মসুয়ার রায় পরিবার এবং বঙ্গসংস্কৃতি
অনিন্দ্য পাল
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে যখন বাংলা শিশুসাহিত্য প্রায় কোনঠাসা, যখন শিশুদের সমস্ত মনোযোগ বৈদ্যুতিন বিনোদনের গ্রাসে, যখন ইঁদুর দৌড়ের ট্র্যাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্বার্থমগ্ন ছোটাছুটি, তখনই সবার অলক্ষ্যে আমরা এমন একজন মানুষের কথা ভুলে যেতে বসেছি যিনি সমস্ত জীবন শিশুদের জন্যই নির্মল হাস্যরস রচনা করে গেছেন। তবে শুধু সেই মানুষটাই নয়, তাঁর পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মও একইভাবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোটদের জন্য অসংখ্য মণিমুক্তো সৃষ্টি করে গেছেন। বংশ পরম্পরায় এভাবে শিশু-কিশোরদের নিয়ে সৃষ্টিশীলতার প্রবাহ বাংলায় কেন সমস্ত পৃথিবীতেই বিরলতম।
অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার 'মসুয়া' গ্রামে লোকনাথ রায়ের পুত্র কালীনাথ রায়ের পাঁচ ছেলের দ্বিতীয় কামদারঞ্জন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৩ সালের ১২ইমে। তাঁর পিতা কালীনাথকে লোকে চিনত 'মুনশি শ্যামসুন্দর' নামে। কালীনাথ আবার সংস্কৃত, আরবি আর ফরাসি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। কামদারঞ্জনকে দূরসম্পর্কের কাকা হরিকিশোর রায়চৌধুরী দত্তক নেন এবং নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর। 'মসুয়া'-র জমিদার হরিকিশোর আর তাঁর স্ত্রী রাজলক্ষ্মীর এই দত্তক পুত্রই পরবর্তী কালে রায় বংশের স্বর্ণযুগ নিয়ে আসেন।
ময়মনসিংহ থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে ১৮৭৯ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে কলকাতায় পড়তে আসেন উপেন্দ্রকিশোর। প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ. এ তে ভর্তি হলেও পরে মেট্রোপলিটন থেকে এফ. এ পাশ করেন এবং তারপর বি.এ পাশ করেন। কলকাতায় এসে উপেন্দ্রকিশোর প্রথমে ৮ নং রতু সরকার লেনে এবং তারপরে ৫০ নং সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের ব্রাহ্ম মেসে থাকেন। এই ব্রাহ্ম মেসে থাকাকালীনই তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্ম নেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়। সম্ভবত এই মেসে থাকাকালীন এবং দ্বারকানাথের প্রভাবেই তিনি ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। এই সূত্রে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি হয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। আবার যার সান্নিধ্যে তিনি ব্রাহ্ম হন, সেই দ্বারকানাথের স্ত্রী ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার, মহিলা গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। ১৮৮৫ সালের ১৫ই জুন দ্বারকানাথের প্রথম পক্ষের ( দ্বারকানাথের প্রথম স্ত্রী ভবসুন্দরী মারা গেলে কাদম্বিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহ করেন) কন্যা বিধুমুখী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয় উপেন্দ্রকিশোরের।
ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের জন্য উপেন্দ্রকিশোরকে পালকপিতা হরিকিশোর তাঁর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন, কিন্তু হরিকিশোরের স্ত্রী রাজলক্ষীদেবীর বিরোধিতায় উপেন্দ্রকিশোর আবার তাঁর অধিকার ফিরে পান। উপেন্দ্রকিশোরের মাত্র কুড়ি বছর বয়সে মারা যান হরিকিশোর। গ্রামের আত্মীয় স্বজন, হিন্দুপন্থী এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের প্রচন্ড প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই উপেক্ষা করেই উপেন্দ্রকিশোর পিতার শ্রাদ্ধ করেন এবং অবশ্যই ব্রাহ্মমতে।
উপেন্দ্রকিশোর এক বহুমুখী প্রতিভার আকর ছিলেন। তাঁর সমস্ত জীবনের সৃষ্টিশীলতা বাংলা এবং বাংলাভাষাকে শুধু সমৃদ্ধশালী করেনি, নতুন পথের সন্ধানও দিয়েছে, যে পথে পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র সুকুমার রায় এবং পৌত্র সত্যজিৎ রায় অনায়াসে হেঁটেছেন। উপেন্দ্রকিশোর সৃষ্ট ফল্গুধারাকেই পরবর্তী দু'ই প্রজন্ম প্রবাহমান করেছে।
কলকাতায় পড়তে এসে উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে আরও একজন মহান মানুষের পরিচয় হয়, তিনি প্রমদাচরণ সেন। প্রমদাচরণের পত্রিকা 'সখা'র দ্বিতীয় সংখ্যায় (১৮৮৩ সালে) প্রকাশিত হয়, উপেন্দ্রকিশোরের প্রথম প্রকাশিত রচনা, একটি নিবন্ধ 'মাছি', উপেন্দ্রকিশোরের বয়স তখন কুড়ি বছর। এই প্রমদাচরণের কাছ থেকে উপেন্দ্রকিশোর যেমন লেখার উৎসাহ পেয়েছেন তেমনি সম্পাদনার কাজও শিখেছেন। তাই প্রমদাচরণকে উপেন্দ্রকিশোরের 'শিক্ষাগুরু' বললে তেমন অত্যুক্তি হয় না।
'সখা', 'মুকুল', প্রভৃতি পত্রিকায় উপেন্দ্রকিশোরের বহু গল্প, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। ছোটদের জন্য লেখা এই সমস্ত গল্পে, প্রবন্ধে একদিকে যেমন হাস্যরস অন্যদিকে তেমনি থাকত নৈতিকতার শিক্ষা। কোন গুরুগম্ভীর জ্ঞানগর্ভ বিষয়ের কচকচানি ছাড়াই সুন্দর সরস প্রবাহে শিক্ষা দেবার প্রচেষ্টা ছিল। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান রচনাতেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। কচিকাঁচাদের জন্য' সেকালের কথা' বইতে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীজগৎ সম্পর্কে যেভাবে লিখেছিলেন, বাংলাভাষায় তা খুব সম্ভবত প্রথম।
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের 'ঠাকুরমার ঝুলি' বাংলা শিশু সাহিত্যের প্রথম মাইলফলক হলেও তার তিনবছর পর প্রকাশিত উপেন্দ্রকিশোরের 'টুনটুনির বই' কোন অংশে পিছিয়ে ছিল না। স্বাতন্ত্রে অনেক আলাদা এই বইতে লেখা শিশুতোষ গল্পে তিনি যে প্রতিবাদ, দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার রাজা আর টুনটুনির দ্বন্দ্বের ছলে দেখিয়েছেন তা এখনও দূর্লভ। এই গল্পগুলোর প্রতীকী মর্মার্থ শৈশবে বইটি পড়ার সময় না বুঝলেও পরিণত বয়সে সমস্ত জীবন ধরে ক্ষুদ্র আর বৃহতের, খাদ্য আর খাদকের সম্পর্ক বুঝিয়ে চলে।
উপেন্দ্রকিশোরের আর এক অমর সৃষ্টি তাঁর সম্পাদিত 'সন্দেশ' পত্রিকা। ২২ নং সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে থাকার সময় প্রথম 'সন্দেশ' প্রকাশিত হয়, ১৩২০ সালের ১লা বৈশাখ। তারিখটি গুরুত্বপূর্ণ, এর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মানুষটি শুধু বাংলাভাষায় লেখেনইনি, তিনি মনেও আদ্যোপান্ত বাঙালি ছিলেন। কে লেখেননি এই 'সন্দেশ'-এ? রায়চৌধুরী পরিবার, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, প্রমথ চৌধুরী, কালিদাস রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রসন্নময়ী দেবী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ' সন্দেশ' কে সমৃদ্ধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন তবে সুকুমার রায়ের সম্পাদনায়। বাংলা শিশু সাহিত্যের দৈন্য এক লহমায় ঘুচিয়ে দিয়েছিল 'সন্দেশ'।
উপেন্দ্রকিশোর সত্যিই বহুমুখী প্রতিভাধর ছিলেন। শুধু সাহিত্যে নয়, চিত্রকলা, আলোকচিত্র, বিজ্ঞানে যেমন আগ্রহ আর ভালবাসা ছিল, তেমনিই তিনি ভাল বেহালা, অর্গান আর হারমোনিয়াম ও বাজাতেন। টুনটুনির বই, ছেলেদের রামায়ণ, মহাভারতের গল্পের জন্য ছবি এঁকেছেন। বিলিতি পদ্ধতির অনুকরণে তেলরঙ, জলরঙ ব্যবহার করেছেন। আবার মুদ্রণ শিল্পে হাফটোন-ব্লকের গবেষণায়, ব্যবহারে তাঁর অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'তিনিই বাঙালির মধ্যে প্রথম নিজ চেষ্টায় হাফটোন শিক্ষা করেন এবং অল্পকালের মধ্যেই তাহার সংস্কার সাধনে কৃতকার্য হন।' উপেন্দ্রকিশোর দক্ষতার সঙ্গে হাফটোন শিল্পের ব্যবহার করেন তাঁর কোম্পানি 'ইউ রায় আর্টিস্ট ' (১৮৯৫ সালে, শিবনারায়ণ দাস লেনে) প্রতিষ্ঠা করে, ১৯১০ সালে এই কোম্পানির নাম দেন ইউ. রায় এন্ড সন্স। ছাপার ক্ষেত্রে তাঁর ' মাল্টিপল ডায়াফ্রাম' নামের হাফটোন পদ্ধতি তখন ছাপার গুনগত মান অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। উপেন্দ্রকিশোর এই হাফটোন বিষয়ে উইলিয়ম গ্যামবলের 'প্রসেস ইয়ার বুক: পেনরোজ পিক্টোরিয়াল অ্যানুয়াল'- এ ন'টি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। 'সখা'তেও 'মুদ্রাযন্ত্র' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি সঙ্গীত আর বাদ্যযন্ত্রের প্রতিও যে গভীর ভাবে অনুরক্ত ছিলেন তা বোঝা যায় তাঁর 'শিক্ষক ব্যতিরেকে হারমোনিয়াম শিক্ষা' বইটি থেকে। তিনি বেশ কিছু ব্রাহ্মসঙ্গীতও রচনা করেছিলেন যার মধ্যে ' জাগো পুরবাসি, ভগবত প্রেম 'পিয়াসি' একটি জনপ্রিয় গান।
১৯১৪ সালে উপেন্দ্রকিশোর সপরিবারে সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ি থেকে উঠে আসেন ১০০ নং গড়পার রোডের বাড়িতে। এখানেই মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে মধুমেহ রোগে মারা যান এই পরম প্রতিভাধর মানুষটি। ১৩ নং কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে (দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর বাড়ি, তখন বাড়িটাকে সবাই চিনত 'লাহা বাবুদের বাড়ি' নামে) উপেন্দ্রকিশোরের পাঁচ সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হাসি (সুখলতা), তাতা (সুকুমার), খুশি (পুণ্যলতা), মণি (সুবিনয়) আর টুনি (শান্তিলতা) কিন্তু সবার ছোট নানকু (সুবিমল) জন্মান ১৮/১ শিবনারায়ণ লেনে। বাবার রসবোধ, বহুমুখী প্রতিভার এক অদ্ভুত প্রবাহ দেখা যায় ছয় সন্তানেরই মধ্যে, কিন্তু ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর জন্মানো তাতা, আমাদের সুকুমার রায় হাজার তারার মধ্যেও পূর্ণিমা চাঁদ। ছোটবেলা থেকেই দুষ্টুমি, কল্পনাশক্তি, ছবি আঁকা সবকিছুতেই সবাইকে টেক্কা দিতেন। মাত্র ন'বছর বয়সেই তাঁর অনুদিত ইংরেজি ছড়ার বাংলা অনুবাদ 'টিকটিকটক' প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর 'মুকুল' পত্রিকায় (১৮৯৬), ঐ ন'বছর বয়সেই প্রথম প্রকাশিত স্বরচিত কবিতা 'নদী' মুকুলে স্থান পায়। সিটি স্কুলে পড়ার সময় লিখে ফেলেছেন নাটক। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা 'রামধন বধ'ই প্রথম নাটক। ১৯০৬ সালে 'কানা খোঁড়া সংবাদ '( কবিতা), সূর্য্যের রাজ্য (গদ্য) এবং পরপর 'প্রবাসী'তে ভারতীয় চিত্রশিল্প সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখেন।
বাবা উপেন্দ্রকিশোরের মত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সুকুমার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে ডাবল অনার্স নিয়ে পাশ করে ১৯১১ সালে গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি নিয়ে ইংলন্ডে যান। সেখানে প্রথমে লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল অব ফোটো অনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি বা এল. সি. সি (বর্তমানে নাম লন্ডন কলেজ অব কমিউনিকেশন) তারপর ম্যানচেস্টার স্কুল অব টেকনোলজিতে দু'বছর মুদ্রণবিদ্যার পড়াশুনা আর হাতে কলমে বিলিতি ছাপার কৌশল শেখার প্রয়াস তাঁকে অনেক অভিজ্ঞ করে তুলেছিল। সেখানেই পেনরোজ অ্যানুয়ালে লেখেন 'হাফটোন ফ্যাক্টস সামারাইজড' (১৯১২) 'স্ট্যান্ডার্ডাইজিং দ্য ওরিজিনাল ' (১৯১৩) দু'টি গবেষণাপত্র। ১৯১৩তে দেশে ফিরে সুপ্রভাদেবীর সঙ্গে বিয়ে। উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার যোগ্য সাহচর্যে, সহযোগিতায় ১০০ নং গড়পার রোডের ইউ. রায় এন্ড সন্স নুতনভাবে সেজে উঠেছিল, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাবে চলে গেলেন উপেন্দ্রকিশোর। সুকুমারের তখন কুড়ি হয়েছে কি হয়নি, তবু সব দায়-দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। 'সন্দেশ'-এর সম্পাদনা থেকে শুরু করে মুদ্রণ ব্যবসা এবং তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় সাহিত্যচর্চা সবই সু-সম্পাদন করে চললেন।
রায় পরিবারের উর্বর মাটিতে শুধু প্রতিভাধরদের জন্মই হয়েছে তা নয়, অনেক সম-সাময়িক প্রতিভাধরদের সঙ্গে মিলন-মিশ্রণও হয়েছিল। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী, নবদ্বীপ চন্দ্র দাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাদের প্রভাব এবং সংস্কার রায় পরিবারকে সবদিক থেকে সম্পন্ন করেছিল। অতুলপ্রসাদ সেন, অজিত কুমার চক্রবর্তী, অমলচন্দ্র হোম, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, কিরণ সংকর রায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের মত মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলেন সুকুমার, কিন্তু এঁদের প্রভাব তাঁর স্বকীয়তাকে নষ্ট করতে পারেনি। ১৯৭০ সালের "ননসেন্স ক্লাব" আর তার মুখপত্র 'সাড়ে বত্রিশ ভাজা'র সঙ্গে সুকুমার-এর সম্মিলন পরবর্তীকালে তাঁর 'ননসেন্স রাইমস'-এর অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। উদ্ভটরস, নির্মল হাস্যরসের ভান্ড থেকে একে একে বেরিয়ে আসছে কাতুকুতু বুড়ো, কুমড়ো-পটাশ, হুঁকোমুখো হ্যাংলা, রামগরুড়ের ছানা, গেছোদাদা, কাকেশ্বর কুচকুচে, হিজবিজবিজ, পাগলা দাশু, গোমড়া থোরিয়াম-এর দল। একদিকে যেমন ছড়া, গল্প, নাটক-এ হাস্যরসের প্রবাহ, তেমনি অন্যদিকে জীবনের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ঝড়-ঝাপটাকেও অদ্ভুত সব দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন সুকুমার।
বাংলা সাহিত্যের, বিশেষ করে, শিশু সাহিত্যে উপেন্দ্রকিশোরের হাত ধরে যে রেনেসাঁ এসেছিল, সুকুমার রায় তাকে অমরত্ব দানের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছিলেন। তাঁর যোগ্যপুত্র সত্যজিতের লেখায় নিছক কলাকৌশলে সুকুমার উপেন্দ্রকিশোর সমকক্ষ ছিলেন না, কিন্তু এই কৌশলের অভাব তিনি পূরণ করেছিলেন দু'টি দুর্লভ গুনের সাহায্যে। এক হল তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, আরেক হল তাঁর অফুরন্ত কল্পনাশক্তি। এই দুইয়ের সমন্বয়ে তাঁর ছবির বিষয় বস্তু টেকনিককে অতিক্রম করে চোখের সামনে জলজ্যান্ত রূপ ধারণ করে।' তিনি তথাকথিত বিদ্বান, নাক উঁচু গম্ভীর মানুষের দলকে ব্যাঙ্গাত্মক হাস্যরসের অস্ত্রে আক্রমণ করেছেন। এই সমস্ত 'রামগরুড়ের ছানারা নিজেরাও হাসে না বা অন্যদেরকেও হাসতে বাধা দেন। বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই যারা 'ফুটোস্কোপ' দিয়ে বিজ্ঞানশিক্ষা দেন, যারা চরম তৃষ্ণায় বিহ্বল মানুষকে জলের পরিবর্তে জল সম্পর্কে জ্ঞান ঢেলে দিয়ে থাকেন, তারাই সুকুমারের সরস ব্যাঙ্গের লক্ষ্য। তাঁর কিম্ভুতের রূপকল্পে তো আমরা সবাই লুকিয়ে আছি। 'বাবুরাম সাপুড়ে'তে তিনি আমাদের গভীরে লুকানো সত্যটাকেই ছড়ায় বেঁধেছেন। আমরা তো চাই অন্যের উপর খবরদারি করতে, আর তার জন্য যদি ফোঁস-ফাঁসহীন ঢুঁশ-ঢাঁশহীন, দুধ-ভাতে নির্বিবাদী কাউকে পাওয়া যায়, তবে তো সোনায় সোহাগা, তাদেরকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করতে আমাদের কোনও কাঠখড় পোড়াতে হয় না। বাংলা সাহিত্যে সুকুমারের অন্যতম অবদান তাঁর বেশকিছু শব্দ, যা একান্তই তাঁর নিজের সৃষ্টি, যেমন বকচ্ছপ, হাঁসজারু, ট্যাঁশগরু, হাতিমি, ফুটোস্কোপ। তাঁর 'আবোল-তাবোল', হ-য-ব-র-ল' বাংলা শিশু সাহিত্যিক যে উদ্ভট, চমকপ্রদ আপাত অর্থহীন হাস্যরস দিয়ে গেছে, তার তুলনা এখনও পাওয়া গেলনা। 'শব্দকল্পদ্রুম'-- এ 'গুরুজি' চরিত্রের মুখের সংলাপে শোনা যায় 'শব্দকে যে অর্থ দিয়ে ভোলায় সে অর্থপিশাচ।'
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল, এই রত্ন-অলংকৃত লেখাগুলো বইয়ের আকারে দেখে যেতে পারেননি সুকুমার। মসুয়ার জমিদারি দেখতে গিয়ে ১৯২১ সালে ২রা মে পুত্র সত্যজিতের জন্মের কিছুদিন পরেই কালাজ্বরে আক্রান্ত হন, প্রায় আড়াই বছর রোগে ভোগার পর ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গড়পার রোডের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে 'ননসেন্স লিটারেচারের জনক চলে যান, হয়ত বা আবোল-তাবোল এর দেশে। তাঁর মৃত্যুর ন'দিন পর প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই 'আবোল-তাবোল'।
গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার উপর এক তীব্র বিতৃষ্ণা ছিল সুকুমারের। 'হ-জ-ব-র-ল' এর আটবছর তিনমাস বয়স্ক নামহীন বালকের মুখদিয়ে যেমন এই বিতৃষ্ণা প্রকাশ পেয়েছে তেমনি প্রকট হয়েছে পাগলা দাশুর চরিত্রচিত্রণে। ভাষার অত্যাচারে তিনি নিজেই বলেছেন 'ভাষা যে নিজের অর্থ গৌরবেই সত্য, একথা ভুলিয়া সে যখন কেবলমাত্র শব্দ গৌরবে বড় হইতে চায়, তাহার অত্যাচার অনিবার্য।'
সুকুমার রায়ের মৃত্যুর প্রায় ১৭ বছর পর তাঁর প্রথম গল্প সংকলন 'পাগলা দাশু ' প্রকাশ করেন প্রকাশক এম.সি.সরকার। সেই সংকলনের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন 'সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি, তাঁর ভাব-সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে।' সুকুমারের আগে বা পরে বাংলা শিশুসাহিত্যে তাঁর পরিপূরক নেই, এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করেছিলেন। কোন ব্যকরণ না মানা এই সরস্বতীর বরপুত্র 'দস্যি ছেলে ' সুকুমার চিরকাল আমাদের মনে অক্ষয় অনবদ্য হয়ে থাকবেন।
তবুও সুকুমারের অকাল প্রয়াণ ১০০ নং গড়পার রোডের বিখ্যাত রায়বাড়ির কাঠামো ভেঙে দিল। তাঁর মৃত্যুর পর রায় পরিবার ঐ বাড়ি ছেড়ে দেন এবং 'হাফটোন ব্লক' ছবির জন্য ভারত বিখ্যাত 'ইউ রয় এন্ড সন্স ' কোম্পানিও বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র ছয় বছরের সত্যজিৎ মা সুপ্রভা রায়ের সঙ্গে চলে আসেন বকুলবাগানে মামার বাড়িতে। সত্যজিতের উপর রায়বাড়ির সংস্কৃতির প্রভাব খুব একটা না পড়লেও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মেধা এবং বহুমুখী প্রতিভার কোন কমতি ছিল না। আট বছরের সত্যজিৎ তার প্রমাণ দেন - 'জান তোমায় বলছি শোন/ হব যখন তোমার মতো বড়ো। / লিখবো লেখা ঝুড়ি ঝুড়ি,/ পাঠিয়ে দেব তোমার বাড়ি/ তুমি তোমার সন্দেশেতে/ লেখাগুলি সাজাবে বসে/ এই আনন্দে দিচ্ছি গড়াগড়ি।' তবে সত্যজিৎ, ঠাকুর্দা উপেন্দ্রকিশোর বা বাবা সুকুমারের মতো সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের নৌকায় প্রথমেই জাঁকিয়ে বসেননি। টালমাটাল একটা পরিস্থিতি প্রথমে সত্যজিৎকে বাঁধের জলের মত আটকে দিলেও তা স্থায়ী হয়নি।
সত্যজিৎ প্রেসিডেন্সিতে প্রথমে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হলেও পরে ইকোনমিক্স নিয়ে আঠারো বছর বয়সে (১৯৩৯ সালে) স্নাতক হন। এরপর ১৯৪০ সালে শান্তিনিকেতনে আঁকা শিখতে যান। ১৯৪১ সালে কুড়ি বছর বয়সে কলাভবনে নন্দলাল বসুর কাছে আঁকা শিখতে শিখতেই লেখেন জীবনের প্রথম গল্প 'অ্যাবস্ট্রাকশন'। গল্পটি কিন্তু বাংলায় নয়, ইংরাজিতে লিখেছিলেন। গল্পটির প্লট তাঁর মাথায় এসেছিল ল্যাটিন আমেরিকার এক চিত্র প্রদর্শনীর ঘটনা থেকে। সেই প্রদর্শনীতে উল্টো করে টাঙানো ছবিটিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিল। সত্যজিতের গল্পেও 'দ্য সমন্যাম বুলিস্ট ' নামের ছবিটি সেরা হয়, যেটা আসলে ছবিতে ব্যবহারের আগের রংয়ের মিশেল ঠিক করার জন্য ব্যবহৃত কাগজ। অর্থাৎ দু'টি বিষয় স্পষ্ট হয়, এক সত্যজিৎ প্রথম দিকে বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন, আর দু'ই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সহজাত মেধা চাপা পড়ে থাকলেও বেরিয়ে এল। পরের বছর (১৯৪২ সালে) প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গল্প 'শেডস অফ গ্রে'। দু'টি গল্পই প্রকাশিত হয় অমৃতবাজার পত্রিকায়। এর পরবর্তী কুড়ি বছর গল্প লেখক সত্যজিৎকে আর পাওয়া যায়না।
১৯৪৩ সালে সত্যজিৎ কলকাতার বিখ্যাত বিদেশি বিজ্ঞাপন কোম্পানি ডি জে কিমারের চাকরিতে যোগ দেন, এবং ঐ বছরই ঐ কোম্পানির সহকারী ম্যানেজার দিলীপ কুমার গুপ্তর 'সিগনেট প্রেস'-এ সত্যজিৎ প্রচ্ছদ, ছবি আঁকার দায়িত্ব নেন। প্রসঙ্গত, এই 'সিগনেট প্রেস' বাংলা সাহিত্যে প্রকাশনা শিল্পের জগৎটাকেই পাল্টে দিয়েছিল।
ছোটবেলা থেকেই সত্যজিৎ সিনেমা সম্পর্কে বেশ আগ্রহী ছিলেন। তাঁর এই আগ্রহ নেশায় পরিণত হয়, শান্তিনিকেতনের লাইব্রেরীতে পল রোথার এর 'ফিল্ম টিল নাউ' এবং রেমন্ড স্পটিশ উডের 'গ্রামার অফ দ্য ফিল্ম ' বই দুটি হাতে আসার পর, সিগনেট থেকে 'পথের পাঁচালী ' প্রকাশের জন্য ডি. কে গুপ্ত সত্যজিৎকে বইটির মলাটের প্রচ্ছদ ও ডিজাইন আঁকতে দেন। তখনি 'পথের পাঁচালী ' পড়ে ফেলেন সত্যজিৎ, এবং তাঁর মনে এর গল্প এমন ভাবে দাগ কাটে যার ফলশ্রুতি ১৯৫২তে পথের পাঁচালীর চিত্রনাট্য।
সত্যজিৎ যে ষোল বছর ডি জে কিমারে চাকরি করেন, সেই সময়টা শুধু তিনি চাকরিই করেননি, উদ্ভাবনের কাজও করে গেছেন। বাংলা, ইংরাজিতে টাইপোগ্রাফি মানে বিভিন্ন ডিজাইনের বর্ণমালা তৈরী করেছেন। 'রে রোমান, রে বিজারে, ড্যাফিন্স এবং হলিডে স্ক্রিপ্ট ' তাঁর তৈরী অক্ষর ডিজাইন। এদের মধ্যে 'রে রোমান', 'রে বিজারে' আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। ক্যালিগ্রাফি, টাইপোগ্রাফিকে যে উচ্চতায় তিনি নিয়ে গেছিলেন, বাংলা প্রকাশনার জগৎ তার জন্য চিরকাল সত্যজিতের কাছে ঋণী থাকবে।
১৯৪৭ সালে তিন বন্ধু সত্যজিৎ বংশী চন্দ্রগুপ্ত চিদানন্দ দাশগুপ্ত মিলে তৈরি করেন কলকাতার প্রথম ফিল্ম সোসাইটি। আবার ১৯৪৮ সাল থেকেই সত্যজিৎ বিভিন্ন ইংরেজি ও বাংলা পত্রপত্রিকায় সিনেমা সংক্রান্ত প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। পরে ১৯৭৬ সালে 'আওয়ার ফিল্মস- দেয়ার ফিল্মস' নামে একটি বই প্রকাশ করেন যাতে তার ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত লেখা প্রায় সব আর্টিকেল গুলি ছিল।
এরমধ্যে সত্যজিতের জীবনে ঘটে যায় দুটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯৪৯ এ কলকাতায় আগত ফরাসি চিত্রপরিচালক 'জাঁ রেনোয়ার' সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ, কথোপকথন আর ১৯৪৮ এ পিসতুতো বোন বিজয়া দাসের সঙ্গে বিবাহ।
সত্যজিতের লেখা চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রথম প্রবন্ধ 'হোয়াট ইজ রং উইথ ইন্ডিয়ান ফিল্মস' (স্টেটসম্যান) থেকে বোঝা যায় প্রথম থেকেই সিনেমা সম্পর্কে তাঁর গভীর চিন্তা ও পরিকল্পনা ছিল, যার নিদর্শন তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা "পথের পাঁচালী"। ১৯৫০ সালে লন্ডন থেকে ফিরে সম্পূর্ণ অনামী কয়েকজন কুশীলবকে নিয়ে এই ছবি করার জন্য যে দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা শুরু করেন, তার ফল পেতে লেগে গেল বেশ কয়েকটা বছর। কলকাতায় "পথের পাঁচালী" রিলিজ করে ১৯৫৫ সালের ২৬ শে আগস্ট। নিজের জমানো টাকা, স্ত্রীর গহনা এবং সবশেষে বিধান রায়ের সরকারের অর্থানুকূল্যে বানানো পথের পাঁচালী এখনো দেশে বিদেশে বাংলা সিনেমা তথা ভারতীয় সিনেমাকে গর্বিত করে। ছবিটি ১৯৫৫ তে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণ ও রুপো পদক থেকে শুরু করে "বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট" পুরস্কার এবং পরপর ১৯৬৬ পর্যন্ত বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়। এরপর প্রায় টানা ৪০ বছর সত্যজিৎ চলচ্চিত্র জগতে নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল। "পথের পাঁচালী" থেকে শুরু করে ১৯৯১ সালের শেষ ছবি "আগন্তুক" পর্যন্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য ও তথ্যচিত্র মিলিয়ে প্রায় ৩৩ টি ছবি করেন। তার সেরা ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম "চারুলতা" (১৯৬৪), "জয় বাবা ফেলুনাথ" (১৯৭৮), "অরণ্যের দিনরাত্রি"( ১৯৬৯), এবং অবশ্যই "কাঞ্চনজঙ্ঘা" (১৯৬১)। "কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছিল সত্যজিৎয়ের প্রথম মৌলিক চিত্রনাট্য এবং প্রথম রঙিন ছবি। আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর পরিচালিত সিনেমা সব সময়ই উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে, যার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯২ তে অস্কার পুরস্কার। তবে সত্যজিৎ শুধু চলচ্চিত্র পরিচালনায় নয়, বাইশটি ছবির সংগীত পরিচালনা এবং বেশ কিছু ছবির সংগীত রচনাও করেছেন। পশ্চিমের সুর এবং দেশজ সুর এর এক সুন্দর মিশ্রণ তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ।
বেশ কিছু ক্ষেত্রে সত্যজিতের দৃঢ়তা এবং নির্ভীক মানসিকতা তাকে এক অনন্য সম্মান এনে দিয়েছিল। যেমন সম্পূর্ণ নতুন মুখ নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরী, কবি হতে চাওয়া এবং "এক্ষণ" নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করানো। সৌমিত্র সত্যজিতের প্রায় চোদ্দটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন অথচ তিনি কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি অভিনয় করবেন। এখানেই সত্যজিতের কৃতিত্ব। সঠিক রত্ন খুঁজে নেবার চোখ ছিল তাঁর।
শুধু চলচ্চিত্র নয় সাহিত্যেও সত্যজিৎ ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল। ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোরের "সন্দেশ", সুকুমারের মৃত্যুর পর কিছুদিন কাকা সুবিনয় রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলেও তারপর বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হবার প্রায় ৩০ বছর পর ১৯৬১ সালে বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কে নিয়ে সত্যজিৎ আবার সন্দেশ চালু করেন যা এখনো তার পুত্র সন্দীপ রায়ের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হচ্ছে। এই সন্দেশের নবজীবনের ষষ্ঠ সংখ্যায় সত্যজিৎ "প্রফেসর শঙ্কু" চরিত্রের জন্ম দিলেন। চরিত্রটি বাবা সুকুমারের 'হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি'-র নিধিরাম পাটকেল এবং প্রফেসর হেঁসোরামের চরিত্রের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। আবার এই সন্দেশের পাতায় "বঙ্কুবাবুর বন্ধু" (দশম সংখ্যায়) এবং "পেরোডাকটিলের ডিম" (একাদশ) লেখা দুটি তাকে সাহিত্যের জগতে প্রথম সারিতে নিয়ে আসে। ১৯৬২তে এই সন্দেশের পাতায় সত্যজিতের আর এক অমর সৃষ্টি ফেলুদার আত্মপ্রকাশ। ১৯৮৫ তে প্রকাশ পায় "তারিণী খুড়োর কীর্তিকলাপ"। সন্দেশের দ্বিতীয় সংখ্যায় সত্যজিৎকৃত লিয়রের তিনটি লিমেরিকের বাংলায় অনুবাদ সম্ভবত বাংলা ভাষায় এজাতীয় পাঁচ লাইনের ছড়ার ক্ষেত্রে প্রথম। বাবা সুকুমার রায়ের ননসেন্স লিটারেচারের পরম্পরা সত্যজিতের মধ্যেও ছিল। তাই লিয়রের "দ্য জাম্বোলিস" তাঁর হাতে হল "পাপাঞ্জুল", লুইস ক্যারলের "জ্যাবারওঅকি" হল "জবরখাকি" এবং "এ ম্যাড গার্ডেনারস সং" হলো "রাম পাগলের গান"। সত্যজিতের প্রথম বাংলা মৌলিক গদ্য রচনা "ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি", সন্দেশের ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পর পর পর তিন সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে চলে এই লেখা। এখানেই প্রথম পাওয়া গেল প্রফেসর শঙ্কুকে।
ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর, বাবা সুকুমার রায়ের মতো তিনিও দায়িত্বশীল শিশু সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর কল্পবিজ্ঞান চরিত্র 'প্রফেসর শঙ্কু' বা গোয়েন্দা চরিত্র 'ফেলুদা' বা চিত্রায়িত 'গুপি বাঘা' কোন ক্ষেত্রেই তিনি শিশুদের জগতে সস্তা লোভনীয়তা বা প্রেমের সুড়সুড়ি প্রশ্রয় দেননি। তাই এইসব ক্ষেত্রে তিনি নারী চরিত্র সর্বাংশে এড়িয়ে গেছেন যা বর্তমানের বাজার চলতি বেশিরভাগ শিশুর সাহিত্যের কাছে শিক্ষনীয় হয়ে উঠতে পারে। যদিও এই ব্যাপারটি কখনো কখনো বিতর্কের আবহ তৈরি করেনি তা নয়, তবু কল্পবিজ্ঞান, গোয়েন্দা কাহিনী, ঐতিহাসিক কাহিনী, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সর্বত্রই তাঁর মেধা, দক্ষতা, শালীনতাবোধ, চিন্তার সূক্ষ্মতা, বাংলা এবং বাঙালিকে গর্বিত করেছে। দেশে ও বিদেশে অসংখ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত এই মানুষটি মৃত্যুশয্যায় অস্কার পুরস্কার নেন। তার কিছুদিন পর ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল এই অসম্ভব প্রতিভাধর মানুষটি বাঙালিকে কাঁদিয়ে চলে যান অন্য কোন ছায়ালোকে।
মসুয়ার রায় পরিবারের উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী যে গঙ্গোত্রীর স্রষ্টা, সুকুমার হয়ে সেই মহান প্রবাহ সত্যজিৎ এর মধ্যে অনায়াসেই খরস্রোতা হয়েছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই রায় পরিবার বাংলা তথা ভারতবর্ষকে যেভাবে সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্রমুদ্রণে সমৃদ্ধ করেছে, এখনো করে চলেছে তার উদাহরণ সত্যিই পৃথিবীতে বিরল। তাঁদের তুলনা শুধুমাত্র তাঁরাই হতে পারেন, অন্য কেউ নয়।
==================
অনিন্দ্য পাল
চম্পাহাটি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। পশ্চিমবঙ্গ।
মোবাইল : 6294814096
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন