শান্তির পথে …
বন্দনা সেনগুপ্ত
আধ্যাত্মিকতা ও শান্তি
ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা কিন্তু এক কথা নয়। মন দিয়ে নিয়মিত জপ ধ্যানাদি করছি অথবা রোজ ঠাকুর ঘরে যাচ্ছি, ঠাকুরকে ফুল তুলসী নকুলদানা দিয়ে অফিসের কথা ভাবতে ভাবতে জপ সেরে রাজনীতি মেখে ভাত খাচ্ছি, বা জন্মাষ্টমী শিবরাত্রি করছি, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ফুচকা আর মাটন খেয়ে মা দুর্গার পুজো করছি, ছট মানাচ্ছি, এই সবই ধর্মের মধ্যে পড়বে।
আধ্যাত্মিকতা অনেক বড় ব্যাপার। আধ্যাত্মিকতা ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করে না কিন্তু বলে
"বহুরূপে সম্মুখে তোমা ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর।
জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।।"
জীব, অর্থাৎ, শুধু মানুষ নয়, সমস্ত জীবের মধ্যেই ঈশ্বরের প্রকাশের কথা বলছে। আর কি বলছে? বলছে "প্রেম", বিশুদ্ধ নিষ্কাম প্রেম। আধ্যাত্মিকতার শুরু এই ভাবনা দিয়ে। শেষ এই প্রেমের অনুভবে। মাঝখানে পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু ও ঘটনা। এই শুরু থেকে শেষে পৌঁছানই আধ্যাত্মিক সাধনা।
প্রকৃত আধ্যাত্মিকতাই আমাদের, সুখের না হলেও, শান্তির পথ দেখাতে পারে। আধ্যাত্মিকতায় অনেক আদর্শ আছে। আমি এখানে কয়েকটি সর্বজন স্বীকৃত আদর্শ নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
ত্যাগ:
গীতামুখে শ্রী ভগবান বলেছেন ত্যাগেই শান্তি। "ত্যাগাৎচ্ছান্তিনন্তরম"। শ্রী রামকৃষ্ণদেব কি বলেছিলেন মনে আছে তো? কাম কাঞ্চন ত্যাগ করতে বলেছিলেন। আমরা সাধারণ সংসারী মানুষ। একটু ভাল থাকবার সাধনাতে জীবনপাত করি। নিজে যেমন আছি, সন্তান যেন তার থেকে একটু ভাল থাকে, তার জন্য লড়ে যাই। টাকা বা কাঞ্চন ছাড়া এসব কি করে সম্ভব? আমরা চাইলেও সম্পূর্ন ত্যাগ করতে পারব না। আর, তাঁর কথাতেই বলি, স্ত্রী পুত্রের প্রতিপালন করা তো গৃহস্থের অবশ্য কর্তব্য।
তাহলে আমরা কি করব? কি করতে পারি?
আমরা যা প্রয়োজন তার বাইরে যাব না। আমাদের বাড়িতে কতো কতো জিনিস থাকে। বিচার করে দেখলে বুঝব তার অনেক কিছুই তার উদ্দেশ্য হারিয়েছে, এখন তারা শুধুই "আছে"! আবার অনেক কিছু কখনোই দরকার ছিল না। হয়ত কারুর আছে বা অতীতে কখনও দেখেছি, লোভ হয়েছে তাই যখন পেরেছি নিজেও করে নিয়েছি। আর, এখন "যদি কভু লাগে কাজে" বলে ফেলেও দিতে পারি না, বয়ে বেড়াই।
যদি নিজেকে বিচার করি, তাহলেই সত্যিকারের প্রয়োজনের সঙ্গে লোভ, ভয়, অনুরাগ বা আসক্তির বিভেদ খুব স্পষ্ট করেই বুঝতে পারব। আবার প্রয়োজন, যা ছাড়া চলবেই না, সেগুলিও কিন্তু সবার জন্য একরকম নয়। বয়স এবং অবস্থাভেদে প্রয়োজন বদলে যায়। সেগুলি খুব ভাল করে বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী চলতে হবে। তখন দেখব যে, আমাদের অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা, জমানো এবং আনুষঙ্গিক অপচয় বন্ধ হয়ে গিয়ে অর্থ নিয়ে দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমে গেছে।
আবার বলছি, নিজেকে জানতে হবে, চিনতে হবে। প্রকৃত অভাব ও অভাববোধের মধ্যের পার্থক্য বুঝতে হবে। কি, কতটা আর কবে ত্যাগ করব, সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারনা থাকতে হবে। নাহলে "আপনা ধন পরেরে দিয়া, বৈরাগী কাঁদেন হা কৃষ্ণ কইরা" হয়ে পড়বে।
বিচার ও আদর্শ:
আমরা যারা সাধু হতে পারব না, অথচ শান্তি চাই, তাদেরও কিন্তু সাধুদের কিছু কিছু আদর্শ পালন করে চলতে হবে। আমরা তো সব আদর্শ পালন করতে পারব না, দরকারও নেই। আমাদের শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের দ্বারা নিজের জন্য প্রয়োজনীয় একটি বা কয়েকটি আদর্শ খুঁজে নিতে হবে। তারপর একটু একটু করে নিয়মিত বিচার করে সে সব আদর্শকে ধরে থাকতে হবে।
বিচার ও ত্যাগের পথ সহজ নয়। ভুল হবে। কখনও কখনও লোভ, ভয় ইত্যাদি আমাদের সব ভুলিয়ে দেবে। দিক। আমরা আবার উঠে দাঁড়াব। আবার, নতুন করে শুরু করব। হার মানব না।
সম্মান:
আমরা প্রথমেই মানুষকে ঈশ্বর বা ব্রহ্ম বলে ভাবতে পারব না। সেটা দোষের কিছু না। কিন্তু, মানুষকে মানুষ বলে নিশ্চয় ভাবতে হবে। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও বয়স নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। হ্যাঁ, ছোটদেরও। মেয়েদের ও।
অনেকেই বলবেন যে আমাকে কে সম্মান করে যে আমি করতে যাব! আমাকে সম্মান করলে যদি আমার ভাল লাগে, তাহলে আমি চেষ্টা করব সবাইকেই সম্মান দেখিয়ে চলতে। অন্তত পক্ষে অসম্মান করব না। হতেই পারে যে আমাকে দেখে অন্যেও শিখল!
ফেসবুক বা হোয়াটস অ্যাপে, আমি খুব মজার মজার পোস্ট দেখি, যেগুলো আসলে কিন্তু বেশির ভাগই মেয়েদের অশ্রদ্ধা করে বানানো। কিছু কিছু পুরুষের বিরুদ্ধেও থাকে। এগুলি পড়তে বা শুনতে মজার হলেও, যারা বানায় তাদের, মানসিকতার দারিদ্র্য প্রমাণ করে। আর, আমরা সেই হালকা হাওয়ায় হাসতে হাসতে ভেসে গিয়ে জীবনের মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলি।
প্রেম ও ক্ষমা:
নিঃস্বার্থ নিষ্কাম প্রেম হয়ত আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু, সাধন তো হতেই পারে। সবাইকে ভালোবেসে আপন করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন সারদা মা বলেছেন, "কেউ তোমার পর নয় মা, জগৎ তোমার আপনার।" তিনি নিজের জীবনের কৃচ্ছ সাধনের মধ্য দিয়ে সেই আদর্শের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সব সময় কি পারব? নিশ্চয়ই নয়। বিশেষ করে প্রতিকূল পরিবেশে তা আরও কষ্টকর হয়ে উঠবে। কিন্তু, তাও আমাদের চেষ্টা করে চলতে হবে।
এখানে অনেকেই বলবেন, এই রকম ভালো ব্যবহার আমি তো পাই না। তাহলে আমার কিসের দায়?
দুঃখের হলেও ব্যাপারটা খুব সত্যি। জীবন আমাদের অনেককেই বড্ড কষ্ট দেয়। ভালোবাসার মানুষগুলি অপমান করে, ব্যথা দেয়, ছেড়ে চলে যায়, অন্যায়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে। আমরা চোখের জলে ভিজে পড়ে থাকি।
সেই দুঃখের সময়েও আমাদের মনে রাখতে হবে যে সবার মধ্যেই ঈশ্বর আছেন। এবং, তাঁর কর্ম আমরা হয়ত বুঝতেই পারব না। তাই, যতদূর সম্ভব চেষ্টা করব ক্ষমা করে এগিয়ে যেতে। মনে করব সারদা মাকে। উনি কি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই না জীবন কাটিয়েছেন!
অনেক সময়েই অন্যায়কারীদের নিজেদের মধ্যে লোভ, ভয় অথবা মানসিক আঘাতের একটা গল্প থাকে যা তারা লুকিয়ে রাখতে চায়। সেসব বোঝা খুব কঠিন। কিন্তু, যদি বুঝতে পারি যে সে কেন এটা করেছে, তাহলে আমার ক্ষমা করার কাজটা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
কৃতজ্ঞতার আলো অনেক কালো মেঘকেই উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। তাই তাদের করা ভালো কাজগুলো মনে করতে পারলে হয়ত একটু সহজে ক্ষমা করতে পারব। অবশ্য, ক্রোধ এবং অভিমানের সময় ভাল কথা বা কাজ মনে পড়ে না, এও সত্যি।
খুব রেয়ার এক দুজন ছাড়া প্রায় প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু নিজস্ব ঝুটঝামেলা ও কষ্ট আছে। যাঁরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন, তাঁদেরও অনেক ঝামেলা আছে মনে রাখতে পারলে, একটু হলেও, আমার চাপ কম থাকবে।
অন্য দিকে, ক্ষমা করব মানে এই নয় যে তাকে আমি আমার উপরে অত্যাচার করার অনুমতি দিচ্ছি। অবস্থা বিশেষে রুখে দাঁড়াতে হবে বৈকি! কথায় বলে শক্তের ভক্ত, নরমের যম। তাই, প্রয়োজনে নিজের অবস্থান ঠিক করে বুঝে নিয়ে, সেখানে দৃঢ় থাকার জন্য যা দরকার সেটা করতে হবে।
অবশ্য, হঠকারিতার বশে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে যেন অনুতাপ না করতে হয়!
শরণাগতি:
শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী স্বামীজীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন শরণাগতির কথা, "ত্বয়া হৃষিকেশ হৃদিস্থিতেন", তিনি যে কর্মে নিয়োগ করবেন, আমরা তাই তো করব! তাতে স্বামীজি বলেছিলেন যে 'বাবা "আমি"টে যখন বুক জুড়ে থাকে, তখন হৃষিকেশ কোথায়? তখন হৃষিকেশের কোনও অস্তিত্বই নেই।' এই যে একটু আগে ভয়, লোভ, ক্রোধ, মানসিক অস্থিরতার কথা বলছিলাম, সে সবই কিন্তু এই "আমি" বা শ্রী রামকৃষ্ণের ভাষায় "কাঁচা আমি"র খেলা, যে সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তাই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, তা সে মানুষ হোক কি চাকরি ঘর বাড়ি বিষয় সম্পত্তি হোক কিংবা সম্পর্কই হোক না কেন!
আমরা, যারা সব কিছু সত্যি সত্যি ত্যাগ করে সাধু হচ্ছি না, হতে চাইছিও না, কিন্তু আধ্যাত্মিকতার পথে এগিয়ে চলতে চাই, তাদের এই আঁকড়ে থাকার ভাবনাটি ত্যাগ করতে হবে।
আর, ব্যক্তি, বস্তু , ঘটনা, পরিস্থিতির থেকে আশা করা বাদ দিতে হবে। সবই তাঁর ইচ্ছা মেনে নিতে পারলে বড্ড শান্তি পাওয়া যায়।
অসুবিধা হচ্ছে যে আগে জানতে হবে যে কি কি আঁকড়ে আছি অথবা আশা করছি! যা আমার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় বলে বোধ করি, তাছাড়া আর কিছু যদি আঁকড়ে না থাকি, "থাকলে ভালো, না থাকলে আরও ভালো" অথবা "ঠাকুর ভাল মন্দ যাই দিচ্ছেন, তাই সই" গোছের মনোভাব নিয়ে দুনিয়া দেখি, দেখব জগৎ কত সুন্দর!
কর্ম:
যদি ফলাফলের আশা বা অপেক্ষা না করে নিজের সাধ্যমত কর্তব্য করে যেতে পারি, তাহলে তার থেকে ভালো তো আর কিছুই হতে পারে না। কর্তব্য, ভালোবেসে, যতদুর সম্ভব, করব। কিন্তু, যেমন সারদা মা বলেছেন, ঈশ্বর যতটুকু শক্তি দেন, ততটুকু নিশ্চয় করব। ভাবের ঘরে চুরি করব না। তাহলেই নিজের শরীর ও মনের উপর অকারণ চাপ পড়বে না। আর, যদি দেখনদারি বা ফলাকাঙ্খা না থাকে, তাহলে তো শান্তিই শান্তি।
সমাপ্তি:
শেষ করার আগে আরেকটা কথা বলি। কর্ম যদি ভালোবেসে না করতে পারি, তাহলে শরীর ও মনের উপর বিশেষ চাপ সৃষ্টি হবে। তেমনই, আদর্শকেও শুধু বিচার করে করে নয়, ভালোবেসেই আঁকড়ে থাকতে হবে। তা নাহলে একদিন না একদিন, ভয়েই হোক কি প্রলোভনে, সেই আদর্শ ছুটে যাবে। ভালোবাসা থাকলে, যত ঋণাত্মক পরিস্থিতিই হোক না কেন, আবার ফিরে আসা সহজ।
নিজেকে ভালো না বাসলে, বিচারও কিন্তু সঠিক পথ দেখাতে পারবে না। কথায় বলে "আপনি বাঁচলে বাপের নাম"। নিজের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে অন্যকে ভালোবাসার কথা বাতুলতা মাত্র। সবার মধ্যে ঈশ্বর দর্শনের চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে বাদ দিলে চলবে না।
============================
বন্দনা সেনগুপ্ত
K G Signature City
Block number C1,
Flat number 506
Madhuravoyal to Ambattur 200 ft Bypass Road
Adyalampattu
Chennai 600095
Tamil Nadu
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন