো। এমনিতেই বহুদিন পড়ে থাকা জমিদারের নিস্তব্ধ নিঝুম বৃহৎ অট্টালিকা প্রাসাদকুক্কুটের নিরন্তর বকবকম যেন প্রাসাদটিকে রহস্যাবৃত করে তুলেছে। মেরামতির সময় ভৌতিক উপদ্রব শুরু হলো। তারা যতবার স্ব স্ব অংশের প্লাস্টার করে, পরের দিন এসে দেখে, সেই প্লাস্টার খসে পড়ে গেছে ব্যাঘ্রের থাবার চাপে। ভৌতিক উপদ্রব বলছি এইজন্য যে প্রত্যেক শরিকের দেওয়ালেই ওই একই নিদর্শন দেখা গেছে যেখানে ভিন্ন ভিন্ন রাজমিস্ত্রি কাজ করছে। আর দেওয়ালে সিংহের পদচিহ্ন পড়া তো সম্ভব নয়। সম্ভব শুধু মেঝেতে। তদুপরি দু -তিন দিন এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। কাজ বন্ধ হবার উপক্রম হলো। বাঘের অগুনতি পায়ের দাগ, যার ফলে প্লাস্টার খসে খসে পড়তে বাধ্য হচ্ছে।
অনেক চিন্তাভাবনা করে কোন কূলকিনারা পাওয়া যায় নি। অবশেষে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য রামলোচন অধিকারী সকলের কাছে রায়বাহাদুর কন্দর্পনারায়ণের শিকার কাহিনী সামনে আনেন। সকলে কৌতুহলী হয়ে শুনতে থাকেন সেই সমস্ত শিকারের ঘটনা।
কন্দর্পনারায়ণ ব্রিটিশের দেওয়া 'রায়বাহাদুর' খেতাব প্রাপ্ত। সেই সুবাদে ব্রিটিশের উচ্চপদস্থদের শিকারে সঙ্গী হতেন। একবার তিনি মৃগয়ায় গিয়ে একটা হরিণ শিকার করে তার মাংস খেয়েছিলেন। তার চামড়ায় জুতো বানিয়ে শিংটাকে দেওয়ালে স্থান করে দেন। পরে অবশ্য দুঃসময়ে অনেক ভালো ভালো জিনিষের সঙ্গে ওটিকে বিক্রি করে দেন। আর একবার শিকারে গিয়ে মধ্য বয়সী একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ধরে এনেছিলেন। সঙ্গে একটা ট্রেনার। ট্রেনারের ট্রেনিং পেয়ে বাঘটির জমিদারের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে যায়। পরে অবশ্য ট্রেনারটি চলে যায়।তারপর একজন সাধুর সাহায্যে জমিদার তাকে বশীকরণ করে ছিলেন। ফল তো পেলেন। কিন্তু বিপরীত ফলও হতে লাগলো। যেমন জমিদারকে সে এতই ভালোবাসতো যে কাউকে জমিদারের সামনে ঘেঁষতে দিতো না। ইতিমধ্যে বাঘটি বেশ বড়ো সড়ো হয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানকও হয়ে উঠেছে। চট করে ওর সামনে কাউকে আসতে বারণ ছিলো।
একবার জমিদার বাইরে থেকে এসে বসেছেন, জমিদারের এক কর্মচারী জমিদারের পা থেকে জুতো জোড়া খুলতে গিয়েছিলো, যেমন যায় আর কি। বাঘের গলার চেনটা কোন ভাবে খুলে গিয়েছিলো হয়তো। ব্যাস! বাঘটা ক্রুদ্ধ হয়ে তার টুঁটি চেপে ধরেছিলো। ছাড়ার নামটি নেই। জমিদার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু না, সে ছাড়তে চায় না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও জমিদার বাঘটিকে গুলি করতে বাধ্য হন। প্রথম গুলিটা করেছেন তবুও সে ছাড়ে নি। বরং আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। জমিদারও ক্রুদ্ধ হয়ে দ্বিতীয় গুলিটা করেন। দ্বিতীয় গুলিটা করার পর বাঘটি নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। অর্থাৎ বাঘ ও কর্মচারী দুজনেই মারা গেলো। বাঘটি যেমন জমিদারকে ভালোবাসতো জমিদারও বাঘটিকে ভালোবাসতেন বেশি বই কম নয়। বাঘটি জমিদারকে ভালোবাসতো, বিনিময়ে জমিদারের হাতেই তাকে প্রাণ দিতে হলো। প্রায়শ্চিত্ত করতে জমিদার তাঁর জমিদারীতে তাকে সমাধিস্থ করেন। তারপর থেকে জমিদার অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগশয্যায় তিনি প্রায়শঃই বাঘটিকে ঘুরে বেড়াতে দেখেন। অন্যেরা বাঘটিকে দেখতে পেতেন না বটে কিন্তু তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারতেন। অর্থাৎ বাঘটির আত্মা মুক্তি পায়নি। মৃত্যুর শেষলগ্নে জমিদার ঘোরের মধ্যে বাঘটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে মারা যান। তারপর থেকে জমিদারীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। রামলোচনবাবু সে সময় পনেরো বছরের কিশোর।
রাজমিস্ত্রীদের অনেকেই বলতে লাগলো, " আমরা ব্যাঘ্রগর্জন শুনেছি বেশ কয়েকবার।" আবার কেউ কেউ বললো,"আমরা বাঘের ছায়ামূর্তি চলে যেতে দেখেছি।" সকলেই বললো, "আমরা তখন এসবে গুরুত্ব দিইনি। মনের ভ্রম বলে উড়িয়ে দিয়েছি।কিন্তু এখন এই সমস্ত বৃত্তান্ত শোনার পর মনে হচ্ছে আমরা ঠিকই শুনেছি এবং দেখেছি।" পাঁচ শরিক ওই বাড়িতে থাকাটা নিরাপদ মনে করলেন না। তারা ঠিক করলেন যে তারা যে কোন মূল্যে এই ভৌতিক বাড়ি বিক্রি করে দেবেন। কারণ তাদের বাচ্চা ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করতে হয়। আর তা ছাড়া গৃহ হলো শান্তির নীড়। ভূতের ভয় নিয়ে কে অশান্তিতে বাস করতে চায়! সমবেত কেউ একজন বলে উঠলো,"আচ্ছা,বাঘের সমাধিটা উৎপাটন করে দিলে হয় না? অমনি রামলোচন অধিকারী প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন,
"না না, তার দরকার নেই। যদি আরও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যায়? কে এর দায় নেবে। ভূত টুথ নিয়ে ছেলেখেলা না করাই ভালো।"
আবার অন্য একজন মন্তব্য করলো," পূজো আচ্ছা করে দোষ কাটিয়ে নিলে হয় না?" প্রতিবাদ ধ্বনিত হলো,"খরচা করে দেখা গেলো ফল কিছুই হলো না। তবে হ্যাঁ, যে তান্ত্রিক বশীকরণ করেছিলো, সে বেঁচে থাকলে, সেই হয়তো ঠিক করে দিতে পারতো।"
এইভাবে বাদানুবাদের মধ্যে দিয়ে এই ভূতুড়ে বাড়িতে বাস না করার সিদ্ধান্তই সর্ব সম্মতভাবে গৃহীত হলো।
চল্লিশ বিঘা জমির ওপর নির্মিত বিশাল অট্টালিকা ক্রয়ের জন্য বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা আসতে লাগলো। সুবিশাল অট্টালিকা সমেত জমিটির নূন্যতম মূল্য নির্ধারণ করা হয় আট কোটি টাকা অবশ্যই সত্য গোপন না করে। ক্রেতা আসে যায়। প্রত্যেকে প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করে ক্রয় করার কিন্তু দামে পোষায় না। প্রত্যেকেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছেন। দেখছেন যদি এই শরিকি বিবাদের ফয়দা তোলা যায়। তারা যা দাম দিচ্ছেন তাতে শরিকরা সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। কেউ কেউ বলছেন, " কি দরকার অতো ঝামেলায় যাবার। যা পাওয়া যায় তাই লাভ। নেই মামার থেকে কাঁনা মামাই ভালো। শেষকালে কেউ নিতেই চাইবে না। শেষে জবর দখল হয়ে যাবে।"
অন্যেরা এ কথায় সহমত হতে পারছেন না। অবশেষে শরিকদের মধ্যে একজন দিল্লি প্রবাসী এক বাঙালী ব্যবসায়ীকে লাগিয়ে দেয় এই সম্পত্তি ক্রয় করার জন্য গোপন এক শর্তে। শর্তটি হলো বিক্রিত মূল্যের ওপর শতকরা কুড়ি ভাগ তাকে দেওয়ায়। ওই ব্যবসায়ী পাঁচ কোটি টাকায় সম্পত্তিটি ক্রয় করতে রাজি হয়। পাঁচ কোটি টাকায় বিক্রি হলে প্রত্যেক শরিক হিসাব মতো এক কোটি টাকা করে পায়। যে শরিক এই পার্টিকে ঠিক করে তার প্রাপ্য মোট পাঁচ কোটি টাকার কুড়ি পার্সেন্ট অর্থাৎ এক কোটি টাকা এবং শরিকি ভাগ এক কোটি অর্থাৎ দু কোটি টাকা। আর যে ব্যবসায়ী ক্রয় করছেন তাঁর ক্রয়মূল্য হলো ছয় কোটি। এছাড়া রেজিস্ট্রি চার্জ তাকেই বহন করতে হবে। কিন্তু কে এই শরিক যিনি অন্যান্য শরিকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন?
এদিকে দিল্লি প্রবাসী নিঃসন্তান ওই ব্যবসায়ী কথা পাকা করে আসার পর স্বামী -স্ত্রী দুজনেই কাকতালীয় ভাবে স্বপ্ন দেখলেন বাঘের। স্ত্রী দেখলেন তাঁর গর্ভে এক ব্যাঘ্র শাবক। আর স্বামী দেখলেন হিংস্র ব্যাঘ্র তার দিকে ধেয়ে আসছে। দুজনেই ব্যাঘ্রের স্বপ্ন দেখে ভীত হয়ে পড়লেন। ছুটলেন হিমালয়ের কোলে সাধনারত গুরুদেবের কাছে জানতে যে ব্যাঘ্রভূত বিরাজিত ওই সম্পত্তি ক্রয় করা যাবে কি না। যদি না যায়, তাহলে তিনি ওই ব্যাঘ্রের প্রেতাত্মাকে যোগ বলে কাটিয়ে দিতে পারবেন কিনা। ধ্যানমগ্ন যোগী ওদের উপস্থিতি এবং উপস্থিতির কারণ ধ্যানস্থ অবস্থায় বুঝতে পারেন। তিনি না তাকিয়েই বলতে শুরু করলেন, " তোরা কি কারণে আমার কাছে এসেছিস আমি জানি। তোরা একটা ভূতুড়ে সম্পত্তি কিনতে চলেছিস, ক্রয় করবি কিনা জানতে চাস। কি তাই তো? তবে শোন — ওই জমিতে কোন ভৌতিক উপদ্রব নেই। কোন একজন শরিক বেশি ফয়দা তোলার জন্য এই ব্যবস্থা করে রেখেছে। ওর ফাঁদে পা দিসনি। তাহলে অন্যের প্রতি অবিচার হবে। তুই ন্যায্য দাম দিবি। আমি হিমালয়ের দুর্গম হিংস্র জন্তু অধ্যুষিত এলাকায় সাধনা করি। শোন যে আইন জানে, সেই আইন ভাঙে। বেশি লেখাপড়া শিখে যারা সভ্য বলে নিজেদের জাহির করে,তারাই বেশি অসভ্যতা করে।এরা হিংস্র জানোয়ারের চেয়ে অধিকতর হিংস্র। সুতরাং ব্যাঘ্র থেকে তোদের কোন ক্ষতি হবে না। ওই বাড়িতে কোন ভূত নেই। আছে ব্যাঘ্ররূপী মনুষ্যভূত। সব শোনার পর স্বামী -স্ত্রী যোগী মহারাজকে প্রণাম জানিয়ে ওই স্থান ত্যাগ করলো। তারা সহজেই বুঝতে পারলো আসল ভূতটি কে এবং তারা তাকে কোন সূযোগ গ্রহণ করতে দেবে না। তারা ওই বিশ্বাসঘাতক শরিকের মুখোশ খুলে দেবে সকলের সামনে ছয় কোটি টাকা তুলে দিয়ে। তবে তিনি রেজিস্ট্রি খরচ দিতে অসমর্থ, তাবলে রেজিস্ট্রি খরচ তাঁদের ঘাড়েও চাপাবেন না। শরিকদের তিনি আরও বলে ছিলেন, রেজিস্ট্রির দিনে রেজিস্ট্রি হয়ে যাবার পর তিনি একটা বডো চমক দিতে চলেছেন ওই দিনে।
রেজিস্ট্রির দিনে রেজিস্ট্রি হয়ে যাবার পর ওই ব্যবসায়ী সকল শরিকদের উপস্থিতিতে সকলকে অবাক করে দিয়ে পাঁচ কোটির পরিবর্তে ছয় কোটি টাকা থেকে রেজিস্ট্রি খরচ শতকরা ছ টাকা হারে ছ কোটি টাকার স্ট্যাম্প ফি ছত্রিশ লক্ষ টাকা বাদ দিয়ে বাকি পাঁচ কোটি চৌষট্টি লক্ষ টাকা পাবেন বলে ঘোষণা করলেন। এক দুজন শরিক জিজ্ঞাসা করলেন,
" চৌষট্টি লক্ষ টাকা বেশি কেন?"
উত্তরে ব্যবসায়ী বললেন, "ঠিক চৌষট্টি লক্ষ নয়। এক কোটি টাকা আমি আপনাদের বেশি দিচ্ছি। তার থেকে ছত্রিশ লক্ষ রেভিনিউ স্ট্যাম্প বাবদ বাদ দিয়ে।আসলে হয়েছে কি এ জমিতে কোন ব্যাঘ্র ভূত নেই। আছে এক ব্যাঘ্ররূপী মনুষ্যভূত। ও আমি সামলে নেবো। তাই আমি খুশি হয়ে চৌষট্টি লক্ষ টাকা বেশি দিলাম।"
একজন অপরাধী শরিক বাদে বাকি শরিকরা সমস্বরে বলে উঠলেন,"কোন মনুষ্য ভূত?
—আপনাদের কৌতুহল আছে, আপনারা জিজ্ঞাসা করছেন কিন্তু যার কৌতুহল নেই, কারণ তিনি জানেন । আছে বরং আমার ওপর চাপা ক্রোধ , তিনিই হলেন ব্যাঘ্ররূপী মনুষ্যভূত। যিনি এই বাঘ মারা যাবার কাহিনীটা জানতেন এবং প্রচার করেছেন ওটা তাঁদেরই কারোর কারসাজি।
— কিন্তু কি ভাবে?
—ব্যাঘ্র চর্ম পোরে ব্যাঘ্রগর্জনের টেপ চালিয়ে,যখন লোকজন কম থাকে এবং আবছা অন্ধকারের মধ্যে।
—কিন্তু কি লাভ?
—সকলকে ভয় দেখিয়ে এটা স্টাবলিস্ট করতে যে এ বাড়িতে ব্যাঘ্রভূত আছে। তাহলে এ সম্পত্তিটা বিক্রি হবে না। কারোর আর ইন্টারেস্ট থাকবে না। তারা যে কোন মূল্যে বিক্রি করে দিতে চাইবে। আর তখন খুবই অল্প মূল্যে এটি কিনে নিতে পারবে।
—আর ওই যে বাঘের পায়ের ছাপ? প্লাস্টার খসে পড়া?
—এটা তারই কাজ। প্রত্যেকের পোর্সশনের চাবি নকল করে সময় মতো গিয়ে প্লাস্টিকের বাঘের থাবার ছাপ ব্যবহার করে করা হতো।
এখন সকলের কাছে দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে গেছে যে ওই ব্যাঘ্ররূপী মনুষ্যভূতের পিছনে আছেন ওই রামলোচন অধিকারী ও তাঁর পরিবার এবং তাদের ঠকিয়ে এক কোটি টাকা গায়ের করার মাষ্টার প্ল্যান ওদেরই। সকলেই আফশোস করতে লাগলেন এত কম মূল্যে প্রায় জলের দরে সম্পত্তিটি বিক্রি হয়ে যাবার জন্যে। আর এ সবকিছুর পিছনে রামলোচন অধিকারী ও তার পরিবার। তবে ধন্যবাদ দিতে হবে ওই ব্যবসায়ীকে। ওর জন্যেই তবু বারো লক্ষ টাকা করে বেশি পাওয়া গেলো।
===============
Samir Kumar Dutta
23/1/A, Mohanlal Bahalwala Road
Bally, Howrah 711201
Mobile no. 9051095623(WhatsApp)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন