চন্দন দাশগুপ্ত
গ্র্যাজুয়েট হবার পর ফ্রেডরিখ ফরসাইথের লেখা "শৃগালের শেষ প্রহর" বইটা পড়েছিলাম। একজন রাষ্ট্র নেতাকে হত্যা করার জন্য নিযুক্ত এক গুপ্তঘাতক কার্যসিদ্ধির জন্য কী দুর্ধর্ষ পরিকল্পনা করেছিল, সেটা নিয়েই এই থ্রিলারটি লেখা। গল্পের শুরুতেই এই থ্রিলারের কথা কেন বললাম, সেটা পরে বলছি।
১৯৮৯ সালের কথা। অক্টোবর মাস। কলকাতায় পুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে। বিকেল বেলা বাড়িতে একটা চিঠি এল। খামটা খুলেই চমকে গেলাম। গত জানুয়ারি মাসে ডবলিউবিসিএস পরীক্ষায় বসেছিলাম, পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, আমি নশো নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছি, এবার নভেম্বর মাসে দুশো নম্বরের পার্সোনালিটি টেস্টে হাজির হতে হবে।
চিঠিটা পেয়ে আনন্দ হলেও, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা কনকনে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। যতদূর শুনেছি, রাজ্যের শীর্ষ আমলারা এইসব পরীক্ষা নেন, কারণ এই পরীক্ষায় যারা পাশ করে, তাদেরকেই ভবিষ্যতে রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলাতে হয়। স্বভাবতই এইসব মৌখিক পরীক্ষার মানও হয় যথেষ্ট কঠিন।
যাইহোক, চিঠির সাথে পরীক্ষার যে বিস্তারিত নির্ঘন্ট দেওয়া ছিল, সেটা ভাল করে দেখে বুঝলাম যে প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে একটা পর্যন্ত চারজন এবং দুটো থেকে চারটে পর্যন্ত চারজন, অর্থাৎ প্রতিদিন মোট আটজন পরীক্ষার্থীর পার্সোনালিটি টেস্ট নেওয়া হবে। আরো বোঝা গেল, চারঘন্টায় আটজন মানে, গড়ে একেক জনের সাথে আধঘন্টা ধরে কথাবার্তা বলা হবে। আমাকে ডাকা হয়েছে সপ্তম দিন সকাল সাড়ে দশটায়।
চোর ডাকাতেরা যেমন দুষ্কর্ম করার আগে অকুস্থলে 'রেকি' করে, আমিও ঠিক তেমনি আগেই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অফিসে, যেখানে পার্সোনালিটি টেস্ট নেওয়া হবে, সেই জায়গাটা দেখে এলাম। কিন্তু দেখার পর খুব হতাশ হতে হল। অফিসটায় বাইরের কাউকে ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছে না। বাইরে থেকে দেখে যা বোঝা গেল, পরীক্ষার্থীদের প্রথমে সম্ভবত একটা ঘরে বসানো হয়। তারপর এক এক করে ভেতরে ঢুকিয়ে পরীক্ষা নেবার পর সম্পূর্ণ অন্য পথে তাদেরকে বাইরে পাঠানো হয়। ফলে তাদেরকে কি জিজ্ঞাসা করা হল, ভেতরে থাকা বাকি পরীক্ষার্থীরা সেটা কিছুতেই জানতে পারে না। গোটা ব্যাপারটাই অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও গোপনীয়তার সাথে করা হয়।
সবটা দেখেশুনে একটু হতোদ্যম হলেও আমি হাল ছাড়লাম না। দ্বিতীয়দিন আবার অকুস্থলে হাজির হলাম। একটা বিষয় নিশ্চিত ছিলাম, যে-পথে পরীক্ষার্থীরা অফিসটায় ঢুকছে, সেই পথে তো কেউ তারা বেরুচ্ছে না। তাহলে তারা কোন্ পথে বেরুচ্ছে ? নিশ্চয়ই এই অফিস থেকে বেরুবার দ্বিতীয় কোনও রাস্তা আছে ?
প্রায় একঘন্টা খোঁজার পর অফিসটার পেছনদিকে একটা ঘিঞ্জি গলির মধ্যে পাওয়া গেল ছোট্ট একটা দরজা। সেখানে মোতায়েন আছে দুজন রাইফেলধারী পুলিশ। লক্ষ্য করলাম, সেই গেট দিয়ে কেউ অফিসটায় ঢুকছেও না, বেরুচ্ছেও না।
অভিজ্ঞ মাছশিকারী ছিপ ফেলে যেমন ঘাপটি মেরে মাছের বঁড়শি গেলার জন্য অপেক্ষা করে, আমি ঠিক সেইভাবে ঐ গেটের উল্টোদিকের একটা নোংরা-ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে ছিলাম। প্রায় একঘন্টা পর তৃতীয় কাপ চা যখন শেষ করে ফেলেছি, ঠিক তক্ষুণি নজরে এল, বেশ স্মার্ট চেহারার একটি ছেলে, চোখে চশমা, হাতে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে ঐ গেট দিয়ে বেরুচ্ছে !
সাথে সাথে তার পিছু নিলাম। গলিটা পার হয়ে ছেলেটা মেন রোডে উঠতেই তাকে ধরলাম,
-------ও দাদা, শুনছেন ?
ছেলেটা ঘাড় ঘোরালো,
-------কিছু বলছেন ?
-------হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি কি আজ ডবলিউবিসিএস পরীক্ষার ইনটারভিউ দিলেন ?
ছেলেটি অবাক,
-------হুম। কিন্তু........আপনি কিভাবে জানলেন ?
সত্যি কথাটা কিছুতেই একে বলা যাবেনা, কারণ ও আর আমি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই মুহূর্তের মধ্যে মিথ্যে বলে দিলাম,
-------জাস্ট অনুমান করলাম দাদা। আসলে আমি এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, নেক্সট ইয়ারে বসার ইচ্ছে আছে।
-------ওঃ, তাই বলুন !
হাঁটতে হাঁটতেই দুজনে কথা বলতে লাগলাম। কথায় কথায় একটু আগে ইন্টারভিউতে তাকে কি কি প্রশ্ন করা হয়েছে, সব জেনে নিলাম। ছেলেটি সব শেষে বলল,
--------ইন্টারভিউ দিয়ে একটা জিনিস বুঝতে পারলাম। ওরা ক্যান্ডিডেটের জেনারেল নলেজ কতটা আছে, সেটা দেখেনা। ওরা দেখে ডেপথ অব নলেজ। আপনি যদি খেলাধুলা ভালবাসেন, তাহলে ওরা সেটার ওপরেই জিজ্ঞেস করবে। আরেকটা কথা হল, ওরা তথ্য জিজ্ঞেস করেনা, আপনার সামনে ওরা একটা সমস্যা আনবে, সেটাকে আপনি কিভাবে হ্যান্ডেল করেন, কিভাবে সেটাকে অ্যানালাইজ করেন, সেটাই ওরা দেখবে।
পরের দুদিনও আমি একই ভাবে অভিযান চালিয়ে আরো জনা চারেক ক্যান্ডিডেটের সাথে আলাপ করে প্রায় হুবহু একই উত্তর পেলাম। ফলে পরীক্ষার জন্য আমার মানসিক প্রস্তুতিটা বেশ ভালই হল।
সবশেষে এল আমার পরীক্ষার দিন। কমিশনের অফিসে পৌঁছাতেই আমার কাছ থেকে গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত সব পরীক্ষার মার্কশিট নিয়ে চেকিং করা হল। তারপরেই বলা হল, "এগুলির একটা করে কপি অ্যাটেস্টেট করিয়ে জমা দিন।"
মহা মুশকিল পড়লাম। তখনকার দিনে জেরক্স এত সহজলভ্য ছিল না। ফাঁকা মার্কশিটের কপি বিক্রি হত। সেটা পূরণ করে একজন গেজেটেড অফিসারকে দিয়ে অ্যাটেস্টেড করাতে হতো। তবে আমি এইসব পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিলাম। তাই বললাম, "অ্যাটেস্টেড কপিগুলো বাইরে দাদার কাছে রেখে এসেছি, এক্ষুণি নিয়ে আসছি।" তারপর বাইরে এসেই ব্যাগ থেকে "প্রিন্সিপাল, বঙ্গবাসী কলেজ" লেখা সীল আর স্টাম্প-প্যাড বার করে নিজের মার্কশিটগুলো নিজেই "ডঃ এ.কে.দত্ত" লিখে অ্যাটেস্টেড করে ফেললাম ! তারপর ভেতরে গিয়ে সব কাগজ জমা করে দিলাম।
প্রায় চল্লিশ মিনিট অপেক্ষার পর আমার ডাক পড়ল। আমার অবশ্য একটা সুবিধে হয়েছিল। যখন আমার পার্সোনালিটি টেস্ট হচ্ছিল, তখন আমি কমার্শিয়াল ট্যাক্সের ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ করছি। আমি ভেবেই নিয়েছিলাম, পরীক্ষা খারাপ হলে কি আর হবে ? আমার মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়বে না। একটা ভাল সরকারী চাকরী তো আমি করছি ! সুতরাং নো টেনশন।
পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে ঘড়ি দেখে চমকে গেলাম ! আমি প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ভেতরে ছিলাম ! আমার হবি, কাজকর্ম এইসব নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল।
প্রথমেই আমাকে কমার্শিয়াল ট্যাক্সের আইনকানুন নিয়ে দুচারটে মামুলি প্রশ্নের পর জিজ্ঞেস করা হল,
--------হোয়াট ইজ ইয়োর ওপিনিয়ন রিগার্ডিং টার্নওভার ট্যাক্স ?
আমি বুঝিয়ে বললাম যে, একজন ব্যবসায়ীর বিজনেসের টার্নওভার একটা সীমা পেরিয়ে গেলে তাঁকে এই অতিরিক্ত টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হয়। সাথে সাথেই আমাকে চেপে ধরা হল,
--------সেই ব্যবসায়ীর ওপর কি এটা আনডিউ প্রেসার সৃষ্টি করা হচ্ছেনা ?
আমি তক্ষুণি বুঝে গেলাম যে, আমাকে ওঁরা ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছেন। আমি যদি বলি এটা সত্যিই ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে, তাহলে ওনারা বলবেন, আপনি কি সরকারের বেশি রেভিনিউ আদায় হোক চাইছেন না ? আবার যদি বলি, বেশি রেভিনিউ আদায়ের জন্য এটাই করা উচিত, তাহলে ওনারা বলবেন, তাহলে তো সাধারণ ব্যবসায়ীদের ওপর অকারণে বেশি চাপ সৃষ্টি হবে, ফলে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাবে ! আমি তখন একটা ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর দিলাম,
-------এটা বাস্তব যে এই টার্নওভার ট্যাক্স ব্যবসায়ীদের ওপর এক্সট্রা বার্ডেন, বাট ফর কালেক্টিং মোর রেভিনিউ, উই শুড সাপোর্ট ইট। মোরওভার, অ্যাজ আ গভর্নমেন্ট অফিসার, আই হ্যাভ নো অপশন টু ক্রিটিসাইজ গভর্নমেন্ট পলিসি।আওয়ার ডিউটি ইজ ওনলি টু এনফোর্স ল।
আমার উত্তর শুনে ইনটারভিউ বোর্ডের সদস্যেরা একদম চুপ করে গেলেন।
যাইহোক, ইন্টারভিউ দেবার সময় মনে হচ্ছিল, কয়েকজন বয়স্ক মানুষের সাথে আড্ডা মারছি। আমাকে অবসর সময় কি করি প্রশ্ন করতেই বললাম সেতার বাজাতে আমার খুব ভাল লাগে। সাথে সাথেই প্রশ্ন ছুটে এল,
-------হু ইজ ইয়োর গুরু ?
আমি এবার একটু চালাকি করলাম। আমার গুরুকে বিশেষ কেউ চেনে না। কিন্তু তিনি ছিলেন কলকাতার এক বিখ্যাত সেতারশিল্পীর প্রিয় ছাত্র। নিজের গুরু হিসেবে ঝপ করে আমি সেই বিখ্যাত শিল্পীর নাম বলতেই ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যেরা একটু নড়েচড়ে বসলেন। আর তারপরেই শুরু হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওপর একের পর এক প্রশ্ন। সেগুলো তো আমার কাছে জলভাত !
তখন সবে বিভিন্ন অফিসে একটা দুটো করে কম্পিউটার বসানো শুরু হয়েছে। এবার আমাকে জিজ্ঞেস করা হল,
--------ধরুন, আপনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। আপনি কি কম্পিউটারাইজেন সমর্থন করবেন ?
আমি এই প্রশ্নটার জন্য তৈরি ছিলাম। এর আগে একাধিক ছেলেকে ওরা ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিল। যারা বলেছিল ----হ্যাঁ সমর্থন করব, তাদেরকে ওরা চেপে ধরেছিল ,----তাহলে তো দেশে বেকার সমস্যা আরো বাড়বে, ঝামেলা-আন্দোলন হলে আপনি প্রশাসন চালাবেন কিভাবে ? আর যারা বলেছিল-----না, সমর্থন করব না, তাদেরকে ওরা নাজেহাল করে দিয়ে বলেছিল, -----সে কী ! কম্পিউটার ছাড়া ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নতি কিভাবে করবেন ?
আমি প্রশ্ন টা শুনে দুই সেকেন্ড চুপ করে রইলাম। দেখালাম, উত্তরটা কি দেব ভাবছি। তারপর ধীরে ধীরে বললাম,
--------বিষয়টির দুটো আসপেক্ট আছে। কম্পিউটার চালু না করলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। আর চালু করলে বেকার সমস্যা বেড়ে যাবার আশঙ্কা আছে।
--------গুড। তাহলে আপনি কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করবেন ?
--------আমি একটা এক্সপার্টাইজ কমিটি তৈরি করব। সেখানে সিনিয়র ইকনমিস্ট, জনপ্রতিনিধি এবং অভিজ্ঞ বুরোক্রাটেরা থাকবেন। তাঁরা ডিটেল সার্ভে করার পর যা সাজেস্ট করবেন, অর্থাৎ কোথায় কিভাবে কম্পিউটার চালু করলে বেকার বাড়বে না অথচ দেশ দ্রুত উন্নতি করতে পারবে, সেই অনুসারে পলিসি তৈরি করব।
আবার সেই ডিপ্লোম্যাটিক রিপ্লাই ! আগে থেকেই অনেক চিন্তাভাবনা করে এই উত্তরটা রেডি করে রেখেছিলাম। যাঁরা ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন, তাঁরা আমার উত্তর শুনে পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর চেয়ারম্যান বললেন,
-------ওয়েল সেইড। আপনার সাথে কথা বলে ভাল লেগেছে। ইউ মে গো নাউ।
পরে জেনেছিলাম, পার্সোনালিটি টেস্টে আমাকে দুশোর মধ্যে একশো বিরানব্বই নম্বর দেওয়া হয়েছিল। লিখিত পরীক্ষার শেষে মেরিট লিস্টে আমার নম্বর ছিল বত্রিশ। আর পার্সোনালিটি টেস্টের পর সেটা হয়ে গিয়েছিল পাঁচ !
পরবর্তীকালে প্রচন্ড কাজের ফাঁকেও যখন সদ্য পাশ করা ছাত্র ছাত্রীরা কাগজপত্র অ্যাটেস্টেড করাতে আসত, তখন মনে হত, চাকরিতে ঢোকার সময় নিজের মার্কশিট নিজে অ্যাটেস্টেড করে যে পাপ করেছিলাম, এখন তারই প্রায়শ্চিত্ত করছি। এছাড়াও চালাকি করে একই ব্যাচের ক্যান্ডিডেটদের কাছ থেকে ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নের ধরণ জেনে নিয়ে আর সেতারের গুরুর নাম ভাঁড়িয়েও অমার্জনীয় অপরাধ করেছিলাম। আজ স্বীকার করতেই হবে, ফ্রেডরিখ ফরসাইথের লেখা "শৃগালের শেষ প্রহর" বইটা থেকেই আমি এইসব দুষ্কর্মের আগাম পরিকল্পনা করার ব্যাপারে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। সেজন্যই বোধহয় অফিসে সহকর্মীদের একাংশ আমার নামই দিয়েছিল "প্ল্যান-মাস্টার" !
==============
চন্দন দাশগুপ্ত
সি/৩০/১, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, রিজেন্ট এস্টেট,
কলকাতা--৭০০ ০৯২
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন